ইট পাটকেল | পর্ব – ৩৬

মামনী কোথায় ভাই?
আশমিন বিরক্ত চোখে তাকালো আশিয়ানের দিকে। কপাল কুচকে গমগমে গলায় বলল,
— তোমাকে আমার বিরক্তির লাগছে আশিয়ান। এখান থেকে যাও।ভাই হিসেবে একটা পরামর্শ দিচ্ছি,এখনো সময় আছে ভালো হয়ে যাও। আমি নিজের মা কেই ছাড় দেই নি।সেখানে তুমি তো সৎ শম্বোন্ধি। মিসেস চৌধুরীর কথা আর কখনো জানতে চাইবে না।পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। তাই তাকে নিয়ে কথা না বলাই তোমার জন্য ভালো।
আশিয়ান তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। ওই ঘটনার আজ এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। আশমিন সেদিন অনেক রাতে বাসায় এসেছিলো। কাউকে কিছু না বলেই নিজের রুমে দুই দিন দরজা বন্ধ করে বসে ছিল। দুই দিন পর যখন রুম থেকে বেরুলো তখন সব কিছু স্বাভাবিক। নূর শারীরিক ভাবে অনেকটাই অসুস্থ।
মেয়েদের নিয়ে আরো নাজেহাল অবস্থা। একটা ঘুমালে আরেকটা জেগে বসে থাকে।কারোর কোলে দিলে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়।একমাত্র নূর আর আশমিনের কাছেই তারা শান্ত থাকে। মাঝে মাঝে তো নূরের কোলেও থাকতে চায় না। দুই ইঞ্চি মেয়েরাই তার কলিজা ভেজে দিচ্ছে। একেবারে বাপের মতো হয়েছে।বেয়াদব!
রাতে টিউবলাইটের মতো চোখ দুটো খোলা থাকে তাদের একটা ও রাতে ঘুমায় না।তবে নূর কে জাগতে হয় না।আশমিন সারা রাত মেয়েদের নিয়ে বসে থাকে। মন্ত্রী সভার গভীর সমস্যা নিয়ে মেয়েদের সাথে আলোচনায় বসে।মেয়েরা ও গোল গোল চোখ করে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে প্যা পু শব্দ করে নিজেদের মতামত দেয়। মেয়েদের মতামত এয়ে আশমিন নতুন উদ্যমে আবার নতুন আলোচনা শুরু করে। এসব দেখে মাঝে মাঝে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে নূর।এতো মাস পেটে রেখে শত্রুর দোসর জন্ম দিলো সে!
গতকাল লুবানা কে বাড়ি নিয়ে এসেছে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে লুবানার ট্রিটমেন্ট করিয়েছে আশমিন।মুলত কামিনী চৌধুরীর পরিকল্পনা জেনে ফেলায় লুবানার এই করুন পরিনতি। তার এক হাত ভেঙে গেছে। নির্মম ভাবে মারা হয়েছে তাকে।এক চোখ ফুলে আছে। শারীরিক অবস্থা আরেকটু স্টেবল হলে তার চোখ অপারেশন করা হবে। এখন এক চোখে দেখতে পায় না লুবানা।ফুলে যাওয়ার কারনে চোখ বন্ধ হয়ে আছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেতলে গিয়েছে।যন্ত্রণায় মাঝরাতে চিৎকার করে কাদতো লুবানা।তাই তাকে বেশিরভাগ সময় গুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়। সানভি এই কয়দিন লুবানার সাথেই ছিল। তবে সবসময় থাকতে পারে নি। আশমিনের সাথে ও থাকতে হয় তাকে। লামিম সারাক্ষণ বোনের সাথে থেকেছে।এই একটা মাত্র বোন ছাড়া তার আর কেউ নেই।
যন্ত্রণায় ছটফট করে যখন লুবানা কেদে উঠত তখন তার সাথে লামিম ও কেদে ফেলতো।সানভি অসহায় চোখে ভাই বোনের কান্না দেখতো।লামিম কে বুকে জরিয়ে শান্ত করলেও লুবনার কষ্ট কমাতে পারতো না। নিজেকে তখন কতটা অসহায় লাগতো একমাত্র সানভি ই জানে।
আশমিনের সাথে আমজাদ চৌধুরীর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সে আশমিনের সাথে কথা বলা ই বন্ধ করে দিয়েছে। সারাদিন কিছু একটা চিন্তা করে গুমরে থাকে।আশমিন দেখেও কিছু বলে না। তাকে সময় দিচ্ছে নিজেকে সামলে নেয়ার।মায়া বেগম ও নিজের মতো ই থাকে।নিজের মতো কাজ করে রুমে গিয়ে বসে থাকে। কারোর সামনে পরতে চায় না। নিজেকে খুব উটকো লাগে তার। তবে এখানে থাকা ছাড়া তার কোন গতি নেই।ভালোই তো আছে।আশমিন তাকে খুব সম্মান করে। আর কি চাই!
ইদানীং আশমিনের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কিছুটা মতবিরোধ হচ্ছে। দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চারিদিকে শুধু দুর্নীতি। মন মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এসব দেখলে। যে যেভাবে পারছে লুটেপুটে খাচ্ছে। মিটিংয়ে তাদের সাথে কথা কাটাকাটি করে ক্ষিপ্ত মেজাজে বাসায় এসেছে আশমিন। নিজের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সোজা নূরের রুমে চলে গেলো সে। মেয়েরা দোলনায় ঘুমিয়ে আছে।নূর তাদের কাপড় ভাজ করে রাখছে। আশমিন সোজা গিয়ে নূরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। মাথার রগ গুলো দপদপ করছে। নূর হাত থামিয়ে আশমিনের দিকে তাকালো। ক্লান্ত মুখটা দেখে মায়া হলো তার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপচাপ বসে রইলো। এমন ধোয়াশা ভালো লাগছে না তার। নিজের মনে কথা গুলো গুছিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— আব্বু কে মিসেস চৌধুরী মেরেছে তাই না?
— হুম।
আশমিনের নির্লিপ্ত গলা শুনে হতাশ হলো নূর। ক্লান্ত গলায় বলল,
— তাহলে আমার কাছে দোষী সাজলেন কেন মন্ত্রী সাহেব?
আশমিন নূরের কথার জবাব দিলো না।নূরের পেটে চুমু খেয়ে ম্লান গলায় বলল,
— মামি মার কাছে যাবে নূর?
চমকে উঠলো নূর। পুরো শরীর কাপছে তার।মনে হচ্ছে ভুল শুনেছে।কাপা কাপা গলায় বলল,
— কি বললেন আপনি?
আশমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। হাতের আজলে নূরের মুখটা নিয়ে তার কম্পমান ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো,
— তোমার মা বেচে আছে নূর। কাল আসছে এখানে। মিসেস চৌধুরী তাকে কানাডায় আটকে রেখেছিলেন। মামি মার কোমড়ের নিচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে।
–ত তাহলে ওই লা*শ?
— অন্য কারো ছিলো। এক্সিডেন্টে তোমার মায়ের ই হয়েছিল। তবে সে বেচে ছিল।কোমড় পর্যন্ত প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। মিসেস চৌধুরী তোমার বাবার সাথে তোমার মা কে ভালবাসার মানুষ হারানোর যন্ত্রণা দিতে চেয়েছিল। তাই তাকে কানাডা নিয়ে গিয়েছিল সবার অগোচরে। নিজের অক্ষমতার জন্য তোমার মা ও ফিরে আসতে পারেনি। যদিও তাকে এতো বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
নূরের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। তার মা বেচে আছে! কামিনী চৌধুরী এতটা পাষাণ কি করে হতে পারলো। সে কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে মায়ের জন্য কান্না করতো। কামিনী চৌধুরী দেখে বিরক্ত হয়ে ঢং বলে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতো।
নূর রাগে কাপতে লাগলো। ধরা গলায় চিৎকার করে বললো,
— আপনার মা একজন সাইকো মন্ত্রী সাহেব। পাগল সে।সুস্থ মানুষ কখনো এমন নিকৃষ্ট হতে পারে না।
আশমিন নূর কে আগলে রাখলো বুকে।নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— তুমি ঠিক বলেছো নূর। সে মেন্টালি সিক ছিল। ভালো হোক খারাপ হোক।সে আমার মা ছিল নূর। তাই তাকে নিয়ে আর কিছু বলো না। আমার কষ্ট হয়। বুকটা ফেটে যায়। আমি আমার আম্মুকে খুব ভালবাসি নূর।সে যা করেছে তার শাস্তি সে পেয়ে গেছে।তাকে আর অসম্মান করে কিছু বলো না।
কথা গুলো বলতে বলতে আশমিনের গলা ধরে এলো। নূর বুঝতে পেরে চুম করে সম্মতি দিলো।যে নেই তাকে নিয়ে আর কটু কথা বাড়াতে চায় না সে। আশমিন কে জরিয়ে ধরে বসে রইলো চুপচাপ। উত্তেজনায় তার হাত পা কাপছে। কাল সে তার মায়ের দেখা পাবে। এতগুলো বছর পর সে তাকে নিজের চোখের সামনে দেখবে ভাবতেই সারাদিনের ক্লান্তি পালিয়ে গেল। আশমিন নূরের মাথায় চুমু খেয়ে নিজের মেয়েদের কাছে গেলো। একজন ঘুমিয়ে আর একজন চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। আশমিন হালকা হেসে তাকে কোলে তুলে নিলো। দুজনের নাম দেয়া হয়েছে সুখ পাখি। ভালো নাম বড় করে আকিকা দিয়ে রাখা হবে। এত ঝামেলায় নাম ঠিক করা হয়নি। নূর অবশ্য মেয়েদের নাম আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। তবে আশমিন তা মানতে নারাজ।এ নিয়ে দুজনের কয়েক দফা ঝগড়া ও হয়ে গেছে। তাই আপাতত তাদের সুখ আর পাখি বলেই ডাকে সবাই। এই ঝগড়ার প্রতিশোধ আশমিন আর দশদিন পরে নিবে। শুধু একটু সুস্থ হয়ে নেক। অসভ্য মেয়ে। মেয়েকে আদর করতে করতে আড় চোখে তাকালো আশমিন। নূর মনের আনন্দে গুন গুন করছে। সুখ কে দোলনায় শুয়িয়ে ধির পায়ে নূরের কাছে গেলো। নূর কে ঝাপটে ধরে নেশালো গলায় বলল,
— বউ,,আমার প্রেম পাচ্ছে। হবে নাকি একটু?
নূর ভয়ার্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। তার কাছে পারমা*ণবিক বো*মার চেয়েও এই কথা টা বেশি ভয়ংকর। শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
— ক কি সব ব বাজে কথা! দ দূরে থাকুন।
আশমিন কবে কার কথা শুনেছে? সে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। নিজের মন ভরে আদর করে নূরের ভেজা চোখে চুমু খেলো।ফোলা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,
— তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও বউ। মন ভরে ভালবাসতে পারছি না তো!
নূরের ইচ্ছে করলো ছাদ থেকে লাফফ দিয়ে ম*রে যেতে। আশমিন কে ধাক্কা দিতে দিতে বললো,
— আপনি একটা অসহ্য মানুষ। আমার কাছে আসবেন না। লুটেরা কোথাকার।
আশমিন শব্দ করে হেসে উঠলো। নূর কে আদর করতে করতে বললো সুন্দরী বউ লুটেরা।হু হা হা।
(আমার কানের খুব খারাপ অবস্থা। ছাদ থেকে পাশের বাসার ভাই পরে আহত হয়ে গেছে। তাও আমার রুমের সামনে! আর আমি শুনতে পাই নি।বুঝুন কি একটা অবস্থা! আমি কানে শুনি না এটা মহল্লায় মহল্লায় রটে গেছে। কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আপসেট থাকায় কাল গল্প দেই নি। শারীরিক ভাবেও অসুস্থ। তার উপর বর এসে একটু পর পর খোচা দিয়ে বলে,আরেকটু বৃষ্টিতে ভিজে আসো।আহা দুঃখ!)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।