ইট পাটকেল | পর্ব – ২৫

রাতের আকাশ দেখায় মগ্ন নূর।আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু একটা ভেবে চলেছে সে।আশমিন এখনো বাসায় আসে নি।তার জন্যই অপেক্ষা করছে নূর।মুখে স্বীকার না করলেও সে আশমিন কে অসম্ভব ভালবাসে। আশমিন তার রক্তে মিশে আছে। এক মুহুর্ত চোখের আড়াল হলেই ভুকের ভিতর আনচান শুরু হয়ে যায়।আচ্ছা, আশমিন কি বুঝতে পারে তার অস্থিরতা? তার চোখ দেখে ভালবাসার গভীরতা বুঝতে পারে এই বজ্জাত মন্ত্রী? আশমিনের ভালবাসায় আবার অত রাখ ঢাক নেই।সে যেখানে সেখানে নিজের ভালবাসা প্রকাশ করে ফেলে।গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলাকালীন বউয়ের কথা মনে পরলে মিটিং থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

— কিছুক্ষন আলোচনা বন্ধ রাখুন। আমি আমার বউ কে মিস করছি।তার সাথে কথা বলা এই মুহুর্তে অক্সিজেন নেয়ার মতো জরুরি।
প্রথম প্রথম সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেও এখন এসব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আড়ালে সবাই মুখ টিপে হাসলেও মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস কেউ করে না।
পিছন থেকে কেউ জরিয়ে ধরায় ধ্যান ভাঙ্গলো নূরের।আশমিনের জেন্টস পারফিউম নাকে ধাক্কা খেতেই মুখে হাসি ফুটলো নূরের।
— আমাকে রেখে আকাশে কি দেখো বউ?
নূর হালকা হেসে জরিয়ে ধরলো আশমিন কে।
— আকাশের মাঝে আমি আপনাকেই খুজি মন্ত্রী সাহেব। আপনি যখন আমার থেকে দূরে থাকেন,তখন আমার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।মনে হয় এই আকাশের নিচেই তো আপনি আছেন।আমাদের মাঝে কোন দূরত্ব নেই। আপনি আর আমি এক আকাশের নিচেই আছি।
আশমিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। আজ নূরের চোখে শুধু তার জন্য ভালোবাসা ই দেখতে পাচ্ছে। আশমিন নূরের কপালে চুমু খেয়ে মন্থর গলায় বলল,
— ভালবাসি বউ।আমাদের মাঝে যাই কিছু হয়ে যাক না কেন, কখনো আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।সহ্য করতে পারবো না আমি।আমার জীবনে আমি নিজের বলতে শুধু তোমাকেই বুঝি।যে আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। যাকে আমি আমার নিজের চেয়েও বেশি চাই।তুমি হচ্ছো আমার একমাত্র প্রশান্তির কারণ। আমার চক্ষুশীতল কারিনী।তুমি যদি চাঁদ হও তাহলে আমি সুবিশাল আকাশ নূর।তোমার আমাতে উঠে আমাতেই অস্ত যেতে হবে। পালানোর চেষ্টা করো না নূর।তোমার শুরু থেকে সমাপ্তি আমিতেই সীমাবদ্ধ।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
নূর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেতে আবদ্ধ করে নিলো নূর কে।নাকে নাক ঘষে গালে হাত বুলিয়ে নূরের চোখে চোখ রাখলো।নূর আশমিনের চোখে চোখ রেখে বললো,
— আমার বিশ্বাস নিয়ে কখনো খেলবেন না মন্ত্রী সাহেব। আমি বিশ্বাসঘাতকদের কখনো ক্ষমা করি না। যে সম্পর্কে ধোকা,কপটতা, প্রতারণা থাকবে সে সম্পর্ক নূর পায়ে মারাতে এক মিনিট ও সময় নষ্ট করবে না।আপনি আমাকে বিশ্বাসের নিশ্চয়তা দিন।আমি আপনাকে সম্পর্কের নিশ্চয়তা দিবো।নূর নামের অর্থ জানেন তো মন্ত্রী সাহেব? নূর মানে হচ্ছে আলো।আলোকে বন্দি করার ক্ষমতা আল্লাহ বাদে কার আছে?আমি চাইলে আপনি আমার ছায়ার নাগাল ও পাবেন না। তাই সাবধান।যে নূর আপনাকে ভালবেসে জান্নাত দেখাতে পারে।সে নূর ঘৃণা করে আপনার জীবন জাহান্নাম ও করে দিতে পারে।
আশমিনের বুক কেপে উঠলো নূরের কথা শুনে। হাতের বাধন হালকা হয়ে গেলো। অস্থির চোখ জোড়া নূরের চোখে রাখতেই নূরের কথার সত্যতা দিনের মতো পরিস্কার দেখতে পেলো সে।নূর গভীর চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। তার বুকেও কাপন ধরেছে।এই ভালবাসায় ফাটল ধরবে না তো?
ভালবাসার খুনশুটি তে নূর আর আশমিনের জীবন। কামিনী চৌধুরী হঠাৎ করেই চুপ করে গেছে।আশিয়ান ও নিজের মতোই আছে।এ যেন ঝড় আসার আগের নিস্তব্ধতা। আশমিন আর নূরের সম্পর্ক স্বাভাবিক দেখা গেলেও তাদের মনের খবর সম্পর্কে কেউ ই অবগত না।গত দেড় মাস যাবৎ অমি গুম হয়ে আছে।আমজাদ চৌধুরী নিজের মতো থাকে।সংসার টা মায়া বেগম টেনে হিচড়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সংসারের দিকে কারোর মন নেই। যে যার কাজে ব্যস্ত।আশমিন রাজনীতি নিয়ে ইদানীং খুব ব্যস্ত থাকে। যতটুকু সময় পায় নূরের সাথেই কাটায়।
হঠাৎ করেই নূরের অফিসে লারার আগমন। লারা কে দেখে বিরক্ত চোখে তাকালো নূর।আশমিনের এতো অপমানের পরেও এই মেয়ের লজ্জা হয় নি।
লুবানা লারার এভাবে হুট করে ঢুকে পরায় কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুড়িয়ে নূরের দিকে তাকাতেই বুঝলো এই আগুন্তকের আগমনে নূর খুশি নয়।
— এভাবে অসভ্যের মতো নক না করে ঢুকে পরলেন কেন?যান,আবার গিয়ে নক করে তারপর অনুমতি নিয়ে তারপর আসুন।
লুবানার কাটকাট গলায় বলা কথা গুলো শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো লারার।
— মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলো।দু টাকার কর্মচারী হয়ে এভাবে কথা বলো কিভাবে?সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। বাইরে যাও।আমার নূরের সাথে কথা আছে।
— মুখে লাগাম দিবো কেন?আমি কি ঘোড়া নাকি?আমার লাগামের কথা চিন্তা না করে আপনি আপনার পায়ে লাগাম দিন।যেখানে সেখানে ঢুকে পরে।
লারা দাতে দাত চেপে তাকিয়ে রইলো লুবানার দিকে। নূর নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। এখানে কি হচ্ছে তাতে তার কোন মাথা ব্যথা নেই।লারা নূরের এই নির্লিপ্ততা দেখে ফুসে উঠলো। দাত কিড়মিড় করে বললো,
— খুব দেমাগ বেড়েছে না?যে আশমিনের জন্য এতো আকাশে উড়ছো সেই তোমাকে ছুড়ে ফেলবে। ভোগ করা শেষ হলে রাস্তায় ছুড়ে মারবে।তখন না এ ঘাটের রবে না ও ঘাটের।
নূর শান্ত চোখে তাকালো লারার দিকে। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— নূর কোন মন্ত্রীর দাপটে চলে না।আমি কে ভুলে গেছো বুঝি?তেহজিব নূর শিকদার আমি।শিকদারেরা মন্ত্রী বানায়। মন্ত্রীদের ক্ষমতায় চলে না। তোমার কি মনে হয় লারা?পুকুরের পানি দিয়ে শিকদাররা এই সাগর বানিয়েছে? নর্দমায় থাকো তো।তাই এই বিশাল সাম্রাজ্য সম্পর্কে ধারণা নেই।
লুবানা,,,একে নর্দমায় ফেলে দিয়ে এসো।ম্যাডামের এতো ভালো পরিবেশ সহ্য হয় না।
লারা সাপের মতো ফোসফাস করতে লাগলো। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। তখন দেখবে এতো ভাব কোথায় থাকে।
— ও ম্যাডাম। দরজা ওই দিকে।নাকি সিকিউরিটি ডাকতে হবে।
লারা লুবানার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে।
নূর চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। লুবানা কিছু না বুঝলেও তার নূরের জন্য খারাপ লাগলো।আশমিন কে তার খারাপ মনে হয় নি। তার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করে। বড় ভাইয়ের মতো স্নেহ করে।নূরের সমস্ত খবরাখবর তার থেকেই নেয়।মাথা ঘুরতে শুরু করেছে লুবানার।
— আপনি ঠিক আছেন ম্যাম?
— হুম।আজকের মিটিং গুলো ক্যান্সেল করে দাও।আমি বাসায় যাচ্ছি।
লুবানা মাথা নেড়ে সায় জানালো। আশমিন আজ সারাদিন নূরের খবর নেয়ার সুযোগ পায়নি।মন্ত্রণালয়ে আটকে গেছে। ইদানীং নূরের শরীর খুব একটা ভালো থাকে না।খাওয়া দাওয়ার প্রচন্ড অরুচি। আশমিন জোর করে ও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই আজ ডাক্তার বাসায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।তার বউ খাবার দেখে নাক মুখ কুচকে ফেলবে আর সে মুখ বুজে দেখবে তা হতে পারে না। এক বিয়ে করেই তার এই অবস্থা! বাবার মতো দুই বউ থাকলে না জানি কি হতো!
নূর বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সোজা স্টাডি রুমে চলে গেলো। মায়া বেগম নূরের খাবার টা স্টাডি রুমেই পাঠিয়ে দিলো। বাসায় এখন আর একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া হয় না।একেক জন একেক সময় খায়।কামিনী চৌধুরী কানাডা গিয়েছে দুই দিন আগে।মায়া বেগমের সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে না। কোন কথা ও বলে না।আমজাদ চৌধুরীর সামনেও খুব কম পরে। আমজাদ চৌধুরী চাতক পাখির মতো বসে থাকে তাকে এক পলক দেখার জন্য। কিন্তু দিনে একবার ও দেখা পান না। মাঝে মাঝে সপ্তাহ পার হয়ে যায়। অপেক্ষা শেষ হয় না।
আশমিন বাড়িতে যখন ঢুকেছে তখন রাত দশটা।আমজাদ চৌধুরী সোফায় চোখ বুজে বসে আছে। কয়েকদিনে বয়স অর্ধেক বেড়ে গেছে।আশমিন ধপ করে গিয়ে তার পাশে বসে পরলো। গম্ভীর গলায় বলল,
— এভাবে বসে আছো কেন? ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।এভাবে চললে তো নূরের আর ননদের মুখ দেখা হবে না। আমি কতো বড় মুখ করে বলেছি, আমার আব্বু ইজ আ স্ট্রং ম্যান। আর তুমি কিনা বোয়াল মাছের মতো চিৎ হয়ে পরে আছো!কালকেই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।কলিকাতা হারবাল। এক ফাইল ই যথেষ্ট।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।