প্রচন্ড নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিলো চারদিকে।সমগ্র প্রাসকোভিয়া জঙ্গল দিনের বেলাতেও ভয়াবহ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে।জঙ্গলের গাছগুলোকে দেখতে এক একটা ভয়ংকর দানবের মতো লাগে।
সহসা তীব্র কলরব করে মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক পাখি উড়ে যায়।অজানা আতঙ্কে বুকের ভেতরটাও কেমন হিম হয়ে আসে।
ক্রিসক্রিংগল সতর্ক দৃষ্টিতে অভিনিবেশ সহকারে দেখেন।তার সামনে আদি-অন্ত কালো পোশাকে ঢাকা হৃষ্টপুষ্ট দেহের পাঁচজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে।প্রত্যেকের হাতে ধারালো তলোয়ার।ওরা আক্রমনাত্মক দৃষ্টিতে শিকারী নেকড়ের মতো তাকিয়ে থাকে ক্রিসক্রিংগলের দিকে।ক্রিসক্রিংগল ঠান্ডা মেজাজে শান্ত গলায় বলেন,,,
-যদি তোমরা লুণ্ঠনকারী হও,তাহলে সামনে থেকে সরে যাও।আমার কাছে মূল্যবান কিছু নেই।অহেতুক লড়াই করে সময় নষ্ট হবে।
ক্রিসক্রিংগলের কথাগুলো ওরা শুনেও শুনতে পেলো না যেন।কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়াও দেখালো না।একজন লোক বাকি চারজন লোকের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে কিছু একটা বোঝালো।ইশারা পাওয়া মাত্রই বাকিরা ক্রিসক্রিংগলের দিকে ছুটে গেলো।
ক্রিসক্রিংগল শুরু থেকেই প্রস্তুত ছিলেন।তিনি শক্ত হাতে তলোয়ার চেপে ধরে দৌড়াতে শুরু করেন।লোকগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে বামহাতে একজনকে ঘু’ষি দিয়ে ডানহাতে অন্যজনের বুকে তলোয়ারের স্ল্যাশ আঁকেন।স্ল্যাশের আ’ঘা’তটা গুরুতর হওয়ায় লোকটা বেশ আহত হয়।মাটিতে শুয়ে কাতরাতে থাকে।উঠে দাড়ানোর ক্ষমতা হয় না তার।বাকি তিনজন একসাথে আক্রমণ করে বসে।
ক্রিসক্রিংগল ভূমি থেকে বেশ অনেকটা উঁচুতে উঠে একপা ভাঁজ করে অন্য পা সোজা রেখে একজনের বুকে লাথি মারেন।লোকটা পেছন দিকে পড়ে যায়।ক্রিসক্রিংগলের শক্তপোক্ত বলশালী একহাতের মুষ্টিবদ্ধ আঘাতে আরও একজন পেছনের দিকে উল্টে পড়ে।দু’জনেই পুনরায় উঠে দাড়ায়।
একজন লোক গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে।বাকি তিনজন তালোয়ার হাতে ধীরপায়ে ক্রিসংগলের চারদিকে ঘুরতে শুরু করে।শুধুমাত্র একজন লোক দাঁড়িয়ে থেকে সবটা দেখছিলো।
ক্রিসক্রিংগল উৎকর্ণ কানে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বুলান।আচম্বিতে পেছন থেকে ক্রিসক্রিংগলের দিকে একটা মারাত্মক আঘাত ঘনিয়ে আসে।ক্রিসক্রিংগল সাবধান ছিলেন।তিনি তার হাতের তলোয়ার দিয়ে আঘাতটা প্রতিহত করেন।দু’জন ব্যক্তির তলোয়ারের ঝংকারে জায়গাটা মুখরিত হয়ে উঠে।সেই দাড়িয়ে থাকা লোকটা হঠাৎই ক্রিসক্রিংগলকে আ’ক্রমণ করে বসে।তার সাথে যোগ দেয় আরও একজন।
ক্রিসক্রিংগল দু’জন লোকের সাথে একহাতে বীরদর্পে তলোয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।কিন্তু এরই মাঝে দু’জন লোক ডানদিক এবং বামদিক থেকে একসাথে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে তাকে।তিনি উল্টো দিকে পিঠ বাঁকিয়ে অনেকটা নিচু হয়ে যান।লোক দু’টোর তলোয়ার একটার উপর আরেকটা বারি খেয়ে শব্দ সৃষ্টি করে।নিচু হওয়া অবস্থাতেই দুই তলোয়ারের নিচ থেকে পেছন দিকে দ্রুতবেগে বেশ খানিকটা দুরে সরে যান ক্রিসক্রিংগল।বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাড়ান।থমথমে ভরাট কন্ঠে সর্তক করে বলেন,,,,
-আমি আবারও বলছি,অহেতুক যুদ্ধ করে সময় অপচয় করছো।আমাকে যেতে দাও।যত দ্রুত সম্ভব আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।
-যদি মাস্টারের খোঁজে এসে থাকো।তাহলে ফিরে যাও।বাইরের কেউ তার কাছে পৌঁছাতে পারবে না।সামনে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে একটার পর একটা ভয়ংকর বিপদ।জায়গায় জায়গায় দল বেঁধে পাহারায় আছে সব শক্তিশালী যোদ্ধারা।সাথে থাকবে ভয়াবহ সব মৃ’ত্যু ফাঁদ।যত সামনের দিকে এগিয়ে যাবে পূর্বের তুলনায় আরও বেশি শক্তিশালী যোদ্ধাদের দলের সম্মুখীন হবে।সবগুলো দলের মধ্যে প্রথম দিকে পাহারা দেওয়া আমাদের দলটাই ছিলো সবচেয়ে দুর্বল।____দাড়িয়ে থাকা চারজন লোকের মাঝখান থেকে কথাটা বলে উঠে একজন।
-কিন্তু আমাকে যেতে হবে।মার্টিন লরেন্সের সাথে আমার দেখা করা প্রয়োজন।
-তার কাছে কাউকে পৌঁছাতে না দেওয়া আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।প্রয়োজনে তোমাকে মে’রে ফেলবো।হয় তুমি বাঁচবে।না হয় আমরা।আমরা জীবিত থাকা পর্যন্ত সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না।কেনো জানি মনে হচ্ছে,তুমি ভালো মানুষ।তাই সাবধান করছি।ফিরে যাও।
-আমি তোমাদের কাউকে মা’রতে চাই না।আমাকে যেতে দাও।___ক্রিসক্রিংগল নরম গলায় বলেন।
-এটা আমাদের নিয়মের বিরুদ্ধে।যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
লোকটা নিজের কথা শেষ করে ক্রিসক্রিংগলের দিকে তলোয়ার হাতে দৌড়ে যায়।বাকি তিনজনও ছুটে যায় তাকে আঘাত করতে।ক্রিসক্রিংগল ভাবেন,,,
-এই লোকগুলো মার্টিনের।ওরা শুধুমাত্র নিজেদের মাস্টারের আদেশ পালন করছে।যা অন্যায় কিছু নয়।আমি ওদেরকে হ’ত্যা করে নিজেই নিজের কাছে নৃ’শং’স প্রমাণিত হতে চাই না।আমাকে অন্য কোনো উপায় খুঁজে নিতে হবে।
লোকগুলোর মুখাবয়ব কালো কাপড়ে ঢাকা ছিলো।কথা বলা লোকটার কন্ঠ শুনে অল্প বয়সী বলে মনে হয়।ক্রিসক্রিংগল তখনো স্থির,নিশ্চল।তাকে মার্টিনের সাথে দেখা করতেই হবে।তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল।কিন্তু এদেরকে জীবিত রেখে এখান থেকে যাবেন কিভাবে?
-এরা সবাই মা’রো অথবা ম’রো কথনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ক্রিসক্রিংগল ভাবেন।তার ভাবনার মাঝেই দুইজন লোক ভারী তলোয়ার হাতে দু’পাশ থেকে তার দু’কাধ লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত করে।ক্রিসক্রিংগল নিজের তলোয়ার মাটিতে ফেলে দেন।ত্বরিত সরে দাড়ান।দু’হাত সোজা রেখে দু’জনের কানের কাছে মোক্ষম আঘাত করেন।লোক দুজন সাথে সাথে চেতনা হারায়।শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে যায়।এই সুযোগে ক্রিসক্রিংগলের বাম কাঁধের উপরের অংশে তলোয়ারের দিয়ে আঘাত করে অন্য আরেকজন।ধারালো তলোয়ারের আঘাতে জায়গাটা চিরে যায়।ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে।একপলক সেদিকে তাকিয়ে ক্রিসক্রিংগল লাফ দিয়ে খানিকটা উঁচুতে উঠে যান।ডান হাতের কনুই দিয়ে শক্তপোক্ত একটা আঘাত করেন লোকটার ঘাড়ের উপর।লোকটা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে।ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠে সে।
ক্রিসক্রিংগলের কাঁধের কাঁটা অংশটুকু ব্যথায় টনটন করতে শুরু করে।যেন জায়গাটুকু অবশ হয়ে আসে।দু’জন গুরুতর আহত।আর দু’জন অচেতন হয়ে গেছে।সামনে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় সজ্ঞানে আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে।যে তীব্র বেগে ছুটে যায় ক্রিসক্রিংগলের দিকে।কাছাকাছি পৌঁছে পরপর কয়েক বার তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে তাকে।ক্রিসক্রিংগল সবগুলো আঘাত প্রতিহত করেন।সবশেষে লোকটা শক্ত করে তলোয়ার ধরে ক্রিসক্রিংগলের পেটের ভেতর সেটা ঢুকিয়ে দিতে উদ্যত হয়।কিন্তু তার তলোয়ারে নিজের তলোয়ারের দ্বারা আঘাত করে সেটা মাটিতে ফেলে দেন ক্রিসক্রিংগল।বাম হাতের কনুই দিয়ে লোকটার চিবুকে আঘাত করেন।শরীরের সমস্ত শক্তি ডান হাতের মুঠোয় জমা করে লোকটার পিঠের উপরে ঘাড়ের কাছে শক্তিশালী একটা ঘুষি দেন।লোকটা উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে।
-আশা করি বেঁচে আছে ও।____মনে মনে কথাটা ভেবে লোকটার নাকের কাছে দু’আঙ্গুল রেখে পরীক্ষা করেন ক্রিসক্রিংগল।নিঃস্বাস পড়ছে।চারদিকে আরও একবার সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলান।পাঁচজন লোক মাটিতে শুয়ে আছে।কেউ আহত অবস্থায়,কেউবা অচেতন হয়ে।সামনে আরও ভয়ংকর সব বিপদ অপেক্ষা করছে।কে জানে কতক্ষণ সময় লাগবে গন্তব্যে পৌঁছাতে।
ধীরে ধীরে সময় গড়ায়।ক্রিসক্রিংগলের ক্ষিধে পায়।সকাল থেকে না খেয়ে আছেন তিনি।খাবার না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে,তখন প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করে বেশিক্ষণ টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাড়াবে।হঠাৎ তার মনে হয় হোঁটচ খাওয়া জায়গায় নিজের ব্যাগ ফেলে এসেছেন।যেটাতে কিছু শুকনো খাবার ছিলো।তিনি পুনরায় কিছুটা পথ পিছিয়ে যান।দ্রুতপায়ে হাঁটেন।
ক্রিসক্রিংগল চাইলেই ক্রিস্তিয়ানকে সাথে নিতে পারতেন।কিন্তু ছেলেটাকে বিপদের সম্মুখীন করতে চাননি।বাড়িতে থাকা মেয়েগুলোর দেখাশোনার ভার দিয়ে এসেছেন ওকে।যদিও তিনি জানেন সিয়া,ইনায়ার উপর যে কোন সময় যে কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।তবুও তাকে ঝুঁকি নিয়ে হয়।র’ক্তপিপাসুগুলো তাদের খুঁজে পাওয়ার আগেই মার্টিনের সাথে দেখা করা প্রয়োজন।ক্রিসক্রিংগল জানেন না কতটা সময় লাগবে মার্টিনকে খুঁজে পেতে।আদৌও কি খুঁজে পাবেন নাকি পথিমধ্যেই প্রাণ হারাবেন,জানা নেই তার।
-আমি মা’রা গেলে সিয়া,ইনায়ার কি হবে?ওদের রক্ষা করবে কে?
মেয়েদের কথা ভেবে নিজের জীবনের প্রতি মায়া হয়।কিন্তু পরমুহূর্তেই ভুলে যান এটা ভেবে,ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।ঈশ্বরের কাছে নিজের মেয়েদের সঁপে দিয়ে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।একবার যখন মার্টিনের খোঁজে বেরিয়েছেন,তখন তার সাথে দেখা করে তবেই ফিরবেন।হাঁটতে হাঁটতে নিজের ব্যাগের কাছে চলে যান ক্রিসক্রিংগল।মাটি থেকে কাপড়ের ব্যাগটা তুলে নেন।হাত দিয়ে ঝেড়ে উপরের ময়লা পরিষ্কার করেন।অতঃপর দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকেন গন্তব্যের দিকে।সময় জানা নেই ক্রিসক্রিংগলের।কখন না জানি এই প্রাসকোভিয়ার বুকে রাত নেমে আসে।তখন তার পথযাত্রা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
_______
সকাল থেকেই বেশ তুষার পড়ছিলো।জঙ্গল,পর্বত,গাছপালা এমনকি বাড়িগুলোতেও তুষার জমে গেছে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো।ইম্যুভিলের অন্তরীক্ষে সূর্যের দেখা নেই।এমনিতেই এই গ্রাম শীতপ্রধান।বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় কনকনে শীতে আচ্ছন্ন থাকে।তন্মধ্যে কিছুদিন ধরে বরফ পড়ছে।যতদুর চোখ যায়,ইম্যুভিলের চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ।বরফের চাদরে ঢেকে গেছে সব।ইম্যুভিলে প্রায়ই পর্যটকদের ভিড় জমে।ভিন্ন ভিন্ন স্থানগুলো থেকে আগমন ঘটে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের।গায়ে বাহারী শীতবস্ত্র,মাথায় টুপি আর পায়ে নী লেন্থ বুট পরে বরফ ছুড়োছুড়ির খেলায় মেতে উঠে।বরফের উপর চলতে থাকে স্কিই।হাড় কাঁপাতো তীব্র ঠান্ডার কথা ভুলে বাড়ি থেকে বাইরে বের হলে দেখা যায় মানুষগুলোর সীমাহিন আনন্দ,হুপো আর স্নো-কক পাখিদের কলধ্বনি।
নীলাভ আকাশে ভেসে বেড়ায় শ্বেতশুভ্র মেঘ।ফ্রাঙ্কলিনের স্বচ্ছ পানির জলাশয়’টাকে মনে হয় ছোটখাটো আইস লেক।সিয়া সিঁড়ির উপর কাঠের পাটা পেতে বসে।ওর পরনে কালো রঙের হুডি জ্যাকেট।তারউপর সাদা রঙের উলের শাল জড়ানো ছিলো।হাত দু’টো ঠান্ডায় জমে যায়।কিচকে কোলের উপর বসিয়ে দু’হাতে শাল টেনে নেয় সিয়া।হঠাৎই থ্যাসোর কথা মনে পড়ে।অদ্ভুত এক ধরনের মায়া কাজ করে স্বর্গীয় প্রাণীটার উপর।যখন ওকে স্পর্শ করে মনের সব যন্ত্রণাগুলো যেন নিমেষেই উবে যায়।
দুরে,অনেক দুরে দাড়িয়ে থাকা সুউচ্চ পাহাড়গুলোর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে সিয়া।কয়েক পল সময় গড়ায়।জলাশয়ের বরফ হয়ে যাওয়া পানিতে ও নিজের হাত ডুবিয়ে দেয়।শীতের প্রকোপে শিরশির করে উঠে সর্বাঙ্গ।সহসা নেত্রচ্ছদ বুজে নেয়।চোখের সামনে ভেসে উঠে কিছু হৃদয় বিদারক দৃশ্য।প্রিয়জন হারানোর অসহনীয় যন্ত্রণা।শত্রুর কাছে পরাজিত হওয়ার ক্রোধ।অনল দহনে জ্বলতে শুরু করে ওর হৃদপিণ্ড।সিয়া নিজের অভ্যন্তরে অনুভূত সমস্ত আক্রোশ সংযত করে নেয়।শান্ত কন্ঠে অনুচ্চস্বরে বলে,,,,
-তুমি নির্দয়,নৃশংস,অত্যা’চারী পি’শাচ। ঠিক এই শীতল কঠিন বরফের মতো নিষ্ঠুর।তবে বরফ আর তোমার মধ্যে পাথক্য কি জানো?এই বরফখন্ডগুলো সাদা আর পবিত্র।কিন্তু তোমার ভেতরটা বিদঘুটে কালো অন্ধকারে আচ্ছাদিত।প্রিয়জন হারানোর ব্যথা কি বুঝো?আমি তোমাকে বোঝাবো।অপেক্ষা করো।
ইনায়া দু’কাপ গরম কফি হাতে নিয়ে জলাশয়ের সিঁড়ির কাছে এসে দাড়ায়।সিয়াকে জলাশয়ের পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে থাকতে দেখে ভড়কে যায়।কফির মগ দু’টো সিড়ির উপর রাখে।দৌড়ে গিয়ে পানি থেকে সিয়ার হাত টেনে তুলে।সিয়া চোখ মেলে তাকায়।ইনায়া কপট রাগ মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-কি করছিলে?রক্ত হিম হয়ে যাওয়া এই ঠান্ডা পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে থাকার মানে কি?
সিয়া নিষ্প্রভ চোখে তাকায়।প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়।হঠাৎই ওর বাবার কথা মনে পড়ে।ক্ষীণকন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
-বাবা এখনো ফিরে আসেননি?
-না।তবে দ্রুত ফিরে আসবেন।
বসা থেকে উঠে গিয়ে কফির মগ দু’টো নিয়ে আসে ইনায়া।একটা মগ সিয়ার হাতে দিয়ে পাশাপাশি বসে।অকপটে জিজ্ঞেস করে,,,,
-ঘুরতে যাবে?
-কোথায়?
-কাছেই একটা তৃনভূমি আছে।এখন অবশ্য বরফ আস্তরনে ঢেকে গেছে।কিন্তু জায়গাটা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর।তুমি চাইলে আমরা ঘোড়া নিয়ে যেতে পারি।সাথে ক্রিস্তিয়ান আর আর্নি।দাদুকে বললে,চারটে ঘোড়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
-কাছেই তৃণভূমি আছে,তুমি কি করে জানলে?___ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সিয়া।
-সকালবেলা যখন তোমাকে খুঁজতে বের হয়েছিলাম,তখন দেখেছি।
-ওহ।___ভাবলেশহীন কন্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় সিয়া।
-হ্যাঁ।তুমি কি যাবে?___ইনায়া পুনরায় জিজ্ঞেস করে ওকে।
-হুম।চারজনের মধ্যে একটা ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতাও হবে।
ইনায়া ঈষৎ রক্তবর্ণ ঠোঁটে মিষ্টি করে হাসে।সিয়া নিষ্পলক চোখে দেখে।ইনায়া সুন্দর।যদি ওকে প্রিন্সেসদের মতো সাজানো হয় তাহলে ঠিক কতটা বেশি সুন্দর লাগবে,সিয়া কল্পনা করতে পারে না।ইনায়া অকল্পনীয় সুন্দর।বিশেষ করে ওর থুতনিতে পড়া টোল’টা বেশ আকর্ষণীয় দেখতে।
সিয়া দু’চোখের পল্লব নাড়ায়।দৃষ্টি সরিয়ে জলাশয়ের দিকে তাকায়।ম্লান কন্ঠে বলে,,,,
-আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবে?
ইনায়া একহাতে সিয়াকে জড়িয়ে নেয়।মাথার একপাশে চুমু খেয়ে বলে,,,,
-অবশ্যই।বলেই দেখো।
-দাদু ফ্রাঙ্কনিলের কাছে যাও।খারকিভ ওব্লাস্টের মানচিত্র নিয়ে এসো।আর জিজ্ঞেস করো,তার কাছে ইম্যুভিলসহ আশেপাশের গ্রাম এবং প্রাসকোভিয়া জঙ্গলের নকশা আছে কিনা।
ইনায়া কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায়।অকপটে জানতে চায়,,,
-এসব দিয়ে কি করবে?
-প্রয়োজন।
সিয়ার গোলাপী রঙের অধর কোণে দেখা যায় রহস্যময় হাসি।ইনায়া বিস্মিত হয়।অথচ ওর হৃদয় জুড়িয়ে যায়।বহুদিন পর সিয়াকে হাসতে দেখা গেলো।সিয়া বরাবরই কম হাসতো।লজ্জা পেতো বেশি।লজ্জায় বুদ হয়ে নেত্রপল্লব বুঁজে নিতো।দুঃখ,যন্ত্রণা,হাসি,কান্না সমস্ত কিছু সবসময়ই মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতো ও।খুব সহজে ওকে বোঝা যেত না।ক্রিসক্রিংগলের নিরুদ্দেশ হওয়া,মা-দাদিনের মৃ’ত্যু।প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর এই নিয়ে দু’বার সিয়াকে কাঁদতে দেখেছিলো ইনায়া।তারপর থেকে সিয়া কাঁদতে ভুলে গেছে।
-আর্নি কি করছে?
সিয়ার করা প্রশ্নে ইনায়া সম্বিত ফিরে পায়।হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বলে,,,
-আর্নি প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে বের হয়না।গায়ে কম্বল জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে থেকে বই পড়ছে।
-তোমার কি মনে হয়,ও তৃণভূমিতে যাবে?
-যদি না যেতে চায়,বেঁধে নিয়ে যাবো।___দৃঢ় কন্ঠে কথাটা বলে উঠে ইনায়া।
-কাকে কোথায় বেঁধে নিয়ে যাবে?
পেছন থেকে ক্রিস্তিয়ানের কন্ঠস্বর শোনা যায়।ইনায়া পেছন ফিরে দেখে।দ্রুত পায়ে ক্রিস্তিয়ান ওর কাছে গিয়ে দাড়ায়।কৌতুহলী কন্ঠে পুনরায় ইনায়াকে জিজ্ঞেস করে,,,,
-কার কথা বলছিলে?
-আর্নি।ভাবছি,চারজনে মিলে তৃণভূমিতে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় যাবো।আর্নি যদি যেতে না চায়,ওকে জোর করে বেঁধে নিয়ে যাবো।
ক্রিস্তিয়ান শব্দ করে হাসে।ইনায়াও হাসে।সিয়া নিশ্চুপ,নির্বাক চোখে প্রাসকোভিয়ার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।অকস্মাৎ নিস্তেজ গলায় ডাকে,,,
-ক্রিস্তিয়ান।
-হুম?
-বাবা শহরে কেনো গেছেন?কখন ফিরে আসবেন?
-জানি না।তবে মাস্টার আমাকে বলে গেছেন,তার ফিরে আসতে দেরি হবে।কয়েক দিন সময়ও লেগে যেতে পারে।আমি যেন তোমাদের খেয়াল রাখি।কাজ শেষ করে তিনি দ্রুত ফিরে আসবেন।
-কি বলছো?কয়েক দিন সময় লাগবে কেনো?ঈশ্বর না চান,যদি তিনি কোনো বিপদে পড়ে যান?___সিয়ার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর।
ইনায়ার মুখে ভয়াবহ দুশ্চিন্তার ছাপ।ক্রিস্তিয়ানও দুশ্চিন্তা পড়ে যায়।কিন্তু ওদের দু’জনের সামনে তা প্রকাশ করে না।বরং সিয়া,ইনায়াকে আশ্বস্ত করে বলে,,,,
-অযথা দুশ্চিন্তা করছো।মাস্টারের ক্ষতি করার মতো ক্ষমতা আছে কি কারো?
সিয়া,ইনায়া উত্তর দিতে পারে না।ওরা বলতে পারে না রক্তপিপাসুগুলো ওদের ঠিকানা জেনে গেছে।যে কোন সময় যে কারো উপর ভয়াবহ বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।
______
গোধূলি সন্ধ্যা।দ্বার বদ্ধ কামরায় সোফার উপর বসে আছে আব্রাহাম।তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো পাশে বসে থাকা একজন সুন্দরী মেয়ে।ওষ্ঠদ্বয়ে বিরাজিত আবেদনময়ী হাসি।আব্রাহাম অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।অনুচ্চস্বরে বিরবিরয়ে বলে,,,,
-আর কতক্ষণ এইসব সহ্য করতে হবে?
মেয়েটা আলগোছে আব্রাহামের কাছ ঘেঁষে বসে।শরীর এলিয়ে দেয় আব্রাহামের বুকে।চোয়াল শক্ত করে বসে থাকে আব্রাহাম।সহসা দরজায় করাঘাতের শব্দ হয়।ওপাশ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের কন্ঠস্বর শোনা যায়,,
-লারা।
আব্রাহাম বাঁকা হাসে।কামরার ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ শোনা যায় না।লোকটা পুনরায় ডাকেন,,,
-লারা দরজা খোলো।
পরপর কয়েকবার ডাকার পর আচম্বিতে দরজা খুলে যায়।কিন্তু দরজার সামনে কেউ নেই।
-দরজা খুলে দিলো কে?
লোকটা মনে মনে ভাবেন।প্রচন্ড ভীত হন।ব্যতিব্যস্ত পায়ে কামরায় প্রবেশ করেন।কামরার চারদিকে নজর বুলাতেই সোফার দিকে দৃষ্টি স্থির হয় তার।আব্রাহামকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে লারা।মেয়েটার চুলগুলো এলোমেলো।আব্রাহামের শার্টের উপরের বোতামগুলো খোলা।যেখানে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছিলো লারা।তার শিরায় শিরায় জেগে উঠেছে আব্রাহামের সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার কামনা।আব্রাহামের ঠোঁটে প্রাণোচ্ছল হাসি।আকুলি বিকুলি হয়ে সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি করে লারা।ক্ষণকাল বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন লোকটা।অতঃপর তীব্র রাগমিশ্রিত কন্ঠে ডাকেন,,,,
-লারা!!
মেয়েটার মাঝে কোনো হেলদোল নেই।আব্রাহাম বিরক্ত সূচক শব্দ করে বলে,,,,,
-আহ!!যাজক হেলেনজিল।আপনার মেয়ে প্রেম করছে।কেনো বিরক্ত করছেন?দেখতে ভালো লাগছে না?
যাজক হেলেনজিল রক্তচক্ষু নিয়ে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আব্রাহামের দিকে।গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ করতে পারেন না।আব্রাহাম ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে।মেয়েটাকে ঠেলে দুরে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাড়িয়ে পড়ে সে।একপা দু’পা করে এগোয় ধর্মযাজক হিলেনজিলের দিকে।কঠিন কন্ঠে বলে,,,,,
-আমাদেরও ভালো লাগে না যখন গীর্জায় ঘন্টাধ্বনি বাজে।মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠে।ইচ্ছে করে,আপনার দেহের সমস্ত রক্ত শুষে খেয়ে আপনাকে পাঠিয়ে দিই আপনার ঈশ্বরের কাছে।তারপর স্বর্গে গিয়ে যতখুশি ঘন্টাধ্বনি বাজাবেন।কিন্তু ইচ্ছেটা পূরন করতে পারিনা।আমার মা নীতিবান রক্তপিপাসু কিনা,তিনি আবার নিরীহ মানুষের রক্ত খাওয়া পছন্দ করেন না।
আব্রাহাম নিজের কথা শেষ করে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।সহসা দ্রুতবেগে ছুটে যায় লারার কাছে।এক ঝটকায় টেনে দাড় করায় তাকে।লারা তখনো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকে আব্রাহামের দিকে।যাজক হেলেনজিল ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে দেখেন।তার ভীষন গলা শুকিয়ে আসে।
যাজক’কে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আব্রাহাম ভয়াবহ গর্জন দিয়ে উঠে।তার নীলাভ নেত্রগুলো রক্তবর্ণ ধারণ করে।ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে তীক্ষ্ণ ধারালো শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে।কামড়ে ধরে লারার ঘাড়ে।মেয়েটা মৃদু আর্তনাদ করে উঠে।যেন জোরে আর্তনাদ করার ক্ষমতাটুকুও ওর নেই।যাজক বীভৎস চিৎকার দিয়ে উঠেন।আব্রাহাম চুকচুক করে রক্তপান করে।
-লারাকে ছেড়ে দাও।মে’রো না।আমি ওকে নিয়ে এখান থেকে অনেক দুরে চলে যাবো।
আব্রাহাম রক্ত পান করা বন্ধ করে দেয়।যাজকের একমাত্র মেয়ে লারা।খুব অল্প বয়সে মা মা’রা যায় ওর।ওকেই টোপ হিসাবে ব্যবহার করে আব্রাহাম।এসব মেয়ে সংঘটিত ব্যাপারে বেশ পারদর্শী সে।তাই যাজক’কে শিক্ষা দিতে আব্রাহামকে কাজে লাগায় এদুয়ার্দো।যাজক বলেছিলেন তার মৃ’ত্য ভয় নেই।কিন্তু এদুয়ার্দো যাজকের মধ্যে মেয়ে হারানোর তীব্র ভয় দেখতে চেয়েছিলো।
-আপনার জন্য এটাই শেষ সুযোগ হেলেনজিল।আজ রাতেই মেয়েকে নিয়ে খারকিভ ছাড়বেন।আমাকে যেন আর আসতে না হয়।
অচেতন হয়ে যাওয়া লারাকে সোফায় ফেলে দেয় আব্রাহাম।দ্রুতবেগে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়।ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসে। মনে মনে বলে,,,,
-শুধু খারকিভ শহর নয়,ধীরে ধীরে সমগ্র ইউক্রেন থেকে বিলীন হয়ে যাবে চার্চের ঘন্টাধ্বনি।ধ্বংস হয়ে যাবে সব চার্চ।ঈশ্বরের নাম মুছে গিয়ে মানুষের মুখে মুখে প্রতিধ্বনিত হবে শয়তানের জয়জয়কার।
_______
খারকিভ,ওয়াভেল কোট।
এদুয়ার্দোর কামরায় ইতস্তত পায়চারি করছিলো ইজাবেল।অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষায় আছে সে।শিকারে গেছে এদুয়ার্দো।এখনো ফিরে আসেনি।ইজাবেল এলোমেলো পা ফেলে হাঁটে।ভয় পায়।তার অন্যায় আবদার শুনে কে জানে,এদুয়ার্দো কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়।বেশ কিছুক্ষণ সময় গড়ায়।
হঠাৎ সশব্দে দরজা খুলে যায়।এদুয়ার্দো কামরায় প্রবেশ করে।ইজাবেল তাকে মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। হাঁটু ভাজ করে কিঞ্চিত মাথা ঝোঁকায়।উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,,,
-অনারেবল ওভারলর্ড।
-ইজাবেললল।__এদুয়ার্দো আদুরে স্বরে ডাকে।
দ্রুতপায়ে হেঁটে ইজাবেলের কাছে গিয়ে দাড়ায়।এদুয়ার্দোর বাহুতে আলগোছে নিজের মাথা এলিয়ে দেয় ইজাবেল।মিহি সুরে ডাকে,,,,
-ভাই।
-বলো।শুনছি।___এদুয়ার্দো শান্ত কন্ঠে বলে।
-আমার আবদার’টা আপনাকে রাখতেই হবে।
এদুয়ার্দো নিশ্চুপ,নির্বাক।ইজাবেলের পরবর্তী কথাটুকু শুনতে চায়।ইজাবেল সময় নেয়।রয়ে সয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলে,,,
-এটা আমার সম্মানের প্রশ্ন।একাডেমির সবাই জানে,আপনি আমাকে কতটা ভালবাসেন।তাই প্রিন্সিপাল আমাকে আপনাকে রাজি করানোর দায়িত্ব দিয়েছেন।তার ধারনা আপনি আমার আবদার অসম্পূর্ণ রাখবেন না।বেশিক্ষণ না।অল্প একটু সময় দিলেই হবে।সেটা আপনার সুবিধা অনুয়ায়ী।
এদুয়ার্দো কোনো প্রত্যুত্তর দেয় না।ইজাবেল মাথা তুলে তার দিকে তাকায়।বিষন্ন বদনে করুন কন্ঠে বলে,,,
-ঠিক আবদার নয়,অনুরোধ।দয়া করে আমার অনুরোধ রাখুন।তা নাহলে প্রিন্সিপালের কাছে আমি ভীষণভাবে লজ্জিত হবো।
-ইজাবেল,তুমি খুব ভালো করে জানো আমার সময় নেই।নিজের কামরায় যাও।___এদুয়ার্দো গম্ভীর স্বরে বলে।
এই সামান্য কথাটা শুনেও ইজাবেলের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।এদুয়ার্দোর হৃদয় মুষড়ে উঠে।ইজাবেলের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকনা সহ্য করতে পারে না সে।
ছোটবেলা থেকেই কেনো জানি মনে হতো,তাদের মা ইজাবেলের প্রতি সবসময়ই উদাসীন ছিলো।অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় ওকে কম ভালবাসতো।এদুয়ার্দোর কষ্ট হতো।এ নিয়ে মা’কে কিছু জিজ্ঞেস করেনি সে।কিন্তু সবসময়ই ছোট বোনকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে।ওর সব আবদার পূরন করেছে।কখনো কাঁদতে দেয়নি ইজাবেলকে।আজ তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে ইজাবেল কাঁদছে।এদুয়ার্দোর রাগ হয়।সে কঠিন কন্ঠে বলে,,,
-তোমাকে কামরায় যেতে বলেছি।
ইজাবেলের কান্নার বেগ বাড়ে।দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় দরজার দিকে।নিঃশব্দে দরজা খুলে পিছন ফিরে দেখে।এদুয়ার্দো তখনো শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।একবারও তাকায় না ইজাবেলের চলে যাওয়ার দিকে।ইজাবেলের অভিমান হয়।ও ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায় কামরার বাইরে।এদুয়ার্দো সোফার উপর বসে।দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়।সে অনুমতি দেয়,,,
-এসো।
কামরায় প্রবেশ করে অ্যাভোগ্রেডো।এদুয়ার্দোকে সম্মান জানিয়ে সম্বোধন করে তাকে,,,,
-অনারেবল ওভারলর্ড।
-আব্রাহাম কোথায়?____এদুয়ার্দোর রাশভারী কন্ঠস্বর।
-রুলার তার কাজ সম্পূর্ণ করে ওডেসায় ফিরে গেছেন।
-ইম্যুভিলে ওদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছো?
-জ্বি।কিন্তু একটা বিষয় আপনাকে জানানো প্রয়োজন।
-বলো।
-জনাব ক্রিসক্রিংগল বাড়িতে নেই।
-যদি আজকের মধ্যে ফিরে না আসে,তাহলে তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব তোমার।____এদুয়ার্দো থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে।
-জ্বি।
-স্যাভেরিন ক্যাসলের চারদিকে আমার বিশ্বস্ত সেনা থাকবে।কে কখন দুর্গের বাইরে বা ভেতরে যায়,কোথায় যায়,আমি সবকিছুর খরব জানতে চাই।যত দ্রত সম্ভব,ব্রাংকো,স্যান্ড্রি,উড্রো উইলসন, অ্যালিস,ক্যারলোয়েন,ভিক্টোরিয়া এমনকি আমার মা’য়ের সব ধরনের গতিবিধি সম্পর্কে আমাকে জানাবে।বিশেষ করে গত কয়েকদিনে ওরা কে কোথায় গিয়েছিলো সবগুলো তথ্য খুঁজে বের করবে।
আদেশের স্বরে রক্ত হিম করে দেওয়া কন্ঠে কথাগুলো বলে এদুয়ার্দো।অ্যাভোগ্রেডো হতবাক হয়।হঠাৎ করে এদুয়ার্দোর এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারন বুঝতে পারে না সে।