সিয়া খুব ধীরপায়ে হাঁটে। ক্রিসক্রিংগলের ভ্রু কুঁচকে আসে। সিয়ার পরনে সাদা কালোর মিশেলে টেকউন্ডো পোশাক। বাকিদের পরনেও তাই। সামনে দু’হাত বেধে সিয়া ওর বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্রিসক্রিংগ ওর দিক থেকে নজর সরিয়ে সামনে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের দিকে তাকান। দৃঢ় কন্ঠে বলেন,

– আর্ট অব মার্শাল অর্থাৎ “যুদ্ধের শিল্প”। এখন আমি তোমাদের গুংফু(কুংফু) এবং তায়কোয়ান্দোর কিছু রণ কৌশল দেখাবো।

গুংফু—গুংফু শেখার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য এবং শক্তি। গুংফু এর নিজস্ব নীতি ও কৌশল আছে। যা চতুরতা আর ধূর্ততার সাথে আয়ত্ত করতে হয়। গুংফুর মূল উদ্দেশ্য হলো আক্রমণের সময় সামনের ব্যক্তির সর্বোচ্চ ক্ষতি করা এবং ভারসাম্য না হারানো। নিজের দেহকে প্রাণনাশক অস্ত্রে পরিণত করা।

তায়কোয়ান্দো— হাত ও পা চালনার শিল্প। লাথি আর ঘুষির মোক্ষম আঘাতে শত্রুকে কাবু করতে হবে। এক্ষেত্রে পায়ের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আত্ম রক্ষার স্বার্থে প্রতিপক্ষের ঘাড়, কনুই এবং হাঁটুতে আঘাত করতে হবে। আক্রমন যে কোন দিক থেকেই হতে পারে, তাই শ্রবণেন্দ্রিয় সর্বদা সজাগ রাখতে হবে। দক্ষতার সাথে শত্রুপক্ষের সবগুলো আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। পেটে পাঞ্চ মে’রে ঘাড় বরাবর কিক দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিতে হবে।

আমি একবার দেখিয়ে দিচ্ছি। সবাই মনোযোগ দিয়ে দেখে নাও।

ক্রিসক্রিংগল নিজের কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং হাত, পা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের তায়কোয়ান্দোর শৈলী শিখিয়ে দিচ্ছিলেন। সিয়া একটু পর পর এক হাত মুখের সামনে রেখে লম্বা লম্বা হাই তুলে যাচ্ছিলো। অকস্মাৎ তার ঘাড়ের উপর আঘাত করে বসলেন ক্রিসক্রিংগল।

– আহহ! ____ব্যথাসূচক শব্দ করে চোখমুখ কুচকে ফেললো সিয়া। ওর বাবা রাগান্বিত স্বরে বললেন,

– নিজে তো মনোযোগ দিয়ে দেখছো’ই না। অন্যদের মনোযোগেও বিঘ্ন ঘটাচ্ছো? প্রশিক্ষণ শেষে মাটিতে দু’হাতের উপর শরীরের সমস্ত ভর রেখে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকবে।

সিয়ার চোখ ভিজে উঠে। ঘাড়ে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে ও। ক্রিসক্রিংগলের মায়া হলো না। তিনি পা দিয়ে আঘাত করলেন ওকে। সিয়া মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। ব্যথায় কুকিয়ে উঠে বলে,

– প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ না দিয়ে আপনি আমাকে আঘাত করতে পারেন না।

– তোমার শত্রুরা নিশ্চয়ই তোমাকে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দিবে না। তাছাড়া এই আঘাতটা করেছি তোমাকে হুশে ফেরানোর জন্য। এখনও কি তোমার ঘুম পাচ্ছে?

দু’হাতের উপর ভর দিয়ে উঠে দাড়িয়ে পড়ে সিয়া। গায়ের পোশাক ঝেড়ে পরিষ্কার করে নেয়। সত্যি সত্যিই ওর ঘুম ছুটে যায়।

– প্রস্তুত হও। আপাতত আমি দেখতে চাই তুমি ঠিক কতগুলো শৈলী আয়ত্ব করতে শিখেছো।

সিয়া প্রস্তত হয়। প্রথম আক্রমনটা ও-ই করে ক্রিসক্রিংগলকে। লড়তে থাকে নিজের বাবার সাথে। কোমল নরম দু’খানা মেয়েলি হাতের দ্বারা ওর বাবার পাথরের মতো শক্ত কঠিন পুরুষালী হাতের আঘাতগুলো প্রতিহত করার চেষ্টা করে। হাত আর পায়ের একসাথে হওয়া আক্রমনগুলো ব্যাহত করতে নাজেহাল হয়। পরপর কয়েকবার আঘাত পায়। বাকিরা মনোযোগ দিয়ে দেখে। এক ঘন্টা পর সিয়ার প্রশিক্ষণ শেষ হয়। ও ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যায়। সম্পূর্ন শরীরসহ হাড়ের গিটে গিটে ব্যথা অনুভব করে। এলোমেলো পায়ে পুনরায় আপেল গাছের ছায়ার নিচে গিয়ে বসে। ঠিক তখনই ক্রিসক্রিংগলের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

– কি হলো? বসে পড়লে যে! শাস্তির কথা মনে নেই? আমার কথার অবাধ্য হলে এর থেকেও বড় শাস্তি পাবে।

সিয়া মাটিতে দু’হাতের উপর শরীরের সমস্ত ভর রেখে ধীরে ধীরে উল্টো হয়ে ঝুলে। কে জানে ওর এই শাস্তি কতক্ষণ সময় ধরে চলে।

________★★_________

কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।

যোসেফ স্যাভেরিনের মৃত্যুর দেড়শো বছর পেরিয়ে গেছে। তার মৃত্যুর পর একে একে দুর্গের সব মানুষগুলোর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। স্যাভেরিন ক্যাসল যেন রহস্যময় মৃত্যপুরী। প্রাচীরগুলো কেমন স্যাঁতস্যাঁতে। শৈবাল জমে কালো কালো দাগ পড়ে গেছে। দুর্গের আশে পাশে বহু দূর-দূরান্তে কোনো জনবসতি নেই। নেই কোনো মানুষের আনাগোনা। দুর্গের দেয়ালে দেয়ালে কতশত বাদুড় ঝুলে থাকে। কি বীভৎস সেগুলো দেখতে!

দিনের আলোতেও যে দুর্গের দিকে তাকালে মানুষের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়, রাতের অন্ধকারে সেই দুর্গ থেকে বাদ্য যন্ত্রের আওয়াজ আর যুবতীদের হাসির শব্দ শোনা যায়। কই, সেখানে তো কোনো মানুষ বাস করে না। তাহলে কে বা কারা হাসে সেই অদ্ভুতুরে দুর্গের ভিতরে?

প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগের কথা,

স্যাভেরিন ক্যাসলে গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকজন পরিদর্শকের আগমন ঘটেছিলো। তারা সবাই পরিত্যক্ত এই দুর্গ পর্যবেক্ষণ করতে এসেছিলো। দুর্গের সম্পূর্ণ হলরুম, প্রত্যেকটা অলিন্দ ঘুরে ঘুরে দেখলো। কামরাগুলোতে প্রবেশ করতেই বেশ হতবাক হলো। বাইরে থেকে অত্যধিক ভয়ংকর দেখতে, অথচ ভিতরে ভয়ের বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটা নেই। সবকিছুই ভীষণ সুন্দর করে সাজানো গোছানো ছিলো।

শত বছরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ স্যাভেরিন ক্যাসল যেনো সেই পুরনো রাজকীয়তা ধরে রেখেছিলো। মনে হলো এই দুর্গে এখনো রাজ পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছিলো।

কামরার মধ্যে বিছানা, আলমারি, চেয়ার, টেবিলসহ সবগুলো মূল্যবান জিনিসপত্র পরিপাটি করে সাজানো গোছানো ছিলো। গোসল খানায় প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো সেখানটাও ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তারা হতভম্ব। স্যাভেরিন ক্যাসল পরিত্যক্ত। তাহলে এখানের সবকিছু এতো সাজানো গোছানো কেনো?

ধীরে ধীরে সময় গড়ালো। দিনের আলো ছাপিয়ে পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নেমে এলো। মনের কোণে প্রগাঢ় ভয় আর কৌতুহল নিয়ে বিভাগীয় পরিদর্শকগুলো একটি টাওয়ারে প্রবেশ করলো।

একচক্ষু লন্ঠন হাতে নিয়ে স্প্রিংয়ের মতো গোলাকার সিঁড়ি বেয়ে তারা কয়েকটা কামরায় ঢুকে গেল। যদিও তাদের ভয় হচ্ছিলো, কিন্তু মনোবল দৃঢ় রেখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। হঠাৎ, তারা একটি কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যেটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিলো। সম্পূর্ণ দরজায় কাঠ খোদায় করে ক্রুশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো। যার উপর জমেছিলো মাকড়সার জালের গাঢ় আস্তরণ আর ধূলো। বিভাগীয় প্রধান মুষ্ঠিবদ্ধ একহাত সামনে ধরে খুকখুক করে কেশে উঠল, অন্যহাতে দরজার উপর থেকে মাকড়সার জাল ছাড়াতে শুরু করলো।

একজন তালা ভাঙ্গলো। দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করতেই কেশে উঠলো। পুনরায় বাইরে বেরিয়ে গেলো। ভিতরে ভয়াবহ অন্ধকার। বিভাগীয় প্রধান বিরক্ত হলেন। লন্ঠন হাতে কামরায় প্রবেশ করলেন। যেখানে কতগুলো কফিন দেখতে পেলেন।

একজন ইন্সপেক্টর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন। একটা কফিন খুলতেই ভয়ংকর চিৎকার দিয়ে উঠলেন। কফিনের মধ্যে শুয়ে ছিলো একজন অসম্ভব সুন্দরী রমনী। কিছুক্ষণ পূর্বেই একটা কামরার দেয়ালে যার তৈলচিত্র টানানো দেখেছিলেন।

ইন্সপেক্টরের চিৎকারে বাকিরাও তার পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রত্যেকের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে কফিনে শুয়ে থাকা রমনীর দিকে অপলক চেয়ে রইলো।

আচমকা সেই ঘুমন্ত নারী রক্তচক্ষু মেলে তাকালো। যার ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে দু’টো তীক্ষ্ণ ধারালো শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। বিভাগীয় প্রধানের হাত থেকে লন্ঠন পড়ে গেলো। শব্দ তুলে কাচগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ভেঙ্গে গেলো। বাকিরা সবাই ভয় পেয়ে দৌড়াতে শুরু করল। কামরার বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু তার আগেই সশব্দে দরজা আটকে গেলো। তিমিরে আচ্ছন্ন কামরার ভেতর থেকে কিছু ভয়ংকর আত্ম চিৎকার শোনা ভেসে এলো।

সেদিন স্যাভেরিন ক্যাসলে প্রবেশ করা গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শকগুলো কেউ আর জীবিত ফিরে আসেনি। সেই ঘটনার পর থেকে কোনো মানুষ ক্যাসলের আশে পাশে যাওয়ার দুঃসাহস দেখায়নি। কারন অনেকেই মনে করেন সেখানে অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। আবার কেউ কেউ আন্দাজ করে নেন, স্যাভেরিন ক্যাসলে রক্তচোষা পিশাচ’রা বসবাস করে। দিনের বেলা ঘুমিয়ে থাকা দুর্গটা রাতের অন্ধকারে প্রাণ ফিরে পায়। তখন দূর থেকে স্যাভেরিন ক্যাসলে আলোর রোশনাই দেখা যায়।

_________★★________

কাস্ত্রোরুজ থর্প।

গ্রামটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফিদেল আলেকজান্দ্রো কাস্ত্রোরুজ। তার নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ করা হয়েছিলো কাস্ত্রোরুজ থর্প। আলেকজান্দ্রো কাস্ত্রোরুজ ছিলেন বিখ্যাত একজন জাদুকর। বর্তমানে রবার্ট ক্রিসক্রিংগল’ই তার শেষ বংশধর।

বড় বোন ইনায়া এবং সমবয়সীদের সাথে নিয়ে পাহাড়ি মেঠো পথ ধরে হাঁটছিলো সিয়া। অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছেন ক্রিসক্রিংগল। দ্রুতপায়ে হাঁটছিলেন তিনি। যেহেতু বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে। ভোর বেলায় মাঠে রেখে আসা ভেড়া আর মেষগুলোকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পোষা কুকুগুলোকেও খাবার খেতে দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। ভেড়া আর মেষগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থে একপাল কুকুর পোষেন তিনি।

হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাঝখানে থেমে যায় সিয়া। দু’হাতে নিজের পেট চেপে ধরে বলে,

– আমি আর হাঁটতে পারছি না ইনায়া। কোথাও বসে একটু জিরিয়ে নিতে চাই।

– দেখো, বাবা অনেকটা দূরে চলে গেছেন। যেকোনো সময় বৃষ্টি নেমে আসবে। আমাদের পৌঁছতে দেরি হলে মা দুশ্চিন্তা করবেন।

– তোর যে অবস্থা। আমি ভাবছি আগামীকাল সকালে অনুশীলন করবি কিভাবে। ___পাশ থেকে কথাটা বলে আর্নি নামের একটি মেয়ে।

সিয়া মনে মনে প্রার্থনা করে, রাতে যেন ওর ভীষণ জ্বর চলে আসে। তাহলে আগামীকাল আর অনুশীলন করতে হবে না। ওর অলস দেহখানা মিছে মিছে উষ্ণতা অনুভব করে। ইনায়ার একহাত খপ করে ধরে নিজের কপালে রেখে বলে,

– দেখো, আমার গায়ে জ্বর এসে গেছে।

ইনায়া হাতের দু’পাশ এপিঠ ওপিঠ করে। অবাক কন্ঠে বলে,

– কোথায়? তোমার শরীরের তাপমাত্রা একদম স্বাভাবিক।

– ও তুমি বুঝবে না। শরীরের ভেতরে ভেতরে জ্বর অনুভব করছি। আমার সারা শরীরে ব্যথা। হাড়ের গিটে গিটেও জ্বর এসে গেছে।

– আহারে বেচারি! মাস্টার সিয়ার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেন না। সুযোগ পেলেই ওর শাস্তির মাত্রা আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন। ___কথাটা বলে আর্নি মুখখানা করুন করে ফেলে।

– বাবা যা করেন ওর ভালোর জন্যই করেন। ওসব নিয়ে কথা না বলে দ্রুত পায়ে হাঁটো।

হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে পৌঁছে যায় ওরা। আর্নি চলে যায় নিজের বাড়ির দিকে। সিয়া কোমরে হাত রেখে ধীরপায়ে হাঁটে। ওকে দেখে ওর মা দৌড়ে আসে।

– কি হয়েছে তোমার?____জিজ্ঞেস করেন সিয়ার মা ইলহামা অ্যালিয়েভ।

– ওর কিছু হয়নি মা। আপনার মেয়ে ঢং করছে। যাতে আগামীকাল সকালে অনুশীলনে না যেতে হয়।

– আমি বুঝতে পেরেছি। তোমরা একেবারে গোসল সেরে নাও। আমি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছি।___ইলহামা বলেন।

সিয়া আর ইনায়া নিজেদের কামরায় চলে যায়। ইলহামা অ্যালিয়েভ দুশ্চিন্তায় পড়েন। এই অলস মেয়েটার ভবিষৎ কি? এতো অলসও কেউ হয়? খানিকক্ষণ বাদেই আকাশ কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকায়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। ইলহামা দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকে যান। ক্রিসক্রিংগল মেষ আর ভেড়াগুলোকে তাড়াহুড়ো করে খামারে তোলেন।

সিয়া গোসল শেষ করে খোলা জানালার পাশে গিয়ে দাড়ায়। কপালের সামনে ব্যাংস লেয়ার দেওয়া ওর কাঁধ ছাড়িয়ে যাওয়া মসৃন বাদামী রঙ্গা চুলগুলো থেকে টপটপিয়ে পানি গড়ায়। ওর চুলের মতো ওর চোখগুলোও বাদামী রঙের। সিয়া বাদামী চোখের দৃষ্টিতে বাইরে পড়া বৃষ্টির দিকে অপলক তাকিয়ে রয়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভীষণ পছন্দ করে ও। রাস্তায় জিরিয়ে নিতে চেয়েছিলো বৃষ্টিতে ভেজার জন্য। ভেবেছিলো ভিজে ভিজে বাড়িতে ফিরবে। কিন্তু তা আর হলো কই? অসভ্য বৃষ্টি বাড়িতে পৌঁছানোর পর ঝরে পড়লো। পথিমধ্যে ঝরলে কি এমনি ক্ষতি হতো?

ওপাশ থেকে সিয়ার ডাক পড়ে। ও দৌড়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যায়। ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। ওর দাদা উইজার্ড ডিয়েটস মুচকি হাসেন। দাদী উরসুলা ভনডারলেন ফোঁড়ন কেটে বলেন,

– একটু আগেই নাকি তুমি হাঁটতে পারছিলে না? এখন দৌড়ে আসলে কিভাবে?

সিয়া মুখ কাঁচুমাচু করে। কোনো উত্তর খুঁজে পায়না। সব মিথ্যা ধরা পড়ে গেছে। ওর মুখের অবস্থা দেখে সবাই একসাথে হাসে। ইলহামা অ্যালিয়েভ তার ঠোঁটের কোণের হাসিটুকু বজায় রেখে বলেন,,,

– তোমার পছন্দ অনুযায়ী খাবার রান্না হয়েছে আজ।

সিয়া টেবিলে সাজিয়ে রাখা খাবারগুলো দেখে নেয় একবার। চিকেন কিয়েভ, সালো, ভারেনিকি, বানুশ, সিরনিকি এবং পটেটো প্যানকেক। সবগুলো প্রিয় খাবার দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও বাইরে তা প্রকাশ করে না ও। বরং মুখাবয়বে বিষন্নতার ছাপ ফুটিয়ে তুলে বলে,

– হঠাৎ এতো আয়োজন? আজ কি কোনো স্পেশাল দিন?

– বাবা বোধহয় মাকে বলে গিয়েছিলেন, আজ তোমার শাস্তির পরিমান একটু বেশিই হবে। তাই মা তোমার পছন্দের সব খাবার খাইয়ে তোমার মন ভুলাতে চাইছেন।

– তুমি কখনোই আমার ভালো সহ্য করতে পারো না। সবসময়ই আমার পেছনে লেগে থাকো।___সিয়া অভিমান করে কথাটা বলে।

– আমি তোমার বড়। আমি নই, তুমিই আমার পেছন পেছন পৃথিবীতে এসেছিলে আমাকে জ্বালাতে। প্রথমে তুমি। তারপর তোমার ঐ অসভ্য কাঠবিড়ালি। ওকে আমি নদীতে ছুঁড়ে ফেলবো।

– কেনো? কি করেছে ও?

– আমার সবগুলো বাদাম খেয়ে ফেলেছে।

ইনায়ার কথা শুনে সিয়া শব্দ করে হাসতে শুরু করে। ওকে হাসতে দেখে ইনায়ার আত্মা জুড়িয়ে যায়। এমনিতে দু’জনের কথা কাটাকাটি লেগেই থাকে। কিন্তু দু’জন দুজনকে ভীষণ ভালবাসে। অথচ কেউ কাউকে বুঝতে দেয়না।

খেতে খেতে ওরা টুকিটাকি গল্প করতে থাকে। ক্রিসক্রিংগল কামরায় প্রবেশ করতেই দু’জনে নিশ্চুপ হয়ে যায়।

_________★★________

খারকিভ, ওয়াভেল কোট।

দুর্গের যতদুর চোখ যায়, চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সুদীর্ঘ, সুউচ্চ পাচঁ টাওয়ার বিশিষ্ট এই দুর্গটি যখন তৈরী করা হয়েছিলো, তখন পাহাড় ছিলো এই দুর্গের মারাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এতে আক্রমণকারীরা খুব সহজে দুর্গে আক্রমণ করতে পারতো না। এই দুর্গটির অধিপতি ক্লিভল্যান্ড এদুয়ার্দো একজন প্রকৃতি প্রেমিক। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল আর সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে বেশ পছন্দ করে সে।

ওয়াভেল কোটের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারের রুফটপে বসে আছে এদুয়ার্দো। তার মুখাবয়বে রাজ্যের গাম্ভীর্য। বয়স কত হবে?ছাব্বিশ বছর? এর কম বা বেশিও হতে পারে। তার চেহারা দেখে সঠিক বয়স অনুমান করা অনেকটাই কঠিন হয়ে দাড়ায়।

আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আজকের এই বৃষ্টিই জানান দিলো বর্ষাকাল এসে গেছে। এতে বেশ ভালোই হয়েছে। শীত আর বর্ষা এই দুই ঋতুতে এদুয়ার্দো বেশ আনন্দ অনুভব করে। ছোট ভাই আব্রাহামকে সাথে নিয়ে নানান রকম এডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ে। তার ভাইটাও হুবুহু তার মতই। প্রকৃতি প্রেমি। আব্রাহামের অবশ্য আরও একটা নেশা আছে।প্রেমের নেশা। তার জীবনে প্রণয়িনীর অভাব নেই। তবুও সে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনের দুঃখ প্রকাশ করে বন্ধুদের কাছে। করুন স্বরে বলে,

– আমার জীবনে একজন মায়াবিনী মানবীর বড্ড অভাব।

আব্রাহামের কথা শুনে তার বন্ধুরা উচ্চস্বরে হাসে। কারন তারা জানে এই ছেলেটার হৃদয় চুরি করতে পারার মতো মেয়ে হয়তো এখনো জন্ম নেয়নি পৃথিবীতে। নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে সব খবরই রাখে এদুয়ার্দো। ভাবতে ভাবতে ধোঁয়া উঠা গরম কফিটা শেষ করে সে। পেছনে একজন ভৃত্য এসে দাড়াল। বুকের কাছে মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত রেখে সম্মান দেখিয়ে বলে,

– অনারেবল ওভারলর্ড! কিয়েভ থেকে চিঠি এসেছে।

এদুয়ার্দো হাত বাড়ায়। ভৃত্য চিঠিটা তার হাতে দেয়।

– ইজাবেলকে তৈরী হতে বলো। ____এদুয়ার্দো আদেশের স্বরে কথাটা বলে।

ভৃত্যটি চলে যাচ্ছিলো। তন্মধ্যে এদুয়ার্দোর রাশভারী কন্ঠস্বর শুনতে পেলো,

– ও কোথায়?

– রুলার ওডেসায় ফিরে গেছেন নিজের ক্যাসলে।

অসামান্য রাগে এদুয়ার্দোর চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে আসে। চোখ দু’টোতে রক্ত জমে যায়। নিজেকে খুব কষ্টে সংযত করে বলে,

– যাও।

ভৃত্যটি চলে যায়। এদুয়ার্দো উঠে দাড়ায়। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। একটি বদ্ধ কামরা হতে উদ বাজানোর শব্দ শুনতে পায়। দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করে। তার ছোট বোন বিছানার উপর পা ছড়িয়ে বসে থেকে একধ্যানে উদ বাজিয়ে যাচ্ছে। এদুয়ার্দো নিঃশব্দে বোনের কাছে গিয়ে দাড়ায়। আলগোছে বিছানার একপাশে বসে। আদুরে স্বরে ডাকে,

– ইজাবেল।

এদুয়ার্দোর ডাক শুনতে পেয়ে ধ্যান ভেঙ্গে যায় ইজাবেলের। হাতে থাকা উদ যন্ত্রটা বিছানার উপর রেখে মিষ্টি হেঁসে বলে,

– ওভারলর্ড! আমরা কি সত্যিই ফিরে যাচ্ছি?

– হ্যাঁ। ___উত্তর দেয় এদুয়ার্দো।

– আমি এখনই তৈরী হয়ে নিচ্ছি।___উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ইজাবেল বলে উঠে।

ইজাবেল তৈরি হতে চলে যায়। এদুয়ার্দো নিজের কামরায় ফিরে আসে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।