ফ্লোরেনসিয়া – ১৭

নীল রঙের লম্বা গাউন পরে আছে ইনায়া। ওর পিঠে এলানো সুদীর্ঘ লালচে-সোনালী চুলের মোটা বিনুনি। আরক্তিম অধরপল্লব কোণে লেগে আছে অনবদ্য স্মিথ হাসি। কর্ণলতিকায় দোল খাচ্ছে ঝকমকে সাদা পাথরের মাকরি। মেয়েটার ওষ্ঠদ্বয়ের সাথে তার চোখ দু’টোও যেন হাসছে। কি ভীষণ মায়াবি দেখাচ্ছে তাকে! আব্রাহাম খুব বেশি বিমুগ্ধ হলো। সে যন্ত্রমানবের ন্যায় ধীরপায়ে হাঁটল। ইনায়া যেন তাকে টানছে। আব্রাহামের হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল। অনুভূত হলো ভয়ংকর সব যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি। প্রচন্ড গলা শুকিয়ে এলো।

হ্যারিয়েট সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে নিজের কামরায় ফিরে গেল। বাদ্যযন্ত্রের শব্দ বা অধিক কোলাহল কোনোটাই পছন্দ নয় তার। হ্যারিয়েটের সাথে হলরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন মাদাম কামালি। বাকিরা যে যার মতো একে অপরের সাথে গল্পগুজবে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আব্রাহাম একপা দু’পা করে ইনায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঈষৎ ভ্রু কুঁচকে বিস্মিত দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। ইনায়ার গাঢ় ধূসর চোখ জোড়ায় অনন্ত নিবিড় মায়া ঠিকরে পড়ল। কতক্ষণ সময় গড়াল কে জানে। হঠাৎই আব্রাহামের কর্ণকুহরে দু’আঙ্গুলে তুড়ি বাজানোর শব্দ ভেসে এলো। সে সম্বিত ফিরে পেল।

– কি ব্যাপার? কি দেখছিস এভাবে?___সহাস্যে জিজ্ঞেস করল বেলাডোনা।

আব্রাহামের মুখাবয়বে অসামান্য বিরক্তি প্রকাশ পেল। এতক্ষণ বেলাডোনাকেই সে ইনায়া ভেবেছিলো। কেমন উসখুস করে উঠল। অতি সামান্য সময়ের জন্য তার চোখ দু’টো তাকে ধোঁকা দিয়ে দিলো। যেন মানতে চাইল না সে। দৃষ্টি সরিয়ে এদিক সেদিকে তাকাল। বক্ষস্থলে কেমন অস্থিরতা অনুভব করল। বেলাডোনার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল। সে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আব্রাহামকে পর্যবেক্ষণ করল।

– কোনো সমস্যা? এরকম করছিস কেনো?____বেলাডোনার অকপট প্রশ্ন।

– কিছুনা।_____অশান্ত কন্ঠে আব্রাহাম বলে উঠল।

বেলাডোনাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে একটা সোফার উপর গিয়ে বসল। হলরুমের একপাশ থেকে ট্রেমভিটার শব্দ ভেসে আসছিল। বসে থেকে কতোগুলো মেয়ে উদ বাজিয়ে যাচ্ছিল। তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টি আব্রাহের দিকে স্থির।

হলরুমের চারপাশ থেকে ম্যাগনোলিয়া ফুলের মনোমুগ্ধকর মিষ্টি সুগন্ধ নাকে এসে লাগল। ছেলেগুলো গল্প করতে করতে ওয়াইন পানে মত্ত হয়ে উঠল। পামেলার বিমোহিত দৃষ্টি আব্রাহামের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল। সহসা নিলসোন আব্রাহামের পাশে এসে দাঁড়াল। আব্রাহাম পামেলার দু’চোখের আড়াল হয়ে গেলো। কিঞ্চিৎ মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল নিলসোন। সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল,

– এস্টীম রুলার। আপনি কি কোনো বিষয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন?

আব্রাহাম তাকে থমথমে ভরাট কন্ঠে বলল,

– না। আমার জন্য ড্রিংকস নিয়ে এসো।

– লাল নাকি কালো?_____সহজ সাবলীল কন্ঠে নিলসোন জানতে চাইল।

– তুমি কি আমার সাথে মজা করছো? অবশ্যই ব্ল্যাক ওয়াইন নিয়ে আসবে। এটা কি রক্ত খাওয়ার মতো জায়গা?_____কপট রাগমিশ্রিত কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে কথাটা বলল আব্রাহাম।

নিলসোন থতমত খেল। নির্বোধের মতো প্রশ্ন করায় একহাতে নিজের মাথা চুলকাল। ঠোঁট ছড়িয়ে মৃদু হাসল। ইদানীং রুলারের হাবভাব তার কাছে স্বাভাবিক লাগছে না। নিলসোনার দিকে তাকাল আব্রাহাম। ক্ষণকাল কিছু একটা ভেবে গম্ভীর স্বরে বলল,

– থাক। ওয়াইনে কাজ হবে না। আমি বাইরে যাচ্ছি। তুমি এদিকটা সামলে নিও।

আব্রাহাম ত্বরিত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। দ্রুতপায়ে হেঁটে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু তাকে বাঁধা দিলো স্টুয়ার্ড। স্টুয়ার্ডের হাতে ওয়াইনের গ্লাস। সে বোকা বোকা হেসে বলল,

– পামেলার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিবি না?

– তুই নিজেই পরিচিত হয়ে নিস।____আব্রাহাম রাশভারি কন্ঠে বলল।

হঠাৎই দু’জনের মাঝখানে বেলাডোনা এসে উপস্থিত হলো। কপাল কুঁচকে আব্রাহামের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,

– অপদার্থটা কি বলছিলো তোকে?

– এই, এই একদম অপদার্থ বলবি না। তোর মাথার সবগুলো চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলবো একেবারে।

– ছিঁড়ে দেখা।

বেলাডোনা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দু’পা এগিয়ে গেলো স্টুয়ার্ডের দিকে। স্টুয়ার্ডও তেড়ে গিয়ে একহাতে বেলাডোনার চুল টেনে ধরল। বেলাডোনা মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। স্টুয়ার্ডের কাঁধে দুম করে কিল বসিয়ে দিল। চলতে থাকল দু’জনের কথা কাটাকাটি আর মা’রামা’রি।

আব্রাহাম আরও বিরক্ত হয়ে উঠল। হলরুমে উপস্থিত থাকা বাকিরা ওদের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এলিমিগ্রিন এসে ওদের দু’জনকে থামানোর চেষ্টা করল। সুযোগ বুঝে আব্রাহাম দ্রুতপায়ে হেঁটে হলরুমের বাইরে বেরিয়ে গেল।

স্টুয়ার্ড আর বেলাডোনার ঝগড়া থামানো গেল না। আরও প্রবল আকার ধারন করল। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে নিলসোন এগিয়ে এলো। স্টুয়ার্ডকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে হলরুমের অন্যপাশে নিয়ে গিয়ে বসল। এমিলিগ্রিন দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। যেন এই মুহূর্তে কোন বিশ্বযুদ্ধ থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সে। বেলাডোনা নিজের জায়গায় গিয়ে বসে। রাগে তার গাল দু’টো লাল হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকছে পড়ছে। মনে মনে স্টুয়ার্ডকে প্রচন্ড গা’লিগা’লাজ করে। অন্যদিকে স্টুয়ার্ড দাঁত বার করে হাসতে শুরু করে।

ঝড়ের বেগে নিজের কামরায় এসে উপস্থিত হলো আব্রাহাম। আইসবক্স খুলে রক্তের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে রক্ত পান করল। কাচের বোতলটা দরজার কাছে সজোরে ছুড়ে মারল। তার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। বিরক্তসূচক শব্দ করে উচ্চস্বরে বলল,

– এরকম কেনো হচ্ছে?

আব্রাহাম কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। দু’চোখের পাতা বুঝে নিল। অথচ নেত্রপল্লব বুজে নিতেই পুনরায় ইনায়ার নির্মল মুখশ্রী দেখতে পেল। জীবনে প্রথম তার সাথে এরকম অবাঞ্ছনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত কিসব ঘটছে। যতসব অপ্রত্যাশিত উপলব্ধি। আব্রাহাম বুঝতে পারল না এসবের কারণ কি? সাধারন এক মানবী কেনো তার সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে?

______★★_______

নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর সেভেরোদোনেৎস্ক। শহরটিতে ছড়িয়ে পড়েছে ভ্যাম্পায়ারদের আতংক। বড় বড় সব ইমারত থেকে শুরু করে ছোট ছোট বাড়িগুলোর সব দরজা জানালা বন্ধ। ভেতরে লন্ঠন জ্বলছে নাকি মানুষগুলো ঘুমিয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছিলো না। রাস্তাঘাট পুরোপুরি জনমানবশূন্য।

সেভেরোদোনেৎস্কের আনাচে-কানাচে অসংখ্য ভ্যাম্পায়ার সেনা পাঠিয়ে দিয়েছে এদুয়ার্দো। তার সুবিশাল সাম্রাজ্যের অগনিত ভ্যাম্পায়ার সৈন্য। সে নিজেও একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঝড়ের মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল। যদি কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

মাঝরাত। চারপাশ ভয়াবহ নিস্তব্ধ। সেভেরোদোনেৎস্কের কোনো এক রাজপথ। রাজপথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি দানবীয় গাছের প্রশস্ত ডালের উপর দু’পাশে দু’হাত রেখে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলো এদুয়ার্দো। নিকষকালো অন্ধকারে তার চোখ দু’টো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছিল। জ্বলজ্বলে চোখ আর প্রখর শ্রবণেন্দ্রিয় খাড়া রেখে সে অপেক্ষায় ছিল। ভয়াল রাতের কঠিন নীরবতা বিদীর্ণ করে হঠাৎই তার কানে ভেসে এলো কতগুলো পায়ের শব্দ। মানুষের নয়, পিচঢালা রাস্তায় ঘোড়ার পায়ে পরা নাল হতে সৃষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো এদুয়ার্দো।

এদুয়ার্দো নড়চড় বিহীন নিঃশব্দে বসে রইল। বৃহদাকৃতির একটি ফিটন তার দিকেই এগিয়ে আসছিল। এদুয়ার্দোর থমথমে গম্ভীর মুখাবয়বে পরম নিশ্চিন্তের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে অদূরে দৃষ্টি স্থির রেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হাসল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করল। দেখতে দেখতে ফিটন’টা তার কাছাকাছি চলে এলো। গাছ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল এদুয়ার্দো। ভারি ভারি পা ফেলে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। তীব্রগতিতে ছুটতে ছুটতে বিশালাকৃতির ফিটনটা তার সামনে এসে থেমে গেল। এদুয়ার্দোর নাকে একাধিক মানুষের ভিন্ন ভিন্ন শরীরের গন্ধ এসে লাগল। কোচওয়ানের আসনে বসে থাকা লোক দু’টাে ভীষণ ভয় পেল। ফিটনের গায়ে ঝুলে থাকা লন্ঠনটা হাতে নিয়ে একজন নেমে দাঁড়াল। ভীতস্বরে কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– কে?

এদুয়ার্দো চোখের পলকে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অকস্মাৎ একটা দমকা হাওয়ায় লোকটা দু’পা পিছিয়ে গেল। ফিটনে বসে থাকা অপরজন আতংকে কাঁপতে শুরু করল। এমন অদ্ভুত দেখতে কোনো মানুষকে আজই তারা জীবনে প্রথম দেখছে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকা ফিটনটা দুলে উঠল। এদুয়ার্দোর সন্দেহ হলো। সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– এর ভিতরে কি আছে?

– কিছুনা।___কাঁপা কাঁপা গলায় লোকটা উত্তর দিল।

ফিটনটা পুনরায় নড়েচড়ে উঠল। যেন ভিতরে কেউ আছে। এদুয়ার্দো লোকটার কথায় কর্ণপাত করল না। এগিয়ে গেল ফিটনের কাছে। লোকটা সহসা তার পথ আঁটকে দাঁড়াল। যেন আচম্বিতে লোকটার সমস্ত ভয় উবে গেল। রাগান্বিত কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করল,

– ফিটনে কি আছে সেটা জেনে তোমার কি দরকার? ভালো চাইলে সরে যাও সামনে থেকে। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

– ভালো চাইলে?____ভ্রু উঁচিয়ে বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল এদুয়ার্দো।

– ফিটনের ভেতরে কতগুলো মেয়ে আছে। এই ছেলেটা ভালো কথায় বুঝবে না। একে অন্যভাবে বোঝাতে হবে।____লোকটা মনে মনে ভাবল।

হঠাৎই সে নিজের পরিধেয় ফারকোটের পকেট হাতরে একটা ছোট আকারের ছুরি বের করে আনল। ছুরিটা এদুয়ার্দোর গলার কাছে উঁচিয়ে ধরে বলল,

– এখনই পালা এখান থেকে। নতুবা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবি না।

এদুয়ার্দো পাত্তা দিল না। সজোরে ফিটনের দরজা খুলে ফেলল। লোকটা প্রথমে ভড়কে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভীষণ রেগে গিয়ে এদুয়ার্দোকে পেছন থেকে আঘাত করে বসল। তার হাত ধরে ফেলল এদুয়ার্দো। ফিটনের মধ্যে ছ’জন মেয়েকে দেখতে পেল। যাদের হাত পা সহ মুখগুলোও বেঁধে রাখা ছিলো। ফিটনটা এমনভাবে বানানো হয়েছে যেটাতে বসার জন্য কোনো আসন নেই। মেয়েগুলো একে অপরের উপর গাদাগাদি হয়ে পড়ে ছিল। যেন হাত পা নাড়ানোর শক্তিটুকুও ওদের মাঝে অবশিষ্ট নেই।

নিমেষেই এদুয়ার্দোর চেহারা বদলে গেল। ভয়ংকর লাল চক্ষু নিয়ে সে পেছন ফিরে তাকাল। যেন তার দু’চোখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ভয়াবহ চমকাল। ছুরি দিয়ে আঘাত করতে যাওয়া হাতটা এখনো এদুয়ার্দোর কবলে। লোকটার কন্ঠনালী হতে কোনো কথা বেরুল না। আতংকে গলা শুকিয়ে গেছে। পালানোর পথ নেই। এদুয়ার্দো অন্যহাতে শক্ত করে লোকটার গলা চেপে ধরে।

অন্য লোকটা কোচওয়ানের আসনে বসে থাকায় এসবের কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। সে উচ্চস্বরে ডাকল,

– জেলেনস্কি!

জেলেনস্কি কোনো সাড়াশব্দ করল না। অগ্যতা লোকটা কোচওয়ানের আসন থেকে নেমে দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। ছেলেটা জলন্ত কয়লার ন্যায় জ্বলজ্বলে চোখে একহাতে জেলেনস্কির গলা চেপে ধরে আছে। লোকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পাথরের মূর্তির ন্যায় স্থির দাঁড়িয়ে রইল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য বোধ করল। যেন নড়চড় করার শক্তি টুকুও নেই। পালিয়ে যেতে ভুলে গেছে।

এদুয়ার্দোর মুখাবয়ব ভয়াবহ হিংস্র দেখাল। সে ক্রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– এই সবকিছুর পেছনে কে আছে? নাম বল।

– জানিনা। আমরা কিছু জানিনা।___জেলেনস্কি উত্তর দিলো।

এদুয়ার্দো আরও শক্ত করে জেলেনস্কির গলা চেপে ধরল। তার লাল টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। ভয়াবহ হিংস্র লাগছিল তাকে দেখতে। কোচওয়ানের আসনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দু’চোখের দৃষ্টিতে মূহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটল। হঠাৎই সে সম্বিত ফিরে পেল। উল্টো ঘুরে প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করল। এদুয়ার্দো লোকটাকে আঁটকাল না। জেলেনস্কিকে উদ্দেশ্য করে বজ্রধ্বনি তুলে বলল,

– র’ক্তচোষাদের ওভারলর্ড এদুয়ার্দো কখনো শিকারের পেছনে দৌড়ায় না। শিকার নিজে থেকেই তার সামনে এসে ধরা দেয়।

– আমি কিছু করিনি। আমাকে ছেড়ে দাও।

জেলেনস্কির প্রাণবায়ু নিভু নিভু হয়ে আসে। যেকোনো সময় সে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যেতে পারে। এদুয়ার্দো হিংস্র গর্জন তুলে জিজ্ঞেস করে,

– বাঁচতে চাইলে বল, এই মেয়েগুলোকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলি?

– কিয়েভের একটি ক্যাসলে।___ক্ষীণস্বরে উত্তর দিল জেলেনস্কি।

ক্রোধের মাঝেই বিস্মিত হল এদুয়ার্দো। সে যেই ভ্যাম্পায়ার চক্রটাকে খুঁজতে এসেছিলো, এই মেয়েগুলো কি সেই চক্রের সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত? নাকি এটা অন্য কোনো রহস্য? ক্ষণকাল ভাবল এদুয়ার্দো। অতঃপর ভাবনার ইতি টেনে জেলেনস্কিকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,

– ক্যাসলের নাম বল।

এদুয়ার্দো প্রশ্ন করতে না করতেই বিদ্যুৎ গতিতে জেলেনস্কির পিঠ বরাবর একটা তীরবিদ্ধ হল। সে করুণ কন্ঠে তীব্র আর্তনাদ করে উঠল। বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে এদুয়ার্দো জেলেনস্কির গলা ছেড়ে দিল। জেলেনস্কি পিচঢালা রাস্তায় মুখ থুবরে পড়ল।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য এদুয়ার্দো স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু যখন হুশ ফিরে পেল, তখন ঝড়ের গতিতে ছুটে গেল। যে দিক থেকে তীরটা ছুটে এসেছিলো সেদিকেই দৌড়াতে শুরু করল সে।

দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়ে এদুয়ার্দো। তার নজরে আসে, জেলেনস্কির সাথে থাকা অন্য লোকটাও রাস্তায় পড়ে আছে। এদুয়ার্দো ত্বরিত বসে পড়ে। বুঝতে পারে লোকটা মা’রা গেছে। যার ঘাড়ে স্পষ্ট দু’টো দাঁতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। যেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

এদুয়ার্দোর দেহের সমস্ত শিরা-উপশিরা আক্রোশের অনলে জ্বলতে শুরু করে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নেত্রচ্ছদ বুজে নেয়। যেন নিজের দুর্দমনীয় ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করছে।

_______★★_______

কাস্ত্রোরুজ থর্প।

প্রতিটা রাত ভয়াল আতংকে কাটে উইজার্ড পরিবারের। কখনো সম্পূর্ণ রাত জেগে কখনো বা আধো ঘুম আধো জাগরণে। ইনায়া সেদিনের পর থেকে সিয়াকে একা রাখে না। প্রত্যেকটা রাত সিয়ার পাশে থাকে।

ইনায়া ঠিক করে দু’জনে পালাক্রমে রাত জাগবে। মাঝরাত পর্যন্ত ও জেগে থাককে, সিয়া ঘুমাবে। তারপর সিয়া জেগে থাকবে, ইনায়া ঘুমাবে। কিন্তু সিয়া ইনায়ার সিদ্ধান্তে ঘোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,

– মাঝরাত পর্যন্ত আমি জেগে থাকবো, তুমি ঘুমাবে। তারপর তুমি জেগে থাকবে, আমি ঘুমাবো।

ইনায়া মেনে নিয়েছিল সিয়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু গতকাল রাতে সিয়া নিজের কথার বরখেলাপ করেছে। সম্পূর্ণ রাত একা জেগেছে ও। ইনায়াকে ডেকে দেয়নি একবারও। রাতে একমুহূর্তের জন্যও দু’চোখের পাতা এক করেনি সিয়া। এই নিয়ে অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে আছে ইনায়া।

সকাল বেলা। হঠাৎই ঘুম থেকে ত্বরিত জেগে উঠেছিল ইনায়া। টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে বসে ছিল সিয়া। কোনো একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। খাঁচার ভিতর কিচ দৌড়াদৌড়ি করছিল। ইনায়া চোখ বড় বড় করে সিয়ার দিকে তাকাল। কপট রাগমিশ্রিত কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করল,

– আমাকে ডেকে দাওনি কেনো?

– তোমার ঘুম ভাঙ্গাতে খারাপ লাগছিলো।___ম্লান কন্ঠে উত্তর দিল সিয়া।

– এভাবে কতদিন জেগে থাকবে? তারপর অসুস্থ হয়ে গেলে?

– হবো না অসুস্থ। দিনের বেলা ঘুমিয়ে নিবো।

ইনায়া পুনরায় একই প্রশ্ন করল,

– এভাবে কতদিন? আমার মনে হয়, ওরা আর আসবে না কখনো।

– না আসলে ভালো। কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকবে হবে।

ইনায়া আর কোনো প্রশ্ন করে না সিয়াকে। গাল ফুলিয়ে বিছানায় বসে থাকে। দরজা ঠেলে কামরায় প্রবেশ করেন ইলহামা অ্যালিয়েভ। তার হাতে খাবারের প্লেট। তিনি মলিন হেঁসে মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলেন,

– পাস্কা আর প্যামপুস্কি বানিয়েছি। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও দু’জনে।

ইনায়া বিছানা ছেড়ে নেমে দাড়াল। দ্রুতপায়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে গেল। টি-টেবিলে খাবারগুলো রেখে ইলহামা বিছনার উপর বসলেন। সিয়া বই বন্ধ করে টেবিলের একপাশে গুছিয়ে রেখে তার মায়ের দিকে তাকাল। অকপটে জিজ্ঞেস করল,

– বাবা কোথায়?

– মাঠে গেছেন।

সিয়া দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করল না। ইলহামা ব্যথাতুর দৃষ্টিতে সিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

– আজ রাতেও ঘুমাওনি, তাইনা?

সিয়া উত্তর দিল না। বরং প্রসঙ্গ পাল্টাতে জিজ্ঞেস করল,

– বাবা আবার কবে থেকে আমাদের প্রশিক্ষণ দিবেন? আমার মনে হয় আগামীকাল থেকে শুরু করলে ভালো হবে।

ইলহামা অ্যালিয়েভের দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় মুষড়ে উঠে। তিনি সিয়ার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার ঘুম কাতুরে মেয়েটা এখন প্রতিরাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়। চোখের নিচে পুরু কালো দাগ যার জলজ্যান্ত প্রমাণ। পুতুলের মতো দেখতে চোখ ধাঁধানো সুন্দর মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না এখন। মলিন হয়ে গেছে তার সমস্ত সৌন্দর্য। বেঁচে থেকেও যেন নিষ্প্রাণ।

– আপনি কাঁদছেন কেনো মা?

সিয়ার প্রশ্নে ভাবনার ছেদ ঘটল ইলহামার। তিনি আঙ্গুলের ডগা দিয়ে দু’গালের অশ্রু মুছে নিলেন। সিয়া অকপটে জিজ্ঞেস করল,

– আমার চুলগুলো এতো অস্বাভাবিকভাবে বড় হয় কেনো মা?

এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই ইলহামার। ছোট থেকেই সিয়ার চুলগুলো অতিদ্রুত বেড়ে উঠত। যা মোটেই স্বাভাবিক মনে হয়নি কারো। বড় চুল সিয়ার পছন্দ ছিলো না বিধায় সে সবসময়ই চুল কেটে কাঁধ পর্যন্ত করে ফেলতো। এ নিয়েও মেয়েকে কম বকা ঝকা করেননি ইলহামা।

ভাবতেই ইলহামা অ্যালিয়েভের চোখ থেকে পুনরায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সিয়ার সামনে বসে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। তিনি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠস্বরে বললেন,

– খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তুমি খাওয়া শুরু করো। ইনায়া এসে পড়বে এখুনি। আমি যাই। আমার অনেক কাজ আছে।

ইলহামা অ্যালিয়েভ তড়িঘড়ি করে কামরা থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। সিয়া স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওর মনে হলো ইলহামা কিছু একটা লুকিয়ে গেলেন ওর কাছ থেকে। কিন্তু এ ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামাল না সিয়া। ইলহামা চলে যেতেই আবারও বই খুলে নিয়ে বসল। টি-টেবিল থেকে পাস্কা আর প্যামপুষ্কির সুঘ্রাণ ভেসে আসছিলো। সিয়া সেদিক থেকে মন সরিয়ে বই পড়ায় মনোযোগ দিলো।

______★★______

ধীরে ধীরে সময় গড়াল। ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। সিয়াদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো আর্নি আর ক্রিস্তিয়ান। উরসুলা ভনডারলেন বারান্দায় বসে ছিলেন। আর্নিকে দেখে তিনি কপাল কুঁচকে ফেললেন। তার মুখাবয়বে প্রচন্ড বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেল। উরসুলা মনে করেন, সবকিছুর জন্য আর্নি দায়ী। ও যদি সেদিন সিয়াকে নিয়ে বেলাভূমিতে না যেতো তাহলে রক্তচোষা’টা কোনোভাবেই নিজের উদ্দেশ্য পূরনে সফল হতো না।

– আপনার শরীর ভালো আছে দাদিন?____বিষন্ন বদনে জিজ্ঞেস করল আর্নি।

উরসুলা উত্তর দিলেন না। তার মুখখানা বেশ গম্ভীর দেখাল। সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নামছিলেন ইলহামা অ্যালিয়েভ। আর্নির কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তিনি দ্রুতপায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ হেসে বললেন,

– তোমরা কখন এলে?

– এইতো এখুনি।____ছোট আওয়াজে উত্তর দিল ক্রিস্তিয়ান।

– সিয়া আর ইনায়া দু’জনেই সিয়ার কামরায় আছে। যাও।

ক্রিস্তিয়ান আর আর্নি দোতলার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিতেই পেছন থেকে ইলহামার কন্ঠস্বর শুনতে পেল,

– শুনো।

ইলহামার বলা কথায় দু’জনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ইলহামা অ্যালিয়েভ তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অতি দূর্বল কন্ঠে বললেন,

– আজ সময় করে সবাই একবার সিয়াকে নিয়ে ঘুরতে যেও। দূরে না। এই আশে পাশেই কোথাও। সারাক্ষণ বদ্ধ কামরায় থেকে মেয়েটা দিন দিন যন্ত্রমানবীতে রুপান্তরিত হচ্ছে। আমি মা হয়ে ওর এই পরিবর্তন সহ্য করতে পারছি না। আমার তৃষ্ণার্ত দু’চোখ পুনরায় ওকে স্বাভাবিক দেখতে চায়। ভাবছি, বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেলে সিয়ার মন ভালো হবে হয়তো।

এতটুকু বলে থামলেন ইলহামা অ্যালিয়েভ। অতঃপর ক্রিস্তিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– সিয়াকে শুধুমাত্র তোমার ভরসায় ছেড়ে দিচ্ছি। সাথে ইনায়াও থাকবে। তোমরা দু’জন ওর সাথে থাকলে ওকে নিয়ে আমার কেনো দুশ্চিন্তা থাকবে না।

– জ্বি। আমি আপনার ভরসা অক্ষুণ্ণ রাখবো।____আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে কথাটা বলল ক্রিস্তিয়ান কুরী।

– যাও এবার।

ইলহামা নিজের কথা শেষ করে উরসুলার পাশে গিয়ে বসলেন। ক্রিস্তিয়ান আর আর্নি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। দ্রুতপায়ে হেঁটে সিয়ার কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যেহেতু ক্রিস্তিয়ান আছে সাথে, আর্নি তাই দরজায় করাঘাত করল। ইনায়া উচ্চস্বরে বলল,

– দরজা খোলাই আছে। ভেতরে এসো।

দরজার অপাশ থেকে আর্নির কন্ঠস্বর শোনা গেল,

– আমি আর্নি। সাথে ক্রিস্তিয়ান ভাই আছে।

– সমস্যা নেই। এসো।

আর্নি দরজা ঠেলে কামরায় প্রবেশ করল। পেছন পেছন ক্রিস্তিয়ান। কামরায় প্রবেশ করে দু’জনেই বেশ আশ্চর্য হল। সিয়া মেঝেতে বসে থেকে কতগুলো রসুনের মালা গাঁথছে। পাশেই রাখা আছে লম্বাকৃতির কতগুলো কাঠের গজাল। রসুনের মালা বানানো শেষ করে সিয়া আর্নির দিকে তাকাল। তখনো ক্রিস্তিয়ান আর আর্নির দৃষ্টি ওর দিকেই স্থির ছিলো। সিয়া দু’বার দু’চোখের পলক ফেলল। আর্নি বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– এতোগুলো মালা দিয়ে কি হবে?

– আমার মনে হয় ওরা আজ রাতে আবারও আসবে।

– কারা?_____শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ক্রিস্তিয়ান।

– এক বা একাধিক র’ক্তচোষা পি’শাচ।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।