এক ঝাঁক উত্তপ্ত রোদ জানলা গলে ঠিকড়ে পরছে ফ্লোরে। মারবেল মেঝের জৌলুশ দ্বিগুন বেড়েছে এতে। সাদিফ ছটফটে পায়ে ঘরে ঢুকল। কপালে সূক্ষ্ম ঘামের নহর। তেমন ছটফটিয়েই ফোন তুলল হাতে। সেকেন্ডে ডায়াল হলো ‘ম্যালেরিয়া’ নামে সেভ করা নম্বরটি।
বুকের ভেতর উত্তেজনায় কেমন করছে ওর। ওষ্ঠপুটের চতুর্দিকে ঝলকে উঠছে প্রোজ্জ্বল হাসি। খবরটা শুনলে মারিয়া খুশি হবে! কিন্তু কতটা হবে সেটুকু জানেনা। হয়ত বসা থেকে লাফিয়ে উঠবে আনন্দে!
সাদিফ একা একা হাসল। ওই মুহুর্তে মারিয়ার উচ্ছ্বল, দীপ্ত মুখখানি ভেবে সেই হাসি দ্বিগুন হলো।
কানে গোঁজা ফোন তখন রিং হচ্ছে সমানে।
কিন্তু অনেকক্ষন হলেও ধরল না মারিয়া। সাদিফ আবার ডায়াল করল। গুনে গুনে তিনবার কল দিলো সে৷ না,ধরছে না তো! কখনও তো এমন হয়নি। আজ অবধি মারিয়াকে তার একবারের বেশি কল দিতে হয়েছে কী না সন্দেহ! মেয়েটাতো খুব দ্রুত রিসিভ করে সব সময়। আজ কী হল?
এবার হাসি কমে চিন্তা বিঁধল মনে। নেতিবাচক ভাবনা নাড়া দিল মস্তকে।
ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ স্ক্রিন জ্বলে উঠল। মারিয়া কল ব্যাক করেছে। এতক্ষণ অনুচিন্তনে ছেঁয়ে যাওয়া মুখমণ্ডল ঝিলিক দিয়ে উঠল মুহুর্তেই। ধরফর করে রিসিভ করল সাদিফ। তেমন ব্যস্ত ভাবে বলল,
‘ কী ব্যাপার, ফোন ধরছিলেন না কেন?’
ভেসে এলো ঘুমুঘুমু স্বর,
‘ উম,ঘুমোচ্ছিলাম।’
সাদিফের কপালের রেখা মুছে গেল ওমনি। একবার পূর্ন দৃষ্টিতে স্ক্রিনে দেখে নিলো। প্রশ্ন জাগল মনে, সব মেয়েদের তন্দ্রাচ্ছন্ন আওয়াজ কি এত সুন্দর হয়? না কী মারিয়ারটাই সুন্দর? পিউয়ের নিদ্রিত কণ্ঠটাও এমন ভালো লাগতো ওর৷ তাহলে কী ধরে নেবে,মেয়েদের কণ্ঠ মানেই শ্রুতিমধুর?
পরমুহূর্তে আপত্তি জানাল সে। ভাবল, ‘ কই,কখনও পুষ্পর গলার স্বর এত ভালো লাগেনি। তাহলে?’
তার ধ্যান ভা*ঙে মারিয়ার জিজ্ঞাসায়। হালকা সেই স্বর,’ হঠাৎ সকাল সকাল স্মরণ? ‘
সাদিফ হাসল। বলল, ‘ বলছি। আগে শুনি,এত বেলা করে ঘুমোনোর কারণ কী? ছুটি উশুল করছেন?’
‘ না না, আসলে আমার এক্সাম রুটিন দিয়েছে। কাল রাত জেগে পড়েছি… ওইজন্যে আজ আর চোখ খুলতে পারছিনা।’
‘ ওহ। কবে শুরু? ‘
‘ এক তারিখ থেকে। আমি কাজের চাপে কিছুই পড়তে পারিনি। হাতে সময় এত কম,কী যে করব!’
‘ এত প্রেশার নেবেন না। যা হয়, হবে। বেশি চিন্তা করলে কিন্তু চোখের নীচে কালি পরে যাবে।’
মারিয়া শুয়ে থেকেই ভ্রু গোঁটাল।
‘ আমাকে নিয়ে দেখছি আপনার অনেক চিন্তা!’
সাদিফ বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হলো না। উলটে সোজাসুজি জবাব দিল,
‘ কাছের মানুষকে নিয়ে চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক না?’
মারিয়া থমকায়। জানে,সাদিফ কথাটা এমনি বলেছে। যেমনটা সব সময় বলে বসে।
কিন্তু এইটুকু কথাই যে তার কাছে বিরাট কিছু। এই যে বক্ষে ওঠা তোলপাড়, এর ভার কে নেবে? উনি তো জানবেনও না,ফোনের এপাশে থাকা মেয়েটি প্রতিটা প্রহর বিভোর যার চেতনায়, তার সামান্য একটু ইঙ্গিত মস্তিষ্কের নিউরন কাঁ*পাতে সক্ষম।
‘ ওসব ছাড়ুন,যে জন্যে ফোন করেছিলাম সেটা শুববেন না?’
মারিয়া ধাতস্থ হয়ে মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ, বলুন।’
সাদিফ জানাল,
‘ আগামী শুক্রবার ধূসর ভাই আর পিউয়ের বিয়ে। আজকেই ঠিকঠাক হলো সব।’
উদ্ভাসিত তার কণ্ঠস্বর। আনন্দ ছটা চুইয়ে পরল প্রতিটি বাক্যে।
অথচ চেহারার পরতে পরতে আমাবস্যা ঘনাল মারিয়ার। শত শত মাইল দূরে থেকেই, যেন পেয়ে গেল সাদিফের মন খারাপের খোঁজ। পিউয়ের বিয়ে ঠিক হওয়া,সমস্ত দুনিয়ার নিকট আনন্দ সংবাদ হলেও,এই মানুষটির কাছে তা বিরহ। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার বেদনা। এক তরফা ভালোবেসে বিফল হওয়ার ইঙ্গিত। মারিয়া জানে,বোঝে, সাদিফ যতই চেষ্টা করুক,যতই তাকে বোঝাক সে ভালো আছে, সব মেনে নিয়েছে,কিন্তু ভেতরের ক*ষ্টটা কী অক্ষ*ত রয়ে যায়নি? তার হৃদয়পটের কোণ ঘেঁষে, বয়ে চলা হাহা*কারের প্রবাহ কি লাঘব হতে পেরেছে? এত সহজ বুঝি সব?
সাদিফের বিষণ্ণতা অনুভব করেই বুক দুমড়ে-মুচ*ড়ে ওঠে ওর। চোখ বুজলে কার্নিশে এসে ভিড় করে জল। সে নিজে যে পথের যাত্রী,যে দুঃখ নায়ের মাঝি,সেই একই ক*ষ্ট ভালোবাসার মানুষটা কেন পাবে? স্নেহের পিউ আর শ্রদ্ধার ধূসর ভাইয়ের এক হওয়ার হৃষ্টতায় মারিয়া হাসতে পারল না। উলটে বিষিয়ে উঠল মন। না জানি সাদিফের কত খারাপ লাগছে এখন! চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষের বিয়ে,সংসার! কী করে সহ্য করবেন উনি ?
মারিয়ার নিজের ভাগ্যের প্রতি শুকরিয়া হলো। ভাগ্যিশ সে দূরে আছে। দূরে থাকবে। পিউ যতটা কাছাকাছি থাকে ওনার, অতটা কাছ থেকে বিচ্ছেদ সওয়ার ক্ষমতা ওর নেই। যে পারে সে কী মানুষ? না কি ঈশ্বর প্রদত্ত বিশেষ গুণের অধিকারী!
মারিয়ার নিস্তব্ধতায় সাদিফ ভ্রু গোছায়। একবার সতর্ক ভাবে দেখে নেয় লাইন কে*টে গিয়েছে কী না! না,তাহলে মেয়েটা চুপ করে কেন? সে নিশ্চিত হতে বলল
‘ ম্যালেরিয়া! আপনি কী আমার কথা শুনতে পেয়েছেন?’
মারিয়া বেদনার্ত ঢোক গিল*ল। কার্নিশে সদ্য জমা হীরকচূর্ণ আঙুলে মুছে চেষ্টা করল হাসার।
‘ হ্যাঁ শুনলাম তো। ভালো খবর!’
সাদিফ মুচকি হেসে বলল, ‘ ভালো খবর হলে আপনার গলার স্বর পাল্টাল কেন? কেন আপনি খুশি হতে পারেননি?’
মারিয়া বলতে গেল, ‘ ককই,হয়েছি….’
সাদিফের হাসিটা এবার ঠোঁট ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। ঝনঝন শব্দ তুলে বারি খেল মারিয়ার শ্রুতিপথের চারপাশে। এতেই বিষাদ টুকু প্রগাঢ় হলো মেয়েটার। গোটা আকাশ দলে-মথে কা*ন্না এসে দলা পাকাল গলায়।
সেই সময়,
সাদিফ আচ্ছ্বন্নের মত ডাকল, ‘ ম্যালেরিয়া!’
মারিয়া চেপে ধরে নীচের ঠোঁট। বুকের ভেতর কিছু একটা ভে*ঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়। ছোট করে, বোজা গলায় উত্তর দেয়, ‘ হু?’
‘ আপনি ভাবছেন,পিউয়ের বিয়ে হবে শুনে আমার ক*ষ্ট হচ্ছে?’
কিছুটা চমকালো সে। সাদিফের বুঝে নেওয়ার পারদর্শীতায় অবাক হলো।
সাদিফ নিজেই বলল,
‘ বিশ্বাস করবেন কী না জানিনা,আমার একটুও ক*ষ্ট হচ্ছেনা। আমি আগেও জানতাম,আজ তো আরো ভালো করে জানি,পিউয়ের জন্যে আমি নই, ভাইয়াই পার্ফেক্ট! আর এই সত্যি জানার পরেও কেন খারাপ লাগবে বলুন?
তাছাড়া পিউ আমার বড় ভাবি হচ্ছে, তাকে মনের কিঞ্চিৎ জায়গায় রেখেও পাপ বাড়াতে চাইনা।
মারিয়া আ*হত স্বরে বলল, ‘ ওসব আপনি নিজেকে ভালো রাখতে বলছেন। আপনার ভেতরটা তো ঠিকই দগ্ধ হচ্ছে, তাইনা?’
সাদিফ অবাক হয়ে বলল,
‘ কেন? আপনি কি বোকা? ভালোবাসলে তাকে পাওয়ার যে সুখ,ভালোবাসার মানুষ কে ভালো থাকতে দেখার সুখ তার চেয়ে অনেক বেশি। আমি কেন সেই সুখটুকু মিস করব?
তারপর বুকে হাত রাখল সে। বলল,
‘ এই যে বুকে হাত রেখে বলছি,আমার একটুও খারাপ লাগছেনা। তাহলে অহেতুক কেন কষ্ট পাচ্ছেন? কাঁদ*ছেন কেন আপনি? ‘
মারিয়া হতবিহ্বল হয়। সে তো শব্দ করে কাঁদেনি। উনি কী করে বুঝলেন তবে? মিথ্যে বলতে চাইল,
‘ কই,কাঁ*দব কেন?’
বাধ সাধল সাদিফ। স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ এতদিনে এটুকু আপনাকে চিনেছি ম্যালেরিয়া। এখন আমার কাছে মিথ্যে বললে, ধরা পরার ঝুঁকি আছে। আজকাল আপনার ভেতরটাও পড়তে পারছি যে।
মারিয়া একপেশে হাসল। উদাস মনে ভাবল,
‘ সত্যিই যদি আমার ভেতরটা পড়তে পারতেন,কবেই ভালোবেসে আপনার কাছে ধরা পরতাম সাদিফ৷ ‘
সাদিফ প্রসঙ্গ পালটে বলল,
‘ আচ্ছা সব কিছু ছাড়ুন তো এবার। বিয়ের মাত্র সাত দিন বাকী! বাড়ি থেকে যদিও বলা হবে,তাও আমি বলছি, আপনি কিন্তু আসবেন। ‘
মারিয়া চোখ মুছে বলল,
‘ সেতো আসবই। ধূসর ভাইয়ার বিয়ে আমি না এসে পারি?’
‘ গুড! আমার একটা উপহার দিতে ইচ্ছে করছে ওদের। কী দেয়া যায় বলুন তো! ‘
সাদিফের উত্থাপনের কারণ মারিয়াকে সহজ করা। হলোও তাই। সে আগ্রহভরে জানতে চাইল,
‘ বর-কনে দুজনকেই দেবেন? না কী একজন?’
‘ অভিয়েস্লি দুজন। আই মিন কাপল আইটেম কিছু। ‘
‘ তাহলে শপে গিয়ে দেখলে ভালো হবে। ‘
সাদিফ থুত্নী ঘষে ভাবুক স্বরে বলল,
‘ শপে যাব? তাহলে বরং আপনিও আমার সাথে চলুন।’
মারিয়া বিস্মিত হয়ে বলে,’ আমি?’
‘ তা নয়ত কে? আমি এসব বুঝিনা। গতবার পিউয়ের জন্য আংটি নিয়েছিলাম,ভাগ্যিশ দেইনি। ওটা দেখলে প্রেম আরো হোতো না।’
সাদিফ ঝরঝরে হাসল। মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আচ্ছা যাব।’
‘ আচ্ছা যাব কী? আজই যাব। ‘
সে চোখ বড় করে বলল ‘আজই?’
‘ ইয়াপ। আপনি ফ্রেশ হয়ে বের হন,আমি আসছি।’
বলেই ফট করে লাইন কেটে দিলো। মারিয়া হু-হা করার সুযোগ টুকুও পেলোনা।
****
পিউ দরজা চাপালো কোমল হাতে। ঘন ঘন প্রঃশ্বাস বক্ষপটে বহাল তখনও। ঠোঁটের চারপাশের
মিষ্টি,ললিত হাসিটুকুন দীর্ঘ হলো হঠাৎ। কাঁ*পতে থাকা পাঁচটা আঙুল এসে ছুঁয়ে দিলো বুকের বা দিক। মানস্পটে হানা দিচ্ছে একটু আগের সকল জীবন্ত দৃশ্যগুলি।
পিউ আনমনা হয়। তিন বছর আগে,সেই প্রথম ধূসরের সাক্ষাৎ পাওয়ার দৃশ্যটুকু মনে পড়ে। একটা তামাটে চেহারা,বলিষ্ঠ শরীর,খাদহীন নেত্রযূগল আর শক্ত চিবুকের প্রেমে পড়েছিল সে। ধীরে ধীরে সেই প্রেম প্রকট হলো। বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকা হৃদযন্ত্র বার্তা দিলো, এটা প্রেম নয়,এ ভালোবাসা পিউ। প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট,প্রতিটি ঘন্টা কাটত সে মানুষের অপেক্ষায়। তখনও কি ভেবেছিল,উনিও ভালোবাসবেন এভাবে? প্রতীক্ষার প্রকোপে, তাকে পাওয়ার ব্যস্ততায় নিরাশ মন যখন শ্রান্ত হয়ে উঠছিল,ঠিক তখনই এক পশলা বর্ষা হয়ে নেমে এলেন ধূসর ভাই। সুর মেলালেন ওর প্রণয় গীতে। স্বচ্ছ স্বপ্নময়ী হয়ে ধরা দিলেন দু’হাতে।
এই ক্ষুদ্র জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখলে ,সেই উপন্যাসের অদ্ভূত চরিত্রে জায়গা পাবেন ধূসর ভাই। পিউ আকুল হয়ে ভাবে,এতটা ভালোবেসেও কীভাবে চেপে রেখেছিলেন উনি? কীভাবে তার চোখে-চোখ না রেখে থেকেছেন? চোখের সামনে ওকে দেখেও নির্লিপ্ত রয়েছিলেন? যেন ভালোবাসা কী জানেইনা। তীব্র ভালোবাসার দহন যেভাবে তাকে পুড়ি*য়েছিল,ওনাকে পো*ড়ায়নি?
ধূসরের বলা প্রত্যেকটা কথা,প্রতিটা শব্দ মাথার ভেতর ঝমঝমিয়ে ওঠে ওর। বুকের মধ্যে ওকে আগলে নিয়ে,বাবার দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করা সেই বানী মনে করে আড়ষ্ট হয় অনুভূতিতে।
‘ পিউ আমার। আমারই থাকবে। আপনার কেন,সৃষ্টি কর্তা না চাইলে কারোর সাধ্য নেই ধূসরের থেকে তার ভালোবাসা কেড়ে নেওয়ার।’
পিউ ভীষণ লম্বা শ্বাস নিলো। প্রশান্তির ঠান্ডা এক দমকা হাওয়ায় জুড়িয়ে গেল শরীর।
ভাবাবেশে চোখ বুজে মাথা এলালো দরজার পৃষ্ঠে।
সহসা লাল হলো গালদুটো। আজ শুক্রবার। ঠিক সাত দিন পর এই দিনেই ওদের বিয়ে। তারপর, একটা সংসার,ছোট ছোট ছেলে মেয়ে!
পিউ রাঙা হয়ে ওঠে কুণ্ঠায়। হেসে ফ্যালে ফিক করে। ভীষণ খুশিতে দুহাতে ওড়না তুলে চক্কর কা*টে পুরো কামড়ায়। যেন খোলা আকাশে উড়তে না জানা ডানা মেলা পাখি। তার দোলাচল হৃদয়ের সঙ্গে, ফ্যানের বাতাসে দুলে ওঠে ওড়না,কপালের অবহেলিত ছোট ছোট চুল।
সে থামল। চিত্তচাঞ্চিল্যে হাত পা নাঁচিয়ে গান ধরল,
‘ হামারি সাদি মে,আভি বাকী হ্যায় হাপ্তে চার।
চারশ বারাস লাগে,এ হাপ্তে ক্যায়সে হোঙ্গে পার?
নেহি কার সাখতা ম্যায়, অর ইক দিন ভি ইন্তেজার।
আজ হি প্যাহনা দে, তেরি গোরে বাহোকা হার।
ও সাজান হো…. ও বালাম হো…… ”
তার নাঁচ-গানের মধ্যেই বিকট শব্দে বেজে উঠল ফোন। পিউ থেমে,এগিয়ে যায়। স্ক্রিনে তানহা লেখা দেখে দ্রুত বিছানায় পা গুছিয়ে বসে। রিসিভ করে খুশির খবর দেয়ার জন্য হা করল,আগেই তানহা হুতাশ করে বলল,
‘ ওরে পিউ,পিউ দেখেছিস কী হয়েছে?’
পিউ হা টুকু বুজে নেয়। কপাল কুঁচকে শুধায়,
‘ কী হয়েছে?’
তানহা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
‘ তুই এখনও দেখিসনি? ‘
‘ কী দেখব?’
‘ তাইতো বলি,তুই এত শান্ত কী করে! ধূসর ভাই কাল একটা ছবি আপলোড দিয়েছেন না টাইমলাইনে? সেখানে এক মেয়ে কী লিখেছে দ্যাখ। ‘
পিউ আর কিছু শুনল না। প্রয়োজনবোধ করল না এক কথায়। এটুকুতেই তার ঈর্ষান্বিত মন ফোসফোস করে উঠল। ত্রস্ত লাইন কে*টে ঢুকল ফেসবুকে,তারপর ধূসরের আইডিতে।
গত রাতে ইকবাল সহ একটা ছবি পোস্ট করেছিল ধূসর। পিউ আগেই দেখেছে। লাভ রিয়াক্টও ভাসছে ওর। তানহার কথা মতো দ্রুত হাতে কমেন্ট দেখা শুরু করল সে। যেহেতু ধূসর এই জেলার ছাত্রলীগের সভাপতি, তার একটা পোস্টে অহরহ লাইক,কমেন্ট স্বাভাবিক।
‘প্রিয় ভাই,প্রাণের ভাই’ লিখে ভরিয়ে ফেলেছে একেকজন। মেয়েদের কমেন্ট হাতে গোনা। পিউ ঘেটেঘুটে, অনেকক্ষন পর, থামল। এক মেয়ের কমেন্টে চোখ পৌঁছাল তার।
লিখেছে…
‘ কালো শার্ট পড়ে আপনাকে আমার কল্পনার থেকেও সুন্দর লাগে! আপনি এত ড্যাশিং কেন বলুন তো? ছেলেদের এত হ্যান্ডসাম হতে নেই।’
পিউয়ের ব্রক্ষ্মতালু অবধি দাউদাউ করে জ্ব*লে উঠল রাগে৷ এত বড় সাহস এই মেয়ের? এত সাহস! তার ধূসর ভাইকে না কি কল্পনায় দ্যাখে? কে এই মেয়ে? পিউ তৎপর আইডিতে ঢুকল। লক করা বিধায় দেখা গেল না কিছু। ক্ষোভ ঝাড়তে চট করে অহেতুক রিপোর্ট দিলো সেখানে।
ধূসর ভাই কেন মেয়েটিকে কিছু বললেন না? কেন একটা কড়া ধ*মক দিলেন না? পান থেকে চুন খসলে ওকে তো ঠিকই ধম*কায়,চোখ পাঁকায়।
তার গায়ের রক্ত ফুট*ছে। পরিষ্কার টের পাচ্ছে খাঁ খাঁ আগু*নে ঝলসে যাচ্ছে সব।
নাকটা ফুঁস*ছে তেজে। কী করলে রা*গ কমবে?
এলোমেলো পাতা ফেলে, অগোছালো মস্তিষ্কে হুট করে এক ভাবনার উদয় ঘটল। যেই ভাবনা মারাত্মক পছন্দ হলো পিউয়ের। কাজটা করলে আর কেউ ধূসর ভাইকে মেসেজ তো দূর,ধারেও ঘিষবেনা।
পিউয়ের মেজাজ তখন থমথমে । মাথায় কঠিন জেদ। মনের ভেতর অবুঝ বাচ্চামো। একান্ত মানুষটাকে পৃথিবী থেকে লুকিয়ে হৃদপিন্ডের নিষিদ্ধ কোনও অলিন্দে ঢুকিয়ে রাখার ইচ্ছে। সমস্ত রক্তকণাও তার জেদের সাথে তাল মেলাল। ভাবনাচিন্তা ছাড়াই হুট করে ধূসরকে ট্যাগ করে
‘ Got engaged ‘ পোস্ট দিয়ে ফেলল সে। ক্যাপশনে আবার ‘আলহামদুলিল্লাহ অবশেষে!’ লিখে দিয়েছে। পুরোটা করল দাঁত পি*ষে পি*ষে। বিড়বিড় করে বলল,’ এইবার সব মেয়েরা দেখবে আর জ্ব*লবে। লুচির মত ফুলবে।’
পিউয়ের মন শান্ত হয়। মেজাজটাও ক্ষান্ত। পৃথিবী জেতার মত আনন্দ হলো যেন। সব গোল্লায় যাক, মেয়েরা আর কমেন্ট করবেনা এতেই শান্তি।
*****
এক হাতে নাকে আঁচল চেপে আরেক হাতে মিনি ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকল পুষ্প। ইকবাল তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। সামনে থেকে ধোঁয়া ছুটছে সমানে। পুষ্প দেখেই খেকিয়ে উঠল,
‘ এই তুমি কী করছো?’
চমকে উঠল ইকবাল। জ্বিভ কে*টে, সদ্য জ্বা*লানো সিগারেটটা স্ত্রীর ভ*য়ে ফেলে দিলো নীচে। এপাশে ফিরল হাসি হাসি চেহারায়। মাথা নেড়ে বলল,
‘ কই কিছু না। ‘
পুষ্প নাক ফুলিয়ে বলল, ‘ তুমি সিগারেট খাচ্ছিলে না?’
ইকবাল আকাশ থেকে পরার ভাণ করে বলল,
‘ আমি? না তো। কী যে বলো মাই লাভ,আমি কেন সিগারেট খাব? তুমি মানা করার পর তো ছুঁইওনা।’
পুষ্প অবাক হলো। সে স্পষ্ট দেখেছে ধোঁয়া উড়তে। অথচ এই লোক কি মিথ্যেটাই না বলছে! কটমট করে বলল,
‘ তাই না কি? আচ্ছা ঠিক আছে। কাছে এসো। ‘
ইকবালের মনে চোরের ঘন্টা ঢংঢং করে লাফিয়ে ওঠে । কাছে গেলেইত সর্বনা*শ! গন্ধ পাবে নিশ্চিত।
‘ কী হলো? এসো।’
সে মাথা নেড়ে বলল, ‘ না। যাব না।’
‘ কেন? এমনি সময় তো কাছে আসার জন্যে মুখিয়ে থাকো। এখন আসবেনা কেন?’
ইকবাল আমতা-আমতা করল কিয়ৎক্ষণ। যুতসই উত্তর না পেয়ে,
কাঁধ উচিয়ে বলল,’ এখন মুড নেই।’
পুষ্প ক্ষে*পে গেল আরো। এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর ট্রে রাখল শব্দ করে।
‘ মুড না কী, মজা বোঝাব পরে। আগে এটা খেয়ে উদ্ধার করো আমায়।’
ইকবাল বাটি দেখে স্ফূর্ত স্বরে বলল, ‘ আরে হালিম! ওয়াও।’
পুষ্প বের হতে নিলে শুধাল,’ কোথায় যাচ্ছো? তুমি খাবেনা?’
‘ দেখছো না নাক চেপে আছি? মাংসের গন্ধ নিলেও গা গোলাচ্ছে আমার।’
‘ তাহলে কী খাবে?’
পুষ্প খানিক মন খারাপ করে বলল,
‘ সেটাইত। পেটে খিদে আছে,অথচ খেতে পারছিনা। কী যে খাই!’
ইকবাল দুষ্টুমি করে বলল, ‘ আমাকে খেতে পারো মাই লাভ।’
পুষ্প নাক চোখ কুঁচকে চাইলে চোখ টিপল সে। পুষ্প মাথা নাঁচিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা,আস্ত তোমাকে তো আর খেতে পারব না। রান্নাঘর থেকে বটি টা নিয়ে আসছি।’
ইঙ্গিত বুঝে ইকবাল চোখ কপালে এনে বলল,
‘ মাই লাভ,তুমি আমায় কে*টে ফেলবে? ফি-মেইল রাফসান হক! এত ভালোবাসার এই প্রতিদান! ‘
পুষ্প ভেঙচি কা*টল। বেরিয়ে যেতে যেতে ফিরে চেয়ে বলল ,
‘ ওহ হ্যাঁ,আর যদি সিগারেট খেতে দেখি ইকবাল,তোমার একদিন কী আমার একদিন।’
চোটপাট দেখিয়ে চলে গেল সে। ইকবাল মুখ কালো করে নিরাশ শ্বাস নিলো। এতদিনের অভ্যেস কি রাতারাতি ছাড়া যায়? মাই লাভটা বোঝেনা ওসব। তার প্রিয় সিগারেটের সঙ্গে সতীনের মত আচরণ করে।
সে ঘরে এলো বারান্দা ছেড়ে। একবার তাকাল বাটি ভর্তি ধোঁয়া ওঠা হালিমের দিকে।
যেতে নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল। নাহ,খাবেনা। মাই লাভও তো হালিম ভালোবাসে, অথচ এখন গন্ধ নিতে পারছেনা বলে খেতে পারবেনা। তাহলে সে কী করে খাবে? মা হতে গেলে যদি এত সেক্রিফাইস করতে হয়, সে বাবা হয়ে কিছু করবেনা? ইকবাল এসে ট্রে উপুড় করে ঢেকে রাখল বাটি।
**
দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। পিউ থমথমে কণ্ঠে জবাব দিল,
‘ খোলা আছে।’
উঁকি দিলো ইকবাল। হাসি হাসি কণ্ঠে ডাকল, ‘পিউপিউ! আসব?’
পিউ ফিরে তাকায়। হেসে বলে ‘ আসুন না।’
ইকবাল ঢুকতে ঢুকতে কপাল কুঁচকে বলল,
‘ আরে তুমি চুপচাপ বসে আছো কেন? তোমার তো এখন নাঁচানাঁচি করার কথা। এ্যাট লাস্ট ধূরের বউ হতে যাচ্ছো।’
পিউ ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। সে তো নাঁচছিল হাত পা তুলে। কিন্তু ধূসর ভাই পরোক্ষ ভাবে হলেও সেই নাঁচে রেস্ট্রিক*টেড সিল মে*রে দিলেন।
ইকবাল এসে বসল তার মুখোমুখি।
‘ তাহলে? অবশেষে ধূসর ভাইকে পাবে। ট্রীট কবে দিচ্ছো? ‘
পিউ হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘ আর ট্রীট!’
ওদের কথার মধ্যেই ভরাট কণ্ঠের প্রশ্ন এলো,’ তুই এখানে?’
পিউ বাকী কথা গিলে ফেলল। পিঠ ফেরাল তৎক্ষনাৎ। ইকবাল জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছু*ড়ল,
‘ কেন? আসতে পারিনা?’
ধূসর দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকতেই পিউয়ের বুকের লাব-ডাব বেড়ে যায়। চোরা মন ভাবল,
‘ওই পোস্টের জন্য আবার কিছু বলতে এসেছে না কী?’
সে ত্রস্ত তটস্থ হয়ে বসল।
অক্ষিপট ডানে- বামে ঘুরিয়ে চুপটি করে থাকল।
ধূসর বলল,
‘ পারবি না কেন? হঠাৎ দেখলাম তাই! ‘
ইকবাল বিছানায় শুয়ে পরে। মাথায় হাত ঠেস দিয়ে প্রতাপী কণ্ঠে বলে,
‘ এটা আমার শালিকার ঘর। শালি মানে আধে ঘর ওয়ালী। আমি আসব, যাব। তুই কে? তুই এসেছিস কেন? আশ্চর্য! ‘
ধূসর চোখ সরু করে বলল, ‘ তাই?’
ইকবাল নিজেই উঠে বসল আবার। কণ্ঠ শৃঙ্গে এনে বলল,
‘ ভাই তোর কী কপাল! একই বাড়িতে একটা বউ পাবি। বিয়ের পর পিউ যে রাগ করে বাপের বাড়ি যাবে সেই ভয় ও নেই।’
তারপর দুঃখের শ্বাস ফেলল সে। যেন প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে পুষ্প তার কাজিন না হওয়ায়।
পিউ দাঁত দিয়ে নখ কা*টছিল। কথাটায় শশব্যস্ত হয়,উদ্বীগ্ন কণ্ঠে বলে,
‘ তাইত। আমি রাগ করে কোথায় যাব ইকবাল ভাই?’
ইকবাল নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমার বাড়ি যাবে পিউপিউ। এই ইকবাল আছে যতদিন, তোমার জন্য দরজা খোলা ততদিন।’
ধূসর নিরুৎসাহিত,
‘ হ্যাঁ নিয়ে যা। এখনই নিয়ে যা। তুইও গাধা,ওটাও তাই। পাল ভারি হবে।’
ইকবাল ফুঁসে ওঠার নাটক করে বলল,
‘ এত বড় অপমান? বাড়ির বড় জামাইকে অপমান? তোর কী মনে হয় পিউকে আমি নিতে পারব না?
পরপর দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘ তা নিয়ে পার্মানেন্টলি রেখে দেই? ইফতির সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেব কী বলিস?’
পিউ জ্বিভ কে*টে মাথা নুইয়ে নিলো। উনি যাকে দেখতে পারেনা,তারই নাম নেয়া? ধূসর চোখ গরম করে তাকাতেই শব্দ করে হেসে উঠল ইকবাল। বলল,
‘ লেগেছে? ওভাবে তাকাস কেন? আমি কি তোকে ভয় পাই শালা?’
‘ পাস না?’
ধূসর এক পা এগোতেই ইকবাল মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে দাঁড়াল। ছিটকে পেছনে গিয়ে বলল,
‘ মোটেইনা। ভয় পাব কেন? আমিও জিম করি। এই দ্যাখ মাসেল।’
টি শার্টের হাতা উঠিয়ে পেশিবহুল বাহু দেখাল সে। ধূসর ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা? তাহলে পরীক্ষা হোক,কার মাসেলে কত জোর?’
ইকবাল ঢোক গিলল। মারামারিতে সে নড়বড়ে যোদ্ধা। ধূসর সেখানে পি এইচ ডি।
হেরে যাবেনা বলে নাটক করে চিল্লিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ আসছি। ‘
‘ওই ডাকছে আমায়। দেখি সর।’
ধূসরকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে হেঁটে গেল সে। দরজা অবধি গিয়ে দাঁড়াল। ফিরে, আঙুল তুলে প্রচন্ড দাপট নিয়ে বলল,
‘ ডাকছে বলে ছেড়ে দিলাম।’
ধূসর তেড়ে আসতে নিলেই,ছুটল ইকবাল। সে থামল না, লম্বা পায়ে পেছনে চলল ওর।
পিউ হেসে ফেলল দুজনের খুনশুঁটি দেখে।পরপর মুখ গোমড়া করে বলল,
‘ আমি কেন হাসছি? আমি তো রেগে থাকব।’
******
একটা হীরের দোকানের সামনে এসে বাইক থামাল সাদিফ। রোদের অসহ তাপ বাইরে। হেলমেট পরে ঘাম চুল বেয়ে গড়িয়ে নামছে গালে ।
দোকানের সাইবোর্ডে চোখ বোলাল সে। নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘ এখানে?’
মারিয়া নামতে নামতে জবাব দেয়, ‘ হ্যাঁ। ‘
‘ ভালো হবে এটা?’
‘ আমি আমার অনেক বন্ধুদের নিতে দেখেছি এখান থেকে। এনাদের ডিজাইন গুলো ইউনিক! আপনি আমাকে ভরসা করতে পারেন।’
সাদিফ হাসল। স্ট্যান্ডে বাইক দাঁড় করিয়ে সাবলীল গলায় বলল,
‘ যেখানে আপনাকে ভরসা করি,সেখানে আপনার পছন্দের ওপর করব না ?’
মারিয়া বহু ক*ষ্টে ঠোঁটের হাসি ধরে রাখে। সাদিফের কিছু কিছু কথা যে তার হৃদয়ের কোথায় চলে যায় সে জানেনা। জানলে এভাবে সোজাসুজি বলত কী? ভেতরে তূখোড় রূপে বইয়ে দেওয়া ঝড় লুকোনোর হাতিয়ার হিসেবে এই হাসি ছাড়া কিছু নেই ওর। সে সামলে নিলো নিজেকে,বরাবরের মত স্থির রাখল অনুভূতি। বলল,
‘ চলুন, ভেতরে যাই। ‘
পা মিলিয়ে, সমান কদমে ভেতরে ঢুকল দুজন। মারিয়া সজাগ, তীক্ষ্ণ চাউনীতে বারবার সাদিফকে দেখছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে ততবার। বুঝতে পারছেনা,আদৌ ভেতরে কী ঠিক আছেন উনি? না কী তারই মত ভালো থাকার ব্যর্থ চেষ্টা এসব।
সাদিফ তখন শুধাল,’ কোন দিকে যাব?’
মারিয়া আশ-পাশ দেখতে দেখতে বলল,
‘ এখানে একটা কাপল রিং সেট আছে। আমি ওদের ফেসবুক পেজে দেখেছিলাম সেদিন। আই থিংক ওটাই বেস্ট হবে গিফট হিসেবে। ‘
‘ দাঁড়ান ,কাউকে জিজ্ঞেস করি।’
ভীষণ জ্বলজ্বলে পাথরের এক জোড়া আংটি সেলস উইমেন বের করে ওদের সামনে রাখল। এক দেখাতেই মুগ্ধ হলো সাদিফ।
হাতে তুলে বলল,
‘ আরে দারুণ তো!’
‘ পছন্দ হয়েছে আপনার? ‘
‘ হ্যাঁ চমৎকার! এটা ফাইনাল। ‘
‘ আর কিছু দেখবেন না? না মানে,আরেকটু বেছে নিলে ভালো হোতো না?’
সাদিফ আপত্তি জানিয়ে বলল ‘ আরে না না। এটাই ঠিকঠাক। ‘
তারপর মেয়েটিকে শুধাল,
‘কত দাম?’
শোনার পূর্বেই ফোন বাজল তার।
‘ এক সেকেন্ড ‘ বলে সাদিফ সরে এলো সেখান থেকে। মারিয়া দাঁড়িয়ে রইল একা। ডিসপ্লেতে রাখা একেকটি দামি হীরের গয়না মোহিত লোঁচনে দেখছিল। হঠাৎ কাঁচের টেবিলের ওপর থেকে চোখ আটকাল ভেতরে রাখা ব্রেসলেটে। দৃষ্টিতে আকর্ষণ আরো বৃহৎ হলো মারিয়ার। ঠোঁট থেকে মোহাচ্ছন্নতায় বেরিয়ে এলো,
‘ কী সুন্দর এটা!’
মেয়েটি তার চোখ অনুসরন করে চায়। আগ বাড়িয়ে বলে,
‘ ম্যাম এটা পছন্দ হয়েছে? এই ডিজাইনটা কিন্তু আমাদের শপে বেস্টের মধ্যে একটি। দাঁড়ান দেখাচ্ছি…’
মারিয়া হ্যাঁ/ না বলার আগেই তিনি ব্রেসলেট কাঁচ গলে বাইরে নিয়ে এলেন। টেবিলের ওপরে রাখলেন।
মারিয়া উজ্জল পাথর গুলো মন দিয়ে দেখল। হাত বোলাল ওর ওপর। নারীর মন,গয়না ভালো লাগবে স্বাভাবিক। কৌতুহলে শুধাল,’ কত দাম এটার?’
‘ ম্যাম, এটা মাত্র ৪৯,৯৯৯ টাকা।’
মাথা লাটিমের মত চক্কর কা*টল মারিয়ার। এমন ফিনফিনে ডিজাইনের একটা ব্রেসলেটের এত দাম? এটাত ওর চার মাসের স্যালারি । অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। হীরে কেনার যোগ্যতা কি আর ওর আছে?
‘ দিয়ে দেব ম্যাম? ‘
‘ হু?’
শুকনো হেসে বলল,
‘ না না। রেখে দিন,এমনি দেখলাম।’ ‘
‘ ওকে।’
সাদিফ কথা শেষ করে এসে পাশে দাঁড়াল ওর। যেচে বলল,
‘ একটা বন্ধু ফোন করেছিল। ছুটির দিন রোজ বিকেলে ওদের সাথে বের হইতো।’
মারিয়া ছোট করে বলল ‘ ওহ।’
সাদিফ মেয়েটিকে বলল,’ তাহলে আমাকে এই রিং সেট প্যাক করে দিন। কার্ড পেমেন্ট হবে তো, না?’
‘ জি স্যার। আপনি রিসেপশনে পে করুন,আমি পাঠাচ্ছি।’
সাদিফ মারিয়াকে বলল,’ আপনি গিয়ে বাইকের কাছে দাঁড়ান। আমি বিল পে করে আসছি। ‘
মারিয়া বাধ্যের ন্যায় মাথা ঝাঁকাল। শ্রান্ত পায়ে হেঁটে চলে গেল বাইরে।
সময় নিয়ে বেরিয়ে এলো সাদিফ। মারিয়া তখন বাইক ঘেঁষে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে সোজা হলো। সাদিফ চারপাশ দেখে কপাল গোটায়।
বলে,’ আশেপাশে ভালো রেস্টুরেন্ট নেই? জানেন কিছু? ‘
‘ রেস্টুরেন্ট দিয়ে কী করবেন?’
‘ কী করব মানে? খাব।’
‘ ওহ।’
‘ আপনি সকালে খেয়ে এসেছেন?’
মারিয়া চোখ তুলে চাইল। বলার আগেই সাদিফ বলল,
‘ খেয়ে আসেননি জানি। তাই এখন খাব,তারপর বাড়ি ফিরব।’
মারিয়া খানিকক্ষণ মূঢ় আঁখিতে তাকে দেখল। চোখ ধাঁধানো, সাদাটে রঙের ছেলেটির দিক তাকালে তার সুপ্ত প্রেম জেগে উঠতে চায়। সাদিফ চারপাশ থেকে দৃষ্টি এনে তার দিক ফিরতেই,এক ভ্রু উঁচাল। পরপর মিটিমিটি হাসল। ঘটনাচক্রে থতমত খেল মারিয়া। চোখ নামাল তৎপর ।
সাদিফ শুধাল,’ কী খাবেন?
সে নীচু কণ্ঠে বলল, ‘ ইয়ে… সকাল সকাল খালি পেটে রেস্টুরেন্টের ভারি খাবার খাব? এর থেকে হোটেলে গেলে হোতো না?’
প্রশ্নের উত্তর জানতে তাকায় সে। অথচ তাকে হতভম্ব করতে, সাদিফ সন্দেহী কণ্ঠে বলল,
‘ হোটেল?’
মারিয়া ইঙ্গিত বুঝেই রুষ্ট চোখে চাইল।
‘ আপনি তো ভীষণ ফাজিল! আমি খাবার হোটেলের কথা বলেছি। ‘
সাদিফ জ্বিভে ঠোঁট চুবিয়ে হাসল। দুষ্টু দুষ্টু হাসিটা দেখে মারিয়া লজ্জায় মিশে যায়। তার লুকোনো অভিপ্রায় খেয়াল করতেই সাদিফের নীরব হাসি প্রকান্ড হলো। হুহা শব্দে বেরিয়ে এলো বাইরে।
পরপর নিজেই আশ্চর্য হয়ে শুধায়,’ কী ব্যাপার বলুন তো! আপনার সাথে থাকলেই এত হাসছি কেন আজকাল?’
****
পিউ বড় যত্নে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত বানিয়েছে পুষ্পর জন্যে। পুদিনা পাতা আর লেবুর মিশ্রণে বানানো এই শরবতের পেছনে অগাধ শ্রম ঢেলেছে সে। পুষ্পর মাথা ঘুরছে। সারাদিন কিছু খায়না। মিনা বেগম বলেছেন এটা খেলে ভালো লাগবে। তাই ব্যস্ত হয়ে মায়ের আগেই বানিয়ে ফেলল পিউ। একটা পুচকু আসবে বাড়িতে। খালামনির কিছু দায়িত্ব আছেনা? কিন্তু বিপদ হলো, চিনি গুলছেনা। নাড়তে নাড়তে কব্জি ব্যথা হলেও পানির তলায় দেখা যাচ্ছে দানা গুলো। ব্লেন্ডারে যা দিয়েছিল ওতে হয়নি। আবার যোগ করতে হয়েছে। আর তাতেই বেধেছে বিপত্তিটা।
এমন হলে হবে কী করে? তার সব পরিশ্রমই তো মাটি।
সে চিনি নাড়তে নাড়তে সিড়ি বেয়ে উঠল। নিবেশিত মনোযোগ শরবতের জলে।
গ্লাসের ভেতর চোখ রেখে হাঁটার মধ্যেই আচমকা একটা শক্ত হাত এসে খপ করে হাত ধরল ওর। পিলে চমকে যায় পিউয়ের। স্পষ্ট ভাবে তাকানোর পূর্বেই হস্তমালিক বিদ্যুৎ বেগে ওকে টেনে নেয় কক্ষে।
আত*ঙ্কের তোপে হাত থেকে স্টিলের চামচটা পরে গেল ফ্লোরে। ঝনঝন শব্দে আরো ভারী হলো পরিবেশ। গ্লাসের শরবত এদিক ওদিকের সঙ্গে ছলকে পরল গায়েও। মানুষটা তাকে ভেতরে এনে দরজা চাপাল। পিউয়ের পিঠ ঠেকল সেই দরজার কাঠে গিয়ে। কাঁপা কাঁপা নেত্রপল্লব তুলে চাইতেই ধরা দিলো ধূসরের শ্যামলা আনন।
পিউয়ের ভয়*ডর নিভে গেল সহসা। ত্রাসের বদলে ভর করল বিস্ময়। হা করে বলল, ‘ আপনি? আমিওতো বলি,এই বাড়িতে এভাবে কে টানে আমাকে! ডাকাত তো নেই।’
ধূসরের শৈলপ্রান্ত বেঁকে আছে। যেন প্রচন্ড বিরক্ত সে। অবশ্য খুব কম সময়ই মসৃন থাকে তা। নিরেট চিবুক দেখে ঘাবড়াল পিউ। মনে পড়ল বসার ঘরে ওকে চোখ রাঙানোর কথা।
আসন্ন পরিস্থিতি ভেবে বক্ষঃস্থল দুরুদুরু হয় । ধূসর শক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়*ল,
‘ তখন চুপ করে ছিলি কেন?’
পিউ কণ্ঠ কাঁ*পিয়ে শুধায়,’ ককখন!’
‘ যখন বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিসনি কেন?’
পিউ মাথা নীচু করল।
অসহায় কণ্ঠে বলল,’ কী বলতাম তাহলে? ‘
‘ তুই আমায় বিয়ে করতে চাস না?’
অবিলম্বে একইরকম ঘাড় ঝাকাল সে।
ধূসরের স্বর গম্ভীর,’ মুখে বল।’
পিউ মেঝের দিক চেয়ে থেকেই, মৃদূ কণ্ঠে জানাল,’ চা.. চাই।’
সবেগে কোমল বাহু দুটো চে*পে ধরল ধূসর। জোরে ধরেনি, অথচ পিউ ভ*য় পেলো। হকচকিয়ে তাকালে, মৃদূ ধমকে বলল,’ তাহলে বলিসনি কেন?’
পিউ ঢোক গিলল।
‘ লজ্জা, লজ্জা করছিল।’
ধূসর শ্বাস ফেলল। বাহু ছাড়তেই সে আবার লেগে গেল দরজায়।
টের পেলো, ধূসরের একটা হাত আগের মত উঠে আসছে মাথার পাশে। পিউয়ের হৃদস্পন্দন জোড়াল হয়। মনে পড়ে যায় সেই ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের কথা।
নিভু নিভু চোখে চাইতেই সে
ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
‘ পৃথিবীর সব লজ্জা তোর একার, তাইনা? ‘
পিউ নিশ্চুপ। ধূসর বলল,
‘ আমাকে না জানিয়ে এনগেজড পোস্ট দিতে লজ্জা করেনি?’
পিউ দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট ঈষৎ কা*মড়ে ধরল এবার। নীচু কণ্ঠে স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ কী করব? আপনার ছবিতে মেয়েরা কমেন্ট করে কেন? আপনিও তো কিছু বলেন না।’
একবার চোরা চোখে তাকাল তারপর। ধূসর
চোখ -মুখ অপরিবর্তিত রেখে বলল,
‘ কী বলব শিখিয়ে দে।’
সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ আমি আপনাকে কথা শিখিয়ে দেব?’
‘ তো? কমেন্ট তো চেকই করিনা। আর এরা আমার ফ্রেন্ড লিস্টেও নেই। পাব্লিক আইডি। এসব কোত্থেকে আসে কে জানে!’
পিউ ব্যগ্র কণ্ঠে শুধাল,
‘ আপনি সত্যিই চেনেন না?’
ধূসর ভ্রু গোটায়,’ সন্দেহ করছিস?’
‘ না না।’
প্রতিটা কথা সে না তাকিয়ে বলছে। তাকালেও দেখছে আশপাশ। সরাসরি মুখের দিকে চাইছেনা দেখে,
ধূসর প্রশ্ন করল,
‘ আমার চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারিস না?’
তার উষ্ণ শ্বাসের তোপে পিউয়ের দেহ এমনিতেই শিরশিরে । রুদ্ধ কণ্ঠে জবাব দিলো,
‘ না। ‘
‘ কেন?’
পিউ কুণ্ঠা ঠেলে,মিনমিন করে বলল, ‘ শরীর কাঁ*পে।’
ধূসর কিয়ৎক্ষণ চোখ ছোট করে রেখে, ঠোঁট কাম*ড়ে হাসল। পাতলা অধর নেড়েচেড়ে বলল,
‘ তোর এই কাঁপার সময়-সীমা আর মাত্র সাতদিন। ‘
পিউ বুঝতে না পেরে তাকাল এবার। চাউনীতে প্রশ্ন।
ধূসর ভণিতাহীন বলে বসল,
‘ এই শুক্রবারের রাত তোর,আগামী শুক্রবারের রাত আমার। ‘
পিউয়ের কান ঝাঁঝিয়ে ওঠে। দুপাশ থেকে সজোরে নির্গত হয় গরম ধোঁয়া। ভ্রুদ্বয় উঠে গেল উঁচুতে। ঠোঁট দুটো ভাগ হলো, বেঁফাস কথাটায়। চোখ- মুখ খিচে বলল,
‘আপনি দিন দিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছেন ধূসর ভাই।’
তারপর দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। ধূসর খোলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় । শব্দহীন হাসি আর চকচকে চোখে দেখে যায় প্রেয়সীর চঞ্চল পায়ের ছুটে যাওয়া।