আফতাব অস্থির,অধীর। গলবিলটা কেমন ফ্যাসফ্যাস করছে দুশ্চিন্তায়। মস্তকের সমগ্র কোষ যেন স্বীয় জায়গায় থমকেছে। ঘামছে বয়ষ্ক গতর।
বাড়ি ফেরা থেকে এক দন্ড শান্তিতে বসতে পারছেন না। ভেতরটায় কেমন করছে! ক্ষণ বাদে বাদে মুচ*ড়ে উঠছে বা-পাশ।
দুহাত পেছনে বেধে সমানে পায়চারি করছেন তিনি। পায়ের গতি দিশাহীন,বেগতিক।
রুবায়দা অনেকক্ষণ যাবত খেয়াল করলেন ওনাকে। চিন্তিত কণ্ঠে শুধালেন,
‘ তোমার কিছু হয়েছে?’
আফতাব থামলেন। স্ত্রীর পানে চাইলেন৷ নিভে যাওয়া অক্ষিপট,নীচু করে বললেন, ‘ না।’
‘ তাহলে এরকম করছো কেন? এসে থেকে দেখছি, একটু শান্ত হয়ে বসছোও না। ‘
আফতাব থমথমে উত্তর দিলেন, ‘ আমায় একটু একা থাকতে দেবে? ‘
‘ কেন..কী…’
‘ প্লিজ রুবা…’
ভদ্রমহিলা দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন না ফের। মনের মধ্যে ওঠা সকল প্রশ্ন চেপে, চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন।
আফতাব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গিয়ে বসলেন রকিং চেয়ারে । পেছনে মাথা এলিয়ে আগে-পিছে দুললেন কিছু সময়। চোখের পাতা এক করতেই,কিছু সুন্দর চিত্রপট ভেসে উঠল সামনে । সাদা তোয়ালে প্যাঁচানো একটা ফুটফুটে, নাদুসনুদুস, শ্যামবর্ণের বাচ্চাকে কোলে নেওয়া, বুকের সাথে মিশিয়ে ধরা।
তাকে হাত ধরে হাঁটতে শেখানো, বাবা বাবা ডাকতে শেখানো, সব কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠল মানস্পটে। আফতাব তড়িৎ বেগে চোখ মেললেন। হৃদপিণ্ড কেমন বিবশ হয়ে গেল । চঞ্চু ভে*ঙে এলো প্রচন্ড কা*ন্নায়। কার্নিশ বেয়ে জল ছুলো চেয়ারের কোমল ফোম।
ধূসর ওনার একমাত্র সন্তান। রুবায়দা আর তার ঘর আলো করে আসা হীরের প্রদীপ। তার বড় আদরের, ভীষণ ভালোবাসার! কিন্তু এই ভালোবাসা সারাজীবন অপ্রকাশিতই থেকে গেল। বড় হওয়ার পর যা কোনও দিন ছেলেটাকে বোঝাতে পারেননি তিনি। না পেরেছেন মুখ ফুটে বলতে। ছেলেটা আজ যা কিছু হয়েছে,নিজের চেষ্টায়। স্ব-উদ্যোগে। ভালো বাবা হিসেবে তিনি এতটাই বিফল যে, কখনও ওর কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিতে পারেননি। ভরসা দিয়ে বলেননি ‘ আমি পাশে আছি।’
কখনও জিজ্ঞেস করেননি,’ তুই কী চাস? বাবাকে বল,বাবা আছি তো।’
ভাইজান যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, চোখ বুজে মেনে নিয়েছেন। যদিও তার সিদ্ধান্তে ধূসরের খারাপ কখনও হয়নি।
কিন্তু আজ,আজ কী করবেন তিনি? ছেলেটা এই প্রথম কাউকে ভালোবাসল। ধূসর মার-পিট করুক,রাজনীতি করুক, অবাধ্য হোক,যাই করে থাকুক না কেন, কোনও দিন কোনও মেয়েঘটিত নোং*রা কথা শুনতে হয়নি ওর নামে। সেই ছেলে পিউকে চায়। ঐ চাওয়ার মাত্রা কতটা প্রগাঢ় হতে পারে,ধারণা আছে তার।
সব বুঝে শুনেও, কী করে বলবেন, সরে এসো পিউয়ের থেকে? ভুলে যাও ওকে! ভুলে যাও সবকিছু। না না,এত নিষ্ঠুর পিতা হওয়া অসম্ভব।
ধূসরের ওপর এমনিতেই ওনার অন্যায়ের শেষ নেই। আবার এমন একটা পাপ কী করে করবেন? সবচেয়ে বড় কথা, ছোট্ট পিউটাও যে ওকে চায়। বিগত বছরগুলোয়,ধূসরের প্রতি মেয়েটির পাগলামো, আজ প্রমাণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেসবের। এত কিছুর জেনে,কী করে বাধা হবেন ওদের মাঝে?
আফতাব পরাস্ত, ব্যথিত চোখে মেঝের দিক চাইলেন। পরপর চকিতে তাকালেন আবার। বাধা হতে হবে। থামাতে হবে ওদের। নাহলে যে সংসার ভেসে যাবে। ভাইজান ধূসরকে পছন্দ করলেও,তার রাজনীতি চোখের বালি। যেই কারণে পুষ্পকে একরকম দ্বায়সাড়া,মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ইকবালের হাতে তুলে দিয়েছেন,সেই পুনরাবৃত্তি তিনি চাননা। আবার একবার ধূসর দাঁড়াক তার প্রতিপক্ষ হয়ে, বেয়াদবি করুক ,হোক এক দফা অশান্তির সৃষ্টি তাও না।
শেষে ভাইজান যদি রা*গে পরিবার ভাগ করতে চান? যদি সম্পর্কচ্ছেদ করেন? ভেবেই আঁৎকে ওঠেন আফতাব। ছেলের কষ্ট যেমন তার সহ্য হবে না,তেমন ভাইজান কষ্ট পাবে এমন কিছুও করতে পারবেন না তিনি। সে মানুষটা না থাকলে আজ কোথায় থাকতো সে? কোথায় থাকতো তার রুবা? এত বড় ঋণ ভাইজানের,এত স্নেহ,এত ভালোবাসা! অন্তর্দ্বন্দ আর মারাত্বক দোটানার প্রকোপে আফতাবের বুকে ব্যথা উঠল। প্রচন্ড হাঁস-ফাঁস করলেন বসে বসে।
সেই সময় নীচ থেকে ধূসরের কণ্ঠ পাওয়া যায়। বাড়িতে এসেছে সে। মায়ের কাছে কফি চাইছে। সিড়িতে তার দাপুটে পদচারণ শুনে আফতাব চোখ মুছলেন। বুকে পাথর চে*পে শক্ত করলেন মুখবিবর।
‘ ধূসর!’
কক্ষে ঢুকতে গিয়ে থামল সে। ডাক শুনে পেছন ফিরল।
‘ জি!’
আফতাব মায়া মায়া নেত্রে ছেলের শ্যামলা মুখ দেখলেন। এখন ওকে কীভাবে বলবেন ওসব? বুকটা ছি*ড়ে যাবেনা তার?
‘ কিছু বলবে?’
ভদ্রলোক নড়ে উঠলেন।
‘ হু? হ্যাঁ। একবার রুমে এসো,কথা আছে।’
ধূসর শ্রান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ খুব ক্লান্ত লাগছে আব্বু! সারাদিন রোদের মধ্যে ঘুরেছি তো,মাথা ব্য*থা করছে। ফ্রেশ হয়ে আসি?’
মমতায় হৃদয় ভে*ঙে-চূড়ে গেল আফতাবের। সন্তানের এমন ক্লান্ত মুখ,আর নরম কণ্ঠ শুনে স্নেহ দুলে ওঠে মনে । এরপর আর ওমন অপ্রিয় বাক্যগুলো উচ্চারণ করার সাহস হলো না। বললেন,
‘ আজ তাহলে থাক। কাল শুনো।’
‘ আচ্ছা।’
ধূসর কামড়ায় ঢুকে গেল। তখনও আফতাব অনিমেষ চেয়ে রইলেন।
ওই কাল আর ওনার আসেনি। বারবার চেয়েও, কিচ্ছু বলতে পারেননি। ধূসরের এত ছোটাছুটি, কাজের প্রতি একাগ্রতা শেষে অবিশ্রান্ত মুখমণ্ডল দেখে প্রতিবার পিছিয়ে এসছেন। জ্বিভের ডগায় এনেও গি*লে ফেলেছেন সব।
***
ইকবালদের বাড়িতে গিয়ে কথাবার্তা সেড়ে এলেন আমজাদ। মেয়েকে উঠিয়ে দেওয়ার তারিখ পাকাপোক্ত করে এসেছেন। এই তো, আগামী মাসের শুরুতেই একটা ঘরোয়া আয়োজন করে পুষ্পকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাবেন বলে ঠিক হলো।
মেয়েটা ভীষণ অসুস্থ! বলতে গেলে সারাদিন না খেয়ে থাকে। জল খেলেও বেসিনে ঢালে। প্রচন্ড দূর্বল!
ইকবালের এ নিয়ে উদ্বিগ্নতার সীমা নেই। সে মাই-লাভ কে মাথায় রাখলে সুস্থ হবে,না বুকে রাখলে সুস্থ হবে তাই নিয়ে দিশেহারা। পুষ্পর শুষ্ক মুখটা দেখছে যতবার,বক্ষ চি*ড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয় ততবার। সারাদিন বিছানায় নেতিয়ে থাকা ওকে দেখতে একটুও ভালো লাগেনা তার। এত অসুস্থ হবে বাচ্চা -গাচ্চার কথা ভাবতোই না।
ইকবালের কিচ্ছু ভালো লাগেনা আজকাল। তার হাসি-টাসি খুব বেশি আসেনা। সারাক্ষণ পুষ্পর চিন্তায় মস্তিষ্ক ঝাঁপাতে থাকে। মিনা, মুমতাহিনা,এমনকি পুষ্পও তাকে বোঝাচ্ছে এসময় এরকম হয়। ক’টা মাস গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। তবুও মন মানেনা ইকবালের। সে প্রতিদিন গুনতে বসে,আর ক মাস? ক’মাস পর বাবুটা আসবে? কবে এমন করুণ, নিদারুণ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে তার মাই লাভ!
*****
বাবাকে দুহাত ভরে মিষ্টি নিয়ে ঢুকতে দেখে মুখ শুকিয়ে গেল পিউয়ের। আজ দুপুর দুইটায় ওর রেজাল্ট দেবে। অথচ বাবা মিষ্টি এনেছেন এই সকাল বেলা? এখন যদি রেজাল্ট ভালো না হয়?
পিউ কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। চিন্তায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। নাস্তাও খায়নি ঠিক করে। তার বুক কাঁ*পছে। হৃদপিণ্ডটা এপাশ হতে ওপাশে এসে ফুটবল খেলছে।
জবা,সুমনা সবাই এত সান্ত্বনা দিচ্ছেন,বোঝাচ্ছেন ভালো হবে, কিন্তু এসব থামছে না। ভোরে মিনাকে ডাকতেও হয়নি। নিজেই ফজরে উঠে নামাজ পড়েছে পিউ। তসবীহ গুনছে একটু পর। বারবার দুহাত তুলে বলছে,
‘ আল্লাহ জীবনে যদি একটাও ভালো কাজ করে থাকি,এর বিনিময়ে হলেও রেজাল্ট টা যেন ভালো হয়।’
তার ভ*য় আরো প্রকট হয়, ধূসর, ইকবাল সাদিফ সবাই লাইন বেধে বাড়ি ঢুকলে। দুশ্চিন্তায় মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে থাকে।
সবাই যেখানে হাসছে সেখানে তার চেহারা কাঠ। উতলা নয়নে বারবার ঘড়ি দেখছে ও। এতটা আতঙ্ক ওর নিজেকে নিয়ে নয়,ধূসর ভাইয়ের বিশ্বাস রাখতে পারল কী না, সে নিয়ে। মানুষটার ওই বড় মুখ করে বলা কথাগুলো, যতবার মনে পড়ে ততবার শ্বাসনালী আটকে আটকে আসে।
আর যাই হোক, ওনাকে যেন ওর জন্যে ছোট না হতে হয়।
পিউ ভুলেও নেটে রেজাল্ট চেক করতে গেল না। বরং ফোন বন্ধ করে রেখেছে। রেজাল্ট বের হলেই তানহা ফোন করবে। থাক তার চেয়ে।
শেষমেষ প্রতীক্ষার প্রহর ফুরালো। রেজাল্ট দিয়েছে পিউয়ের । দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের সুফল হিসেবে, এ প্লাস পেয়েছে সে। তবে বাংলায় নম্বর কম পাওয়ায় গোল্ডেন জোটেনি । যা পেয়েছে তাতেই হৈহৈ করছেন সকলে। আমজাদ গর্বের সঙ্গে বললেন,
‘ আমি জানতাম,জানতাম আমার মেয়ে ভালো রেজাল্ট করবে। ওই জন্যেইত আগেভাগে মিষ্টি এনেছি। ‘
পিউ হাসে। চকচকে চোখে একবার সম্মুখে বসা ধূসরের পানে চায়। মানুষটা খুশি হয়েছেন কী না জানেনা ও। হাসছেও তো না। রেজাল্ট সবার আগে বের করেছেন,কিন্তু একবার কিছু বললও না ওকে। খুশি হলে এত চুপচাপ কেন?
পরিবারের সবাই হৃষ্ট,শুধু মিনা বেগমের এই রেজাল্টে চলল না। গোল্ডেন মিস হওয়ায় হা-হুতাশ করছেন তিনি। হাঁটতে- চলতে প্রলাপ করছেন,
‘ বারবার বলেছি পড়,পিউ পড়। পড়তে বসল কখন? পরীক্ষার আগে। অতগুলো বিষয় দুমাসে পড়ে পারা যায়? বিদ্যেসাগর নাকী? এখন গেল তো,গোল্ডেন টা ছুটে?
নামাজ কালাম ঠিকঠাক পড়বেনা। আল্লাহ খুশি হবেন কী করে? ওইজন্যেই ধরা খেয়েছে। জ্ঞান তো এক ফোটা নেই। আছে শুধু সালমান খান কী করল,শাহরুখ খানের কী হল এসব নিয়ে।’
পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এত ভালো রেজাল্ট করেও মায়ের মন মতো হলো না?
***
বিকেলে টেলিভিশন চলছিল বসার ঘরে। অথচ আফতাব পত্রিকা মেলে বসেছেন। তবে,চোখ, ধ্যান একটাও নেই সেখানে। কী যে লেখা আছে তাও জানেন না। শুধু আড়চোখে দেখছেন ধূসর জুতো পরছে। আবার বের হবে? আজ তো কথাটা বলতে চেয়েছেন,বলা হবে না?
পিউ চঞ্চল পায়ে নীচে নামতেই আফতাব তটস্থভাবে বসলেন। মেয়েটা ছোট, ভালোমন্দ বোঝেনা। ওকে দূরে দূরে রাখতে হবে ধূসরের থেকে।
ধূসরের পরিপাটি বেশভূষা দেখে রুবায়দা শুধালেন,
‘ কী রে,আবার বের হচ্ছিস না কি?’
‘ হ্যাঁ।’
ইকবাল শুধাল, ‘ কোথায় যাবি? আমিও যাই।’
‘ হ্যাঁ আয়। সাদিফ ও আয়। ‘
সে উঠে বলল, ‘ একটু দাঁড়াও। টি-শার্ট টা পালটে আসি।’
আমজাদ বললেন,’ দলবল নিয়ে যাচ্ছোটা কোথায়?’
‘ মিষ্টি কিনতে।’
‘ মিষ্টিতো তোর বড় আব্বু সকালেই এনেছেন। শেষ হয়নি।’
‘ বড় আব্বু বাড়ির জন্য এনেছেন বড় মা। আমি এলাকার জন্য আনতে যাচ্ছি।’
সকলে তাজ্জব হয়ে তাকালেন। মিনা অস্ফুট আওড়ালেন, ‘ এলাকার জন্যে?’
পিউ অবাক হয়েছে সবথেকে বেশি। সে যে দুপুর থেকে দ্বিধাদ্বন্দে ছিল,ধূসর ভাইয়ের খুশি নিয়ে। এইত পেয়ে গেল উত্তরটা। ওর ভালো রেজাল্টের জন্য পুরো এলাকায় মিষ্টি বিলাবেন ধূসর ভাই?
এর মানে উনি এত খুশি হয়েছেন? পিউয়ের চেহারার প্রতিটি কোনায় রোদ্দুর উঁকি মারল। কামিনী ফুলের মত স্নিগ্ধ দুই ঠোঁট ভরে উঠল হাসিতে।
সাদিফ তৈরি হয়ে নেমে এলো। সিড়ির মাঝপথে এসে থামল আবার। মনে করার ভঙি করে বলল,
‘ ও সরি! চশমাটা আনিনি। একটু দাঁড়াও।’
তারপর আবার ছুটে গেল রুমে৷
পুষ্প আহ্লাদী স্বরে বলল,
‘ ভাইয়া! এটা কিন্তু পার্সিয়ালিটি হয়ে যাচ্ছে। আমি যখন এ প্লাস পেয়েছিলাম,এলাকায় কিন্তু মিষ্টি দেওয়া হয়নি।’
ধূসর বলল, ‘ তোর সময় আমি ছিলাম?’
সে নিভে গেল।
ঠোঁট উলটে বলল ‘ তাও ঠিক।’
আফতাব বিড়বিড় করে বললেন,
‘ থাকলেও বিলাতো না কি? বদমাশটা তো পিউতে মজেছে। পারলে দেশবাসিকে মিষ্টি বিলাতো আজ।’
পিউ চপল পায়ে, ঘেঁষে এলো বাবার কাছে। আবদার করল,
‘ আব্বু আমিও যাই? ‘
মিনা বললেন,
‘ তুই আবার কোথায় যাবি?’
‘ কেন? ধূসর ভাইয়ের সাথে যাব। মিষ্টি কিনব।’
ধূসর ছোট্ট শ্বাস ফেলে ইকবালের দিক চাইতেই সে দুষ্টু হেসে চোখ টিপল।
পরপর পিউকে বলল, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ পিউপিউ চলো,সবাই মিলে মিষ্টির প্যাকেট বইব আজ।’
আমজাদ মানা করলেন না। বললেন ‘ যাও।’
পিউ পা বাড়াতে যাবে ওমনি আফতাব চেচিয়ে উঠলেন,
‘ নায়ায়া।’
চমকে তাকাল সকলে। পিউয়ের রুহু উড়ে গেল। সকলে ভড়কে একযোগে চাইতেই আফতাব থতমত খেলেন। হাসার চেষ্টা করে বললেন,
‘ না মানে,বলছিলাম যে, পিউ মা যেওনা তুমি।’
‘ কেন চাচ্চু?’
তিনি থেমে থেমে বললেন,
‘ আমি চাইছিলাম,তোমাকে নিয়ে কেক আনতে যাব। ভালো রেজাক্ট করেছ,একটা প্রিন্সেস ড্রেস ও কিনে দেব। ওদের সাথে তোমার যেতে হবেনা। আমার সাথে যেও,কেমন? ‘
পিউ হা করেও চুপ করল। বড়দের ওপর না বলবে কী করে? কিন্তু তার মন যে ধূসর ভাইয়ের সাথে যেতে চায়। ওনার একটুখানি সঙ্গতে যে সুখ,সেটা কি হাজার খানেক প্রিন্সেস ড্রেসে আসবে?
কিন্তু হবু শ্বশুরকেও না করতে পারল না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে, মাথা কাত করে বলল,
‘ আচ্ছা।’
আফতাব স্বস্তির হাসলেন। বললেন, ‘ লক্ষী মেয়ে! এসো চাচ্চুর পাশে এসে বোসো।’
পিউ গিয়ে বসল। তিনি স্নেহের হাত মাথায় বোলালেন ওর। পরপর ছেলের দিক চেয়ে বললেন,
‘ তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও যেখানে যাচ্ছিলে।’
সাদিফ নেমে এসেছে অতক্ষণে। তিনজন একসাথে বেরিয়ে গেল। বাইরে এসেই ইকবাল বিভ্রান্ত কণ্ঠে শুধাল,
‘ আঙ্কেল হঠাৎ ওমন করলেন কেন?’
ধূসরের জবাব এলো না। সে নিম্নাষ্ঠ কা*মড়ে কিছু ভাবছে।
*****
পুষ্পকে তুলে দেওয়া উপলক্ষে আরেক দফা শপিং হলো সিকদার বাড়ির। প্রতিবারের মত জবা আর সুমনাকে পাঠানো হলো কেনা-কাটার জন্য। পুষ্প অসুস্থ থাকায় যায়নি। তবে লাফানো পিউটা সবার সাথে হাজির থাকে সব সময়।
ইকবালের পরিবারের জন্যেও মোটামুটি কেনাকাটা করেছেন ওনারা। বাড়িতে সবাই ফিরলে, বসার ঘরে সব মালপত্র নিয়ে বৈঠক বসল। প্রত্যেকটা জিনিস সবাইকে দেখানোর আয়োজন চলল। তার মধ্যে ধূসর,ওপর থেকে নেমে এসে দাঁড়ায়।
কথায় কথায় সুমনা ওকে বললেন,
‘ ধূসর, পুষ্পর পরেই কিন্তু তোর সিরিয়াল। মেয়েকে পাঠিয়ে ঘরে বউ আনব আমরা। জায়গা পূরন করতে হবেনা?’
ওনারা ভাবলেন সে বলবে,
‘আমি বিয়ে করব না’।
বা অমত প্রকাশের কিছু একটা শোনাবে। কিন্তু সে ভণিতাহীন বলল,
‘ করব,খুব তাড়াতাড়িই করব।’
বড়রা একটু অবাক হয়ে চাইল ওর দিকে। পিউ নুইয়ে আছে। মনোযোগ দেখাচ্ছে হাতের শাড়ির ভাঁজে।
জবা কপাল কুঁচকে শুধালেন,
‘ কাউকে কি ঠিক করে রেখেছিস? রাখলে আমাদেরও দেখা। শুধু শুধু পাত্রী খুঁজে কষ্ট করব কেন?’
আফতাব সতর্ক, তবে মন্থর ভঙিতে চানাচুর চিবোচ্ছেন৷ কান দুটো খাড়া করে রেখেছেন ছেলের দিকে।
পিউ মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। ধূসর ভাই যেই সাহসী মানব, আবার ইদানীং বউ বউ করে জপছে, এক্ষুণি না কিছু বলে বসেন।
ধূসর তখন ওর দিকেই চাইল। পিউ আরো ঘাবড়ে গেল এতে। চোখাচোখি করে,সেকেন্ডে ফেরাল দৃষ্টি। বলল,
‘ তোমাদের পাত্রী খুঁজতে হবেনা। মন দিয়ে মেয়ের বিয়ের আনন্দ করো। ‘
‘ সেতো করবই। কিন্তু ছেলের বিয়েটা…’
ধূসর কথা টেনে নেয়,
‘ ওটা সামনে। এই আনন্দে কিছু কমতি পড়লে সেখান থেকে পুষিয়ে নেবে। ছেলে-মেয়ের বিয়ে হবে,এভ্রিথিং স্যূড বি ডাবল।’
বলে দিয়ে, নিরুদ্বিঘ্ন ভঙিতে ডায়নিং রুমে চলে যায়। সবার শেষে ফেরায়, শেষেই খেতে বসেছে ও।
পিউ চুপসে তাকিয়ে থাকল। কথার মধ্যে ঠিকই ক্লু দিয়ে গেল এই লোক! সবাই চোখ পিটপিট করছে। ধূসরের কথার আগা-মাথা তারা বোঝেনি। রুবা দুপাশে মাথা নেড়ে উঠে গেলেন ছেলের নিকট। কী লাগে, না লাগে দেখতে!
শুধু আফতাব কটমট করছিলেন ভেতর ভেতর । দাঁত চেপে বিড়বিড় করলেন,
‘ হতচ্ছাড়া বদমাশ! ‘
****
মোটামুটি একটা অনুষ্ঠান করা হলো পুষ্পর বিয়েতে। ও এমনিই অসুস্থ,তাই খুব কাছের লোক ছাড়া আমজাদ কাউকে ডাকলেন না। অত ধকল নেওয়ার মত অবস্থা মেয়েটার নেই তিনি বোঝেন।
ইকবালের আত্মীয় স্বজন আর নিজেদের, এই নিয়েই একটা গেট-টুগেদার হলো। পুষ্প বিয়েতেও নেতিয়ে আছে। কোনও রকমে বেনারসি পড়লেও একটা গয়নাও পড়েনি। ইচ্ছেই করছেনা কিছু।
কিন্তু যখনই পালা এলো বিদায়ের,
ওমনি যেন আধ্যাত্মিক পর্যায়ে জাগ্রত হয়ে উঠল। শরীরের সমস্ত অসুখ শেষ। একেবারে জোর গলায় হাউমাউ করে কা*ন্না শুরু করল সে। এদিকে মিনা বেগম মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার।
সকাল থেকে কেঁ*দে ভাসিয়ে শরীর দূর্বল ওনার। বাড়ির এত গুলো মেয়ে একসাথে কাঁ*দলে, সাউন্ড সিস্টেমও হার মানবে। জবা সুমনা,রুবা তো আছেন,সাথে পিউয়ের দুই মামী,বর্ষা,শান্তা, সুপ্তি সব যোগ দিয়েছে।
রাদিফ,রিক্ত মজায় ছিল এতক্ষণ। একরকম পাঞ্জাবি পরে হুটোপুটি করে সারা বাড়ি ঘুরছিল। যখনই মাকে কাঁদতে দেখল,রিক্ত কোনও কিছু না বুঝে কান্না শুরু করে দেয়। রাদিফ দাঁড়িয়ে থাকে মুখ কালো করে।
পিউ আস্তে আস্তে, শব্দহীন কাঁদছিল।
কিন্তু যখন পুষ্পকে ঘর থেকে নামাতে গেল, তার ওই শব্দ আর ঠোঁটের ভেতর রইল না। চিৎকার করতে করতে বোনের কোমড় আকড়ে ধরল সে।
কিছুতেই যেতে দেবেনা ওকে। পুষ্পর কা*ন্না এতে আরো জোড়াল হয়। বোনের কা*ন্না দেখে এখন সে বেশি করে যেতে চাইছেনা।
বেগতিক অবস্থায় পড়ে গেলেন পুরুষরা। ইকবাল অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
পুষ্প বারবার মায়ের ঘরের দিক ছুট লাগাতে চায়। ওনাকে অচেতন রেখে কীভাবে যাবে ও? এমনিতেই অসুস্থ এর ওপর আবার কান্নাকাটি! অতিরিক্ত ধকলে শেষমেষ নিজেও ঢলে পড়ল।
কাউকে কিছু করতে হয়নি। ইকবাল নিজেই অত মানুষের মধ্যে, কোলে তুলল তার বউকে। সবাইকে পেছনে রেখে গাড়ির দিক এগোলো। পিউ, বোনকে যেতে দেখে বাচ্চা হয়ে গিয়েছে।
‘আপুকে নিওনা’ বলতে বলতে ছুটতে ধরলেই দুহাতে আকড়ে ধরল ধূসর। সদর দরজা পার হতে দিলোনা। মিনা ওপরের ঘরে,তার কাছে রুবায়দা আছেন। বাকীরা সবাই ওদের বিদায় দিতে নেমে গেলেন নীচে।
পিউ ছটফট করল ছুটতে। হাত পা ছু*ড়ে ছোটাছুটি করল। কিন্তু তার সমস্ত শক্তি ধূসরের বলিষ্ঠতার সামনে হার মানে।
শেষে ওর বুকের মধ্যেই লেপ্টে গেল বিড়াল ছানার ন্যায়। কেঁ*দে ভাসাল পাঞ্জাবি।
ধূসর লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। নিশ্চুপ সে,পিউয়ের রেশম চুলে নিরন্তর হাত বোলাতে থাকে। কান্নার মাত্রাটা যখন কমে আসে,তখন বুক থেকে পিউয়ের মুখ তুলল ধূসর। নিয়ে সোফায় বসাল। পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো চুপচাপ।
পিউয়ের হেচকি উঠেছে। অশ্রুতে সাজগোজ শেষ। কাজল নেমে চলে এসেছে গালে। হেচকি তুলতে তুলতে কোনও রকম চুমুক দিলো গ্লাসে। অল্প একটু খেয়ে আবার রেখে দিলো।
তৎপর,ফের কোটর ভরল বোনের কথা মনে করে। ফুঁপিয়ে কেঁ*দে উঠতেই ধূসর হাঁটুভে*ঙে বসল ওর সামনে । মোলায়েম কণ্ঠে শুধাল,
‘ বোকার মত কাঁদছিস কেন? পুষ্প কি আর আসবেনা এখানে?’
পিউ ও-কথা শুনল না। অশ্রুতে একাকার হওয়া চোখ তুলে,নাক টেনে বলল,
‘ সাদিফ ভাইয়ের সাথে আপুর বিয়েটা হলেই ভালো হোতো ধূসর ভাই। তখন ও আমাদের সাথে এখানেই থাকতো। কোথাও যেতো না। আর আমারও এত কষ্ট হোতো না। ‘
ভীষণ বাচ্চামো কথায় ধূসর হেসে ফেলল। পরপর চোখ ছোট করে শুধাল,
‘ তুই,আমি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবি?’
পিউয়ের কান্না থামল সহসা। আঁতকে, এমন ভাবে তাকাল,যেন এ শোনাও পাপ। তার চোখ-মুখ দেখে ধূসরের হাসি বেড়ে আসে। অথচ তাতে শব্দ হলোনা,দঁন্তপাটি বাইরে এলোনা। শুধু একটু এগিয়ে গেল। স্বযন্তে ওর চোখের জল মুছিয়ে বলল,
‘ পুষ্প,ইকবালকে ভালোবাসে। তাহলে সাদিফকে কেন বিয়ে করবে?’
কথাটা মাথায় ঢুকল পিউয়ের। কান্না-কাটি ভুলে ঘাড় দোলাল সে। মিহি কণ্ঠে স্বীকার করল,
‘ তাইতো। আমিই বোকার মত একটা কথা বলে ফেললাম।’
‘ তাহলে আর কাঁদবি?’
পিউ দুপাশে মাথা নাড়ল। বোঝাল কাঁদবে না।
****
আমজাদ গাড়ির জানলার কাচ ধরে রেখেছেন। সিটে হেলে থাকা পুষ্পর দিক চেয়ে চক্ষু জ্বলছে তার। মেয়েটা চলে যাচ্ছে,কেন যেন মানতেই পারছেন না তিনি। বড় অসহায় ঐ দৃষ্টি। একটু যদি আটকানো যেত! ইকবাল আলগোছে পাশে এসে দাঁড়াল। নম্র স্বরে বলল,
‘ ভে*ঙে পরবেন না আঙ্কেল। পুষ্পকে আমি ভালো রাখার সর্বচ্চ চেষ্টা করব।’
আমজাদ আর নিয়ন্ত্রনে থাকতে পারলেন না। ঝরঝর করে কেঁ*দে ফেললেন। ইকবাল স্কন্ধে হাত রাখতেই আচমকা জড়িয়ে ধরলেন ওকে। ভগ্ন গলায়, অনুরোধ করলেন,
‘ ওকে দেখে রেখো বাবা। মেয়েটা আমাদের ছাড়া কোনও দিন কোথাও থাকেনি। কখনও কষ্ট দিওনা ওকে।’
‘ দেব না আঙ্কেল। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
*****
আফতাব সবার আগে বাড়িতে ঢুকেছেন। ভেতরে চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে গেলেন চৌকাঠে।
পিউ, ধূসরকে কাছাকাছি বসা দেখে ভীতশশস্ত্র, সতর্ক নেত্রে তাকালেন বাইরে। সিড়ি বেয়ে উঠছে সকলে। স্পষ্ট আসছে পায়ের আওয়াজ। এখন যদি কেউ দেখে ফ্যালে? ওনার জায়গায় ভাইজান এলে কী হোতো?
তিনি ত্রস্ত গলা খাকাড়ি দিলেন। নড়েচড়ে তাকাল ওরা। পিউ চাচাকে দেখে গুটিয়ে আনল দেহ।
ধূসর উঠে দাঁড়াল। বাবার দিক ফিরল। চেহারায় একটুও শঙ্কার চিহ্ন নেই। উলটে স্বাভাবিক তার কণ্ঠ, জিজ্ঞেস করল,
‘ ওনারা চলে গিয়েছে?’
আফতাব ভেবেছিলেন ছেলের চোখে-মুখে একটু ঘাবড়ানোর ছাপ দেখবেন। এই যে অসময়ে, বাপ এসে পড়ল, এটা একটা চিন্তার বিষয় না? কিন্তু না, সে তো বুক ফুলিয়ে আছে।
হতাশ শ্বাস ফেললেন। উত্তর হিসেবে মাথা দোলালেন। ধূসর পিউয়ের দিক চেয়ে বলল,
‘ চোখে-মুখে পানি দিয়ে আয়,যা।’
মেয়েটা ঘাড় হেলায়। বাধ্যের মত উঠে যায়।’
আফতাব নিরস চোখে, কিছুক্ষণ ধূসরকে দেখলেন। যতবারই ভাবছেন, এখন বলি,আজ বলি, পারছেন না। পিতৃ সত্ত্বাটা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসছে পেছনে।
*****
সাদিফের কিছু ভালো লাগছেনা। বাড়িতে আজ অনুষ্ঠান অথচ ওর ছুটি নেই। লজ্জার খাতিরে চায়ইনি। এক বছরে এত ছুটি তো আর কাটানো যায়না।
সে ক্ষণে ক্ষণে আক্ষেপের শ্বাস নিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে নিজেদের ব্যবসায় গেলেই ভালো হোতো৷ এরকম অন্যের হুকুম তামিল করার প্যারাটা থাকতো না।
আমজাদ বিয়ের তারিখ শুক্রবার দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আজমল দুই দিনের বেশি একদিনও থাকতে পারবেন না। ভাইয়ের জন্যে তারিখ আর পিছিয়ে আনা হলো না ওনার।
সাদিফও রা করলনা এ নিয়ে। ভাবল,
সেতো বাড়িতেই থাকে,সবার সাথে। বাবা বছরের অর্ধেক সময়টায় থাকেন বাইরে। ওর চাইতে তার আনন্দ বেশি প্রয়োজন।
মারিয়ারও মন ভালো নেই। পুষ্প তাকে বারবার ফোন করে যেতে বলেছিল। আবার বর্ষাও আসবে বিয়েতে।
কিন্তু ও কী করবে? গতবার সাদিফ অনেক বলে-কয়ে ওর ছুটিটা এনে দিয়েছিল। অথচ আজ সে নিজেই ছুটি নেয়নি। বোনের বিয়ের দিনও অফিস করছে৷ সেখানে ওতো কোন ছাড়!
দুজন মুখ ভাড় করা মানুষ সামনা-সামনি হলো লাঞ্চ ব্রেকে। কেন্টিনে এসে একে-অন্যের মনঃকষ্ট অনুভব করল বসে বসে। মারিয়া বলল,
‘ আমার এত খারাপ লাগছে যেতে না পেরে! আপনার না জানি কেমন লাগছে! ‘
বিনিময়ে সাদিফ শ্বাস ঝাড়ল। বলল,
‘ চাকরি জীবনটাই এরকম। এখানে নিজের স্বাধীনতা থাকেনা।’
‘ আমিতো দ্বায়ে পরে চাকরি করছি। আপনার তো দ্বায় নেই। তাহলে এলেন কেন?’
সাদিফ মুখ কালো করে বলল,
‘ সি-এ হওয়া প্যাশন ছিল। আর প্যাশন ফুলফ্যিল করতে গেলে কিছু তো স্যাক্রিফাইস করতে হবে ম্যালেরিয়া।’
মারিয়া ছোট করে বলল ‘ তাও ঠিক।’
পরমুহুর্তে উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ ওরা নিশ্চয়ই আজ অনেক মজা করছে! ইশ,আমি যেতে পারলাম না। শান্তা, বর্ষা ওদের সঙ্গেও দেখা হলোনা। কত কী করব ভাবলাম! সবাই মিলে কত প্ল্যান করলাম সেবার।’
‘ কী প্ল্যান?’
মারিয়া স্ফুর্ত কণ্ঠে জানাল,
‘ কাবিনের সময় সবাই ঠিক করেছিলাম,একরকম শাড়ি পরব। কিন্তু তখন কী আর জানতাম,বিয়েটা এত দ্রুত হবে? আমারও যাওয়া হবেনা।
পরপর মন খারাপ করে বলল,
‘ আমি যেতে পারব না শুনে বর্ষা, পুষ্প দুজনেই খুব রাগা-রাগি করেছে জানেন। বলেছে আর কথাই বলবেনা।’
মারিয়ার শোকাহ*ত মুখস্রী,কিন্তু সাদিফ আঁৎকে উঠল মনে মনে। ফের ওর শাড়ি পরার কথা শুনে ভ*য় পেলো। মনে পড়ল সেই পুরোনো কথা। শাড়ি পড়নে মারিয়ার দিকে তার ওমন হা করে চেয়ে থাকার বেহায়া দৃশ্য। বিড়বিড় করে বলল,
‘ ভাগ্যিশ যাওয়া হয়নি। নাহলে আজকেও একটা ইজ্জতের ফালুদা বানানোর মত কাজ করে ফেলতাম।’
** অফিসের মন খারাপ, বাড়ি ফিরে আরও গাঢ় হয়েছে সাদিফের। বাড়িটার এমন নিশ্চুপ,নিরব পরিবেশ নিতে পারছেনা সে। বসার ঘরটা একদম ফাঁকা। রোজকার আড্ডা নেই,যে যার ঘরে।
কেউ কথা বলছেনা,গল্প করছেনা। পাচ্ছেনা কোনও হাসির আওয়াজ। পুষ্পর কথা মনে করেও তার বুক ভারী হলো। বিয়ে ঠিক হওয়ার আগ অবধি কত সুন্দর ছিল ওদের সম্পর্ক! কত খুনশুঁটি করত দুজন। ইশ! যাওয়ার সময় দেখাও হলোনা।
রাদিফ বিপাকে পড়েছে। সবার কা*ন্না মোটামুটি কমলেও, বড় মায়ের কা*ন্না থামেনি। একটু পরপর ফুঁপিয়ে উঠছেন তিনি। দূর্বল চিত্তে শুয়ে আছেন বিছানায়। তার জন্যে বাড়িটা আরো বেশি বিষণ্ণ। অতিথিরা চলে গিয়েছেন। শূনশান সব। পিউ আপু ঘর অন্ধকার করে বসে। রিক্তটাও ঘুম। সে একা একা কী করবে?
উপায়ন্তর না পেয়ে টিভি ছাড়ল। কার্টুনের চ্যানেল ধরল। এর মধ্যে পিউ নামল নীচে। জোরে জোরে কান্নার দরুন , এখন মাথাব্যথা করছে। বাড়ির এই অবস্থা,মা-ও অসুস্থ। তাই নিজেই চলল কফি বানাতে। রাদিফ বুঝতেই, এপাশ থেকে আবদার করল,
‘ পিউপু আমিও কফি খাব। ‘
সে শুধু মাথা দোলাল৷
কফি এনে রাদিফের হাতে দিয়ে ফিরতে নিলেই ও বলল,’ কোথায় যাচ্ছো,বোসোনা। ‘
পিউ বসল চুপচাপ। চটপটে, চঞ্চল বোনের, আজ এই মলিন আনন রাদিফের ভালো লাগছেনা৷ ক*ষ্ট হচ্ছে ওর।
অন্য সময় দুজন টিভির রিপোর্ট নিয়ে হাতা-হাতি করত। অথচ আজ ওর মন ভালো করতে যেচে রিমোট এগিয়ে দিলো সে। বলল,
‘ নাও, তুমি দ্যাখো।’
পিউ অনীহ কণ্ঠে বলল, ‘ দেখব না। তুই দ্যাখ।’
‘ তোমার একটা পছন্দের মুভি চলছে দেখলাম। দেখবে? ধরব চ্যানেলটা?’
‘ কী মুভি?’
‘ আমি ওসবের নাম জানি না কী? তোমাকে অনেকবার দেখতে দেখেছি। আচ্ছা দাঁড়াও। ‘
সে নিজেই রিমোট চে*পে চে*পে চ্যানেল পাল্টাল। স্ক্রীনে দেবের সিনেমা চলছে। বহু আগের! প্রতিটা গান পিউয়ের ভীষণ পছন্দ,সিনেমাটাও।
কিন্তু আজকে আর আগ্রহ পেলো না।
তখন ওপর থেকে সাদিফ নেমে আসে। হাতে খালি জগ,রুমের জন্য পানি নেবে। রাদিফকে টিভির সামনে দেখেই বলল,
‘ তোর পড়া নেই ?’
সে ঠোঁট উলটে বলল,
‘ আজকেও পড়ব? আজ সবার মন খারাপ, আমারও মন খারাপ। মন খারাপ থাকলে পড়তে হয়না।’
সাদিফ ভ্রু উঁচাল যুক্তি শুনে।
‘ কে বলেছে এসব কথা?’
রাদিফ সহসা আঙুল তাক করল পিউয়ের দিক। সে তব্দা খেয়ে, হা করে বলল,
‘ আমি কখন বললাম?’
‘ একটু আগেই তো বললে।’
পিউ কটমটিয়ে উঠল, ‘ রাদিফ! মা*র খাবি কিন্তু। ‘
‘ সত্যি কথার ভাত নেই। ‘
সাদিফ হাসল৷ শ্বাস ফেলে দুদিকে মাথা নাড়ল। ঘুরে ডায়নিং টেবিল থেকে পানি ঢালছিল জগে। সিনেমা তখনও চলছে। প্রতিটা ডায়লগ পরিষ্কার কানে আসছে। এক পর্যায়ে একটা কত্থোপকথন শুনে, হাত থামল ওর।
যেখানে হিরো কাউকে বলছে, ‘ কিন্তু আমরা তো বন্ধু।’
ভদ্রলোক বোঝালেন,
‘ তাতে কী? একজন ভালো বন্ধুই কেবল একজন উত্তম জীবনসঙ্গী হতে সক্ষম।’
সাদিফের কী হলো কে জানে! এটুকু শুনেই তার আঙুল কেমন নড়ে-বড়ে হয়। লাইনগুলো যেন প্রখর ভাবে, মস্তিষ্কে তীরের মত শাই করে ঢুকে যায়।
দেয়ালের দিক চেয়ে নিজেকেই শুধাল,
‘ একজন ভালো বন্ধু, সত্যিই ভালো জীবনসঙ্গী হতে পারে?’
*****
তিনদিনের মাথায় পুষ্পকে নিয়ে ইকবাল ফিরল। সাথে নিয়ে এলো সবার কমে আসা হাসি। নিমিষে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠল গৃহ। পুষ্প আর মিনার কা*ন্না কে দ্যাখে! মা- মেয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে রাখল দুজনকে। যেন কত শতাব্দী পর দেখা !
পিউ অভিমান করে বলল,
‘ আমাকে কেউ জড়িয়ে ধরছেনা। আমি বুঝি কেউনা?’
পুষ্প হেসে বোনকে বুকে জড়ায়। ও বাড়িতে নূড়ি যতবার তার পেছনে ঘুরেছে, ততবার এই ছোট্ট বোনটাকে ভেবে বুক পু*ড়েছে ওর৷
****
এদিকে, দিনকে দিন অসহায় হয়ে পড়ছেন আফতাব। সবার কাছে পিউ- ধূসরের প্রেম লুকোনো, কিন্তু তার কাছে পরিষ্কার। এখন মনে হচ্ছে আগের মত থাকলেই ভালো হোতো। এই অসহায়ত্ব একটু একটু করে আকাশ ছুঁতো না। কেন জানলেন আগেভাগে? এমন চাপা ক*ষ্ট,টানাপোড়েন আর নিবিড় যন্ত্র*না নিয়ে রাতে এক ফোঁটা ঘুম আসেনা। চিন্তায় আগের মত স্বাভাবিক নেই তিনি। রুবায়দা, ভাইজান কারোই সাথেই গল্পে বসতে পারছেন না।
ধূসরকে তিনি জানেন,চেনেন। আন্দাজ রয়েছে ওর কর্ম নিয়ে। পিউয়ের প্রতি যে মাত্রায় সে আসক্ত, তার এক বলাতেই ছাড়বেনা নিশ্চিত। উলটে অশান্তি প্রকট হবে। সবার কানে যাবে। কী করবেন তাহলে? কী পদক্ষেপ নিলে সুষ্ঠু হবে সব?
মস্তক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আফতাবের। তবুও সুরাহা পাচ্ছেন না। এ যেন খড়ের গাঁদায় সূচ খোঁজার দশা। শেষে মাথা চেপে বসে রইলেন বিছানায়। কী মনে করে হঠাৎ মুখ তুললেন। ঢোক গিললেন।
আচ্ছা,একবার ভাইজানের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করলে হয়না? একবার সন্তপর্ণে পিউয়ের হাত ছেলেটার জন্যে চেয়ে দেখলে হয়না? ভাইজান মানা করলে তো আর আশা থাকল না। কিন্তু, একবার তো চেষ্টা করাই যায়।
ছেলেটার থেকে ওর ভালোবাসা ছি*নিয়ে নেওয়ার বদলে, জীবনে প্রথম বার ওর ভালো বাবা হয়ে এইটুকু করা যায়না? ভাইজান রা*গ করলে করবেন। ভুল বুঝলে বুঝবেন। অন্তত এই মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব তো লাঘব হবে!
আফতাব উঠে দাঁড়ালেন সহসা। সাহস সঞ্চয় করলেন বক্ষে। এই প্রথম ছেলের জন্যে কিছু চাইবেন তিনি। দরকার পড়লে ভাইজানের পায়ে ধরবেন। তাও চাইবেন। তাতে যা হবার হোক!
**
আফতাব ব্যস্ত পায়ে বের হলেও, ঘরের সামনে এসে থামলেন। নার্ভাস লাগছে! কোঁচকানো চামড়ার হাতটা থরথর করছে। ভাগ্য যে কোথায় আনল আজ! ভালোবাসা হারানোর য*ন্ত্রনা উপলব্ধি করেছেন তিনি। রুবাকে বিয়ে করার, আগের দিন পর্যন্ত ওই য*ন্ত্রনায় কাতরেছেন। তখনও তো জানতেন না, মেয়েটা পালিয়ে আসবে! যদিও তা সৌভাগ্য !
কিন্তু ছেলেকে এই একই ক*ষ্ট তিনি ভুগতে দিতে চাননা।
আফতাব বিনয়ী কণ্ঠে শুধালেন,
‘ ভাইজান আসব?’
অবিলম্বে জবাব এলো, ‘ এসো, এসো।’
ভেতরে ঢুকলেন তিনি। আমজাদ গভীর মনোযোগে বসে বসে দাবার গুটি সাজাচ্ছেন। ওনাকে দেখেই বললেন,
‘ তোমাকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম। ভালো হয়েছে এসেছ, বসো।’
আফতাব বারবার জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছেন। কোত্থেকে শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। বলার জন্য ভেতরটা উচাটন করলেও, মুখে আসছেনা কেন?
‘ কী হলো? বসো।’
আফতাব নড়েচড়ে, সবেগে বসলেন। আমজাদ গুটি সাজাতে সাজাতে বললেন,
‘ ভালো লাগছিল না! তাই দাবা নিয়ে বসলাম। ভাবলাম গুটিগুলো সাজিয়ে তোমাকে ডাকব।’
ভদ্রলোকের ওষ্ঠপুটে হাসি। আফতাব চাইলেন না, হাসিটা মুছে যাক। নি:সন্দেহে তিনি যা বলতে এসেছেন, তা শুনলে ভাইজানের হাসিই মুছবে না, বরং…..
পরেরটুকু আর ভাবতে পারলেন না আফতাব। যত ভাববেন তত কঠিন লাগবে সব৷ ফের জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,
‘ ভাইজান,একটা কথা বলতাম।’
‘ উম, পরে। আগে এক দান খেলি এসো।’
‘ ভাইজান খুব জরুরি!’
‘ আরে শুনব তো। সাথে তোমাকেও কিছু শোনাব।’
আফতাব উৎসুক হলেন, ‘ কী?’
আমজাদ বিস্তর হেসে বললেন,
‘ একটা সিক্রেট। বলব, আগে এই দানে আমায় হারিয়ে দেখাও। ‘
*****
শুক্রবার সকাল বেলা,
ধূসর সবে নাস্তা করতে বসল। এই দিনে বাড়ির সবাই একসাথে, একটু বেলা করে খায়। আমজাদ খেতে খেতে মিনাকে শুধালেন,
‘ পিউ খাবেনা?’
তিনি উত্তর দেওয়ার আগে,
নিজেই ডাক ছুড়লেন, ‘ পিউ? খাবেনা?’
ওপর থেকে চঞ্চল কণ্ঠের উত্তর এল,
‘ আসছি আব্বু।’
তেমন দৌড়েই নামল মেয়েটা। বেনীতে রাবার বাধতে বাধতে এসে দাঁড়ালে আমজাদ পাশের চেয়ার টেনে দিলেন।
পিউ বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে বসল।
খাওয়ার মধ্যে হঠাৎ তিনি ধূসরকে শুধালেন,
‘ আজ বের হবে?’
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ বিকেলে থাকতে পারবেনা বাড়িতে?’
পিউ প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল,
‘ বিকেলে কি আমরা ঘুরতে যাচ্ছি সবাই?’
আমজাদ হাসলেন। জানালেন,
‘ না। অন্য একটা কাজ আছে।’
মিনা শুধালেন ‘ কী কাজ?’
‘ বলছি,তবে সবার থাকা জরুরি। ধূসর,তুমি কোথাও গেলেও পাঁচটার মধ্যে চলে এসো। ‘
ধূসর বলল, ‘ কিছু হয়েছে?’
‘ না। হয়নি,তবে হবে।’
‘ কী হবে আব্বু?’
পুষ্পর প্রশ্নে আমজাদ পিউয়ের দিক চাইলেন। বললেন,
‘ পিউয়ের জন্য আমি একটা দারুণ সমন্ধ পেয়েছি। সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে ওকে। ‘
ব্যাস! ধূসরের খাওয়া থেমে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে তাকাল সে৷
পিউ সবে পানি নিয়েছিল মুখে। নাকে-মুখে ঢুকে তালুতে উঠে গেল সব। খুকখুক করে ফে*টে পড়ল কাশিতে। এই এক ঘোষণায় আরো ক’জনের খাওয়ার রফাদফা হলো। সবার বিমূর্ত, আ*তঙ্কিত লোঁচন বিক্ষিপ্ত ছুটল ধূসরের মুখ জুড়ে। এবার কোন অশান্তি আসবে কে জানে!