সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ বাড়ি। অথচ বসার ঘর মানুষজনে ভর্তি। সামান্যতম জায়গা হয়ত ফাঁকা! রাত প্রায় দশটা বাজে। এক ঘর মানুষের মধ্যে গম্ভীর চোখমুখ নিয়ে বসে আছেন বাবা আর চাচ্চুরা। তাদের ঠোঁটে বিন্দুমাত্র হাসি নেই। মেজো চাচ্চুর হ*তাশ,বি*ধ্বস্ত মুখভঙ্গি। আমার বাবা যতটা গর*ম,শ্বশুর মশাই ঠিক ততটাই নরম আর শান্ত গোছের। ছেলের একেকটি কাজে তার আক্ষেপের শেষ নেই। হয়ত উনি সবচেয়ে বেশি ভ*য়ে থাকেন,বাবা আর চাচ্চুদের ক*টু কথা শুনবেন সেই ভেবে।
কাঠগড়ায় ধূসর ভাই। অহেতুক আর অযৌক্তিক বিচারকার্য চলছে। অবশ্যই ধূসর ভাইয়ের করা অনাকাঙ্ক্ষিত কাজটি নিয়ে। ধূসর ভাইয়ের প্রিয় ডার্ক মেরুন রঙের গাড়িটি বিক্রি নিয়েই ,আহা*জারি তাদের। এমনকি আমার নিজেরও মন ভালো নেই। কেন ধূসর ভাই গাড়িটা বেঁচে দিলেন এ আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা। আমার প্রিয় রং মেরুন, সাথে ধূসর ভাইয়ের গাড়িও মেরুন। অতীব পছন্দের এই গাড়িটি ধূসর ভাই এইভাবে বেঁচে দেবেন ব্যাপারটা ধারনাতীত।
বসার ঘরের এক কোনায় ঠোঁট উলটে দাঁড়িয়ে আমি। ওড়নার কোনাটা আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে একবার তাকালাম ওনার দিকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো,এই যে উনি এমন একটা কান্ড ঘটালেন অথচ ওনার মধ্যেই বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। কী নিরুদ্বেগ, গা ঝাড়া ভাবভঙ্গি! আমি মুখ ভেঙচালাম। কী দরকার ছিল গাড়িটা বেচার? হুহ!
এই রাশ*ভারি পরিবেশটির রেশ কাটালেন বাবা। হাস্যহীন, ভীষণ অপ্রমত্ত কন্ঠে বললেন,
” আমাকে একটা কথা পরিষ্কার করে বোঝাবে ধূসর? ”
ধূসর ভাইয়ের আঙুলের মাথায় বাইকের চাবি ছিল। এতক্ষন ধরে সেটাকেই টুংটং করে নাড়ছিলেন। বাবার কথায় তাকালেন।
বাবা বললেন,
” গাড়ি বিক্রি কেন করলে?”
ধূসর ভাই ওপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চে*পে ধরলেন। অন্যদিক তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলে আবার ফিরলেন বাবার দিকে। যেন বি*রক্ত হলেন খুব।
অথচ ধীরস্থির জবাব দিলেন,
” বলেছিতো চাচ্চু,ভালো লাগছিল না গাড়ি।”
” তোমার জবাব আমার উপযুক্ত মনে হয়নি। ভালো লাগছিল না বলে কেউ গাড়ি বেচে দেয়? বাইকের দরকার,কিনতে ইচ্ছে করেছে বেশ,কিনেছো। ভালো কথা সেটা। তাই বলে গাড়ি কেন বেচবে।ওটাও থাকতো! ”
মেজো মা পাশ থেকে উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
” আমারও তো একই কথা! এরকম করার কোনও মানে হয় বলুন তো ভাইজান । ঘরের জিনিসপত্র বেঁচাকেনা এসব কি ভালো না কী? আচ্ছা,তুমি কিছু বলছোনা কেন? কথা কি ফুরিয়ে গেছে?”
কথাটুকু মেজো চাচ্চুকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো । চাচ্চু ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বড় দুঃ*খ নিয়ে বললেন,
” কী বলব? তোমার ছেলে কি আমার কথা শোনে?”
মেজো মা তৎক্ষনাৎ জ্ব*লে উঠে বললেন,
” এখন আমার ছেলে বলছো কেন? যখন স্কুল/কলেজের রেজাল্ট কার্ড দেখতে,তখন তো সারাবাড়ি নাঁচতে নাঁচতে বলে বেড়াতে ‘ আমার ছেলে,’ ‘আমার ছেলে’ । ভালো কিছু করলে ছেলে তোমার, আর তোমার মনঃপুত কাজ নাহলেই ছেলে হয়ে যায় আমার,তাইনা?”
মেজো চাচ্চু মুখ দিয়ে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করে বললেন,
” এক কথার মধ্যে আরেক কথা ঢুকানোর স্বভাব কি কোনও দিন যাবেনা তোমার? আমি কী বলছি আর তুমি কী বলছো? কথা না বুঝে উত্তর দিচ্ছো কেন?”
” আমি যা বুঝেছি ঠিকই বুঝেছি। তুমি…”
আমরা সবাই গোল গোল চোখে তাদের ঝ*গড়া দেখছিলাম। হঠাৎই ধূসর ভাই বলে উঠলেন,
” চুপ করবে তোমরা? ”
মেজো মা কথাটুকুন সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ হলেন। গিলে ফেলে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ধূসর ভাই কপাল গুঁছিয়ে বললেন,
” আমি বুঝলাম না,একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তোমাদের এত স*মস্যা কেন হচ্ছে? আমার ইচ্ছে হয়েছিল গাড়ি কিনেছিলাম,ইচ্ছে করল বিক্রি করলাম,সিম্পল! ”
আমি চোখমুখ কুঁচ*কে ফের মুখ ভেঙচালাম। ব্যাপারটা এতটাও সিম্পল না বুঝলেন! আপনি যে আস্ত একটা নি*র্বোধ, আবারও তার প্রমান দিলেন । ছোট চাচ্চু নম্র কণ্ঠে বললেন,
” হ্যাঁ, কিন্তু থাকলে কী হতো,দুটোই ব্যাবহার করতে….”
” আমি তো অনেকবার বললাম চাচ্চু,গাড়ি ভালো লাগছিল না। আর যে জিনিস আমার পছন্দ নয় সেটা আমি আমার কাছে রাখিনা। আমার মনে হয়, এ নিয়ে অহেতুক মাতামাতি করছো তোমরা। ”
” এসব তোমার অহেতুক মনে হচ্ছে?”
বাবার কথায় ধূসর ভাই মুখের ওপর বললেন,
” হ্যাঁ, হচ্ছে। আমার ব্যাপারটা আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক?”
বাবার মুখ থমকে এলো। ধূসর ভাই আবার বললেন,
” গাড়ি আমি আমার স্কলারশিপের টাকায় কিনেছিলাম। কারোর টাকা ন*ষ্ট করিনি। তাই তোমাদের এসব বাড়াবাড়ি যুক্তিহীন! ”
সোজাসাপটা জবাবে প্রত্যেকের মুখে যেন বড়সড় তালা ঝুলে গেল। কেউই আর জবাব দিতে পারল না। ধূসর ভাই,আম্মুর দিকে চেয়ে বললেন,
” তুমি টেবিলে খাবার দাও বড় মা,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
এরপর আর দাঁড়ালেন না উনি। শব্দযুক্ত কদমে ঘরে গেলেন নিজের। আমি ওনার যাওয়ার দিক চেয়ে দীর্ঘ*শ্বাস ফেললাম। ধূসর ভাই গাড়ি কিনেছেন এ অবধি দুটো। প্রথমে দেশে ফিরেই কিনেছিলেন একটা ধবধবে সাদা গাড়ি। এর মাস খানেক পরে সেটা ছোট চাচ্চুকে দিয়ে দিলেন। তারপর হুট করে কিনলেন মেরুন রঙের এই গাড়িটা। যেটা চলছিল প্রায় বছর তিনেক। জানিয়েছিলেন এই গাড়িটা ওনার ভীষণ শখের। আর তাই আমাদের পরিবারের কেউ সে গাড়িতে উঠতে পারেনি। ধূসর ভাইয়ের গাড়ি মানেই সে একাই ব্যবহার করবেন। এমনকি মেজো মাও ও গাড়িতে ওঠেননি। সেটাই আজ বিক্রি করলেন উনি। কেমন গোলমেলে বিষয় না!
এই ! এক সেকেন্ড! সেদিন আমি সাদিফ ভাইকে বলেছিলাম আমার গাড়ির থেকে বাইক ভালো লাগে! ধূসর ভাই কী এনি হাউ সেটা শুনতে পেয়েই এই কাজ ঘটালেন? আমার জন্যেই কী এসব? আমার মস্তিষ্কের টনক হঠাৎই নড়েচড়ে উঠল। সদাজাগ্রত হয়ে ধূসর ভাইয়ের রুমে দিকে ফিরলাম। ধূসর ভাই কি আমাকে খুশি করতেই এরকম করলেন? এর মানে ওনার অনুভূতি আছে আমার প্রতি? আমার স্বপ্ন পূরনের উদ্ভট এই ভাবনা লতাপাতার মতন নিমিষে বেঁয়ে চলল। তৎক্ষনাৎ পা বাড়ালাম ধূসর ভাইয়ের কামড়ায়। এই রহস্যের সত্যতা যতক্ষন না জানব,শান্তিতে বসতে অবধি পারব না। আনচান আনচান মন নিয়ে ছুট লাগাতে গেলাম। হুট করে পেছন থেকে সাদিফ ভাই হাত টেনে ধরলেন। আমি চোখ কুঁচ*কে তাকাতেই ফিসফিস করে শুধালেন
” কোথায় যাচ্ছিস?”
আমার মা*রাত্মক বি*রক্ত লাগল। এই লোক আসলেই একটা ডিস্টার্ব। যাচ্ছি জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আর মূল্যবান কাজে অথচ ঠিক বাগড়াটা দিয়ে দিলেন? আমার ভেতরটা অবা*ধ্য হলেও ওপর ওপর আমি ভীষণ সভ্য মেয়ে। তাই সভ্য ভাবেই জবাব দিলাম,
” আসছি একটু। ”
ওনার উত্তরের আশায় চেয়ে থাকলাম না। নিজেই সাদিফ ভাইয়ের হাতটা ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলাম।
এত তাড়াহুড়ো করে এলাম, যে কয়েক সেকেন্ড লাগল ধূসর ভাইয়ের রুমের সামনে আসতে। দরজা চাপানো। আমি আস্তে করে মাথা নামিয়ে উঁকি দিলাম। ভেতরটা দেখে আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা করলাম। কী করছেন উনি? ঢুকব এখন? যা কান্ড ঘটল নিচে রে*গে টেগে নেইতো? ঠিক তক্ষুনি ভেতর থেকে ধূসর ভাইয়ের শীতল স্বর ভেসে এলো,
” অভদ্রের মতো উঁকি না মেরে ভেতরে ঢোক।”
আমি চমকে উঠলাম । প্রস্তুত ছিলাম না তো! পরপর বুকে হাত দিয়ে জো*রেশোরে নিঃশ্বাস টানলাম। নিজেকে তৈরী করলাম ধূসর ভাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার। তারপর মাথার ওপর ছাদের দিক চেয়ে বিড়বিড় করলাম,
” হে আল্লাহ দেখো,ওনাকে যেন ঠিক ঠিক প্রশ্ন করতে পারি।”
গুটিগুটি পায়ে ঢুকলাম ধূসর ভাইয়ের কক্ষে। উনি পড়নের শার্ট পালটে টি-শার্ট পরেছেন। আমার দিকে পিঠ ফেরানো । আমি ঘনঘন পলক ফেলে চেষ্টা করলাম বোঝার। উনি অন্যদিকে ফিরে আমাকে কী করে দেখলেন? ওনার কি মাথার পেছনেও দুটো চোখ আছে?
ধূসর ভাই ঘুরে তাকালেন। চোখ ছোট করে বললেন,
” কিছু বলবি?”
ওনার ব্যস্ত প্রশ্ন,সাথে পেস্ট রঙের টিশার্টে ওনার দারুন চেহারাখানা আমার মাথা গুলিয়ে দিলো। ভুলে গেলাম সব। মাথা নাড়লাম দুদিকে। মানে বলবনা। পরক্ষনে সতর্ক হলাম। মনে পড়ল, না আমিতো বলতেই এসেছি। তবে উত্তর দেয়ার আগেই ধূসর ভাই বলে উঠলেন,
” এসছিস কেন তাহলে? আমার চেহারা দেখতে?”
আমি হা করতে গিয়েও মুখটা বন্ধ করে ফেললাম। কথাটা যে একেবারে ভু*ল, তা কিন্তু নয়। আপনার চেহারা দেখার শর্তে যদি সারাদিন ভাত না খেতে দেয়,আমি তাতেও রাজি। আপনার এই রুপের আ*গুনে কবেইত ঝ*লসে গেছি!
” বোঁকার মত হাসছিস কেন?”
আমার ঠোঁট চা*পা হাসিটা মুহুর্ত মধ্যে চু*পসে গেল ধূসর ভাইয়ের জিজ্ঞাসায়। আবারও ঘনঘন মাথা নাড়লাম দুদিকে। অ*ধৈর্য উনি, বোধহয় চ*টে গেলেন এতে। ক*টম*ট করে বললেন,
” তোর মুখ নেই? বোবা তুই? কথা বলতে পারছিস না?”
‘কথা বলতে পারছিস না’ এত্ত উঁ*চু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন কথাটা আমার রু*হ,আ*ত্মা সব এক জায়গায় গুঁটিয়ে এলো।
কেঁ*পে-টেপে একাকার হয়ে,ব্যস্ত গলায় বললাম,
” কিছু না,কিছুনা।”
” কিছু না হলে বের হ। তোকে না বলেছিলাম,আমার রুমের ধারেকাছে না আসতে? খুব অবাধ্য হচ্ছিস পিউ। কী ভাবছিস? তোর ওই ব্যাবসাদার বাপ আছে বলে কিছু বলবনা? ভ*য় পাই ওনাকে? ”
ধূসর ভাইয়ের হঠাৎই ক্ষ্যা*পাটে রুপ ধারন করায়, আমার মুখটা ছোট হয়ে এলো। মিনমিন করে বললাম,
” কখন বলেছি এ কথা?”
উনি চোখ পাঁ*কালেন ” তুই বের হবি?”
এরপরে আর দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়না। আমি কী অত ক্যা*বলা,মানসন্মান হীন না কী? এমন ভাব করছেন যেন রুম তো নয়,রাজার সভা। আমি চো*টপাট দেখিয়ে সত্যি সত্যিই ঘুরে হাঁটা ধরলাম। ভাবখানা এমন, যে ওনার ছায়াও মারাব না আর। অথচ দরজা অবধি গিয়েই পা জোড়া থ*মকে গেল। অনুভূতি গুলো মাথা তুলল। জো*রদার দাবী জানাল, “একবার জিজ্ঞেস কর পিউ, একবার জেনেই নে না,তোর ধারনা ঠিক কীনা!”
আমি সেই ক্ষনে ঘুরে তাকালাম। ধূসর ভাই ঠিক তখনি মুখ ঘোরালেন আরেকদিক। যেন তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষন। আমার ওসব ভাবার সময় হলোনা। ধৈর্য হীন কন্ঠে শুধালাম,
” আপনি কি গাড়িটা আমার জন্যে বেঁচেছেন? ”
উনি তাকালেন। খুব অবাক হয়ে বললেন,
” তোর জন্যে বলতে…!”
আমি জ্বিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজালাম। মনের প্রশ্নটা সাজিয়ে-গুছিয়ে মুখ ফুঁটে করতে পারলে হয়! আমতা-আমতা করে বললাম,
” না মানে… সাদিফ ভাইয়ের বাইকে ওইদিন___”
” তুই আজ কলেজ যাসনি শুনলাম।”
আমার কথাটুকুন পূর্নতা পেলনা। উনি পালটা প্রশ্ন ছু*ড়ে আট*কে রাখলেন মাঝপথে। আমি ধূসর ভাইয়ের ছোট ছোট চোখের দিক সরু দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম
” কার কাছে শুনেছেন?”
উনি গুঁটিয়ে রাখা ডান ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বললেন,
” জবাব দিহিও চাইছিস আজকাল? ইম্প্রেসিভ!”
আমি আবারও উদ্বেগ নিয়ে বললাম,
” না না তা বলিনি,আমি আসলে জানতে এসেছিলাম যে…..”
ধূসর ভাই এবারেও থামিয়ে দিলেন। ফা*জিল লোক একটা কথাও বলতে দিচ্ছেন না আমায়। পথিমধ্যেই বলে উঠলেন,
” তোর বাপ কে বলব, ইদানীং কান ধরে কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকছিস? ”
ঠান্ডাস্বরের হুম*কি। আমার চোখ কপাল ছুঁলো। ধ্ব*ক ধ্ব*ক করে উঠল ছোট্ট খাট্টো বুকখানি। এই কথা বাবা কেন,পরিবারের কেউ জানলে স*র্বনা*শ। ঘটনা একদিনের, অথচ আমাকে ক্ষে*পিয়ে মারবে সারাটাজীবন। আর বাবা? উনি জানলে সঙ্গে সঙ্গে কলেজে যাবেন,খোঁজ নেবেন। কেন ওনার মেয়ে কান ধরল তার তদন্ত করবেন। তারপর কোনও ভাবে ম্যাম যদি বলে দেয় খাতা ভরে ধূসর ভাইয়ের নাম লিখে ধ*রা খেয়েছিলাম? ইয়া মা’বূদ! আমি থাকলেও আমার মাথাটা থাকবেনা। আমি বি*মুর্ত হয়ে ধূসর ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম। কী সাংঘা*তিক লোক! কি ধু*রন্ধর! ধূসর ভাই ফের ভ্রুঁ উঁচালেন,
” বলব?”
আমি শুকনো ঢোক গিলে দুদিকে মাথা নাড়লাম। কাচু*মাচু চেহারায় অনুরোধ জানালাম,
” না। প্লিজ!
ধূসর ভাই বুকের সঙ্গে হাত বেঁধে দাঁড়ালেন। বললেন,
” বেশ! তাহলে ঠিক পাঁচ গোনার মধ্যে রুম ছাড়বি। আর এই গাড়ি বেঁচা-কেনার ব্যাপার নিয়ে ভবিষ্যতে কোনও দিন তোকে যেন মাথা ঘামাতে না দেখি। মনে থাকবে?”
আমার মন ঝুপ করে খা*রাপ হলো। যাকে বলে উথাল-পাতাল করা মন খা*রাপ।
ধূসর ভাই মানুষটা এমন অনুভূতিহী*ন,উদাসীন কেন? আমি যে কী বলে, কী বোঝাতে চেয়েছি,চেয়ে এসেছি,উনি কী কোনও দিন বুঝবেন না? নাকী উনি বুঝেও ভাণ করেন না বোঝার!
আমি কিছু বলতে চাইলাম,এর আগেই ধূসর ভাই প্রচন্ড ভাব সমেত গুনে উঠলেন,
” এক, দুই….
আমার নেত্রযূগল বৃহৎ হলো। ধূসর ভাইয়ের পাঁচ গোনা শেষ করার আগেই ভীষণ জো*রে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। সচেতন দুরুত্বে এসে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস ফেললাম। মাথাটা ওনার প্রতি রা*গে টগ*বগ করে উঠল । এত্ত ভাব কীসের? ভালোবাসি বলে মাথা কিনে নিয়েছেন না কি? মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে ধূসর ভাইয়ের চৌদ্দ গোষ্ঠী গা*লি দিয়ে উড়িয়ে দিতে। শুধু সেটা নিজের গোষ্ঠি বলেই ,পিছিয়ে যাই!
________
রাত কাটল। ধূসর ভাইয়ের গাড়ির ব্যাপারটা ধামাচা*পা পরল তার ঠান্ডা আচরনের তলায়। কিন্তু আমার মন খা*রাপ গেল না কোনও কিছুতে। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি হয়ত একটু বেশিই ছ্যাচ*ড়ামো করছি। একটা ছেলের প্রেমে এত পা*গল হওয়ার কিছু নেই। তারপর সুদৃ*ঢ় মনে প্রতিজ্ঞা করি,
” কাল থেকে আর ধূসর ভাইয়ের জন্যে এমন করবনা। ওনাকে দেখলেও ফিরে তাকাব না।”
আফ*সোস! আমার কাল আর আসেনা। আমি আজেতে ডুবেছি। আর সেই আজকের পুরোটা ঘিরে ধূসর ভাই। আমার আদ্যপ্রান্ত জুড়ে ধূসর ভাই। আমার মন তটিণী-র কানায় কানায় ধূসর ভাই নামক স্রোত বয়। আমার রঙিন পৃথিবীর সবটাই যে ধূসরময়। আচ্ছা, আমি কী সময় কা*টানোর জন্যে প্রেমে পড়েছি? না, একদমই নয়। পরেছি অনুভূতির কবলে পরে। তাহলে সেই প্রেমে পাগলামো থাকবে না,তো কী থাকবে?
এই চিন্তাটাই আমার সেই সু*দৃঢ় শপথের দেয়াল খানখান করে ভে*ঙে দেয়। আমি পারিনা,কোনও ভাবেই পারিনা নিজেকে সামলাতে। এই দোষ কী আমার? না,এটা সম্পূর্ন ওই মানুষটার অপ*রাধ,যে এত বি*শ্রী ভাবে আমাকে তার প্রতি আ*সক্ত করেছে।
শীতের সময় হলেও দুপুর বেলা বেশ রোদ পরে। তারপর কলেজের ইউনিফর্মেই গর*ম লাগতে যথেষ্ট। ছুটির প্রায় আধঘন্টা, কিন্তু এখনও বাড়িতে পৌঁছাইনি। গাড়ির তেল শেষ। ড্রাইভার চাচা গিয়েছেন তেল ভরতে। আমি অ*ধৈর্য মানুষটা কীভাবে এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকব? তাই ফুটপাত ধরে হাঁটছি এখন। গাড়ি এলে এই রাস্তা দিয়েই আসবে। চাচা আমাকে দেখতেই পাবেন। আমি সুস্থির হয়ে হাঁটছি,আর ভাবছি ধূসর ভাইয়ের কথা।
“এই যে মিস পিউপিউ! ”
একটা পরিচিত পুরুষালি আওয়াজে ঘুরে তাকালাম চটপট। পেছনে দাঁড়ানো সাদা গাড়ির জানলা থেকে মাথা বের করলেন ডেকে ওঠা আগন্তুক। ভীষণ চেনা চেহারাটা দেখেই আমার ঠোঁটে হাসি ভিড়লো। ওপাশের মানুষটাও মুচকি হেসে বললেন,
” কী খবর আপনার? একা একা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন কই? সঙ্গী দরকার?”
আমি বেশ উত্তে*জিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেমন আছেন ভাইয়া?”
ইকবাল ভাই মাথা নাড়লেন।
” মা*রাত্মক ভালো আছি। তোমার কী খবর? ”
” এইতো আলহামদুলিল্লাহ! আজকাল বাসায় কেন যাচ্ছেন না? ”
” সে বলছি, তার আগে বলো তুমি হাঁটছো কেন? গাড়ি কই?”
আমি কাঁধ উঁচু করে জানালাম,
” তেল শেষ। ”
ইকবাল ভাই বললেন,
” ও, তাহলে আর হেঁটে লাভ নেই। উঠে এসো গাড়িতে। আমি পৌঁছে দিচ্ছি। ”
বলার সাথে সাথে উনি গাড়ির দরজাও খুলে দিলেন। আমিও বিনাদ্বি*ধায় উঠে বসলাম সেখানে। ইকবাল ভাই হচ্ছেন ধূসর ভাইয়ের ছোট্ট বেলার বন্ধু। ওনাদের গলায় গলায় দোস্তি। শুনেছি সেই নার্সারি থেকে একসঙ্গে পড়াশুনা করেছেন। একটা সিক্রেট কী জানেন? মাঝে মাঝে এই ইকবাল ভাইকেও আমার হিং*সে হয়। কারন ধূসর ভাইয়ের কলিজার টুক*রো হচ্ছেন ভদ্রলোক। এত মাখোমাখো প্রেম এদের, বলার অপেক্ষা রাখেনা। যা করবেন, একসাথে। ঈদে পাঞ্জাবিটাও কিনবেন একরকম। চু*রি করলেও একসঙ্গে করতেন হয়ত। ধূসর ভাই যাদেরকেই এত অতিমাত্রায় ভালোবাসেন তাদের সব্বাইকেই ভালোবাসা যেন আমার রুটিন হয়ে দাঁড়াল।
শুনেছিলাম, একবার মিছিলে গেছিলেন ওনারা। বাড়িতে জানার পর ধূসর ভাইকে না কী মে*রে তক্তা বানিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। আর সেই জন্যে কেঁ*দেকে*টে বুক ভাসিয়েছিলেন ইকবাল ভাই। বাবার পা অবধি ধরেছেন প্রহার ঠেকাতে। ওসব এখন অতীত! এখন সেই বাবাকেই ধূসর ভাই পা*ত্তা দেয়না। তার কথা কানে তোলেনা। আচ্ছা, বিদেশ থেকে ফিরলে মানুষ বুঝি ভ*য়ড*র ও ফেলে আসে? তাহলে আমারও কি একবার বিদেশ যাওয়া উচিত? আমিও না হয় সব আ*তঙ্ক রেখে এসে একদম, ধূসর ভাইয়ের চোখের দিক চেয়ে বলে দেব ” আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
” কী ভাবছো? এই পিউপিউ!’
আমি নড়ে উঠলাম। গহীন ধ্যান ছুটে গেল ইকবাল ভাইয়ের ডাকে । ওনার পানে অপ্রস্তুত হয়ে তাকালাম। গাড়ির ভেতরে এসির ঠান্ডা বাতাস বইছে। ইকবাল ভাই ভ্রুঁ গুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ এত কী নিয়ে চিন্তা করছিলে শুনি?”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
” না, তেমন কিছুনা।
আচ্ছা, আপনি বাড়ি আসেন না কেন, বললেন না তো!”
ভাইয়া লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
” দুটো কারনে যাইনা।
এক, সামনে মেয়র নির্বাচন, অনেক ঝা*মেলা। আর দুই,তোমার বাবা।”
আমি চোখ সরু করতেই ভাইয়া বললেন,
” সে তো রাজনীতির নাম শুনলেও চেঁ*তে যান৷ আমাকে দেখলে বিরাট কপাল চলে আসে একজায়গায়। তাই ভাবি ওনাকে একটু শান্তি দেই। আপাতত চোখের সামনে না যাই। আমি ভাই এখন মনে প্রানে একজন রাজনৈতিক নেতা। একটা গোটা জেলার সভাপতি হয়েছি যেখানে,সেখানে ভাবতে পারছো আঙ্কেলের মুখের অবস্থা কী হবে আমায় দেখলে? চেয়ার টেয়ার ছু*ড়ে না মা*রলে হয়!
আমি মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে বললাম,
” এটা কোনও অজুহাত হলো? বাবা মোটেই এরকম নন। উনি তো ধূসর ভাইকেও দেখতে পারেন না। দিন রাত ওনার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেন রাজনীতি ছাড়ো,ব্যবসায় আসো। কই উনি তো এক কান দিয়ে ঢুকাচ্ছেন অন্য কান দিয়ে বের করছেন। তাহলে? ”
ইকবাল ভাইয়া চক্ষু কপালে তুলে বললেন,
” কে ধূসর? ওতো ওর নামের মতোই। ওর খা*রাপ লাগা, ভালো লাগা কিচ্ছু বোঝা যায়না। মাঝেমাঝে আমিই দ্বিধায় ভুগি ও রাগ করে না কি খুশি হয়! মানুষ এতটা নিরুদ্বেগ কী করে হয়? আমি ওর মতো নই বাবা! যে দেখেও না দেখার ভাণ করব,আবার কিছু জিনিস বুঝেও না বোঝার নাটক করব।”
কথাটার আগামাথা আমি কিছুই বুঝলাম না। জিজ্ঞাসু চেহারায় চেয়ে থাকতে দেখে ইকবাল ভাই হাসলেন অল্প। বিজ্ঞের মত মাথা দুলিয়ে বললেন,
” বড় হও পিউ,সব বুঝবে তারপর। ”
আমার মেজাজখানা সাং*ঘাতিক খা*রাপ হলো। সবাই কেন কানের কাছে এই একটা কথা বলছে? আমি কি ছোট? ফিডার তো খাইনা। ভালোবাসার মতন কঠিন বিষয়বস্তু বুঝি, তাহলে?
কিন্তু উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। ইকবাল ভাইয়ের ফোন বাজল। কথা বলায় ব্যস্ত হলেন উনি। আমি তাকিয়ে রাস্তার দিকে। সামনে গাড়ি চালাচ্ছেন ভাইয়ার ড্রাইভার। ইকবাল ভাইকে আমাদের পরিবারের সবাই চেনে। আমাকেও ভীষণ আদর করেন। ধূসর ভাই এই একটা ছেলের সাথে মেশা নিয়ে আমায় কোনও দিন কিছু বলেননি। কারন আমি নিজেও জানি ইকবাল ভাই আমাকে ঠিক তার বোনের চোখেই দেখেন। আমার ভাবনার মধ্যেই ফোন কা*টলেন তিনি।
জিজ্ঞেস করলেন,
‘ ধূসর কি বেরিয়েছি বাড়ি থেকে?”
ক্ষনশ্বর ভেবে বললাম,
” আমি তো দেখিনি আজ। হতে পারে!
ইকবাল ভাই মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বললেন,
” বড় ঝা*মেলায় আছি বুঝলে! রাজনৈতিক ঝ*ঞ্জাট এমন আগাছার মতন,ছড়িয়ে পরলে ছা*টাই করতে জান বেরিয়ে যায়। ধূসরটা সাথে আছে বলে একটু ভরসা পাচ্ছি,নাহলে কীভাবে যে ম্যানেজ দিতাম গড নোস! ”
আমার ছোট্ট মাথায় এত্ত কিছু ঢুকলনা। ভীষণ কৌতুহল নিয়ে বললাম,
” কী ঝামে*লা ভাইয়া? ”
” বলে শেষ করা যাবেনা রে পিউপিউ! সামনে মেয়র নির্বাচন না? বিপক্ষ দলের সাথে বড়সড় ঠান্ডা যু*দ্ধ চলছে। যে কোনও সময় ভ*য়াবহ রুপ না নিলে হয়!”
” এত ঝুঁ*কির কাজ কেন করেন আপনারা? ছেড়ে দিলেই তো হয়!”
ইকবাল ভাই হাসলেন,যেন মজার কিছু শুনলেন তিনি। বললেন,
” বোঁকা মেয়ে! বি*পদ তো সব জায়গায় থাকে,তাই বলে নিজেদের প্যাশন ছেড়ে দেব? শোনো,রাজনীতি হচ্ছে আমার আর তোমার ধূসর ভাইয়ের প্যাশন। আমার তো মনে হয় রাজনীতি আমাদের র*ক্তে মিশে। আমি আর ধূসর বরাবর অন্য কারো ঔ*দ্ধ্যত স*হ্য করতে পারিনা। না পারি অনুপযুক্ত,অযোগ্য লোকের নেতৃত্ব মেনে নিতে। তোর মনে আছে কী না জানিনা,কারন তুমি তখন ছোট খুব, সেই ক্লাশ টেন থেকে আমরা নেমেছিলাম এই পথে। তারপর প্রথম যখন মিছিলে নেমে ধূসর ধরা পরল বাড়িতে? সেবারই তো তোমার বাপ মশাই বেধ*রম মে*রেছিলেন ওকে। তারপরেও যখন ফিরল না ধূসর,বিদেশ পাঠাল ওকে। কিন্তু কী হলো? রাজনীতি কী পারল ছাড়াতে? হা হা হা!
ইকবাল ভাই সশ্বব্দে হাসলেন। ঠাম দেহ হেলেদুলে উঠল। কিন্তু আমার হাসি পেলনা। এটা কী হাসির ব্যাপার? মোটেইনা।
ইকবাল ভাই হেসে-টেসে চুপ করলেন। স্বল্প সময়ের নীরবতা চলল এরপর। হঠাৎই উনি প্রশ্ন ছুড়*লেন,
” তুমি ধূসর কে পছন্দ করো পিউ?”
আমি চমকে তাকালাম। আমার বড় বড় চোখদুটো অবাক হয়ে নি*ক্ষিপ্ত হলো ওনার পানে। ইকবাল ভাই মিটিমিটি হেসে ভ্রুঁ নাঁচালেন।
” কী? করো? ভালো-টালো বাসো?”
আমি বিস্ময় সামলে নিলাম। ধাতস্থ হয়ে বসে দুপাশে মাথা নেড়ে বোঝালাম ” না”।
হাস্যরসিক ইকবাল ভাই এতেও হাসলেন। শব্দ আমার কানে গেলেও ফিরলাম না ওনার দিকে। উনি খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে বললেন,
” মিথ্যে বলো না মেয়ে! তোমার চোখ দেখলে বোঝা যায়,তুমি ধূসর কে ভালোবাসো।”
আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম,
” আসলেই তাই?”
ইকবাল মাথা দোলালেন।
” অবশ্যই! ”
আমি বোঁকা বোঁকা চাউনীতে রাস্তার দিকে পুনরায় তাকালাম। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে স্ক্রিন গ্লাসে ভালো করে চেহারাটা দেখলাম। বিশেষ করে আমার অক্ষিযূগল। সত্যিই কী আমার চোখ দেখে বোঝা যায় আমি ধূসর ভাইকে ভালবাসি? তাহলে উনি কেন এতদিনেও বুঝলেন না?
আমার কান্ডে ইকবাল ভাইয়া অট্টহাসিতে ফে*টে পরলেন। নীরব গাড়িটায় ওনার হাসি এদিক সেদিক প্রতিধ্বনি পেলো। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইলাম। লজ্জ্বা পেলাম খুব।
কিন্তু চুপ থাকতে পারিনি। প্রশ্নটা মনের মধ্যে চে*পে রাখতে না পেরে করে ফেললাম,
” তবে উনি কেন বুঝতে পারেন না ভাইয়া?”
ইকবাল ভাইয়ের মুখস্রী তাৎক্ষণিক সিরি*য়াস হলো। খুব গুরু*ভার কণ্ঠে জবাব দিলেন,
” কী জানি! সেতো ধূসরই জানবে,ওর মনে কী আছে,বা কে আছে!”
আমার ভেতর থেকে অজান্তেই ভারী নিঃশ্বাস বের হলো। ধূসর ভাইয়ের মনটা যদি একটু চি*ড়ে দেখা যেত,এতটা বিভ্রান্তিতে আমার দিন-দুনিয়া খোয়াতো না।
ইকবাল ভাইয়ের গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ওনার ড্রাইভার বেরিয়ে ওনার দরজা খুললেন। আর ভাইয়া, এসে খুলে দিলেন আমার পাশের দরজাটা। এই ঘটনায় ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধটা গাঢ় হলো। কত বড় মাপের মানুষটাও আমায় কতটা গুরুত্ব দিলেন ভেবেই ইমোশোনাল হয়ে পরলাম। ইশ! আমার নিজের একটা বড় ভাই যদি থাকতো,ঠিক ওনার মতোই হতো হয়ত৷ অবশ্য সাদিফ ভাই আছে,কিন্তু ওনার মাথায় ঘুরপাক খায় আমাকে খাটি*য়ে মা*রার চিন্তা। পিউ পানি দে,পিউ তোয়ালে এনে দে,চা নিয়ে আয়,শার্ট ধুতে দিয়ে আয়, উফ!
আমি নেমে দাঁড়ালাম। ইকবাল ভাই মিষ্টি করে হেসে বললেন,
” যাও। পড়াশুনা ভালো করে করবে। সামনে পরীক্ষা না? এ প্লাস চাই কিন্তু!
” সে ঠিক আছে,কিন্তু আপনি কী আজও বাড়িতে ঢুকবেন না ভাইয়া? এভাবে দরজায় এসে ফিরে যাবেন? ”
ভাইয়া হাতঘড়ি দেখে বললেন,
” আজ যাব না, অন্য সময়। আমি আসি এখন…”
আমি তীব্র আপ*ত্তি জানিয়ে বললাম,
” মোটেইনা। চলুন…”
ভাইয়া তবুও মানা করলেন। ভেতরে উনি যাবেন না। আমি ততটাই জো*র করলাম। কারন বাবা এখন বাড়িতে নেই। তাহলে অসুবিধে কোথায়? আমি জোরাজোরিতে রীতিমতো হাত ধরে টানা*টানি শুরু করলাম ওনার। ঠিক তখনি পেছন থেকে ধূসর ভাইয়ের নিরেট স্বর শোনা গেল,
” কী ব্যাপার? ”
আমরা এক যোগে তাকালাম। ওনাকে দেখেই ইকবাল ভাইয়ের হাতটা ফটাফট ছেড়ে দিলাম। ইকবাল ভাই এতেও ঠোঁট চে*পে হাসলেন। ধূসর ভাই এগিয়ে এলেন। আমাকে একবারও না দেখে ওনাকেই জিজ্ঞেস করলেন,
” তুই হঠাৎ এখানে?”
ইকবাল ভাই প্রসস্থ হেসে বললেন,
” এইতো এলাম। তোর ফুলটুসি বোনটা রাস্তায় হাঁটছিল,মায়া হলো দেখে তাই গাড়ির তেল পু*ড়িয়ে পৌঁছে দিলাম বাড়িতে। তোর বোনের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে না বল!”
আমি উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলাম ধূসর ভাইয়ের অভিব্যক্তি বুঝতে। বারবার বোন বোন বলায় ওনার কি খা*রাপ লাগছেনা? আমারতো লাগছে। কিন্তু না, এবারেও এক মুঠো ব্য*র্থতা আমায় ছুঁয়ে দিল। এমন কিছুই হলোনা। উলটে ধূসর ভাই চট করে আমার দিক তাকিয়ে, ফট করে ধম-কে উঠলেন,
” হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা ভেতরে।”
এই শুরু হলো। আমাকে দেখলেই হয়েছে। উনি মনে হয় ধম*কা ধম*কি সব নাকের ডগায় নিয়ে ঘোরেন। আমি আসলেই চটজলদি বের করার ধান্দায়। আমি মুখ কালো করতেই ইকবাল ভাইয়া মায়া দেখিয়ে বললেন,
” আহা ব*কছিস কেন? বাচ্চা মেয়ে! থাক পিউপিউ,তুমি মন খা*রাপ করো না।”
এই সান্ত্বনায় আমার মন খা*রাপ লাঘব হলোনা। ছোট করে বললাম,
” আসি ভাইয়া। ”
আমি পা বাড়ালাম বাড়ির ভেতর। পেছন থেকে হঠাৎই ধূসর ভাইয়ের একটা কথায় লম্বা কদম ধীর হলো। উনি বলতে নিচ্ছিলেন,
” তোকে না বলেছি,পিউকে আমার ব___
কী সম*স্যা তোর? যেতে বললাম না ?”
এইরে! ধূসর ভাই ঠিক লক্ষ্য করলেন আমি দাঁড়িয়ে কান পেতে রয়েছি? ফের একটা রামধ*মক খেয়ে আর দাঁড়ানোর সা*হসে কূলোলানো। ছুটতে ছুটতে ঢুকে গেলাম বাড়িতে।
এক দৌড়ে সিড়ি অবধি গিয়েও পা জোড়া থেমে গেল। কিছু একটা খেয়াল করে ঘাড় কাঁত করে পেছনে তাকালাম। পরের দৃশ্যে কপালে ভাঁজ পরল আমার। আপু বসার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে। পর্দা আগলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কী দেখছে ও? আমি আগ্রহভরে আস্তে আস্তে এসে আপুর পেছনে দাঁড়াই। ওর চোখ,ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকাই। ওখানে তো ইকবাল ভাইয়া আর ধূসর ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। আর তো কিছু নেই। তাহলে আপু দেখছেটা কী? কোনও কিছুই, কিছুতেই আমার মোটা মাথায় ঢুকলোনা। কৌতূহল মেটাতে জিজ্ঞেস করলাম,
” কী দেখছিস?”
আপু ভূত দেখার মতন চমকে উঠল। আমাকে দেখে চোর ধ*রা পরার মত চেহারা বানিয়ে ঢোক গিলল। দুদিকে মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
” কিছু না। কিছুনা। ”
” তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন এভাবে? ”
আপু চোরা চোখে একবার ধূসর ভাইদের ওদিকটায় দেখে তড়িঘড়ি করে হেঁটে চলে গেল। আমি ব্যক্কল হয়ে চেয়ে রইলাম। কী হলো ব্যাপারটা?
______
সেদিন সন্ধ্যায় একটা আশ্চর্যজনক কান্ড ঘটল। প্রতিদিনকার মত বিকেলে আমার টিউটর এলেন। উনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এই চার মাস হলো পড়াচ্ছেন আমায়। স্যার এলে ওইদিন ও বরাবরের মত আম্মু হাঁক ছাড়লেন,
” পিউ! তোর স্যার এসছেন। ”
আমি সবে সবে ঝিমুচ্ছিলাম ঘুমাবো বলে। মায়ের ডাকে তটস্থ হয়ে বইখাতা গুছিয়ে ছুটলাম। আমাদের প্রাইভেট পড়ানোর জন্যে বাড়িতে একটা ঘর বরাদ্দ আছে আগেই। আমি গেলাম। ঢোকার আগে স্যারকে সালাম দিলাম। স্যার ইয়াং ছেলে। সাদিফ ভাইয়ের ও ছোট হবেন। পড়াশুনাতো করছেন এখনও। আমার আওয়াজ পেয়ে তাকালেন স্যার। শুভ্র হেসে বললেন,
” এসো। ”
আমি ঢুকলাম। গিয়ে বসলাম প্রতিদিনকার জায়গায়। স্যার শুধালেন,
” কী খবর? কেমন আছো?”
” ভালো আছি স্যার। আপনি? ”
” এইতো। তোমার চুলের এই অবস্থা কেন পিউ?”
আমি লজ্জ্বা পেলাম। অগোছালো চুলে হাত বুলিয়ে মিনমিন করে বললাম,
” ঘুমিয়ে পরেছিলাম একটু।”
স্যার মুচকি হেসে বললেন,
” তাও খারাপ লাগছেনা দেখতে। যাক গে,কী পড়বে আজ? কেমিস্ট্রি? ”
স্যার ভ্রুঁ নাঁচালেন। আমি বললাম,
” আপনার যা ইচ্ছে।”
রসকষহীন রসায়ন বইটা স্যারের দিকে এগিয়ে দিলাম। স্যার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আমার দিকে তাকালেন। বললেন,
” তুমিতো কেমিস্ট্রিতে ভালো। রিয়্যেল লাইফেও ভালো না কী!”
আমি কথাটার অর্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। পরপর কিছু বলতে যেয়ে হঠাৎ চোখ পড়ল দরজায়। ধূসর ভাই দাঁড়িয়ে। এদিকেই চেয়েছিলেন। আমি তাকানো মাত্রই গটগটিয়ে রুমে ঢুকে গেলেন নিজের। ওনাকে দেখে একটু অবাক হয়েছি। উনিতো এই সময় থাকেন না বাড়িতে। এলেন কেন এখন?
স্যার পড়ায় তাগাদা দিলেন। মনোনিবেশ না চাইতেও চলে গেল ওদিকে। টানা দেড় ঘন্টা পড়ার পর অব্যহতি মিলল।
পড়াশুনা শেষ করে নিচে নামলাম। স্যার চলে গেছেন ততক্ষনে। বসার ঘরে তখন চায়ের আসর বসেছে সন্ধ্যেবেলার। আয়োজনে আমাদের বাড়ির মহিলা সদস্যরা। আমি গিয়ে বসলাম আপুর পাশে। আপু জিজ্ঞেস করল,
” চা খাবি?”
আমি মাথা দোলাই। আপু কাপ ভর্তি চা এগিয়ে দিল। সামনের সোফায় আম্মু,মেজো মা,ছোট মা, সেজো মা গল্প জুড়েছেন। ছোটমা তার প্রিয় সিরিয়ালের খলনায়িকাকে বকাঝকা করলেন কতক্ষন!
পাশে ছোটাছুটি করে খেলছে রাদিফ আর রিক্ত। এর মধ্যে ধূসর ভাই নেমে এলেন নিচে। ওনাকে দেখেই মেজো মা বললেন,
” চা খাবি ধূসর?”
আমি আড়চোখে ওনার দিকে তাকালাম। শ্যামলা বর্ন মুখে চাপদাড়িওয়ালা এই লোকটাকে দেখে হৃদপিণ্ড কেমন কেমন করে উঠল। নতুন নয়,এরকম প্রত্যেকবারই হচ্ছে।
ধূসর ভাই বললেন ” না।”
তারপর সরাসরি
আম্মুকে শুধালেন,
” পিউয়ের টিউটরের ফোন নম্বর আছেনা তোমার কাছে? ”
সবার মনোযোগ ওনার দিকে ঘুরে গেল। আম্মু উত্তর দিলেন,
” হ্যাঁ আছে তো। কেন ? ”
ধূসর ভাই গুমোট কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন,
” ওকে ফোন করবে। বলে দেবে কাল থেকে যেন
আর পড়াতে না আসে।
সবে সবে চুমুক দেয়া চা’টা জ্বিভ পুড়ি*য়ে দিল আমার। ছোটখাটো ছ্যা*কা খেলেও মন-মস্তিষ্ক সব ওনার দিকে নিবদ্ধ হলো। হঠাৎ স্যারকে মানা করব কেন?
ছোট মা বললেন,
” কেন রে বাবা? ছেলেটাতো ভালোই পড়ায়। এক ঘন্টার জায়গায় দেড় ঘন্টা পড়াচ্ছে। সামনে পিউয়ের পরীক্ষা, এই সময় কি ঠিক হবে?”
ধূসর ভাই অনুষ্ণ স্বরে বললেন,
” এসব আমার মাথায় আছে ছোট মা। কারন ছাড়া বলছি না নিশ্চয়ই? পিউয়ের পড়াশোনায় ক্ষতি হোক এমন কিছু আমি করব কী?”
” না তা বলিনি…”
সেজো মা বললেন,
” কিন্তু ওকে পড়াবে কে? তুই? ”
কথাটা বলার সময় সেজো মায়ের চোখমুখ ঝলকে উঠলেও আমার মুখমণ্ডল শুকিয়ে গেল। ভী*ত হলাম,আবার ওনার পড়ানোর কথা উঠছে কেন?
ধূসর ভাই বললেন,
” না। তোমাদের এত চিন্তা করতে হবেনা। আমার এক বন্ধু আছে,ও এসে পড়িয়ে যাবে।”
এরপর বক্তব্য শেষ করে চলে গেলেন, যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই। আমরা প্রত্যেকে বিভ্রান্ত হয়ে চেয়ে রইলাম। মেজো মা বললেন,
” কী যে হয় ছেলেটার!”
আম্মু নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বললেন,
” যা হবে ভালোই হবে৷ ধূসর যখন দায়িত্ব নিচ্ছে আমার আর চিন্তা নেই। যাই,ফয়সাল কে বারন করে দেই।আর এ মাসের বেতনটাও নিয়ে যেতে বলি।”
বলা মাত্র আম্মু উঠেও গেলেন স্যারকে ফোন করতে। মোটামুটি পরিবেশটা স্বাভাবিক হলেও আমি অস্বাভাবিক বনে রইলাম। খুব গভীর ভাবে ভাবলাম,
ধূসর ভাইয়ের মতিগতি সুবিধের নয়। আকষ্মিক আমার স্যারের পেছনে পরার কারন তো একটা আছেই।