সিকদার বাড়িটি মূলত দুইতলা ভবনের তৈরী। বিশাল প্রস্থের ডুপ্লেক্স এটি। ক্রিম আর সাদা রঙের মিশেলে প্রতিটি দেয়াল তকতকে,ঝকঝকে। শুরুতে এমন ছিলনা অবশ্য। বাড়ির মূল কর্তা, প্রতিষ্ঠাতা, চার সন্তানের পিতা জমির সিকদার। সাধ্যমতো স্তম্ভ তুলেছিলেন। তবে সম্পূর্ন করতে পারেন নি। পাঁকা মেঝে হলেও মাথার ওপর ছিল টিনের ছাদ। অর্থ যা কামিয়েছেন ব্যয় হতো পরিবার সামলাতে। বাকিসবের ফুরসত কই?
হৃদয়ের ব্যামোর তোপে দুনিয়া ছেড়েছিলেন তিনি। তখন পুত্রবধূদের মধ্যে সবে মাত্র রুবায়দা বেগম ছিলেন। গণনা অনুসারে তিনি মেজো বউ হলেও এই বাড়িতে সবার প্রথমে আগমন হয়েছিল তারই।
আফতাব তখন বেকার। পড়াশুনাও শেষ হয়নি। রুবায়দার বাড়িতে বিয়ের তোরজোড় শুরু হলো হঠাৎ । ওই আমোলে, মুখ ফুটে অন্য কাউকে পছন্দের কথা জানানো চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না। তাও আবার মেয়ে মানুষের! যাদের থাকার নীতিই ছিল পর্দার আড়ালে।
লজ্জ্বা,শরমের বালাই ভুলে সাহস করে রুবায়দা তবুও পিতাকে জানিয়েছিলেন। আফতাবের মতো চাকরিহীন ছেলেকে তিনি নাকচ করলেন এক কথায়। এদিকে তার অবস্থা হলো দূর্বিষহ। খাওয়া দাওয়া ভুলে বসলেন। হতে থাকলেন অগোছালো। মস্তিষ্কে চাপের পরিমান তরতর করে বাড়ছিল। রুবায়দার সাথে অন্য কারো বিয়ে,এ ভাবনাও অসম্ভব।
দুজনেই দুজনের জন্যে ম*রিয়া যখন, সম্মুখে খোলা রইল একটি পথ। উপায় না পেয়ে আফতাবের হাত ধরে ঘর ছাড়লেন বাবার। একেবারে বিয়ে সেড়ে হাজির হলেন শ্বশুর বাড়ি। আফতাবের মত ভদ্র,শান্ত, মার্জিত গোছের ছেলের কান্ডে তখন বাড়ি শুদ্ধ লোক হতচেতন, হতবাক। জমির সিকদার কথাই বলতে পারেননি অনেকক্ষণ। আজমল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছেন মাত্র। আনিস পড়তেন দশম শ্রেনীতে। তার থেকেও বড় কথা, বড় ভাই আমজাদ অবিবাহিত। কেবল একটা চাকরিতে ঢুকেছেন তিনি। বেতনও আহামরি ছিল না। বড় ভাইয়ের আগেই মেজো ভাই বউ নিয়ে বাড়িতে হাজির? তৎকালে বিষয়টা এতটাই জটিল,আর অসহ থাকায় প্রত্যেকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ভাষাহীন।
জমির সিকদার একজন সৎ সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। বড় পরিবার,পুরো সংসারের জোয়াল টানা সব মিলিয়ে একটু আধটু হিমশিমিয়ে যেতেন। আমজাদ চাকরি নেয়ার পর বাবার কাঁধে কাঁধ মেলানোয় একটু কমেছিল মাত্রাটা। অবশ্য আগেও কখনও সন্তানদের কোনও ইচ্ছে তিনি অপূর্ন রাখেননি। স্বচেষ্ট থাকতেন,তাদের আবদার মেটাতে।
কোনও টায় অপারগ হলে,বাকী তিন ভাই ভিড়তেন আমজাদের কাছে। প্রতিটি সহোদর তার চোখের মণি। কিন্তু আফতাব যেন একটু বেশিই সমীহ পেতেন। পিঠাপিঠি,সাথে আফতাবের ভদ্রতা,সভ্যতা আবার বাকী দুজনের চেয়ে তার চোখে অঢেল শ্রদ্ধার বর্ষন দেখে টান, মায়াও ছিল বাকীদের চেয়ে বাড়তি।
সেই ভাইয়ের কাজে তিনি নিজেও চমকেছেন,আশ্চর্য হয়েছেন। জমির রা*গে কাঁ*পছিলেন প্রায়। চি*ৎকার,চেঁচামেচিতে ভরে গিয়েছিল বাড়ির বসার ঘর। তাদের মা তখন দিশেহারা। কী রেখে কী সামলাবেন!
রুবায়দা গুনগুন করে কাঁ*দছিলেন। আফতাবের মস্তক নীচু। বাবার চোখের দিকে একটি বার সে তাকায়নি অবধি। রাগা*রাগির এক পর্যায়ে জমির বললেন,
‘ ও বেকার,বিয়ে করে বউ আনল,খাওয়াবে কী? ওকে কে খাওয়াবে?’
আফতাবের বলার কিছু নেই তখন। উত্তে*জনায় ওইসময় অত কিছু মাথায় আসেনি। সেই ক্ষনে আমজাদ এক কথায় ঘোষণা করলেন
‘ আমি খাওয়াব আব্বা।’
সকলে অবাক হয়ে তাকালে তিনি বললেন ‘ ‘আফতাব আগেও যা খেত এখনও তাই খাবে। রুবায়দার জন্যে এক প্লেট বাড়তি ভাত লাগবে তাইতো? সমস্যা নেই,সেই ভাতের হিসেব না হয় আমার সাথে করলেন!’
শুধু আফতাব নয়,বাকী দুই ভাইয়ের মাথা শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে গেল তার প্রতি। জমির কিছু বলতে পারলেন না আর। রা*গে গজগজ করে প্রস্থান নিলেন সভা থেকে।
আফতাবের পড়াশুনা শেষ করে চাকরি নেয়া অবধি আমজাদ সামলেছেন সব। রুবায়দার মত লক্ষীমন্ত রমনীর, শ্বশুর কে কাবু করতে বেশিদিন লাগেনি। শ্রদ্ধা,যত্ন,ভালোবাসা দিয়ে গলিয়ে দিলেন জমিরের শ*ক্ত ভীত। একটা সময় এই মেয়েকেই চোখে হারাতেন তিনি। পরিবারের স্বাভাবিকত্ব আর সুখ দুয়ারে দাঁড়িয়ে তখন।
তার মধ্যে ওনার মৃ*ত্যু আবার হাজির করল শো*কের ঘনঘটা।
আমজাদের ঘাড়ে বর্তাল পরিবারের সকলের দ্বায়ভার। আফতাব পরীক্ষা শেষের আগেই চাকরীর জন্যে বিভিন্ন স্থানে আবেদন শুরু করলেন। অন্তত ভাইয়ের থেকে কিছুটা বোঝা নিজের কাঁধে নেবেন বলে। লাভ হয়নি। তাদের মা পরামর্শ দিলেন বাসার দুটো রুমে ভাঁড়াটে তোলার। কিছু হলেও টাকা আসবে। দুই ভাইই নারাজ তাতে। নিজেদের বাড়িতে অন্য লোক তুলবেন কেন?।
শেষে দুজন মিলেমিশে পরিকল্পনা করলেন ব্যবসা করার। বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয় যোগ করলেন। তখন রুবায়দার পেটে বেড়ে উঠছে ধূসর। তার ও তো বাড়তি যত্নের প্রয়োজন! আমজাদের সঙ্গে মিনা বেগমের বিয়ে হয়েছে নতুন। কিন্তু ওইটুকু সঞ্চয় তাদের পরিকল্পনা মাফিক ব্যবসার জন্যে যথেষ্ট হয়নি। তাদের মা সাহারা হলেন সে সময়। নিজের সব গয়না বের করে তুলে দিলেন ছেলেদের হাতে। দেখাদেখি রুবায়দা আর মিনাও অনুসরন করলেন একই পথ। নাকফুল আর চুড়ি দুটো বাদে সমস্ত কিছু দিয়ে দিলেন। ওই অর্থ মিলিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু হলো। দুই ভাই রাতদিন গাধার মত খাটলেন। ব্যবসা দাঁড় করাতে ত্যাগ করলেন আরামের ঘুম। বিনীদ্র রজনী বশ করল তাদের সহধর্মিণীদেরও। আস্তেধীরে ব্যবসা গড়ে ওঠে। শ*ক্ত পোক্ত ভীত,মজবুত হতে শুরু করে। গোডাউন একটার জায়গায় দশটা তৈরী হলো।
বাসে- ট্রামে যাতায়াতের পথে ব্যবহার হলো নিজস্ব গাড়ি। আফতাব কোথাও গরমিল করলে,আমজাদ বুদ্ধি দিয়ে সব মিটিয়ে ফেলতেন। বড় বড় ক্লায়েন্ট সামলাতে হয় তাকেই। আফতাব লম্বাচওড়া ছিলেন,তবে বুদ্ধীন্দ্রিয়ে পাকা-পোক্ত নয়। সেদিক থেকে আমজাদ করেছেন সব। ভাইকে বিশ্রামে পাঠিয়ে নিজে ঘাম ফেলেছেন। ভাইদের জন্যে বউ হিসেবে বেছে বেছে রত্ন খুঁজে এনেছেন। প্রত্যেককে শিখিয়েছেন,কীভাবে নিজেদের ভালোবাসতে হয়। এই বিরাট পরিবারে তিনি এক দরদী বাজপাখি। আর ভাইদের নিকট ফেরেস্তাতূল্য!
এই পরিজন সে আগলে রাখলেও, ভাইদের ছেলেমেয়ের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্কের কথা কোনও দিন মাথায়ও আনেননি। আজমলের আবদার সবথেকে বেশি ভড়কে দিয়েছে তাকেই। সাথে বসার ঘরেও পিনপতন নীরবতা নেমেছে, ওই এক ঘোষনায়।
নিস্তব্ধ হয়ে পরেছে সকলে। হতবাক চেহারায় একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো কিছুক্ষণ। আমজাদ বিস্ময়ের তোপে খানিক সময় ভাইয়ের দিক হা করে চেয়ে রইলেন। ধাতস্থ হতে বিলম্ব হলো। তারপর ত্রস্ত ভঙিতে চায়ের কাপ টেবিলে রাখলেন। আজমল একটু লজ্জা পেলেন। এমনিতেই প্রস্তাবখানা রাখতে অস্বস্তি হচ্ছিল তার। যা সবার প্রতিক্রিয়া দেখে দ্বিগুন হলো এখন।
বিভ্রান্ত নজর একবার স্ত্রীর চেহারায় বোলালেন। তাকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে। আজমল দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার ভাইয়ের পানে তাকালেন। ইতস্তত করে বললেন,
‘ ইয়ে,আমি কি কোনও ভুল কিছু চেয়ে বসলাম ভাইজান?’
আমজাদ নড়ে উঠলেন। ওষ্ঠযূগল মিলিত হলো। গলা খাকাড়ি দিয়ে সামলালেন নিজেকে। সকলের বিস্ময়াবহ ভাবমূর্তি কে*টে গেল ওমনি। তিনি
সংশয় সমেত শুধালেন
‘ তুমি কি কথাটা নিশ্চিত হয়ে বললে আজমল?’
আজমল একটু চুপ থেকে বললেন,
‘ জি। আসলে, আমারও পুষ্পকে পছন্দ,সাথে জবারও। দুজনেই পরামর্শ করে ঠিক করলাম ওকে সারাজীবনের জন্যে আমাদের কাছেই রেখে দিই। মেয়েকে আজ না হোক কাল পরের ঘরে তো দেবেনই। আমাদের কাছেই থাকল না হয়!’
বলতে বলতে তার হাতটা পুষ্পর মাথায় বুলিয়ে গেল। মেয়েটার বিস্ময়াহত চাউনী তখনও অনড়। অগ্রমস্তিষ্ক ছি*ন্নভিন্ন। স্নায়ুতন্ত্র বিবশ,বিদীর্ণ।
আমজাদ মাথা নামিয়ে তাকিয়ে রইলেন মারবেল মেঝেতে। স্থূল মুখস্রী দেখে সকলে একটু ঘাবড়ে যায়। আমজাদ চুপ রইলেন। যেন গহীন প্রণিধানে ভাবছেন। একে অন্যকে ভ্রুঁ উঁচায় তখন। ঘটনাচক্র ঠাওর করতে ব্যর্থ তারা। শেষে চোখ তুললেন তিনি। আগের থেকেও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ তুমি এরকম একটা প্রস্তাব কী করে রাখলে আজমল? আমিত সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি।’
পিউ এতক্ষণে কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠল। আশায় বুক বাঁধল বাবার কথায়। তবে কী বাবা মানা করে দেবেন?
আজমল ভীত হলেন। ভাইজান হয়ত নাখোশ হয়েছেন। তার কি আর একটু ভাবা উচিত ছিল? জবার কথায় স্বায় দিয়ে ভুল করে বসলেন না তো? এই জন্যে ভাইজান আবার ভুল না বোঝেন।
তৎপর, তটস্থ চাউনী সকলের। চোখমুখ কৌতুহলী। মিনা বেগম শ*ঙ্কিত নেত্রে চেয়ে। স্বামীকে সামলানোর জন্যে মুখ খুলবেন কেবল,আচমকা হো হো করে হেসে উঠলেন আমজাদ। উপস্থিত প্রত্যেকে চকিত,চমকিত। ভ্যাবাচেকা খেল এক কথায়। আজমল হাসবেন, না কি হাসবেন না, দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলেন। কয়েক পল বোকা বোকা চাউনীতে চেয়ে থাকলেন।
আমজাদ হাসতে হাসতে বললেন,
‘ এই দারুণ বিষয়টা আমার মাথায় আগে কেন আসেনি আজমল? ভাই থেকে বেয়াই হওয়ার বুদ্ধিটা কিন্তু মন্দ নয়।’
ছ্যাত করে উঠল পুষ্পর বক্ষস্থল। থমকে তাকাল বাবার দিকে। অথচ
স্বস্তির শ্বাস টানল সকলে। আজমলের ঠোঁটে তৎক্ষনাৎ হাসি ফোটে। উন্মুক্ত হয় শুভ্র দাঁত। কপালের ভাঁজ চটজলদি মিলিয়ে গেল। বাকীদের ঠোঁট দুলে উঠল খুশিতে। তিনি আগ্রহ ভরে শুধালেন,
‘ তাহলে আপনার রাজী ভাইজান?’
‘ রাজী মানে? আলবত রাজী। তুমি মুখ ফুটে চাইলে আমি দেব না,এমন হয়েছে?’
পিউ চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এমন যে হবে সে আগেই জানত।
আজমলের জবাব,
‘ জি না।’
‘ তাহলে আবার জিজ্ঞেস করলে কেন? আমার মেয়ে আজ থেকেই তোমাদে সম্পদ ধরে নাও আজমল। মেয়ে পেলেপুষে দূরে পাঠানোর যা*তনা থেকে বাঁচিয়ে দিলে। ‘
জবা বেগম হুড়মুড়িয়ে ছুটে গিয়ে মিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরলেন। ভদ্রমহিলা পরতে পরতেও সামলালেন নিজেকে। জবা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন ‘ ‘ আপা আমরা বেয়াইন হয়ে যাব।’
মিনা হাসলেন। পালটা জড়িয়ে ধরলেন তাকে। সকলে যখন হাসছে, পুষ্পর চেহারায় পরতে পরতে ছুটছে আমাবস্যা। হত*বুদ্ধি সে,নির্বাক। কী বলবে, কী করবে জানেনা। কম্পিত নেত্রে সামনে বসা সাদিফের দিক তাকায়। সে সুস্থির ভঙিতে কাপে চুমুক দিচ্ছে। মুখস্রীতে উত্তেজনা,উদ্বেজনা কিচ্ছু নেই। মানুষটি তুলনামূলক নির্বিকার,নিষ্প্রভ। যেন কিছু শোনেনি,কিছু ঘটেনি।
রুবায়দা ছুটে গেলেন ফ্রিজ থেকে মিষ্টি আনতে। সুমনা বললেন,
‘ তাহলে সবাই মিলে বিয়ের একটা দিন পাঁকা করি?’
‘ কার বিয়ের কথা হচ্ছে?’
ধূসরকে দেখে,এই এতক্ষণে পিউয়ের প্রানে পানি এলো। তীব্র আশা ফুটে উঠল চেহারায়। আনিস বললেন,
‘ এসেছিস,আয় বোস এখানে।’
ধূসর গিয়ে বসল। আজমল বললেন,
‘ এটাই বলতে চাইছিলাম তখন,আমাদের ইচ্ছে পুষ্পর আর সাদিফের দু জোড়া হাত এক করার। ‘
পিউ আগ্রহভরে, ফের নড়েচড়ে বসল। উদগ্রীব,উতলা সে। ধূসর ভাই সাহসী মানব। কাউকে পরোয়া করেন না। নিশ্চয়ই এক্ষুনি বলে দেবেন আপুর মনের কথা। সবাইকে গুরুভার কণ্ঠে ঘোষণা দেবেন,
‘ এই বিয়ে হবেনা। কারণ পুষ্প, ইকবাল কে পছন্দ করে। ‘
হ্যাঁ এক্ষুনি বলবেন।
অথচ তাকে বিমূর্ত করে দিয়ে ধূসর বলল,
‘ ভালো সিদ্ধান্ত।’
পিউ আশ্চর্য বনে যায়। ওষ্ঠ ফাঁকা হয় নিজেদের শক্তিতে।
সে পরমুহূর্তে আবার বলল,
‘ তা যাদের বিয়ে দেবে তাদের মতামত নিয়েছেন চাচ্চু?’
আজমলের টনক নড়ল যেন। কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত হলেন। বাকীদের অবস্থাও তাই হয়। যাদের বিয়ে দেবে তাদের মতামত নেবেনা?
তিনি শশব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, সাদিফ বাবা!’
সাদিফ এতক্ষণে তাকায়। চশমার সাদা গ্লাস ভেদ করে তার নিষ্প্রাণ দৃষ্টি অবধি পৌঁছাতে পারেনা কেউ।
তিনি রয়ে সয়ে শুধালেন ‘ বিয়েতে তোমার আপত্তি নেইত?’
পিউ নীচের দিক চেয়ে দুদিকে মাথা নাড়ল। সাদিফ ভাইয়ের উওর ওর জানা। উনিতো আপুকে পছন্দ করেন। তার ওপর ইকবাল ভাইয়ের বিষয়েও কিছু জানেন না। ‘না’ বলার প্রশ্নই আসেনা এখানে। ‘ হ্যাঁ’ ই বলবেন। সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনফার্ম।
পুষ্পর ব্যকুল নেত্রযূগল সাদিফের দিকে নিবদ্ধ। তার কন্ঠনালী কা*পঁছে। ভেতর ভেতর ছট*ফটে ভঙিতে অনুরোধ করছে,
‘ না বলো ভাইয়া,প্লিজ না বলো।’
প্রত্যেকের জিজ্ঞাসু চাউনী যখন সাদিফের ওপর,সে তখন গাঢ় দৃষ্টিতে মেঝের দিক চেয়ে রয়। চোখ না তুলেই, ঠোঁট নেড়ে জানায়,
‘ না। তোমাদের ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।’
পুষ্পর বুক ভে*ঙে এলো। হৃদয় ভ*গ্ন হলো হতাশায়৷ পিউ আবার সন্তর্পনে চ বর্গীয় শব্দ করে। জানতো এমনটাই হবে। সাদিফ ভাই ইজ আ বেস্ট বয় ইন দ্য ফ্যামিলি কী না!
সে গুটিকতক ভরসা জড়োসড়ো করে ধূসরের পানে পুনরায় তাকাল। সবার মধ্যে পারলনা চিল্লিয়ে নিবেদন করতে। কিন্তু তার ভেতরটা অধৈর্য ভীষণ। সে চেঁচায়,
‘কিছু করুন ধূসর ভাই,কিছু করুন। ‘
ছেলের উত্তরে জবা বেগমের বক্ষ থেকে পাথর নেমে গেল। গাল ভরল হাসিতে। উদ্বীগ্ন চোখেমুখে দেখা গেল সূর্যকিরণ। যাক! তাহলে তিনি ভুল ভাবেননি,সাদিফের তবে পুষ্পকেই পছন্দ।
সবার উজ্জ্বল চেহারা ধূসর একবার একবার দেখল। বেশ মনোযোগ সেই পরিদর্শনে।
নিশ্চিন্ত মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে চট করেই বলল,
‘ সবে তো একজনের মতামত নেয়া হলো,পুষ্পর মতামত? ‘
পিউয়ের নেতিয়ে যাওয়া মুখস্রী, মুহুর্তমধ্যে সতেজ হলো।
উত্তরাশার কুটি কুটি চারা বক্ষে রোপন করল সবেগে। অতিদ্রুত বোনের দিক তাকাল ফের। বিড়বিড় করে বলল ‘ আপু বল তুই রাজি না।’
পুষ্পর পুরো শরীর কাঁ*পছে। জ্বিভ বিবশ। কথা ফুটছে না। ধূসর তখনি পুরূ স্বরে ডাকে,
‘ পূষ্প?’
সে ত্রস্ত, ক্লান্ত,চোখ তোলে। অবরুদ্ধ কণ্ঠে জবাব দেয় ‘ জজি!’
ধূসর পূর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘ বিয়েতে তুই রাজি?’
মেয়েটা ভীতু,অচঞ্চল। বাবা-চাচাদের সামনে মাপঝোঁক করে কথা বলেছে সব সময়। চোখ তুলে অবধি দেখেনি। প্রত্যুত্তর করেনি।
সেখানে আজ না বলবে? পারবে বলতে?
এক ঘর মানুষের মধ্যে যদিও বা না বলে বসে, তারপর কী হবে? কতগুলো প্রশ্ন বাণ ছো*ড়া হবে আন্দাজ করলেই ঘামছে। হচ্ছে আতঙ্কে আঁটশাট। গলবিলটা তখন মরুভূমি প্রায়। যেন তৃষ্ণায় শহীদ হবে। একটু পানি পেলে ভালো হতো!
ধূসর ধৈর্যহীন হয়ে বলল ‘ কী হলো?তুই রাজি?’
পুষ্প শুকনো ঢোক গে*লে। অতিক*ষ্টে,বেগ সমেত সাহস জমায় বক্ষে। না বলার জন্যে, হা করতে যায়,অথচ কথা ফোটার আগেই আমজাদের রাশভারি কণ্ঠে শোনা গেল,
‘ অবশ্যই রাজি। আমার মেয়েকে আমি চিনি। সে আমাদের মতের বাইরে কখনওই যাবেনা। মুখের ওপর আপত্তি করার শিক্ষা তারা পায়নি। আমাদের পছন্দ যে তাদের জন্যে খা*রাপ হবেনা তারা অবগত। এইটুকু বিশ্বাস আমাদের আছে। তাইত পুষ্প মা?’
বাবার আত্মবিশ্বাস,অহং*কার আর গর্ব দেখে পুষ্পর কথা মুখেই আটকে গেল। ঠোঁটগহ্বর থেকে জ্বিভটা আর বের হওয়ার জোর পেলো না আর। ঘোলা চোখে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। জবা উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন,
‘ কী রে, তাই কী? বল কিছু ।’
পুষ্প অবসাদগ্রস্ত ভারী চোখ নামিয়ে নিলো। ভারা*ক্রান্ত মন চে*পে রেখে, মন্থর বেগে ওপর নীচে মাথা দোলাল। নিরবে বোঝাল ‘ হ্যাঁ ‘।
পিউ বিহ্ববল হয়ে দেখে গেল তা।
ধূসর হেসে বলল ‘ গুড।’
বিস্ময়ে পিউয়ের মাথা চক্রের ন্যায় ঘোরে। একবার পুষ্পকে দ্যাখে, একবার ধূসরকে। এরা দুজন এরকম করছে কেন? ধূসর ভাই সব জেনেশুনেও বা….
আমজাদ সূক্ষ্ণ হাসছিলেন। ধূসরের মুখে ‘ গুড’ শুনতেই হাসিটা উবে গেল। ভীষণ অবাক হলেন। মেয়েকে বলা কথাখানা তিনি যে ইনিয়ে-বিনিয়ে ওকে খোঁচা মা*রতে বলেছেন,ছেলেটা কি বোঝেনি? এত নির্বোধ তো সে নয়। বুঝলেও হাসল কেন তাহলে ?
তিনি নিজেই ভ্রান্তিতে তলিয়ে গেলেন। কূল পেলেন না ধূসরের রহস্যের।
মিনা বেগম ঘুরে এসে স্বামীর পাশে বসলেন। হাত নাড়িয়ে স্ফূর্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ তবে না হয় ভালো দিনক্ষণ দেখে, আংটি বদলের দিনটাও পাঁকা করব? কী বলিস ধূসর?’
ধূসর বলল ‘ করো।’
রুবায়দা পিরিচে মিষ্টি নিয়ে হাজির। আমুদে গলায় বললেন, ‘ তার আগে সবাই মিষ্টিমুখ করো দেখি। নে জবা তুই আগে খা।’
বলতে বলতেই একটা আস্ত রসগোল্লা ঠুসে দিলেন তার মুখে। সবাই হেসে ফেলল।
হৈহৈ পরিবেশ থেকে অকষাৎ পুষ্প উঠে দাঁড়াল। কাউকে কিছু না বলে ঘরের দিকে রওনা হলো। জবা বেগম হেসে বললেন,
‘ লজ্জা পেয়েছে!’
সাদিফের কাপের চা শেষ হচ্ছেনা আজ। হাতল ধরা আঙুল গুলোও হালকা, পাতলা কম্পমান। তবুও বাইরে থেকে তার সাদাটে চিবুক পাথরের ন্যায় শক্ত,উদ্বেগহীন।
পিউ বোনের যাওয়ার দিকে বেদ*নাদায়ক, সহায়হীন চোখে চেয়ে থাকে। ধূসরের দিক ফিরতেই দেখল সে শান্ত নজরে তার দিকেই তাকিয়ে। ঠোঁটের ভাঁজে মিটিমিটি, পুরুষালি হাসিটা পিউয়ের মেজাজ খা*রাপ করল। নাকমুখ কোঁচকাল সে। এতদিন পেছনে,মনে মনে ধূসরকে হাজার হাজার ভেঙচি কে*টেছে । কিন্তু আজ,মাথাটা গরমে দাউ*দাউ করে জ্ব*লছে। প্রবল সাহসে বুকটা ফুলে ওঠে তার। ধূসরের মুখের ওপর ভেঙচি কে*টে চেহারা ঘুরিয়ে নেয়। হনহন করে নিজেও প্রস্থান নেয় বোনের পিছুপিছু।