“ভালোবাসি” শব্দটা উচ্চারন করার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাম গালে শক্তপোক্ত এক চ*ড় বসালেন ধূসর ভাই। কান,মাথা,গাল ঝিমঝিম করে উঠল আমার। ভোঁ ভোঁ করে ঘুরল সমগ্র পৃথিবী। হতবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। ধূসর ভাইয়ার র*ক্তাভ চোখদুটো আমাতেই নিবদ্ধ। ক্রো*ধে ফুঁ*সছে তার চোখা নাক। এই আঠের বছরের জীবনে কোনওদিন মা*র না খাওয়া আমি, আজ যেন কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে ঘুরছে,
” ধূসর ভাই আমায় চ*ড় মারলেন?”
রু*দ্রমূর্তি ধারনকারী ধূসর ভাইয়াকে দেখে আমার অন্তরা*ত্মা শুকিয়ে যাওয়ার যোগাড় হয়। উনি বিদ্যুৎ বেগে সুদৃঢ় হাতে আমার কনুই চে*পে ধরে বললেন,
” খুব সাহস বেড়েছে তোর তাইনা?
এতটা নি*র্লজ্জ্ব হয়েছিস যে,আমার সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলতে জিভে আটকালোনা?
ওনার ধম*কে আমার ছোট্ট শরীরটা ক*ম্পিত হয়। থরথর করে হাঁটু কাঁ*পে। তবুও খুব ক*ষ্টে সাহস যুগিয়ে বললাম,
” আমি,আমি কী করব? আপনিইতো সত্যিটা শুনতে চাইলেন। ”
উনি আরো জোরে হাত চেপে ধরলেন। ব্যাথায় মুচ*ড়িয়ে উঠলেও ছাড়লেন না,তোয়াক্কা দেখালেন না। উলটে রা*গে আ*গুন হয়ে বললেন,
” তোর জিভ টে*নে ছি*ড়ে ফেলব পিউ। তুই আমায় চিনিস না। ভবিষ্যতে তোর মুখ থেকে এসব যেন না শুনি।”
আমি হেরে যাওয়ার পাত্রী নই। ভ*য় পেলেও কাঁপা কণ্ঠে বিরোধিতা জানিয়ে বললাম,
” কেন বলবনা আমি? আমি কি কাউকে ভভালোবাসতে পারিনা? কাউকে ভালো লাগতে পারেনা আমার? আপনিই বা কেন এত রিয়্যাক্ট করছেন,আপনি বুঝি কাউকে ভালোবাসেন না?”
ধূসর ভাইয়ার ভ্রুঁ শিথিল হলো ওমনি। আমি স্পষ্ট খেয়াল করলাম ওনার বদলে যাওয়া অভিব্যক্তি। কিছুক্ষন অমত্ত হয়ে চেয়ে রইলেন। পরপরই চিবুক শ*ক্ত করলেন। দাঁত খিঁ*চে বললেন,
” এক থা*প্পড়ে তোর সব দাঁত ফে*লে দেব বে*য়াদব! তোর বয়স কত? ভালোবাসার কী বুঝিস তুই? পড়াশুনার নাম করে কলেজে গিয়ে এসব করছিস ?
ওকে ফাইন! তোকে তো আমি পরে দেখছি,আগে দেখে আসি, তোকে প্রেমপত্র দেয়া সেই দুঃ*সাহসী আশিককে।”
কথাটা শুনেই আমার চোয়াল ঝুলে পরল। ধূসর ভাইয়া আমার হাতখানা ছাড়লেন না,যেন সজো*রে ছু*ড়লেন। আমার দিকে আক্রো*শপ্রসূত চাউনী নিক্ষেপ করে গটগটিয়ে ঘর ছাড়লেন। এদিকে আত*ঙ্কে ঘাম ছুটে গেল আমার। ধূসর ভাইয়া মা*রাত্মক লোক। মা*রপিটে পি-এইচ-ডি প্রাপ্ত। ওনার বিশ্বাস নেই। রা*গের মাথায় কী না কী করবেন!
আমি তড়িঘড়ি করে ফোন তুললাম হাতে। কন্টাক্ট লিস্ট খুঁজতে গিয়েও হাতের প্রতিটি আঙুল কাঁপছে
। চটজলদি ডায়াল করলাম রবিনের নম্বরে। ছেলেটা ধরল না। কোথায় ম*রে গেছে কে জানে! এই মুহুর্তে ফোন না ধরলে ধূসর ভাইয়া সত্যিই ওকে ক*বর দিয়ে দেবেন। টানা কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো ফোন। ওপাশ থেকে রবিন অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
” পিউ! তুমি আমায় ফোন করেছো?”
আমার যতটা না ভ*য় লাগছিল এর থেকেও অধিক মেজাজ খারা*প হলো রবিনের মুখে তুমি শুনে। ও কিন্তু বরাবর আমাকে তুই বলে সম্বোধন করতো। বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে এই তুমিময় নাটক। আমি খুব তাড়াহুড়ো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” কোথায় আছিস তুই?”
” কেন,দেখা করবে না কী?”
” চুপ কর। এই মুহুর্তে যেখানে আছিস পা*লা। কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পর। একটা কাজ কর,সেলুনে গিয়ে বসে থাক,ওটা সে*ফ জায়গা।”
রবিন ভ্রু কোঁচাকাল। আগামাথা না বুঝে বলল,
” কেন? কী হয়েছে? লু*কোতে যাব কেন?”
আমি হা হুতাশ করে বললাম,
” না লুকোলে তোর কপালে ভীষণ দুঃ*খ আছে রবিন। ধুসর ভাই তে*ড়ে যাচ্ছেন তোর কাছে। ”
রবিন তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
” ককেন? আমিতো কিছু করিনি। সেদিনের পর থেকে তোমাকে বির*ক্তও করিনি পিউ। তুমি কি ওনার কাছে আমার নামে না*লিশ করেছো?”
” না*লিশ করিনি। তবে ওনার হাতে তোর লেখা চিঠি আছে। এবার তুই ঠিক কর,পালাবি না ওখানেই বসে থাকবি। আমার সাবধান করার করলাম। জান বাঁ*চানো ফরজ,এই কথা মাথায় রেখে কোনও গর্তে গিয়ে লু*কিয়ে থাক। রাখছি।”
রবিন ঢোক গিলল। আ*তঙ্কিত হয়ে চারপাশ দেখল। কপাল বেঁয়ে দরদর করে পরে যাওয়া ঘামটা মুছেই চট করে দৌড় লাগাল। এদিকে আমি ফোনের লাইন কাটলাম। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে একটু ধাতস্থ হলাম৷ গালের হাড় ব্যা*থায় টনটন করছে। কী মা*রটাই না মে*রেছে পা*ষান লোক!
সত্যি বলতে ধূসর ভাইয়ের থা*প্পড় খেয়ে আমার খারাপ লাগেনি,না লেগেছে ক*ষ্ট। কারন আমি তৈরি ছিলাম। আমি জানতাম, ওনার সামনে অন্যকাউকে ভালোবাসি কথাটা উচ্চারন করতে দেরি হলেও আমার গ*র্দান ছেদ হতে দেরি হবেনা। কিন্তু কী করব আমি? এছাড়া উপায়ও তো ছিলনা। ধূসর ভাইয়ের মুখ থেকে একটা সত্যি কথা শোনার আশায় আজ তিনটে বছর এভাবেই কাটছে। কীই না করেছি! কত চেষ্টা চালিয়েছি,কত পন্থা অবলম্বন করেছি। কিন্তু না,কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাইনি। আমি আজও বিভ্রমে ভুগি,
” ধূসর ভাই আমায় ভালোবাসেন? না কি বাসেননা? ”
উত্তরগুলোও আমারই মতো বিভ্রান্ত। তারা একবার বলে হ্যাঁ, পরের বার না। তবে উনি আমায় ভালোবাসুক আর না বাসুক, আমি যে ওনার প্রেমে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছি এতে কোনও ভুল নেই। ওনার প্রতি অনুভূতি আমার অতলস্পর্শী সমুদ্রের ন্যায়।
উনি সামনে এলেই আমার হৃদয় কাঁ*পে,কেমন অস্থির অস্থির লাগে। মনে হয় আমি নেই,হাওয়ায় ভাসছি। উড়ছি মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে। মাঝেমধ্যে তো লজ্জ্বা শরম বিসর্জন দিয়ে ক্যাবলা বনে চেয়ে রই ওনার দিকে। আমার এই সর্বনা*শের শুরু হয়েছিল সেদিন, যেদিন প্রথম দেখেছিলাম ওনাকে।
ধূসর ভাইয়া আমার চাচাতো ভাই। মেজো চাচ্চুর একমাত্র ছেলে। অথচ ভাইবোনের দিক থেকে সবার বড়। আমাদের এএকান্নবর্তী পরিবার। আব্বুদের চার ভাইয়ের আন্ডাবাচ্চা ধরলে সে এক মস্ত বড় তালিকা। ভাইদের মধ্যে আমার আব্বুই সবার বড়। বিষয়টা একটু ওলটপালট। হিসেব মত বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়ে বড় হলেও এদিক থেকে আব্বু অনেক পিছিয়ে। কারন আব্বুর আগেই মেজো চাচ্চু বিয়ে করে বউ এনেছিলেন ঘরে। চাচির নাকী অন্যকোথাও বিয়ের তোরজোর চলছিল। আবার অন্যদিকে সেজো চাচ্চুর ছেলে সাদিফ ভাই সেও আমার বড়। সম্পর্কে ঠিক হলেও বয়সটা কম্পলিকেটেড।
সে যাক গে, আমার বয়স যখন আট? ধূসর ভাইকে পড়াশুনার জন্যে পাঠানো হয় নিউইয়র্কে। পাক্কা সাত বছর বিদেশে কাটিয়ে ভাইয়া দেশে ফিরলেন। যেদিন ওনার আসার কথা, কী উৎসবটাই না লেগেছিল বাড়িতে! আত্মীয় স্বজনের উপচে পরা ভীড়ে পা রাখার জো ছিলনা। সকলের উৎকন্ঠিত অপেক্ষার ইতি টেনে ধূসর ভাই কদম রাখলেন বাড়িতে। বড় বড় মানুষের মধ্য দিয়ে আমি কোনওরকমে খরগোশের মত ঢুকিয়ে উঁকিঝুঁকি দিলাম ওনাকে দেখতে। ঠিক যেই মাত্র দেখেছি,হাহ! বিনাদ্বিধায় নাম লেখালাম এই প্রেম নামক সমূহ বিনা*শের খাতায়। রীতিমতো পিছলে পরলাম ওই ইয়া লম্বা-চওড়া মানুষটার প্রেমে। এত সুদর্শন,সুপুরুষ আমার চাচাতো ভাই,ভাবতেই আমার চিত্ত অম্বর ঘন কালো মেঘে ছেঁয়ে গেল। ওনার পাশে ‘ ভাই’ শব্দটা একটুও মানতে ইচ্ছে করল না। কেন এই লোক আমার ভাই হবেন? পরিবারের বাকীরা ওনাকে ভাইয়া, ভাইয়া বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও আমি কখনোই ওনাকে ভাইয়া বলে ডাকিনি। ছয় ফুটের অত বড় একটা লোককে ‘ ‘ধূসর ভাই ‘বলে সম্বোধন করেছি। এভাবে তো মানুষ পাড়াপড়শিকেও ডাকে তাইনা? ওনাকে সম্বোধনের দিক দিয়ে যত দূরে ঠেলব, মনের দিক দিয়ে তত কাছে আসবেন।
কিন্তু উনি! উনি একটা ফা*লতু লোক। একটা গ*র্দভ, বোকারাম! আজ তিন তিনটে বছর আমি ওনার চোখের সামনে ঘুরঘুর করে এত এত প্রেম ঢেলে দিচ্ছি, অথচ ওই মানুষটার চোখেই পড়ছেনা? সে দুনিয়ার সব বোঝে,বোঝেনা শুধু আমাকে। যেন প্রেম কী আদৌ জানেনা। ছেলেদের বেশি সুন্দর হতে নেই,হলেই তাদের অহংকার বেড়ে যায়। এই যেমন ওনার আকাশচুম্বী ভাব। উনি আমাকে মনে করেন ড্রেনের ময়লা পানি। যা দেখলেই নাকমুখ কুঁচকে আসবে। আমাকে ধ*মকানো যাবে,রা*গানো যাবে,আজকের পর মা*রাও যাবে।।কিন্তু ভালোবাসা যাবেনা। কখনও ভালো করে তাকায় অবধি না সে লোকের আবার ভালোবাসা! ভাবতেই আমার মন ছোট হয়ে এলো। কাঁ*দোকাঁ*দো চেহারায় ঘর থেকে বের হলাম। ওমনি সামনে পরলেন আম্মু। বেখেয়ালে আমাকে একবার দেখে আবার সতর্ক চোখে তাকালেন।
” তোর গালে দাগ কীসের?”
চট করে গালে হাত বোলালাম আমি। আমতা-আমতা করে বললাম,
” কই,কীসের দাগ?”
আম্মু চিন্তিত হয়ে এগোতে ধরলেন। আমি তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে এক পা পেছনে গিয়ে বললাম,
” মশা কাম*ড়েছে আম্মু,সত্যি বলছি।”
” মশা কাম*ড়ালে আঙুলের ছা*প বসবে কেন? কেউ মে*রেছে?”
আম্মুর উদ্বিগ্ন প্রশ্নে আমি একবার ভাবলাম বলে দেব। বলব যে আমাকে তোমাদের আদরের ধূসর আকাশ বাতাস কাঁ*পিয়ে এক চ*ড় মেরেছে। পরক্ষনেই দমে গেল সেই ইচ্ছে। ধূসর ভাইয়ার বিচার কখনওই হবেনা। আম্মু, আব্বু তো জীবনেও করবেন না। উলটে আমাকেই ধম*কে বলবেন,
” নির্ঘাত তুই কিছু করেছিস!”
আর তারপর যদি ধূসর ভাই সত্যিটা বলে দেন? আমি যে ওগুলো ওনাকে রা*গাতে বলেছিলাম,সেতো আর উনি জানেন না। সব দো*ষ আমার!
আজ কলেজ ছুটির সময় আমারই ক্লাশমেট রবিন একটা চিঠি গুজে দিয়েছিল আমার হাতে। আমি কিছু বলার আগেই দৌড়ে পালাল। আমিতো চিঠি বয়েও আনিনি। না পড়েই ফেলে দিয়েছি। অথচ ধূসর ভাইয়ের কানে ঠিক পৌঁছে গেছে সেই বার্তা। ওয়াশরুম থেকে কেবল মাত্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েই দেখছি আজরাইল সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতেই কটমটে কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন,
” ছেলেটা কে?”
আমি বেশ কয়েকটি উপন্যাসে পড়েছিলাম, নায়ক জেলাসিতে মুখ ফস্কে বলে দেয় ভালোবাসার কথা। সেই ট্রিক্স কাজে লাগাতে কথার এক পর্যায়ে ইচ্ছে করে বলেছিলাম ‘রবিনকে ভালোবাসি ‘আমি। কিন্তু এর শেষটায় কী হলো? ওনার মুখ থেকে কিছুতো বের হলোইনা উলটে প্রকান্ড থা*প্পড় খেয়ে আমি উলটে পরলাম। ভেবেই দীর্ঘ ব্য*থিত এক নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।
আম্মু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
” কী ব্যাপার? কথা বলছিস না কেন? কে মে*রেছে তোকে?”
আমার সম্বিৎ ফিরল। কথা ঘোরাতে বললাম,
” কে মারবে? কী যে বলোনা! তুমি কী কাজে যাচ্ছিলে যাওনা আম্মু। আমার অনেক তাড়া,দাঁড়ানোর সময় নেই।”
মিছিমিছি ব্যস্ততা দেখিয়ে একরকম পালিয়ে এলাম। পেছন থেকে আম্মু অনেকবার ডেকেও আমাকে দাঁড় করাতে পারলেন না।
আমি গিয়ে উঁকি দিলাম সাদিফ ভাইয়ার ঘরে। আস্তে করে ডাকলাম,
” ভাইয়া! ও ভাইয়া!”
না,সাড়া এলোনা। ভাইয়া তো এ সময় বাসায়ই থাকেন। আজতো রবিবার। তবে কী ছাদে? ঘুরে তাকাতে যাব ওমনি একটা প্রসস্থ বুকের সঙ্গে ধা*ক্কা লাগল নাকে। পিছিয়ে পরে যেতে ধরলেই সাদিফ ভাইয়া যত্র হাত টেনে ধরলেন। টালমাটাল আমিটাকে সোজা দাঁড় করিয়ে বললেন,
” তুই কি সত্যিই এত পুষ্টিহীনতায় ভুগছিস পিউ ? সামান্য একটা ধাক্কা খেয়ে এভাবে পরে যায় কেউ? ”
আমি নাক ডলতে ডলতে ওনার দিকে তাকালাম। চোখে চশমা পরুয়া, ফর্সা, গোলগাল চেহারার ছেলেটাকে সরু চোখে নিরীক্ষন করে বললাম,
” আমি কি জানতাম আপনি আসবেন? উফ,ওটা শরীর না লোহা!
সাদিফ ভাইয়া কপাল গুঁটিয়ে বললেন,
” আমি তো তোর মত তুলো খাইনা। যাকগে,উঁকি মারছিলি কেন? ”
আমি ফটাফট বললাম ” একটা হেল্প চাই,করবেন?”
সাদিফ ভাইয়া ভ্রুঁ নাচালেন,
” কী হেল্প?”
আমি উশখুশ করতে করতে বললাম,
” ধূসর ভাইকে একটা ফোন করবেন?”
ভাইয়া চোখ ছোট করলেন,
” কেন? কী কাজ?”
” না মানে,শুনতাম উনি কোথায় আছেন!”
” তোর ফোন থেকে কর।”
আমি চুপসে এলাম। মাথা খা*রাপ?
এখন ওনাকে ফোন করব কি নিজের বিপদ বাড়াতে? তাছাড়া ধরবেন কী না তারই নেই ঠিক। সাদিফ ভাইয়া কল দিলে একটা কথা ছিল। ধূসর ভাইয়ের চোখে মনি উনি। সাদিফ ভাইয়া বললেন,
” এখন ভাইয়াকে ফোন করা যাবেনা। সামনে ওদের দলের নির্বাচন, ব্যাস্ত থাকতে পারে। সেধেসেধে ধ*মক খাওয়ার ইচ্ছে তোর থাকতে পারে আমার নেই।”
আমি করুন কণ্ঠে বললাম,
” একটা ফোন দিননা প্লিজ!”
সাদিফ ভাইয়া কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি মুখটা আরো কা*লো করে ফেললাম। ভাইয়া ছোট করে বললেন,
” দিচ্ছি।”
আমার মুখ ঝলমলিয়ে ওঠে। ভাইয়ার দয়ার শরীর। কত ভালো লোক সে। দাঁত কপাটি বের করে বললাম,
” আপনি খুব ভালো! ”
সাদিফ ভাইয়া সেই একইরকম ঠান্ডা চাউনীতে তাকালেন। যেন পূর্ন দৃষ্টিতে পরোখ করছিলেন আমায়। পরপর নাকের ডগা থেকে চশমাটা ঠেলে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
ফোন তুলে কল দিলেন ধূসর ভাইয়ের নম্বরে। রিং হতে হতে কেটে গেলেও ধরলেন না তিনি। সাদিফ ভাইয়া আবার ফোন করলেন, এবারে কেটে দিলেন উনি। ভাইয়া আমার দিকে ফিরে বললেন,
” কেটে দিয়েছে,ব্যস্ত বোধ হয়।”
আমার চিন্তাটা তরতরিয়ে বাড়ল। রবিনটাকে কী খুঁজে পেলেন উনি? ছেলেটা শুধু শুধু কেলানি খাবে এবার। আমি না হয় ধূসর ভাই আসার আগে আগে দোর দিয়ে রুমে বসে থাকব। ভাণ করব ঘুমিয়েছি,নাহয় অসুস্থ। কিন্তু ও?
আমার চিন্তিত মুখস্রী দেখে সাদিফ ভাইয়া এগিয়ে এলেন। নরম কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
” কিছু হয়েছে তোর? ”
আমি তাকালাম। দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝালাম ‘না’। তারপর আস্তে করে বললাম,
” আসি।”
ভাইয়া কিছু বলতে চাইলেন,আমি না শুনেই রুমে এলাম। পেছনে সাদিফ ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আমি চি*ন্তায় সারা রুমজুড়ে পায়চারি শুরু করলাম। কী হবে এখন? কী করব আমি? কোনও একটা উপায় না পেয়ে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পরলাম বিছানায়। না, আর ভালো লাগছে না। এত অ*শান্তি নিতে পারছিনা আমি। চোখ বন্ধ করে হাত পা মেলে দিলাম। কী আশ্চর্য! এখানেও ধূসর ভাইয়ের তামাটে চেহারা ভেসে উঠছে। লোকটা ফর্সা নন,কিন্তু দেখতে মারাত্মক। সব থেকে মারাত্মক ওনার হাঁটাচলা,ওনার এটিটিউড,ওনার কথা বলার ভঙ্গি। নাহলে কী এক দেখাতেই প্রেমে পরি? উফ! এই লোক আমায় মে*রেই ফেলবে।
শুয়ে থেকে থেকে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি জানিনা। আমার ঘুম আবার ভীষণ গভীর। ওইসময় যদি আমাকে তুলে রাস্তায়ও ফেলে দেয়া হয় আমি নিশ্চিত, কিচ্ছু টের পাব না।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন বাইরে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। চোখ ডলে উঠে বসলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় বারোটার কাছাকাছি । এইরে,এতক্ষন ঘুমিয়েছি? পেট মুচড়ে উঠে জানান দিলো সে খাবার চাইছে। আনাচে-কানাচে ইঁদুর ছুটছে তার। আমি দ্রুত বিছানা হতে নেমে দাঁড়াই।
ধূসর ভাইয়া এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেন না। আজও নিশ্চয়ই আসেননি! উনি আসার আগে আগে খেয়েদেয়ে ঘুমোতে হবে। নাহলে আমাকে বাগে পেলেই আমি শেষ!
আপাতত সপ্তাহখানেক ওনার সামনে পরার ইচ্ছে আমার নেই।
আমি আস্তেধীরে দরজা খুললাম। আমার ঘুমানোর সময়টুকুতে কতজন যে ডেকে গেছে, তার হিসেব নেই আমি জানি। বাড়ির প্রত্যেকে জানে আমার কুম্ভকর্ণ ঘুমের কথা। সাড়া না পেয়ে নিশ্চয়ই বুঝেছে আমি মরার মত ঘুমোচ্ছি। বসার ঘরে নিভু নিভু আলো ব্যাতীত সারা বাড়ির আলো নেভানো। আমি পায়ের জুতো হাতে নিয়ে সিড়ি ভেঙে নামলাম,যাতে শব্দ না হয়। এরপর আলগোছে সাবধানে খাবার টেবিলের কাছে এলাম। টেবিলের ওপর প্লেটে ভাত বেড়ে রাখা। আম্মু বা চাচীরা কেউ একজন রেখেছেন। সবার খাওয়া শেষ, আমিই বাকী। ঘুম ভেঙে যে খাবার খুঁজব এ খবর তাদের আয়ত্তে। আমি জুতো মেঝেতে রেখে পায়ে পরলাম আবার। বেসিন থেকে হাত ধুঁয়ে এসে খাবারের ঢাকনা তুললাম। সাদা ভাতের ওপর ইলিশ মাছের টুকরোটা আমার খিদে বাড়িয়ে দিলো দ্বিগুন। ঝটপট বসতে গেলাম চেয়ারে। কিন্তু এর আগেই, আচমকা চেয়ার টেনে নিয়ে গেল কেউ একজন। ফলস্বরূপ আমি ধপাস করে প*রলাম ফ্লোরে। টাইলসের মেঝেতে অতর্কিত আক্রমন, আমার কোমড় থেকে পা অবধি ধরিয়ে দিলো ব্যা*থায়। প্রচন্ড ভড়কে, হকচকিয়ে পেছনে তাকালাম। চোখের সামনে ধূসর ভাইকে টানটান হয়ে দাঁড়ানো দেখে বুঝে নিলাম,
” আজকে আমি শেষ!”

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।