এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ৪৬

–আজ অনেকদিন পরে আম্মুদের বাসায় যাচ্ছি।এই প্রথমবার আমার এভাবে যাওয়া যেনো শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি।আগে তো যেমন তেমন ভাবেই যেতাম।আজ প্রথমবার অনুভব হচ্ছে আমি বিবাহিত।আজ তার বায়না আমি যেনো শাড়ি পরেই বের হই।আর আমাকে দেখতে যেনো ঠিক বউ বউ মনে হয়।তার অনুরোধেই আজ হলুদ শাড়ি পরে বের হলাম।

উনি কফি কালারের শার্ট পরেছেন সাথে ব্লু জিন্স ,শার্টের বোতাম খুলে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ অনেক্ষণ ধরে।কিছু একটা বলবেন বলে মনে হচ্ছে।আমি ড্রেসিন টেবিলের সামনে সাজুগুজু নিয়ে বিজি আছি।

‘আমি উনার কাছে গিয়েই জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলবেন?’

‘উনি দুঃখি দুঃখি মুখে বললেন,বোতাম খুলে দাঁড়িয়ে আছে দেখছো না।’

‘তো কি ব্যাপার বোতাম লাগাবেন না।’

‘উনি আমার হাত টেনে ধরে উনার বুকের কাছে নিয়ে বোতাম হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,বোতাম লাগিয়ে দাও শার্টের।তুমি দিবে বলেই দাঁড়িয়ে আছি।’

‘বোতাম লাগাতে লাগাতে বললাম, এতদিন তো একাই লাগিয়েছেন।’

‘আগেও চাইতাম তুমি লাগিয়ে দাও,ভাবতাম নিজে থেকে এসে লাগিয়ে দিবে।বাট আর দিলে না তাই নিজেই বলে ফেললাম।ভাবছি এইভাবেই নিজের সব অধিকার আমাকে আদায় করে নিতে হবে।’

আমি উনার মুখের দিকে লাজুকভাবে হাসলাম।

উনার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিয়ে মামা মামিদের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

বিভোর ভাই ও আমাদের সাথে যাচ্ছেন।আম্মু বলে দিয়েছে বিভোর যেনো আবশ্যই আমাদের সঙ্গে আসে।বিভোর ভাই নিজের বাইক নিলেন আর আমি আর উনি এক বাইকে যাচ্ছি।শাড়ির আঁচল ঠিকভাবে ধরে উনার কাঁধে হাত রেখে বসলাম।বাসা থেকে সোজা রুপগঞ্জে গেলেন বাইক নিয়ে।রুপগঞ্জের দিকে যেতে দেখে একটু অবাক হলাম।

‘বিহান ভাই কে বললাম,কি ব্যাপার রুপগঞ্জ এলেন যে।কি কিনবেন।’

‘আমাকে কি ছোটলোক মনে হয়।শ্বশুর বাড়ি কি খালি হাতে যাবো।এমনি বিয়ে করেছি অত্যাচারী রাজাকার বংশে।খালি হাতে গেলে আমার নামের পাশে ছোটলোক কিপ্টা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিবে।মানুষ বলাবলি করবে শ্বশুর ও যেমন কিপ্টা জামাই ও তেমন কিপ্টা।’

‘দেখুন বাবাকে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবেন না বলে দিচ্ছি।আমাকে কি কম গহনা দিয়েছে বাবা যে কিপ্টা বলছেন।’

‘একটু রাগি মুড দেখার জন্য ই বললাম।আমার শ্বশুর ইজ দ্যা বেষ্ট শ্বশুর আই নো পিচ্চি।তার হিরের থেকে দামী মূল্যবান জিনিস আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।’

বাইক থেকে মাছের গলিতে নামলাম আমরা।।

বিহান ভাই আর বিভোর ভাই মাছ কিনছেন।এত্ত বড় রুই মাছ কিনে নিয়ে যাবেন সাথে আবার চিংড়ি ইলিশ। এত মাছ কে খাবে।বাবাহ এত মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বিহান ভাই তো একটুও কিপ্টা নয়।এর ই মাঝে একটি শ্যামবর্ণের ছেলে এসে বিহান ভাই কে ডাকছেন।এই বিহান শোন।কিন্তু উনার কান পর্যন্ত কথাটা পৌছাচ্ছে না।ছেলেটি একভাবে ডেকেই যাচ্ছে।সো আমি নিজেই ডাক দিলাম বিহান ভাই আপনাকে ডাকছেন কেউ।

‘বিহান ভাই এগিয়ে এসে বললেন,আরে ভাই এখানে তুই।’

‘মেয়েটা কে বিহান।’

‘আমার বউ।’

‘তোর বউ তোকে ভাই ডাকে।এই জীবনে প্রথম দেখলাম বউ বরকে ভাই ডাকে।’

‘পুচকি মানুষ তো যা ইচ্ছা তাই বলে ব্যাপার নাহ।আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’

‘ছেলেটি চলে গেলে বিহান ভাই আমাকে বললেন,আজ ফুপ্পির কাছে এর বিচার দিবো।আমাকে ভাই ডেকে তার মেয়ে আর কতদিন নিহত করবে। ‘

‘তাহলে কি এই ভরা মাছের বাজারে বর বলে বলে ডাকবো।’

‘স্টুপিড আমার ফ্রেন্ড কি ভাবলো।এর শাস্তিস্বরূপ তোর জন্য এখান থেকে পাঙ্গাশ মাছ কিনে নিয়ে যাবো।’

‘এই দেখুন আমি ইলিশ,চিংড়ি ছাড়া অন্য মাছ ভাল পছন্দ করিনা।আর পাঙ্গাশ আমার বমি পায়।’

‘হ্যাঁ এইজন্য পাঙ্গাশ ই খাওয়াবো তোকে।’

কয়েক মিনিট পরেই বাড়িতে পৌছে গেলাম বাকি জিনিস গুলো কিনে।

রিয়া বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে, খোলা চুলে হালকা সাজগোজ বেশ সুন্দর লাগছে।আমরা বাড়িতে প্রবেশ করতেই রিয়ার চোখ আগে বিভোর ভাই এর উপর পড়লো।বিভোর ভাই হেলমেট খুলে রিয়ার দিকে তাকালেন।আহা কি চাহনি দুজনের।রিয়া বোধহয় আগে থেকেই জানতো বিভোর ভাই আসবেন।

বাবা ভাইয়া,আম্মু,কাকিমনিরা সবাই এগিয়ে এলো আমাদের দেখে।মাছ,মাংস,ফল সবাই ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলো ভেতরে।আয়রা ছুটে এসে বিহান ভাই এর কোলে উঠলো।বিভোর ভাই শালিকা বলে ডেকে চকলেট ধরিয়ে দিলো হাতে।আয়রা চকলেট পেয়ে ভীষণ খুশি।

আমরা ভেতরে গিয়ে নাস্তা খেয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসে আছি সবাই।তোহা আপু আর তিয়াশ ভাইয়া বলে উঠলো আজ বিহান ভাইকে পেয়েছি পিকনিক হবে।রিয়া বললো,আইডিয়া টা খুব ই ভালো।তিয়াশ ভাইয়া বললো,সবাই দুইশত করে টাকা জমা দাও।বিহান ভাই বলে উঠলেন,আমার টাকা দিয়া দিয়ে দিবে।আমি বেশ শান্ত চোখে তাকিয়ে বললাম আমার কাছে একশ টাকার একটা নোট আর দশ টাকার দুইটা নোট আছে আর তো টাকা নেই।যাও বা আছে তা ও বাড়িতে।উনি স্ট্রেইট বলে দিলেন আমি সেসব জানিনা আমার টাকা তুমি দিবে তাই দিবে।রিয়া বলে উঠলো, আমার টাকা কিপ্টা বিভোর ভাই দিবে।বিভোর ভাই বললেন,ছিঃনিজের উনাকে কিপ্টা বলছো।তোহা আপু মেহু আপুকে কল দিয়ে বললো,মেহু আপু আজ সন্ধ্যায় আমাদের পিকনিক আছে দুইশ টাকা নিয়ে চলে এসো।ভাইয়া বললো,ও মামা বাড়ি আসছে টাকা দিবে কেনো?আমি দিবো ওর টাকা।ব্যাপার টা সন্দেহের নাহ ভাইয়া আগ বাড়িয়ে মেহু আপুর টাকা দিতে চাইছে।তোহা আপু বললো সবার তো সবাই আছে আমার টাকা না হয় আজ ডাক্তার সাহেবের বউ ই দিবে।কি একটা অবস্থা আমাকে এভাবে ফাঁসানো হচ্ছে আমি এখন টাকা পাবো কই।

রান্না ঘরে আম্মু আর রিয়ার আম্মু আমাকে ডেকে নিয়ে সেই পরিমানে বকাঝকা শুরু করলো।আমি যেনো বিশাল কোনো অন্যায় করে ফেলেছি।

‘আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম’ আমি কি করেছি আম্মু।হঠাত বকছো কেনো?’

‘আম্মু অগ্নিচোখে বললো,তুমি বিহান কে ভাই ডাকো কেনো?’

‘কাকিমণি বললো ছিঃদিয়া এতদিন যা বলেছো বলেছো এখন আর ভাই ডাকবা না দেখতে আর শুনতে খারাপ দেখায়।মানুষ সমালোচনা করে বুঝো না।’

‘সেই ছোট্ট বেলা থেকে বলে আসছি তো তাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’

‘আম্মু বললো,খারাপ অভ্যাস গুলো তো তোমার কোনদিন যাবে না।আর যেনো শুনিনা ভাই বলেছো।’

‘তাহলে কি বলবো শুধু বিহান ডাকতে কেমন লাগবে।তোমার ভাতিজা বলবে তুই কত বড় অসভ্য দিয়া বড়দের নাম ধরে ডাকিস।’

‘কেনো তুমি নাম ধরে ডাকবে কেনো?স্বামির নাম ধরে কেউ ডাকে।নাম ধরে ডাকবা না। আমরা যেভাবে বলি ওইভাবেই বলবা।’

‘তুমি তো বলো দিয়ার বাবা শোনো।আমি কার বাবা বলবো।টুনির বাবা।’

‘ছেলে মেয়ে হোক তখন তুমিও তাদের নাম ধরে ডেকো।’

চুপচাপ বকাঝকা গুলো হজম করে মনে মনে ভাবছি,

এই বিহান ভাই থুক্কু এই বিহান টা আমার আম্মুর কাছে এসেই নালিশ দিয়েছে আজ ওর যে কি করবোনা নিজেই জানেনা।

বিহান ভাই থুক্কু বিহান, বিভোর ভাই আর ভাইয়া ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছে।বিভোর ভাই আর ভাইয়া গল্প করছে।আর উনি পূর্ণ দৃষ্টি ফোনে নিক্ষেপ করে ফোন স্ক্রল করে চলেছেন।

‘আমি গিয়ে বললাম,এই যে শুনুন।’

উনি কোনো উত্তর দিলেন না।

‘আবার বললাম, এইযে আপনাকেই বলছি শুনুন।’

তাও ফোনের দিকেই মন উনার।আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না।

‘ভাইয়া বিহান কে বললো,বিহান দিয়া তোকে ডাকছে।’

‘উনি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আমার দিকে কপালের চামড়া ভাজ করে তাকিয়ে বললেন,আমাকে ডাকছো?’

‘হ্যাঁ আপনাকেই!মন কোথায় থাকে।কতবার ডাকছি আমি।’

‘এইযে, ওইযে করছিলে বুঝবো কিভাবে কাকে বলছো।’

‘আপনাকেই ডাকছিলাম।’

‘আমাকে তো বিশাল ভঙ্গিমায় ভাই ডাকা হয় তাই আজ হঠাত এমন আজ্জিব সম্মোধন এ বুঝতে বেশ মুশকিল হয়েছে আমার।সিরিয়াসলি বলছি।’

‘বিভোর ভাই বললেন, দিয়া বুড়ি রেগে আছে মনে হচ্ছে তা হঠাত কি নিয়ে এত রাগ দিয়া।’

‘ওইযে আপনার চাচাতো ভাই কে বলুন আমার রুমে আসতে।আমার কথা আছে।’

‘ভাইয়া আর বিভোর ভাই খুব জোরে হেসে দিয়ে বিহান কে বললো,যা দিয়া ডাকছে।’

‘উনি ভাইয়া আর বিভোর ভাই এর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হালকা হেসে নিয়ে ফোন প্যান্টের পকেটে রেখে বললেন,যাচ্ছি তোদের বোন তো আর প্রেম করতে ডাকছে না। নিশ্চয়ই কপালে শনি আছে।একটু খোজ খবর নিস আমার গেলাম বিসমিল্লাহ বলে।’

রুমের মধ্য পায়চারী করে বেড়াচ্ছি কখন আসবেন উনি।

এক মিনিটের মাঝে উনি রুমে প্রবেশ করে প্যান্টের দুই পকেটে হাত গুজে সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
উনার সন্দিহান মন এটাই বলছে আমি হঠাত এইভাবে ডেকে পাঠালাম কেনো?

‘শান্ত কন্ঠে বললেন,কি হয়েছে ক্ষেপী এইভাবে ডাকা হয়েছে কিজন্য।’

‘আপনার ইউরিন টেস্টের রেজাল্ট জানতে।’

‘ইন্টারেস্টিং!ভেরী ইন্টারেস্টিং ব্যাপার জানতে ডেকেছো।’

আমি ক্ষীপ্ত নয়নে তাকিয়ে রইলাম।

‘উনি বললেন,আগামি কয়েক মাসের মধ্য তোমার ইউরিন টেস্টের ব্যাবস্থা করছি ওয়েট।’

‘এই দেখুন বাজে কথা কম বলুন।আম্মুর কাছে নালিশ দিয়েছেন কেনো?আমাকে বকেছে আম্মু।’

‘ওহ আচ্ছা!এই ব্যাপার।’

‘কেনো দিয়েছেন নালিশ আপনি।আজ আপনার খবর আছে বিহান ভাই থুক্কু বার বার ভাই হয়ে যায়।ছোট বেলার অভ্যাস চেঞ্জ হতে তো সময় দিবেন তাইনা?’

‘এইদিকে আমাকে বার বার ভাই ডাকলে যে আমার রোমান্টিক ফিলিংস এর দফারফা হয়ে যায় বোঝো না।’

‘ফিলিংস এর আবার দফারফা হয় নাকি।কি আধ্যাত্মিক আলাপ বিলাপ বাবা।’

উনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে অসভ্য কয়েকটা কথা বলে ফিলিংস এর দফারফা বুঝালেন।

আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে ভাবলাম,ছিঃকি অসভ্য কথা।মানুষ এত অসভ্য কথা ও বলতে পারে।

উনি দুষ্টু হেসে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।