এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ৩৫

জানালার গ্রিলসহ খয়েরী কালারের মসৃণ পর্দা ভেদ করে এক টুকরো চাঁদের আলো রুমের পূর্বসাইডে রাখা আলমারির গায়ে এসে আচড়ে পড়েছে।আমার দৃষ্টি সোজা চন্দ্রপানে নিক্ষেপ রয়েছে।ঝলসানো চাঁদটাকে যেনো ভীষণ মলিন লাগছে আজ দেখতে।চাঁদের ও মনে হয় আজ ভীষণ মন খারাপ।জানালার গ্রিল ধরে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি আমি আর ভাবছি চাঁদের ও কি তার প্রিয় জনের সাথে অভিমান হয়েছে।কোথা থেকে এক টুকরো সাদা মেঘ যেনো ভেসে এসে গোলাকার চাঁদটাকে ঢেকে দিলো।আকাশ ভরা টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ছড়াছাড়ি।নীল আকাশে সাদা মেঘে মনে হচ্ছে নীল কাপড়ে সাদা ছাপা। লাউ এর টাল এর সামনে খানিক টা জায়গা টালের জন্য অন্ধাকার হয়ে আছে দেখতে।ওই জায়গা বসে দুলাভাই আর বিভা আপু নিশ্চিন্ত মনে দুজনে প্রেম করছে এক জনের কাধে আরেকজন মাথা রেখে।তখন রেস্টুরেন্ট থেকে ভালো লাগছে না বলে খাবার রেখে উঠে ওয়েটারের কাছে গেছিলাম।ওয়েটার কে জিজ্ঞেস করলাম,যে টাকা দিলো উনি কার জন্য টেবিল বুকিং করেছিলো।

ওয়েটার বললো,বিহান ভাইয়ার কথা বলছেন নাকি আপু।

আমার দুই ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিত ফাঁকা।মাথা নেড়েই বললাম হা উনি।

ওয়েটার হেসে বললো,বিহান ভাইয়া মাঝে মধ্য বন্ধুদের সাথে এখানে আসেন।উনার বন্ধুরা ভাইয়ার ওয়াইফ কে নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেন কিন্তু ভাইয়া সে ব্যাপারে কিছুই বলেন না।শুধু এই টুকুই বলেন পুচকি আমার পারসোনাল সম্পত্তি সেই ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলবো না আর কারো সাথে মিট করাবো না।ভাইয়া ভাবিকে ভীষণ ভালবাসেন।অনেক বলেছি ছবি দেখান না।তবে আজ হঠাত বললেন,ভাইয়া নাকি সন্ধ্যার পর ভাবিকে নিয়ে আসবেন।ভাইয়ার বউ দেখার সৌভাগ্য হবে এটা ভাবতেই অনেক ভাল লাগছিলো।কিন্তু ভাবি নাকি অসুস্থ তাই আসতে পারবে না।আপু বিহান ভাইয়াকে চিনেন না।অনেক বড় ডাক্তার সে।আমাদের নড়াইলের গর্ব সে।ভীষণ ভাল একজন মানুষ।
টেনশন আর দুঃচিন্তায় চোখ মুখ শুকিয়ে এত টুকু হয়ে গিয়েছে আমার।টেনশনে মাথা পাগল পাগল লাগছে। উনি যে একটা টেবিল বুকিং করে রেখেছিলেন আমি তো সেটা ভাবতেই পারিনি।কি করবো এখন।বুকের মাঝে দুরুম দুরুম করে যাচ্ছে।টেনশনে হাঁপাচ্ছি।

তখন ই বাড়ি ফিরে এসে থেকে আমি অপেক্ষা করছি উনার জন্য। উনি কখনো রাস্তায় অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেন না।সব সময় বলেন বাইরে আড্ডা দেওয়ার থেকে তোকে বিরক্ত করার মাঝে তৃপ্তি বেশী।তাই ভাবছি হয়তো চলেই আসবেন।অত কিছু ভেবে তো মিথ্যা বলি নি আমি।দুলাভাই আর আপুকে বা কি বলতাম।ভেবেছিলাম উনি হয়তো জানবেন ই না আমি বাইরে গেছিলাম বা জানলেও রাগ করবেন না।উনি কি সত্যি রাগ করেছেন।ব্রিজে তো রেগুলার সন্ধায় যান আজ তো দেখলাম না।আসার সময় চোখ এদিক ওদিক করে চারদিক খুজলাম কোথাও পেলাম না উনাকে।রাস্তার দিকে চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছি আমি।রাতে ল্যামপোস্টের আলোয় রাস্তাঘাট ঝলমল করছে।রাস্তা দিয়ে গাড়ি বাইক ক্রামাগত যাতায়াত করেই যাচ্ছে।আমি প্রতিটা বাইকের হর্নেই মুখ উচিয়ে রাস্তা দেখছি উনি এসছেন কিনা।প্রহর গুনতে গুনতে রাত দশ টা বেজে গেলো উনার আসার নামে কোনো খবর নেই।ফোন সুইটস অফ,এই অবস্থায় কি করবো সেটাও বুঝছি না।এরই মাঝে দেখলাম উনার বাইক বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখি উনার বাইকে বিভোর ভাই।বিভোর ভাই এর শার্টের বোতাম সব গুলো খোলা প্রায়।চোখ মুখ ঘেমে কেমন তেলতেলে হয়ে গিয়েছে।বিভোর ভাই কে দেখে মুখটা চুপসে গেলো আমার।নিমিষেই মুখটা কালো হয়ে গেলো আমার।কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে।

–বিভোর ভাই আমাকে বললেন,দিয়া কি যে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি আজ জানিস না।সারাদিন যশোরে ছোটাছুটি করেছি গরমে জীবন যায় যায় অবস্থা। শরীর থেকে কয়েক মন পানি বেরিয়েছে।বিভোর ভাই প্যান্ট প্রায় হাঁটুর নিচ অবধি উলটে ভাজ দিয়ে রাখা।

–আমি চুপ রইলাম কিছুই বললাম না।

–বিভোর ভাই শার্ট খুলে হাতের কব্জিতে নিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা মলম আমার হাতে দিয়ে বললেন,এটা বিহান তোকে দিতে বলেছে।দিনে চার বার করে লাগাবি হাতে।

–উনি কোথায় বিভোর ভাই?

–আমার গাড়ি আবির নিয়ে গিয়েছে,আর বিহান আমাকে রাস্তা থেকে ওর বাইক দিয়ে বললো বাসায় নিয়ে আসতে।

–উনি আসলেন না।

–আসবে এক্ষুণি! এক বন্ধুর সাথে দেবদার তলায় বসে তার ল্যাপটপে কিছু দেখাচ্ছে।বিভোর ভাই আমার হাতে বিহান ভাই এর ফোন টা দিয়ে বললেন,বিহান ওর ফোন ও পাঠিয়ে দিয়েছে।ফোনের সুইটস অফ হয়ে গিয়েছে দিয়া।

–কি আশ্চর্য উনি ফোন ও পাঠিয়ে দিয়েছেন।

–বিভোর ভাই কে ডেকে বললাম,বিভোর ভাই রিয়া আজ খুজছিলো আপনাকে।

–রিয়ার নাম টা শুনেই চোখ মুখ ঝলমল করে উঠলো বিভোর ভাই এর।রিয়া তাকে খুজছিলো এটা যেনো বিশাল কোনো নিউজ তার কাছে।

–বিভোর ভাই আমাকে বললেন,কি বলেছে দিয়া,অনেক এক্সসাইটেড বিভোর ভাই।

–কিছুই বললো না,তবে আপনাকে না পেয়ে মন খারাপ করলো।

–বিভোর ভাই মাথায় হাত চালিয়ে বললেন,ওহ শীট।আজ ই আমাকে যশোর যেতে হলো।

–বিভোর ভাই দ্রুত গোসল করে আবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আর আমাকে বলে গেলেন দিয়া তোর বোনের সাথে দেখা করে আসি।মামি ডেকে বললেন,এই বিভোর এত রাতে না খেয়ে আবার কোথায় ছুটলি।এই ছেলেটা সারাদিন বেড়িয়ে কি মন ভরে নি।

বিভা আপু বললো,আম্মু ছেলে বিয়ে দাও বাড়িতে থাকবে।বলেই হেসে দিলো।

–বিভোর ভাই এর গায়ে খয়েরী গেঞ্জি,পরনে সাদা গ্যাবাডিং থ্রি কোয়ার্টার। আমাদের বাড়ির পেছনে রিয়ার ঘরের জানালার পাশে গিয়ে রিয়াকে ক্রমাগত ফোন কল দিয়েই যাচ্ছে।

–রিয়া ফোন কানে নিয়ে বললো,এত রাতে ফোন দিচ্ছেন যে?

–এই রিয়া একবার জানালার কাছে এসো প্লিজ।

–কেনো?

–প্লিজ এসো।

–না আম্মু মাইন্ড করবে দেখে ফেললে।

–একবার এসো।
সারাদিন জার্নি করে মাত্রই এসে জাস্ট গোসল করে না খেয়ে এসেছি।একবার কি তোমার চাঁদমুখ দেখার সৌভাগ্য হবে।

–না খেয়ে এসেছেন কেনো?

–তোমাকে দেখবো বলে।কসম লাগে এসো।একবার দেখেই চলে যাবো।

–রিয়া ফোন কানে নিয়ে জানালার পাল্লা সরালো।

বিভোর ভাই এর হাতে একটা বেলুন সেখানে লেখা আই লাভ ইউ রিয়া।

–রিয়া একটা কেক এর প্যাকেট জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললো আমার সামনে দাঁড়িয়ে খান।আর এখন যান আম্মু এসে যাবে।দ্রুত বাসায় গিয়ে ভাত খেয়ে নিন।

–আসুক আগে মন ভরে দেখতে দাও তো।

–যান বলছি।

–আমাকে খুজেছিলে।সেই মুহুর্তে মনে হচ্ছিলো আমার কপাল এত খারাপ।আমাকে আজ ই যশোর যেতে হলো।

রিয়া হাতের চুড়ি উঁচু করে দেখালো রিনিঝিনি বেজে চলেছে রিয়ার চুড়ি।রিয়া গাল ভরে হাসছে।বিভোর মুগ্ধ হয়ে হাসি দেখছে।
বিভোর ভাই উনার গাছ থেকে নেওয়া একটা গোলাপ ছুড়ে মেরে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিলো রিয়ার দিকে।রিয়া লজ্জা জানালা লাগিয়ে দিলো।

__________________________________–মামি আমার রুমে এসে বললেন,দিয়া বিহান আজ এত দেরি করছে কেনো মা।

–উনার নাকি বাইরে কি কাজ আছে বিভোর ভাই বললেন।

–রাত এগারো টা বাজতে গেলো।

–মামি তুমি ঘুনিয়ে পড়ো উনি আসলে আমি খাবার দিয়ে দিবো।

আজ প্রথমবার উনার জন্য নিজ হাতে রান্না করলাম।রান্না করার সময় অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলাম। উনার মুখে কত প্রশংসা শুনবো কত কিছু ভেবে রাখলাম অথচ আজ ই উনি আসছেন না।উনি কি রেগে গিয়েছেন নাকি কষ্ট পেয়েছেন।
রাত ক্রমশ বেড়েই চলেছে অথচ উনি আসছেন না।আমি এদিক ওদিক পায়চারী করেই যাচ্ছি।বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ির মেইন গেইটে নজর রেখেছি কখন আসবেন তার জন্য।রাত একটায় উনি বাসায় আসলেন।উঠানে দুই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে গম্ভীর মুডে হেঁটে দো’তলায় প্রবেশ করলেন।আমি উনার সামনেই দাঁড়িয়ে কিন্তু আমাকে যেনো দেখেন ই নি উনি সেরকম একটা ভাব।সোজা রুমের ভেতরে প্রবেশ করলেন।আমি আর কিছুই বললাম না।উনাকে দেখেই আমি ডায়নিং থেকে খাবার গুলো নিজের রুমে নিতে শুরু করলাম।সব খাবার নিয়ে টেবিলে রাখলাম।উনি রুমে এসে গেঞ্জিটা খুলে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লেন।সেইই যে গেলেন আর বেরোলেন না।ভেতরে পানির শব্দ হয়েই যাচ্ছে। দেড় ঘন্টা পরে বেরোলেন উনি।মুখশ্রী ভীষণ গম্ভীর হয়ে আছে।সাওয়ার তো এত লং টাইম উনি নেন না।দেড় ঘন্টা পরে ট্রাউজার আর সাদা গেঞ্জি পরে বাইরে বেরোলেন।আমি খাটের এক কোনায় মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছি কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।