এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ২৯

–ঘড়িতে ঠিক ঠিক সময় ৬ঃ৩০ মিনিট।মাত্রই সন্ধ্যা নেমেছে শহরে,অলিতে গলিতে জ্বলে উঠেছে কৃত্রিম আলোকরশ্মি।ক্রমশ চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। দিনের আলো অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ও শুরু হয়েছে।বিহান ভাই এর জন্য কিনে আনা শার্ট নিয়ে পায়চারী করেই যাচ্ছি একবার রুমের এপাশ আরেকবার রুমের ওপাস।নিচে থেকে মামি ডাকছেন,দিয়া আবির এসছে। সব ঘরের লাইট অন করে ছাদ থেকে কাপড় গুলো এনে রান্নাঘরে আয়।ভাইয়ার কথা শুনে রুমের লাইট অন করে ছুটে এলাম নিচে।

–ভাইয়াকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি।হুবহু এমন ই একটি শার্ট আজ মেহু আপু কিনেছে তার ফ্রেন্ডের জন্য।সেই শার্ট টা সেইম টু সেইম এমন ই ছিলো।চোখ ডলাডলি করে ভাল ভাবে দেখি হ্যাঁ তেমন ই তো লাগছে সেই শার্টের মতো।

–ভাইয়া আমাকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো কি দেখছিস দিয়া।

–আমি বললাম ভাইয়া কবে কিনলে শার্ট?

— ভাইয়া নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললো কেমন লাগছে আমায় দিয়া।

–আমার ভাইয়া লাখে একটা ছেলে তাকে কি আর খারাপ লাগে।বললে না কবে কিনলে।

–ওই একটা ফ্রেন্ড গিফট করেছে।

কি আশ্চর্য ব্যাপার!ভাইয়াকেও গিফট করেছে।হতেই পারে দোকানে তো আর একটায় ছিলো না শার্ট।অন্যকেউ ও কিনতে পারে।

–আমি দুষ্টুমি করতে বললাম,ছেলে না মেয়ে ফ্রেন্ড ভাইয়া।

–ভাইয়া হেসে দিলো কিন্তু উত্তর দিলো না।

ভাইয়া মামির সাথে কথা বলে বেরিয়ে গেলো।

মামির সাথে হাতের হাত রান্নায় সাহায্য করছি আমি।মাগরিবের আজান দিলে মামি নামাজে চলে গেলে আমি সব খাবার ডায়নিং এ সাজিয়ে দিলাম।মামি নামাজ শেষ করে দ্রুত আবার নিচে চলে এলো।সব কিছু গোছগাছ হয়ে গেলে মামাকে ফোন দিয়ে বললো বেশী করে ছোট মাছ নিয়ে আসতে। রাতেই মাছ কেটে রাখবে সকালে রান্নার জন্য।

–ওই দিকে বিভোর ভাই বাজারে ছোটাছুটি করে চলেছে।বিভা আপু আর তার হাজবেন্ড এসেছে তাছাড়া বিহান ভাই এর জন্য ও রান্না করছেন বড় মামি।আমাদের কাজ গোছানো শেষ হলে আমি বড় মামির পিছ পিছ ঘুরছি আর এটা ওটা মুখে দিয়ে খাচ্ছি।বড় মামি মাঝে মাঝে মজা করে বলেন, কি ব্যাপার বৌমা আজ এত খুশি খুশি লাগছে যে।লজ্জা তো পেয়েছি মারাত্মক পরিমণে সেটা ঠিক,তবে লজ্জা ভেতরে আটকে মামিকে বললাম আমাকে বৌমা টৌমা বলবে না মোটেও মামি।মামি এক গাল হাসলেন আমার কথা শুনে।এখানে এসছি বিহান ভাই কত দূর এসছেন সে খবর নিতে।সরাসরি তো আর কাউকে বলতে পারছি না।এইদিকে যে নিজে ফোন করবো তাও ভীষণ লজ্জা লাগছে।বিভোর ভাই ব্যাস্তভাবে কোথা থেকে এসে বললেন আম্মু আমি রাস্তায় যাচ্ছি বিহান কে এগিয়ে আনতে।মামি বললেন,বিহান কত দূরে এসেছে বিভোর।বিভোর ভাই বললেন,আম্মু চৌরাস্তায় চলে এসেছে।

চৌরাস্তায় মানে আর ১০ মিনিটে উনি চলে আসবেন।আমি এক পা দু’পা করে নিজের রুমে চলে গেলাম।আজ উনি আসবেন বলেই ভীষণ লজ্জা লাগছে আমার।মন আর কান দুটোই রাস্তায় আছে। যে কোনো মুহুর্তে উনার আগমন ঘটবে।মন চাচ্ছে একটা শাড়ি পরতে কিন্তু বিভা আপু আর দুলাভাই আমাকে ভীষণ লজ্জা দিবে যে উনি এসছেন বলে আমি সেজেছি।
রুম দিয়ে পায়চারী করতে করতে হঠাত বাইকের শব্দ কানে এলো।শব্দ টা ধীরে ধীরে এ বাড়ির দিকে এগোচ্ছে।আর আমার বুকের ধুকপুক আওয়াজ ও বেড়ে চলেছে।

আমি এক ছুটে বারান্দায় এসে দেখি উঠানে কালো রঙের বাইক টা থামিয়ে মাথা থেকে হেলমেট টা খুলে এলো মেলো চুল গুলোর মধ্য হাত চালিয়ে ঠিক করছেন।পরনে ব্লু জিন্স,গায়ে ছাই রঙা শার্ট, পায়ে আজ জুতা নেই সিম্পল চটি।বাইকে বসেই আড়চোখে একবার বারান্দার দিকে নজর দিলেন উনি।চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।চুল ঠিক ঠিক করতে করতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সোজা দোতলার বারান্দায়।যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি।এত মানুষের ভীড়ে উনার চোখ জোড়া কি আমাকেউ খুজছে।

বড় মামা, ছোট মামা, মামিরা সবাই এগিয়ে গেলো দুলাভাই আমাকে ডেকেই চলেছেন নিচে আসার জন্য।বিভা আপু ও ডেকে চলেছে কিন্তু আমি লজ্জায় নিচেই এলাম না।বিহান ভাই সবার সাথে কুশল বিনিময় করছেন।বিভোর ভাইয়ের বাবা বললেন,কিরে বাপ গাড়ি থাকতে এত কষ্ট করে বাইকে আসিস কেনো?কষ্ট হয়ে যায় না তোর।বিহান ভাই হেসে বললেন,কাকু আমার গাড়ি ভাল লাগে না এই বাইক ই ভীষণ প্রিয় আমার।বড় মামি বললেন,বিহান বাবা আমি কিন্তু তোমার জন্য রান্না করেছি, রেস্ট নিয়ে চলে এসো।বড় মামা বললেন,তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো ছেলেটা মাত্র এসছে এখন আবার তোমার ঘরে যাবে, তুমি ভাত তরকারী পাঠিয়ে দাও।বিহান ভাই বললেন, কোনো ব্যাপার নাহ কাকু লং টাইমের জন্য এসছি প্রতিদিন ই তোমাদের সাথেই খাবো।আজ রাতে আর খাওয়ার ইচ্ছে নেই পথে এক ফ্রেন্ডের মা জোর করে খাইয়ে দিয়েছে।এইদিকে দুলাভাই ডেকে চলেছেন,শালাবউ কোথায় তুমি দেখে যাও কে এসছে।মনে মনে বলছি দুলাভাই আপনার না খবর আছে তাও ভীষণ খবর।বার বার আমার নাম ধরে ডেকে আমার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

আমার মামা বাড়ি আর পাঁচ টা ফ্যামিলির মতো নয়।এ বাড়িতে মাত্র দুটো ছেলে বিহান ভাই আর বিভোর ভাই আর একটায় মেয়ে বিভা আপু।তিন ছেলে মেয়েকে কেউ কখনো আলাদা করে দেখেই নি। তাদের দেখে মনে হয় আপন তিন ভাই বোন।চেহাররা ও ভীষণ মিল।দুই মামির এমন ভাব দেখে মনে হয় যেনো তারা দুই বোন।এই দুই মামির জন্য এই পরিবারে এত শান্তি।বিহান ভাই আর বিভোর ভাই দুইজন দুইজনের কলিজার থেকে প্রিয়।সারাক্ষণ দুজন দুজন কে পঁচাবে কিন্তু দুজন এক সাথে ছাড়া থাকতে পারে না।তাদের সাথে যুক্ত আছি আমি আর ভাইয়া।ভাইয়া আর আমিও এ বাড়ির ছেলে মেয়ে।এ বাড়িতে যা কিছু করা হয় ভাইয়া আর আমি বাদ যায়।ভাইয়া আর বিহান ভাই বিভোর ভাই প্রায় এক ই বয়সী ভীষণ ভাব তিনজনের।মানুষ বলে তিন জমজ।

–বিহান ভাই সবার সাথে কথা শেষ করে নিচে থেকেই হাত মুখ ধুয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললেন,আম্মু ভীষণ ক্লান্ত আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে যাবো।আজ আর খাবো না।

–মামি বললেন,কিছুই খাবি না।

–বিহান ভাই না বলে উপরে চলে এলো।

উনাকে রুমে ঢুকতে দেখেই গোছানো আলনা গোছানোর ভান করছি।

–দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে ব্যাগ টা ফ্লোরে রাখলেন।চোখে মুখে হাতে পায়ে পানি চিক চিক করছে,গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে পিঠের সাথে।উনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,কি ব্যাপার কাজের নেয়ে ছকিনা দেখছি কাজে খুব ই বিজি আছে নিচে যে এত ডাকাডাকি হলো কাজের জন্য যাওয়া হলো না বুঝি।কথা বলতে বলতে আমার গায়ের ওড়না টেনে নিয়ে হাত পা মুছতে শুরু করলেন।

–আমি দ্রুত কোথাও ওড়না না পেয়ে ওনার জন্য কেনা শার্ট দ্রুত গায়ে জড়িয়ে বললাম,এটা কি নতুন অসভ্যতা শিখেছেন গায়ের ওড়না দিয়ে হাত পা মুছছেন।

“আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললেন,নিচে যাওয়া হলো না কেনো ভ্রু উচিয়ে?”

“উনার দিকে না তাকিয়ে আলনার দিকে তাকিয়ে বললাম আলনা গোছাচ্ছি তো তাই যেতে পারিনি।না হলে তো এসে বলবেন আমি পিচা*শ ঘর গোছায় না।”

“উনি পা মুছতে মুছতে বললেন,সিরিয়াসলি আর কত বেয়াদব হলে তুই ভাল হবি।না মানে তোর বেয়াদবির লিমিট কোন পর্যন্ত।”

“এসেই শুরু করেছেন।গত ছয়মাসের অত্যাচার এখন করবেন নাকি।সারা রাস্তা কি ভাবতে ভাবতে এসেছেন যে আমাকে এসে এসব বলবে।”

“এত চটে যাওয়ার কারণ কি বেয়াদব মহিলা।”

“একটা মেয়ের গায়ের ওড়না টেনে বলছেন চটে যাওয়ার কারণ কি?”

“তুই তো মহিলা,অসভ্য বেয়াদব ধুরন্ধর বিবাহিত পাপী মহিলা।নিজেকে মেয়ে দাবি করিস কোন লজিকে?”

“মেয়ে আর মহিলা কি আলাদা।”

“এটাও জানিস না, অশিক্ষিত মহিলা।ভালো বই না পড়ে সারাদিন উপন্যাস পড়লে যা হয় আরকি।”

“ওড়না নিলেন কেনো?”

“বউ এর ওড়না নিয়েছি,এতে এত রাগের কি আছে।আমার সামনে কিছু পরলেই বা কি না পরলেই বা কি।তুই চাইলে এই গরমে আমার সামনে বিকিনি পরতেও পারিস, আই ডোন্ট মাইন্ড।তাছাড়া আমার বউ এর ওড়না আমি নিয়েছি তোর বাপের কি বুঝলাম নাহ।”

“আমাকে আবার বউ ও ভাবেন আপনি?তা কোথায় আপনার সে শ্বশুরের মেয়ে।স্যাকা ট্যাকা দিছে নাকি।কথা টা খোঁচা দিতেই বললাম কেননা আমার সন্দেহ উনি আমাকেই শ্বশুর মেয়ে মনে করেন।”

“তো ভাবিনি কবে?বিয়ে করেছি বউ ছাড়া কি কাকিমা ভাববো নাকি।আমি স্যাকা খেয়েছি তাই নাকি, কিভাবে খায় সেটা পানি দিয়ে গুলিয়ে নাকি পান্তা ভাতে।”

“দেখুন আপনি এসেই কতগুলো আজে বাজে কথা বলেছেন আমাকে পাপি,অসভ্য,বেয়দব, অশিক্ষিত।তা আজ কি পাপি টা নতুন যোগ করলেন বিহান ভাই।”

“তুই তো মহাপাপী বলেই ভ্রু কুচকে এক প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়ালেন আমার সামনে।ভ্রু নাচিয়ে বললেন কি বুঝিস নিতো?অকে আমি বুঝাচ্ছি তোকে।
প্রথমত স্বামিকে ভাই বলে ডাকিস।তারপর স্বামির সাথে এতদিন পরে দেখা একটা সালাম ও দিস নি।আবার আলনা গোছানোর নামে মিথ্যা বলেছিস তাও আবার নিজের স্বামির সাথে।তাছাড়া স্বামির কোনো সেবাযত্ন করিস না আরো মুখে মুখে তর্ক করে বেয়াদবি করিস।
আগের যুগের মহিলারা কিভাবে স্বামির সেবা যত্ন করতো জানিস।দাদী নানীদের দেখেও কিছু শিখিস নি।শিখবি কিভাবে তোর দাদি তো আর তোর দাদার সেবা যত্ন করে নি।শোন আমি বলছি স্বামিরা বাড়িতে আসলে দৌড়ে গিয়ে পানি এগিয়ে দিতো কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতো।এমন কি হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে বলতো আমার অন্যায় হলে মারুন স্বামি।সারারাত স্বামির পা টিপতো।”

“বাবাহ এত ভক্তি করতো?লাঠি এগিয়ে দিতো।আর আগের যুগের স্বামিরা বুঝি কিছু করতো না।”

“হুম করতো তো দায়িত্ব নিয়ে বউ কে ১৮-২০ বছর প্রেগন্যান্ট রাখতো। এটা ছিলো তাদের বিশেষ ট্যালেন্ট। ”

“এক ভাবে ১৮-২০ বছর প্রেগন্যান্ট। ”

“এটাও বুঝিস নি গাধী,আগের মহিলাদের কম হলেও ১৫-১৬ টা করে বাচ্চা হতো তার বেশী ছাড়া কম হয় নি।তোর দাদির উনিশ টা ছেলে মেয়ে থেকে এখন ৪ টা আছে।আমিও ভাবছি তোর দাদার রুলস ফলো করবো ১৯ টা সন্তানের মা বানাবো তোকে।”

আমি ভীষণ ভাবে রেগে উনার দিকে তাকালাম।মানে এই মানুষ টা এত লজিক কোথায় পায়।এর মাথায় এত এত কথা কিভাবে আসে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।