ফ্রেস হয়ে একটু বসেছিল হুর এমন সময় ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। ফোন টা হাতে নিতেই বুঝতে পারলো ফাইয়াজের মেসেজ। হালকা হেসে মেসেজ ওপেন করতেই একটা শুকনো ঢোক গিললো হুর। মেসেজে লেখা ছিলো,
~ আর মাত্র কিছু সময় মাই ডিয়ার মিসেস। তারপর সারাজীবনের জন্য আমার ব’ন্দি’নী হয়ে যাবে। প্রস্তুত থেকো। শুভরাত্রি।
মেসেজ টা পড়ে হুরের মনে আবার ভ’য় জাগলো। মনে মনে ভাবলো,
— কি সাং’ঘা’তি’ক লোক ভাবা যায়। আমার মতো মাসুম বাচ্চা কে ভ’য় দেখাচ্ছে। এমনিতেই মন আমার কেমন কেমন করছে 😒। তারপর আবার ভ’য় দেখায়। ধুর এই লোকের চিন্তা মাথা থেকে আউট করতে হবে।
হুর জানে এই ভ’য় দূর করার একমাত্র উপায় হচ্ছে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো। মায়ের কোলে মাথা রাখলে সকল দু’শ্চি’ন্তা, ভ’য় সব কিছু দূর হয়ে যায়। সারা দুনিয়ার শান্তি ভর করে মস্তিস্কে। কিন্তু তার আম্মু বাবাই ফ্রেস হয়েছে কিনা ভেবে কিছু সময় পর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো হুর। কিছুক্ষন আগেই ফাইয়াজদের বাড়ি থেকে ফিরেছে তারা। সারা বাড়ি আত্মীয় দিয়ে ভরা হুরদের। কিছু গেস্ট কে লিয়াদের বাড়িতেও থাকতে দেয়া হয়েছে। যাতে গাদাগাদি না হয়ে যায়, সবাই আরামে থাকতে পারে।
নিজের রুমের প্রতিটা জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো হুর। এই প্রতিটা জিনিসের সাথে তার হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। প্রতিটা জিনিস খুব শখের। তার পছন্দ অনুযায়ী তার রুমটাকে ডেকোরেট করিয়েছিলো তার বাবাই। নিজের স্টাডি টেবিল টার দিকে চোখ যেতেই চোখ ভর্তি জল নিয়ে হেসে ফেললো হুর। এটা খুব বায়না করে কিনেছিলো। টেবিলে সাজানো কিছু বই খাতা সরিয়ে তার পিছন থেকে নিজের পার্সোনাল ডায়েরি বের করলো হুর। এই ডায়েরিতেই নিজের জীবনের সকল প্রিয় অপ্রিয় মুহূর্ত গুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছে সে। হুর ফাইয়াজের দেয়া চিরকুট টা ব্যাগ থেকে বের করে এনে চেয়ার টেনে বসলো। ডায়েরি তে একটা নতুন পেজ বের করে তাতে লিখতে শুরু করলো,
~ আমার স্বামী নামক মানুষটার দেয়া প্রথম ভালোবাসাময় চিরকুট।
কথাটা লিখে আঠা দিয়ে কাগজ টা ডায়েরির সাথে চি’প’কে দিলো হুর। যাতে কোনোভাবে পরে না যায়। তারপর আরেক পৃষ্ঠা বের করে তাতে লিখতে শুরু করলো,
~ মেয়েদের জীবন বড়োই অদ্ভুত তাই না! এইতো পাঁচ দিন আগে আমি শুধুমাত্র কারোর মেয়ে ছিলাম। কিন্তু হুট করে হয়ে গেলাম কারোর স্ত্রী, কারোর বাড়ির বউ। জীবন টা হঠাৎ করেই এলোমেলো হয়ে গেলো। আজ এই বাড়িতে আমার শেষ দিন। এই বাড়িতে আর আসবো না তা নয় কিন্তু এরপর আসবো মেহমান হয়ে। এসব ভাবলে যে আমার দম ব’ন্ধ হয়ে আসছে। কিভাবে থাকবো আমার পরিবার কে ছেড়ে! হে আল্লাহ তুমি আমাকে ধৈর্য্য দাও। আমি যেই উদ্দেশ্যে ফাইয়াজদের বাড়িতে যাছি সেই উদ্দেশ্য পূরণে সাহায্য করিও।
ডায়েরি বন্ধ করে অঝোর ধারায় কাঁ’দ’তে লাগলো হুর। যেখানে একটা দিন বাবা মা ভাই কে ছাড়া থাকে নি সেখানে পার্মানেন্টলি কিভাবে তাদের ছাড়া থাকবে!
কারোর আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করলো হুর। দরজার দিকে তাকাতে দেখলো তার বাবাই, আম্মু আর ছোটো ভাই একসাথে এসেছে। হুর তাদের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু হুরের মুখ দেখেই হাসান সাহেব আর মিসেস হেনা উ’ত্তে’জি’ত হয়ে গেলেন। স্পষ্ট বুঝতে পারলেন মেয়ে অনেক কেঁ’দে’ছে। ফর্সা নাক মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হাসান সাহেব মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
— কি হয়েছে আমার আম্মুটার! আমার আম্মুটা কেঁ’দে’ছে কেনো! সে কি জানে না তার কা’ন্না দেখলে তার বাবাইয়ের অনেক ক’ষ্ট হয়!
হুর তার বাবাইয়ের বুকে লেপ্টে থেকে জড়ানো কণ্ঠে বললো,
— তোমাদের ছাড়া কিভাবে থাকবো বাবাই! আমার অনেক ক’ষ্ট হবে। আমি তো এই বাড়ির মেহমান হয়ে যাবো তাই না বাবাই!
হুরের বাবা হালকা হেসে বললেন,
— দেখলে হেনা তোমার পা’গ’ল মেয়ে কিসব উল্টোপাল্টা কথা বলছে! ও নাকি এই বাড়ির মেহমান হয়ে যাবে! শোনো আমার পা’গ’লী’টা’র কথা। আম্মু এই বাড়িটা তোমার ছিলো তোমার আছে আর সবসময় তোমার থাকবে বুঝেছো। আর কে বলেছে আমাদের ছাড়া থাকবে! আমরা নিয়মিত তোমার সাথে দেখা করতে যাবো, তুমি যখন ইচ্ছা হবে চলে আসবে। এখন এতো মন খারাপ করো না তো। নাহলে আমরা সবাই কিন্তু এখন কা’ন্না শুরু করে দিবো তখন আমাদের সামলিও তুমি হুম।
হুর তার বাবার বাচ্চামো কথায় হেসে দিলো। হুরের হাসি দেখে সবাই আলতো হাসলো। হুরের বাবাই বললো,
— হুরের আম্মু যাও তো খাবার নিয়ে আসো। আজকে তোমাদের সবাই কে আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো। বেশি করে নিয়ে আসবে কেমন!
——–
সকাল থেকে ভিড় লেগে আছে হুরের রুমে। কেউ এসে বউ দেখে যাচ্ছে তো কেউ পার্লারের লোকেরা ঠিকভাবে সাজাচ্ছে কিনা তা তদারকি করছে। লিয়া হুরের পাশেই বসে আছে। হুর না চাওয়া শর্তেও আজ তাকে ভারী মেকআপ নিতে হচ্ছে। রিসেপশন বলে কথা। বউ কে বেস্ট লাগতে হবে। ফাইয়াজদের বাড়ি থেকে সবকিছু পাঠানো হয়েছে। ফাইয়াজ নিজেই পছন্দ করে কিনেছে সব। হুর আর লিয়ার ফ্যামিলির সবাইকেই কিছু না কিছু উপহার দিয়েছে সে। ফাইয়াজের পছন্দ নিঃসন্দেহে মা’রা’ত্ম’ক সুন্দর। প্রত্যেকটা জিনিস এতটাই পছন্দ হয়েছে সবার যে কেউ কোনো খুঁত ধরতে পারে নি। সবকিছুই বেস্ট।
মেরুন রঙের লেহেঙ্গা, হীরের অলংকারে সজ্জিত হুর কে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী লাগছে। লিয়া তো বারবার হুর কে খোঁ’চা দিয়ে বলছে,
— আজ ফাইয়াজ ভাইয়া তোকে দেখে জ্ঞান হারাবে। ইস আমি কেন যে ছেলে হলাম না 🥺। নাহলে তুই আমারই বউ হতি শিওর। জোর করে হলেও তোকে বিয়ে করতাম।
লিয়ার কথা শুনে হুরের গালজুরে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়লো। লিয়াকে ধা’ক্কা দিয়ে বললো চুপ করতে। কিন্তু লিয়া কি আর চুপ থাকে! হুরকে আরও বেশি লজ্জা দিতে লাগলো সে।
——–
কনের গাড়ি সেন্টারের সামনে এসে থামতেই ফাইয়াজ সবাইকে রিসিভ করতে বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। অবশ্য তার মূল উদ্দেশ্য তো নিজের বৌটা কে দেখা। তাকেও আজ কোনো অংশে রাজপুত্রের চেয়ে কম লাগছে না। শ্যাম বর্ণের সুঠাম দেহে মেরুন শেরওয়ানি টা ফুটে উঠেছে।
গাড়ির কাছাকাছি আসতেই পা জোড়া থেমে গেলো ফাইয়াজের। বুক অসম্ভব হারে কাঁ’প’তে লাগলো। এ কাকে দেখছে সে! এই মেয়েটা কি তাকে নিজের রূপে ডু’বি’য়ে মা’র’তে চায় নাকি! ফাইয়াজ সম্মহোনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো হুরের দিকে। চোঁখের পাতাও যেনো ফেলতে ভুলে গেছে।
ফাইয়াজের এমন দৃষ্টি দেখে সবার মাঝে হাসির রোল পরে গেলো। লিয়া হুরকে ধা’ক্কা দিলো সামনে দেখার জন্য।
হুর মাথা তুলতেই ফাইয়াজের চোঁখে চোখ পড়লো তার। দৃষ্টি বিনিময় হলো। ফাইয়াজের থমকানো দৃষ্টি দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো হুর। মনে মনে বললো,
— এই লোক সবার সামনে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো ! পরে যে সবাই আমায় লজ্জা দিবে! দৃষ্টি দিয়েই মে’রে ফেলবে নাকি!
হুর আরেকবার আড়চোখে তাকালো ফাইয়াজের দিকে। সবার উচ্চস্বরের হাসাহাসিতে হুশ ফিরলো ফাইয়াজের। বেচারা একটু লজ্জা পেলো বটে। দ্রুত নেমে এসে হুরের হাতটা কোমল ভাবে স্পর্শ করে তাকে হাঁটতে হেল্প করতে লাগলো। এই নিয়েও সবাই এক দফা হাসি ঠাট্টা করে ফেললো।
——–
অনুষ্ঠান শুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হলেও বিদায় বেলায় এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো ফাইয়াজ।