–রিসেপশন এর ব্যবস্থা কর বাবাই। আমি যতো দ্রুত সম্ভব আমার শ্বশুর বাড়িতে যেতে চাই।
ব্রেকফাস্ট করে ড্রয়িং রুমে খোশ গল্পে মেতে ছিলো সবাই। হুরের এই একটা কথা যেনো বো’মে’র মতো ফা’ট’লো। সবাই তব্দা খেয়ে হুরের দিকে তাকিয়ে রইলো। হুরের কাছ থেকে এই কথা কেউই আশা করে নি। বেচারা ফাইয়াজ জুস খাচ্ছিলো। হুরের কথা শুনে কাশি উঠে গেলো তার। হুরের মা মিসেস হেনা ফাইয়াজের পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করলো। মিস্টার হাসান অবাক স্বরে বললেন,
-“কি বলছো তুমি মামুনী! আমরা তো ঠিক করেছিলাম তোমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তোমাকে ফাইয়াজের হাতে তুলে দিবো। ইন ফ্যাক্ট আমরা তো এখন তোমার বিয়ে টাই দিতে চাচ্ছিলাম না। তুমি যা বলছো বুঝে বলছো তো! ”
হুর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–হ্যা বাবাই আমি যা বলছি বুঝেই বলছি। বিয়ে টা যখন হয়েই গেছে আমি চাচ্ছি আমার শ্বশুর বাড়িতেই থাকতে। হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমরা একে অপরকে বুঝে ওঠার সময় পাই নি। তাই আমার মনে হয় একসাথে থাকলে আমরা দ্রুত একে অপরের সাথে মানিয়ে নিতে পারবো। আর এমনিতেও আমার শ্বশুর বাড়িতে কোনো মেয়ে মানুষ নেই। আমার মনে হয় ওখানে থাকলে আমি আঙ্কেল আর উনার আপন মানুষের মতো খেয়াল রাখতে পারবো। এখন বাকি টা তোমাদের ইচ্ছা।
হুরের কথাগুলো শুনে মন জুড়িয়ে গেলো ফরিদ সাহেবের। এমন একটা মেয়েই তো তিনি নিজের ছেলের বউ রূপে চেয়েছিলেন। যে তাদের কথা চিন্তা করবে। তাদের জন্য যে চিন্তা করার মানুষের বড়োই অভাব। চোখ ভোরে উঠলো ফরিদ সাহেবের। হুরের সামনে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন,
–আমি খুব খুশি মামুনী তোমাকে আমার পুত্রবধূ করতে পেরে। তোমার প্রতিটা কথায় আমি প্রমান পেয়েছি আমি ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি। আমি সঠিক মেয়ে কে নিজের ছেলের বউ করেছি। জানো তো ফাইয়াজের আম্মু মা’রা যাওয়ার পর থেকে আমরা বাপ বেটা অনেক একা। হ্যা, হয়তো আমরা একে অপরের জন্য ছিলাম। কিন্তু একটা শূন্যতা সবসময় আমাদের ঘিরে রাখতো। আমি বিজনেস এর কাজ নিয়ে পড়ে থাকতাম। দিন শেষে হয়তো একটু সময় দিতাম আমার ছেলে টাকে। আমার ছেলে কখনোই এ নিয়ে অভিযোগ করে নি। কিন্তু আমি তো বাবা। আমি তো বুঝতাম ওর ক’ষ্ট। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলো না। আমাদের জন্য চিন্তা করার কোনো মানুষ ছিলো না। তোমার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে আমাদের জন্য চিন্তা করার মানুষ টা চলে এসেছে। তোমার সিদ্ধান্তে আমি অনেক খুশি হয়েছি আম্মু। আর তুমি ঠিক বলেছো আমাদের বাড়ি তে কোনো মেয়ে মানুষ নেই। অনেক অনেক সার্ভেন্ট আছে। তারা হয়তো আমাদের সব চাহিদা পূর্ণ করে ; কিন্তু একটা আপন মানুষ, ভালোবাসার মানুষ, চিন্তা করার মানুষের যে বড়োই অভাব আমাদের। তুমি আমাদের বাড়ি তে যতো দ্রুত আসবে আমি ততোই খুশি হবো।
হুর মাথা নিচু করে রাখলো। সে যা বলেছে তা শুধু মাত্র বাহানা ছিলো। এসবের পেছনে তো অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। নাহলে সে কখনোই এতো জলদি ফাইয়াজ দের বাড়িতে যেতে চাইতো না। সে নিজেও ফাইয়াজের সাথে থাকার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত না। কিন্তু তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য হলেও ওই বাড়িতে যেতে হবে।
ফরিদ সাহেব হুরের বাবার সামনে গিয়ে তার হাত ধরে বললো,
–দ্বিমত করিস না বন্ধু। আমি হুরের কোনো অযত্ন হতে দিবো না। আমার আম্মা বানিয়ে নিয়ে যাবো। এতো বছর তো তোর বাড়ি মাতিয়ে রাখলো। এবার নাহয় আমার বাড়িতে আনন্দ আসুক।
মিস্টার হাসান আর মিসেস হেনা অনেক উস’খুস করার পর রাজী হলেন। মেয়েটা যে তাদের কলিজার টু’ক’রো। মেয়ে কে ছাড়া কিভাবে থাকবেন ভাবতেই মন টা বি’ষি’য়ে গেলো তাদের। কিন্তু এখন যে হুর শুধু তাদের মেয়ে না অন্য বাড়ির বউ ও। কিভাবে জোর করবেন তারা!
——
হুর রুমে ঢুকতেই ফাইয়াজ কোথা থেকে এসে যেনো দরজা বন্ধ করে দিলো। হুরের পিছনে এসে দাঁড়াতেই হুর কি মনে করে যেনো ঘুরলো আর অমনি জো’রে একটা বা’রি খেলো ফাইয়াজের বুঁকের সাথে। মাথা ড’লতে ড’লতে চোখ পা’কিয়ে বললো,
–সমস্যা কি! এভাবে ভূ’তে’র মতো পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেন! যত্তসব আপনার ওই শ’ক্ত বুঁকের সাথে বা’রি খেয়ে আমার ম’গ’জ টা মনে হয় উল্টো দিকে ঘুরে গেছে।
হুরের আজগুবি কথা শুনে আহাম্মক বনে গেলো ফাইয়াজ। সে কতো জরুরী কথা বলতে এসেছে আর এই মেয়ে কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছে। এর কথায় কান দিলে চলবে না। ফাইয়াজ নিজের স্বর গম্ভীর করে বললো,
–দেখো আমি এসব উল্টোপাল্টা কথা শুনতে আসি নি। আমি অনেক জরুরী কিছু জানার জন্য এসেছি।
হুর মাথা ড’লা ছেড়ে চোখ পিটপিট করে ফাইয়াজের দিকে তাকালো।
–দেখো যা বলবে সত্যি বলবে। তোমার মাথায় কি চলছে বলো তো! যেখানে আমাদের বিয়ে টাই অনিশ্চিত ছিলো সেখানে তুমি এখন শ্বশুর বাড়ি যেতে চাচ্ছ। ব্যাপার টা কি!
হুর ফাইয়াজের বুকে টো’কা দিয়ে বললো,
–আমি আমার শশুর বাড়ি যেতে চাচ্ছি তাতে আপনার কি সমস্যা!
ফাইয়াজ মুখ কুঁচকে বললো,
–তোমার আচরণ আমার ঠিক লাগছে না। নিশ্চই তোমার মাথায় অন্য কিছু চলছে।
হুর ফাইয়াজের দিকে তে’ড়ে এসে বললো,
–আমার মাথায় কিছু না চললেও আপনার মাথায় নিশ্চই কিছু চলছে। নাহলে আমি আপনাদের বাড়ি যেতে চেয়েছি বলে আপনি এমন করছেন কেনো!
হুর কিছু একটা ভাবার ভান করে উত্তে’জিত হয়ে বললো,
–ওয়েট ওয়েট এবার বুঝতে পেরেছি আপনার মাথায় কি চলে।
ফাইয়াজ হুরের দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো। মনে মনে ভাবতে লাগলো এই মেয়ে এখন তাকে আবার কি উল্টোপাল্টা কথা শুনাবে। হুরের আরেকটু কাছে গিয়ে বললো,
-“কি চলছে!?
হুর ও ফাইয়াজের মতো চোখ ছোটো ছোটো করে বললো,
–ওহো! এখন এমন ভান করছেন যেনো ধোয়া তুলসী পাতা। তাতে কি আমি তো ঠিকই ধরে ফেলেছি। আপনি ভেবেছিলেন যতদিন আমি বাপের বাড়িতে থাকবো ততদিন আপনি টইটই করে ঘুরবেন আর মেয়েদের সাথে লাইন মার’বেন তাই না! আর এখন অনুষ্ঠান হয়ে গেলে তো সবাই জেনে যাবে আপনার বিয়ে হয়ে গেছে। কোনো মেয়ে আর আপনাকে পাত্তা দেবে না। তাই আপনি চাচ্ছেন আমি যাতে আপনাদের বাড়ি না যাই। এই অনুষ্ঠান না হোক।
ফাইয়াজ হুরের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। চি’ল্লি’য়ে বললো,
–হোয়াট!!! তোমার মাথা ঠিক আছে!! এসব কি আ’বো’ল’তা’বো’ল বলছো!
হুর সেই একটা ভাব নিয়ে বললো,
–“খাই না আমি সুজি,
তাই আপনার মাথায় কি চলে
সবই বুঝি।”
ফাইয়াজ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো হুরের দিকে। সে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তার মনে হচ্ছে এই মেয়ের মাথা সত্যিই গেছে। ফাইয়াজ মুখ টা ক’রুন করে মনে মনে ভাবলো,
–বিয়ের শো’কে পা/গ/ল টা/গ/ল হয়ে গেলো না তো! এখন এই পা/গ/ল কে সামলাবো কিভাবে! আমাকেও পা/গ/ল বানিয়ে দিবে। আহারে আমার কপাল পু/ড়লো মনে হয়। একটা মাত্র বউ আমার বিয়ের শোকে পা/গল হয়ে গেছে।
এরমধ্যে হুর বলে উঠলো,
–এখন আমাকে মনে মনে কি উল্টোপাল্টা বলছেন হ্যা! আমি কিন্তু আঙ্কেলের কাছে বিচার দিবো আপনার মাথায় এসব চলে। আপনি আমাকে ব’কা দেন!
হুরের উল্টোপাল্টা কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো ফাইয়াজের। হুরের দিকে রা’গী দৃষ্টি দিয়ে বললো,
–ওকে শ্বশুর বাড়িতে আসার অনেক শখ তো তোমার তাই না! আসো তুমি জাস্ট আসো। আজকে যা করলে তার পানি’শমেন্ট উঠিয়ে রাখলাম। আমার বাড়িতে আসো তারপর দেখবো তোমাকে আমার কাছ থেকে কে বাঁচায়!
হুর মনে মনে ভ’য় পেলেও সাহসী বাচ্চার ভঙ ধরে বললো,
–আরে যান যান আপনাকে আমি ভ’য় পাই না হুঁহ!!
ফাইয়াজ যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো হুর। বুকে হাত দিয়ে মুখটা কাঁ’দো কাঁ’দো করে বললো,
–এবারের মতো তো বেঁচে গেলাম। কিন্তু যেভাবে ভয় দেখিয়ে গেলো! যদি সত্যি পানি’শমেন্ট দেয়! তাহলে আমাকে কে বাঁচাবে। এমনিতেই ভ’য়ে বুকটা ধুকপুক করছিলো তার মধ্যে আরও ভ’য় দেখিয়ে গেলো। আমার মতো মাসুম বাচ্চার সাথে এতো বা’জে ব্যবহার!! এটা কি মানা যায়! একবার আসি তারপর আপনাকে উঠতে বসতে ব’কা খাওয়াবো আঙ্কেল কে দিয়ে হুঁহ।
——
অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ফরিদ সাহেব অনুমতি পেতেই নিজের বাড়ির দিকে ছু’টেছেন। অনেক আয়োজন করতে হবে তাকে। সব জোগাড় করতে হবে, সবাইকে ইনভাইট করতে হবে। অনেক কাজ! সব কিছু সামলে হাঁপিয়ে উঠছেন তিনি। কিন্তু থামছেন না। একটা মাত্র ছেলে তার। সবকিছু বেস্ট হতে হবে। ফাইয়াজ ফরিদ সাহেব কে এতো অস্থির হতে দেখে তার কাছে গেলো। হাত টা ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে বললো,
–বাবা তুমি এতো অস্থির হচ্ছ কেনো! একদম দৌ’ড় ঝাঁ’প করবে না। আমরা আছি তো। আমরা সব সামলে নেবো। বেশি দৌড়া দৌড়ি করলে তুমি অ’সু’স্থ হয়ে যাবে।
ফরিদ সাহেব ফাইয়াজের পিঠ চা’প’কে বললেন,
–আরে বেটা আমার এতো জলদি কিছু হবে না। নাতি নাতনি না দেখে আমি যাছি না। আর আমি অস্থির হবো না তো কে হবে! আমার একটা মাত্র ছেলে। তার বিয়ে সাধারণ ভাবে দিলেও রিসেপশন টা আমি বেস্ট করে করবো। সবাই শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। আমাকে কাজ করতে দে বাপ।
ফাইয়াজ তার বাবার সাথে কথায় পারবে না বলে নিরব সম্মতি দিলো। সে জানে তার বাবা তাকে কতোটা ভালোবাসে। তার রিসেপশন আর বাবা বসে থাকবে এটা সম্ভব না। তাই আর আটকালো না। তাকিয়ে রইলো বাবার প্রাণবন্ত হাসির দিকে। কতো টা বছর পর মানুষটা এতো সুন্দর করে হাসছে। ফাইয়াজ মনে মনে প্রার্থনা করলো সব যেনো ঠিকঠাক ভাবে হয়। কোনো বি’প’দ যেনো না আসে। তার বাবার মুখের হাসিটা যেনো বজায় থাকে।