অন্ধকার ক্লাসরুমে হুর কে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে আছে কেউ একজন। হুরের বুক জোরে জোরে ধুকপুক করছে। বদ্ধ রুম টায় এতটাই অন্ধকার ছেয়ে আছে যে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না হুর। অচেনা লোকটার অস্তিত্ব খুব কাছেই টের পাচ্ছে সে। লোকটার নিঃশ্বাস ঘাড়ে গলায় আ’ছড়ে পড়তেই কেঁপে উঠলো হুর। লোকটার বুকে ধাক্কা মা’রলো তাকে সরানোর জন্য। কিন্তু এক চুল ও নড়াতে পারলো না। উল্টো লোকটা তার হাত নিজের হাতের মাঝে বন্দি করে নিলো। লোকটার নিঃশ্বাসেও রাগের আভাস পাচ্ছে হুর। লোকটা হুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-“তোমাকে বলেছিলাম না তুমি শুধু আমার! তোমার সাহস কি করে হলো ওই ছেলেটার কাছ থেকে ফুল আর চিঠি নেয়ার! অনেক বার বেড়েছে তোমার তাই না! তোমাকে আগেই সতর্ক করেছিলাম তুমি ভুল করলে তোমারও শাস্তি পেতে হবে। আর ওই ছেলেটার অবস্থা আমি কি করবো তা জাস্ট দেখতে থাকো। আমার জানের দিকে হাত বাড়ানোর শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে। ”
লোকটার কথা শুনে আঁ’ত’কে উঠলো হুর। লোকটার আওয়াজ শুনেই সে বুঝে গেছে এইটা সেই অচেনা লোকটা যে তার রুমে এসেছিলো। হুর তো লোকটার কথা ভুলতেই বসেছিলো। কারণ বহুদিন লোক টা আসে নি। আজকে আবার হঠাৎ করে এসেই শাস্তির কথা বলছে। হুর ভয়ার্ত গলায় বললো,
-“দে,,, দেখুন ওই ছেলে টার কোনো ক্ষতি আপনি করবেন না। ওর কোনো দোষ নেই। ”
হুরের কথায় যেনো আরও রেগে উঠলো লোক টা। হুরের গাল শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
-“অনেক মায়া লাগছে না ওই ছেলের জন্য! অনেক প্রেম জেগেছে মনে! তোর সাহস কিভাবে হলো ওই ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলার! এতক্ষন তো শুধু ভেবেছিলাম একটু খাতিরদারি করে ছেড়ে দেবো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওই ছেলে কে উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ”
মুখ এতো শক্ত করে চেপে ধরায় ব্যথায় গুঙিয়ে ওঠে হুর। দাঁত মনে হচ্ছে গালে গেথে যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে চুপ করে থাকলে চলবে না। একজনের জীবন ম’রণের ব্যাপার। এই লোক যে ভয়া’নক হবে তা হুর ওই রাতেই ধারণা করেছে। মুখ চেপে ধরে রাখায় হুর অস্পষ্ট স্বরে নিজের কথাগুলো আওড়ালো। লোকটার মনে হয়তো কৌতূহল জন্মালো হুর কি বলতে পারে তা ভেবে। লোকটা হুরের মুখ থেকে হাত টা সরিয়ে নিলো। হুরের জানে যেনো পানি এসেছে এতক্ষনে। আর একটু সময় গেলে ব্যথায় দম আটকে ম’রে যেতো মনে হয়। মুখ নাড়াতেও ক’ষ্ট হচ্ছে হুরের। তাও ক’ষ্ট করে বলতে লাগলো,
-“আ,,, আপনি ভু,,, ভুল বুঝছেন। ওই চিঠি আর ফুল আমার জন্য ছিলো না। ওই,,, ওই টা লিয়ার জ,, জন্য ছিলো। ওই ছেলেটা আমাদের ভার্সিটি তে মাস্টার্স করছে। সে নাকি লিয়া কে ভা,,, ভালোবাসে। কয়েকবার লিয়া কেও বলেছে। কিন্তু লিয়া তাকে পাত্তাই দেয় না। তার কথাই কখনো পুরো টা শোনে না। তাই ওই ভা,,, ভাইয়া টা আজকে আমাকে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে আমি যেনো ওই চিঠি আর ফুল টা লিয়া কে দেই। ওই ভাইয়া টা আমাকে না লিয়া কে পছন্দ ক,, করে। ”
নিজের কথা শেষ করে হাঁপিয়ে উঠলো হুর। চোখ দিয়ে তার পানি গড়াচ্ছে। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো,
-“এমন রাক্ষ’সের মতো কেউ গাল চেপে ধরে! গালের হার গুলো সব মনে হয় ভেঙে গেছে নাহলে এতো ব্যথা করছে কেনো! ”
-“এরচেয়েও বা’জে ভাবে চেপে ধরতে পারি। অন্যায় করলে শাস্তি তো দিবোই তাইনা! খুব ব্যথা পেয়েছো তাই না পরি! ইশ আগে কেনো বলো নি ওই ছেলে লিয়া কে চিঠি লিখেছে। তাহলে তো এতো ক’ষ্ট পেতে হতো না। ”
হুর দাঁত ক’টম’ট করে করে মনে মনে বললো,
-“ওরে রা’ক্ষসের বাচ্চা তুই আমাকে বলার সুযোগ দিলি কই। ডাইরেক্ট মুখটা চেপে ধরে হাড়গোড় ভেঙে দিলি। তোর জীবনেও ভালো হবে না। বউ পাবি না শয়’তান কোথাকার! আবার আমাকে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখিস। তোকে বিয়ে করার চেয়ে তো আমি সারাজীবন কুমারী থাকবো তাও ভালো। ”
-“আর কতো বকা দিবে জান! আর আমার বউ তুমিই হবে এটা নিশ্চিত থাকো সেটা তুমি চাও বা না চাও। ”
হুর চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললো।
-“লোকটা আবার আমার মনের কথা বুঝে যাচ্ছে না তো! ”
-“উহুম আমি তোমার মনের কথা আন্দাজ করে নিচ্ছি। তুমি কি চিন্তা করতে পারো তা আমার জানা আছে। ”
হুর শুকনো ঢোক গিলে এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে লাগলো। এর মাঝে গালে ধার জাতীয় কিছু লাগতেই আহঃ করে উঠলো হুর। কিছুক্ষন যেতেই বুঝতে পারলো লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়ি তার গালে বিধছে। লোকটার উপস্থিতি এতো কাছে বুঝতে পেরে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটপট করতে লাগলো সে।
লোকটা হুরের গালে নাক ঘষে বললো,
-“আমি ব্যথা দিয়েছি। এবার আমিই নাহয় ব্যথার ওষুধ দিয়ে দেই!”
কথা শেষ করেই লোকটা হুরের দুই গালে পরপর কয়েকটা চুমু খেলো। হুর লোকটাকে সরাতে ব্যর্থ হয়ে নিজের চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষন পর সব কিছু স্বাভাবিক মনে হতেই চোখে মেললো হুর। দেখলো ক্লাসরুমের দরজা খোলা। হুর দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আশপাশে সব দিকে তাকালো কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলো না। এটা ক্লাস টাইম। সবাই হয়তো ক্লাসে।
-“ধুর আজকেও দেখতে পারলাম না কে এই লোকটা। আমার জীবন টা অতিষ্ট করে দিলো। ”
হুর রা’গ করে ক্যান্টিন এ গিয়ে বসে পড়লো। এখন ক্লাসে গেলেও স্যার ঢুকতে দিবে না। তাই শুধু শুধু অপমানিত হওয়ার চেয়ে এখানে বসে থাকা ভালো। হুর এক কাপ কফি অর্ডার করে ভাবতে লাগলো ভার্সিটি তে আসার পরের ঘটনা।
হুর আর লিয়া ভার্সিটি তে আসার পর লিয়া হুর কে ক্লাসে যেতে বলে নিজে যায় লাইব্রেরি তে। তার নাকি একটা বই লাগবে আর আনতে বেশি সময় লাগবে না। হুর নিজের ক্লাস রুমেই যাচ্ছিলো হঠাৎ সিনিয়র ভাই মাহিম তার পথ আটকে দাঁড়ায়। হুর চেনে এই ভাইয়া কে। তার মতে যথেষ্ট ভদ্র একজন মানুষ মাহিম। আর মাহিম যে লিয়া কে পছন্দ করে এটাও জানে হুর।
মাহিম হুর কে ফুল আর চিঠি দিয়ে অনেক রিকোয়েস্ট করে যাতে সে এই চিঠি আর ফুল লিয়া কে দেয়। হুর প্রথমে নিতে না চাইলেও পরে মাহিম তাকে বোন বলায় সে রাজী হয়ে যায়। এতটুকু তো সে করতেই পারে। মাহিম কে আশ্বস্ত করে আবার লাইব্রেরির পথে হাঁটা দেয়। কারণ ক্লাসে এসব দেয়া ঠিক হবে না। সবাই বা’জে নজরে দেখতে পারে। লাইব্রেরির আশেপাশে অনেকগুলো ফাকা ক্লাসরুম আছে। হুট করে তার মধ্যের একটা রুম থেকেই অচেনা লোকটা হুরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। হয়তো লোকটা আগে থেকেই রেডি ছিলো এমনটা করার জন্য।
সব চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হুর। কফি চলে এসেছে। কফি খেয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নেয় আরও বিশ মিনিট বাকি ক্লাস শেষ হতে। তাই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে টিপতে শুরু করে।
——————————-
বাড়ি ফিরেছে হুর। আসার সময় লিয়ার হাতে ফুল আর চিঠি টা গুঁজে দিয়েছে কিছুতেই নিতে চাচ্ছিলো না সে। অনেক বলে কয়ে দিয়েছে তাকে। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতেই একটা ঝা’টকা খেলো হুর। ফাইয়াজ আর মিস্টার ফরিদ তাদের বাড়িতে এসেছে। ফাইয়াজ এর মুখটা অসম্ভব গম্ভীর লাগছে। হুর অবাক হয়েছে তাদের হঠাৎ আগমনে। আজ প্রায় এক মাস পর ফাইয়াজ তাদের বাড়িতে এসেছে। এর মাঝে মিসেস হেনার সাথে প্রতিদিনই তার ভিডিও কলে কথা হতো। কিন্তু সময়ের অভাবে সে নাকি আসতে পারতো না। হুরের সাথে এর মাঝে একবারও কথা হয়নি ফাইয়াজ এর। ভিডিও কলে কথা বলার সময় সে আশপাশ থেকে দেখতো মাঝে মাঝে ফাইয়াজ কে। কিন্তু সামনে যেতো না অভিমান করে। ফাইয়াজ ও তার সাথে কখনো কথা বলতে চায় নি তাই হুর ও আর সামনে যেতো না। হুরের বাবা হাসান সাহেব ও বাড়িতে আছেন। হুর ভাবলো হয়তো ফরিদ সাহেব এসেছে তাই তার বাবাই ও চলে এসেছে।
হুর সামনে গিয়ে ফরিদ সাহেব কে সালাম দিয়ে কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করলো। টুকটাক কথা শেষে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো সে। অনেক tired লাগছে তার। শাওয়ার নিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিবে ভাবলো হুর। কিন্তু তার মাথায় একটা জিনিস ঘুরপাক খাচ্ছে আর তা হলো সবাই আজ অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই গম্ভীর ছিলো। কিছু হয়েছে কিনা ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে গেলো হুর।