নিশুতি রাত। নিরুৎসাহিত দেহ, মনে সন্তান’কে নিয়ে পাঁচফোড়ন গৃহে উপস্থিত হলো শাহিনুর। শরীরটা ভীষণ অসাড় লাগছে। ধীরেধীরে বুকের ভিতর উত্তাপ বাড়ছে৷ পুরোনো স্মৃতিচারণ হতেই তীব্র কষ্টে বুকটা টনটন করছে। এই গৃহে কম স্মৃতি নেই তার। জীবনের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়েছিল এ গৃহ থেকেই৷ এ গৃহের আনাচে-কানাচেতে কিশোরী নববধূর কিছু মধুর স্মৃতি রয়েছে। যার সূচনা করেছিল তার ডাক্তারসাহেব। তার উপস্থিতি টের পেতেই হঠাৎ পাঁচফোড়ন গৃহে ক্রন্দনধ্বনি বেজে ওঠল। শাহিনুরের কোলে ফুটফুটে বাচ্চা’কে দেখে গৃহের সকলেই ছুটে এলো। অরুণা এসে শাহিনুরের থেকে বাচ্চাটা নিজের কোলে নিলো। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো, নাতনি’কে। হাঁক ছেড়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ওরে তোরা দেখ আমাদের প্রণয়ের মেয়ে। জমিদার বংশের প্রথম নাতনি।’
পাঁচ পুত্রের জননী প্রেরণাও এগিয়ে এলো। এক পলক শাহিনুর’কে দেখে বুকের ভিতর জ্বলে ওঠল তার। নিমিষেই চোখ ফিরিয়ে নাতনিকে কোলে নিলো। আদর করতে করতে অঙ্গন’কে জিজ্ঞেস করল,
-‘ নাম কী রেখেছে?’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অঙ্গন বলল,
-‘নাম রাখেনি। সেজো ভাই নাম না রাখলে নতুন ভাবি নাম রাখবে না।’
সহসা কেঁপে ওঠল প্রেরণা। শাহিনুরের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-‘যার হাত ধরে পালিয়েছিলে আজ তাকে ছাড়াই এ গৃহে প্রবেশ করছো? আমার ছেলেটা তোমার কাছ থেকেও নিখোঁজ হয়ে গেল!’
নড়ে ওঠল শাহিনুর। বুকের ভিতর তীব্র কষ্টটা গাঢ় হয়ে ওঠল। অঙ্গন বলল,
-‘আম্মা এসব কথা থাক। আমি আপনাকে কথা দিয়েছি তো ভাই’কে খুঁজে বের করব। আমাকে ভরসা করুন।’
অশ্রুসিক্ত নয়নে অঙ্গনের দিকে তাকিয়ে চুপ করল প্রেরণা। এই ছেলে যখন পুত্রবধূ আর নাতনিকে ফিরিয়ে এনেছে তখন নিশ্চয়ই তার সেজো পুত্রকেও ফিরিয়ে আনবে। তাই চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে শবনম’কে বলল,
-‘বড়ো বউ খাবার বাড়ো।’
তারপর শাহিনুরের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘সেজো বউ, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও।’
শবনম এসে শাহিনুরের কাঁধ চেপে ধরল। বলল,
-‘তোমার ঘরদোর সব পরিষ্কার করে রাখছি। তা বোন কেমন আছো? ভাইটা হঠাৎ কোথায় গেল! কী হয়েছিল সঠিক বলবা। আসলে অঙ্গন গতকাল হঠাৎ কী সব বলল বুঝে ওঠতেই পারলাম না।’
শবনম কথা বলতে বলতে শাহিনুর’কে নিয়ে অন্দরে চলে গেল। জেবা এসে শাশুড়িদের সঙ্গে বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। শাহিনুরের মেয়েটাকে কোলে নিতে চাইল। কিন্তু প্রেরণা কারো কোলেই দিলো না। সে নিজেই কোলে রেখে ফুটফুটে মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। কখনো কখনো অরুণাকে বলে ওঠল,
-‘উনি বেঁচে থাকলে আজ কত খুশি হতেন। এ বংশে শুধু ছেলেই একটা মেয়েও নেই। তার বংশের প্রথম মেয়ে, আমার প্রণয়ের মেয়ে।’
অন্দর থেকে ছেলেকে কোলে নিয়ে এসে সখিনা বলল,
-‘আম্মা স্বপ্নরে ধরেন তো খুব কান্নাকাটি করতাছে।’
জেবা স্বপ্ন’কে কোলে নিলো। অরুণা সখিনা’কে বলল,
-‘তোমার কি রুচি আছে? ওর কোলে একজন আছেই আবার আরেকজনকে সাধো।’
সখিনা হঠাৎ করে চোখের পানি ফেলতে শুরু করল। নাকিসুরে বলল,
-‘আমার পোলাও তো আপনাগো বংশধর। সব বাড়িতে পোলার কদরই তো বেশি।’
সখিনার এহেন কথা শুনে অঙ্গন ধমকে ওঠল। ত্বরান্বিত হয়ে বৈঠকখানায় প্রবেশ করে বলল,
-‘সব বাড়িতে ছেলের কদর বেশি থাকলেও এই বাড়িতে সবার কদর আছে। এ বাড়ির জন্য স্বপ্ন যতটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিক ততটা সেজো ভাইয়ের মেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। বরং একটু বেশিই সে আমাদের কাছে। এর কারণটা নিশ্চয়ই তুই জানিস। আশা করি খোলাসা করে বলতে হবে না, এতে আমার ছেলের অপমান হবে।’
তপ্ত মেজাজে কথাগুলো শেষ করেই স্বপ্ন’কে কোলে নিলো অঙ্গন। তারপর প্রেরণার পাশে বসে মৃদু হাসলো। বলল,
-‘আম্মা বহুদিন পর বাড়িতে প্রাণ ফিরেছে তাই না। দেখবেন, আমাদের ছেলে, মেয়েরা, আপনার নাতি, নাতনিরা আবার এই সংসারে সুখ ফিরিয়ে আনবে।’
সখিনা চোখ মুছতে মুছতে ভিতরে চলে গেল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে ভাতিজি’কে এক নজর দেখার জন্য পল্লবও নিচে নেমে এলো। এসেই মা’য়ের হাসি হাসি মুখ দেখে কোলে জ্যোতির্ময়ী শিশু কন্যাকে দেখে চোখ, মন দু’টোই উৎফুল্লতায় ভরে গেল। অঙ্গন তাকে দেখে বলল,
-‘ বড়ো ভাই, আমাদের ছোট আম্মা’কে দেখে যাও।’
ঠোঁটে তৃপ্তিকর হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে এলো পল্লব। এসেই মা’য়ের কোল থেকে নিজের কোলে নিলো বাচ্চাটাকে। জিজ্ঞেস করল,
-‘কতদিন বয়স ওর?’
অঙ্গন বলল,
-‘আঠারো দিন।’
শুনেই আঁতকে উঠল সে। অস্ফুটস্বরে বলল,
-‘আঠারো দিন যাবৎ প্রণয় নিখোঁজ!’
শিশুকন্যাটি আন্দোলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। পল্লবও তার চোখে চোখ রেখে ‘মা মা’ করছিল। হঠাৎ কি হলো চোখমুখ শক্ত করে কেঁদে ওঠল মেয়েটা। প্রেরণা দ্রুত ওঠে নিজের কোলে নিয়ে দোল দিতে লাগল। অন্দর থেকে একছুটে বৈঠকখানায় প্রবেশ করল শাহিনুর। আকস্মিক মেয়ের কান্না শুনে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছে। বিধায় শাড়ির আঁচল মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। তাকে এভাবে উপস্থিত হতে দেখে সকলে হতভম্ব হয়ে গেল। শাহিনুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এসে শাশুড়ির থেকে মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে বুকে চেপে ধরল। কাঁপা কণ্ঠে অঙ্গন’কে প্রশ্ন করল,
-‘কী হয়েছে?’
-‘হঠাৎ করেই।’
প্রেরণা শক্ত গলায় বলল,
-‘খিদে পেয়েছে হয়তো ঘরে গিয়ে খাওয়াও মেয়েটা’কে। আমরা এতটা অমানুষ না, যে নিজেদের রক্ত’কে, নিজেদের বংশধরের ক্ষতি করব। তাই যদি করতাম সখিনা’কে এ বাড়ির বউ করে আনতাম না। এত ভয়ের কিছু নেই।’
মেয়ের কান্নার শব্দ কমে এলেও শান্ত হতে পারলো না শাহিনুর। বরং শাশুড়ির শেষ বাক্য শুনে শিউরে ওঠল। স্মরণ হলো, তখন সখিনাও গর্ভবতী ছিল। রঙ্গনের সন্তান ছিল ওর গর্ভে। যে সন্তানের পিতৃ পরিচয় পাওয়ার জন্য প্রণয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল সে! তাইকাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সখির?’
-‘অঙ্গন।’
গটগট পায়ে শাহিনুরের সামনে থেকে চলে গেল অঙ্গন৷ প্রেরণা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘তুমি ঘরে যাও ও’কে খাওয়িয়ে ঘুম পাড়াও।’
হতভম্ব শাহিনুর মাথা নাড়িয়ে পেছন ঘুরতেই পল্লবের মুখোমুখি হলো। দু’জোড়া চোখ এক হতেই পল্লব দৃষ্টি সংযত করে নিলো।
-‘এই রূপ সবাই’কে ছারখার করে দিয়েছে। এদিকে তাকানো মানে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা।’
আপন মনে বির বির করে এসব বলতে বলতেই বৈঠকখানা ত্যাগ করল পল্লব। শাহিনুরও আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তার কক্ষে চলে গেল।
__
ভোর ছ’টায় দ্বারে তীব্র করাঘাতের শব্দ হলো। সদ্যই মেয়ে’কে দুগ্ধ পান করিয়ে শুইয়েছে শাহিনুর। মেয়ের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে স্মরণ করছে, ডাক্তারসাহেবের ঘুমন্ত মুখের মায়াভরা দৃশ্যটিকে। যতবার মেয়ের পানে তাকায় ততবারই আপনমনে বলে ওঠে, বাবার মতো হয়েছে। আজো ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু কর্ণে দ্বারের তীব্র করাঘাতের শব্দ শুনতেই শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘কে?’
ফলশ্রুতিতে শব্দ আরো বেড়ে গেল। যেন দ্বার ভেঙে ওপাশের ব্যক্তিটি কক্ষে প্রবেশ করবে। হঠাৎই বুকের ভিতর ধক করে ওঠল। ঢোক গিলে শুষ্ক গলা ভিজিয়ে নিলো সন্তর্পণে। ক্রমান্বয়ে দ্বারে করাঘাত বাড়তে থাকলে সে নরম সুরে বলল,
-‘খুলছি।’
কণ্ঠে যত নম্রতা প্রকাশ করল, চেহেরায় তার চেয়ে অধিক কঠিন্যতা ধারণ করল। আশপাশে তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করতেই বারান্দায় একটি শক্তপোক্ত লাঠি দেখতে পেলো। সময় নষ্ট না করে ত্বরিতবেগে লাঠিটা নিয়ে দরজা খুলতেই মুনতাহার বিধ্বস্ত মুখশ্রী ভেসে ওঠল৷ সঙ্গে সঙ্গে হাতে থাকা লাঠিটা মেঝেতে পড়ে গেল। বিস্মিত কণ্ঠে উচ্চারিত হলো,
-‘মেজো ভাবি!’
আপাদমস্তক মুনতাহা’কে দেখে তার সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল৷ সাদা শাড়ি, খোলা চুল, রক্তিম দু’টো চোখে কী ভয়ানক লাগছে মেয়েটাকে! মুনতাহা সামনের পাটির দাঁত বের করে বিদঘুটে আকৃতির হাসি দিলো। ফলে আরেকদফা শিউরে ওঠল সে। মুনতাহা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার মতো করে কক্ষে প্রবেশ করল। ঘাড় উঁচিয়ে পালঙ্কের দিকে তাকিয়ে শাহিনুর’কে কটাক্ষ করে বলল,
-‘এতদিন একা দুঃখী ছিলাম। আজ দোকা হলাম।’
ভ্রূদ্বয় কুঁচকে ধীরপায়ে মুনতাহার সামনে এলো শাহিনুর। কেন জানি মুনতাহা’কে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগছে তার। তাই হাত বাড়িয়ে মুনতাহার হাত ধরে বলল,
-‘ভাবি আপনি কখন এলেন? বড়ো ভাবি বলল বাবার বাড়ি গেছেন।’
এক ঝটকায় শাহিনুরের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে অট্টস্বরে হেসে ওঠল সে। বলল,
-‘হ্যাঁ গেছিলাম। কিন্তু ফিরে এসেছি, কেন এসেছি বলোতো?’
বলতে বলতেই গিয়ে পালঙ্কে বসল। পা দোলাতে দোলাতে দুহাত উপরে তুলে হাই তুলল। পুনরায় হেসে ওঠে বলল,
-‘তোমাকে দেখতে এসেছি। স্বামী’কে হারিয়ে তুমি ঠিক কতটা দুঃখে আছো, তা দেখে দুচোখ জুড়াতে এসেছি।’
অবাক চোখে তাকিয়ে রইল শাহিনুর। মুনতাহার মতো শান্তশিষ্ট, চাপা স্বভাবের মেয়েটার এমন পরিবর্তন হজম করতে কষ্ট হলো। আঠারোদিন যাবৎ প্রণয়ের গভীর ভালোবাসা, যত্নের অভাবে না হয় সে কাঙালি হয়ে আছে। কিন্তু মুনতাহা কেন এমন উন্মাদ হয়ে গেছে? কীসের অভাবে? একটা নরপশুর জন্য শোকে জর্জরিত হয়ে মেয়েটা নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে কেন? কোন প্রশ্নেরই উত্তর মিললো না তার। মুনতাহা ভাবুক শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠল। বলল,
-‘আমিও বিধবা তুমিও বিধবা এবার আসো আমরা সই পাতাই!’
সহসা দু’হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠল শাহিনুর। বলল,
-‘চুপ করুন মেজো ভাবি। অমন কথা বলবেন না।’
থরথর করে কাঁপতে শুরু করল সারা দেহ। এ দৃশ্য দেখে বেশ মজা পেলো মুনতাহা। তাই পা তুলে হাঁটু মুড়িয়ে আয়েশ করে বসলো। বলল,
-‘কেন কেন বিধবা বানাতে ভালো লাগে, বিধবা হতে ভালো লাগে না? একমিনিট তুমি সাদা শাড়ি পড়োনি কেন?’
আর সহ্য করতে পারলো না শাহিনুর। অসহনীয় কণ্ঠে বলল,
-‘বেরিয়ে যান, এ ঘর থেকে চলে যান আপনি।’
সঙ্গে সঙ্গে মুনতাহা ওঠে দাঁড়ালো। শাহিনুরের সম্মুখে এসে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,
-‘দেখ কেমন লাগে!’
শাহিনুর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-‘আমি বিধবা নই, আমি বিধবা নই।’
উচ্চস্বরে মুনতাহা বলল,
-‘তুই বিধবা, তোর সন্তান এতিম। আমাকে নিঃশ্ব করেছিস না? জামাইকে তাবিজ করে আমার জামাইকে খু/ন করেছিস না? ফল দেখ তোকেও সর্বহারা করে দিলাম আমি।’
শাহিনুরের শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ওঠল। আচমকাই মুনতাহার গলা চেপে ধরল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গলা চেপে ধরে বলল,
-‘আপনি সর্বহারা করেছেন! তার মানে আপনি সব জানেন, বলুন আমার ডাক্তারসাহেব কোথায় বলুন।’
চাপা কণ্ঠে মুনতাহা বলল,
-‘মরে গেছে!’
দ্বারের বাইরে থেকে ঝড়ের বেগে অঙ্গন এসে শাহিনুরের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। অঙ্গন’কে দেখে ছেড়েও দিলো শাহিনুর। চিৎকার করে বলল,
-‘অঙ্গন ভাই মেজো ভাবি কী সব বলছে।’
অঙ্গন হতভম্ব হয়ে মুনতাহার দিকে তাকাল। প্রশ্ন করল,
-‘আপনি এখানে কী করছেন? কখন এলেন কী বলেছেন নতুন ভাবি’কে?’
মুনতাহা কাশতে কাশতে গলা চেপে ধরে মুহুর্তেই রূপ বদলালো। গিরগিটিও বোধহয় এত তাড়াতাড়ি নিজের রূপ পরিবর্তন করতে পারবে না। যত তাড়াতাড়ি মুনতাহা করল। সে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
-‘আমি শুধু বলেছি বিধবা মেয়েদের সাদা শাড়ি পড়তে হয়৷ এতেই আমাকে খু/ন করতে এসেছে। আমাকে তুমি বাঁচাও ভাই, আমাকে তুমি বাঁচাও।’
বলেই অঙ্গনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো মুনতাহা। শাহিনুরের মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেছে। কাঁদছে। শাহিনুর গিয়ে মেয়ে কোলে নিলো। তীব্র সন্দেহ মনে চেপে মুনতাহা’কে স্বান্তনা দিয়ে বাইরে নিয়ে গেল অঙ্গন। বলল,
-‘ভোর সকালে একা এসেছেন?’
-‘হ্যাঁ। আজ থেকে আমি এখানেই থাকব।’
চিন্তান্বিত হয়ে অঙ্গন বলল,
-‘মামা জানেন?’
মুনতাহা না সূচকে মাথা নাড়াল। অঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘ঘরে যান।’
[১১০]
চেনা গৃহটি আজ বড়ো অচেনা। চেনা মানুষগুলো আজ বড়ো অচেনা। এমনই অনুভূতিতে সিক্ত হৃদয় শাহিনুরের। আজ সবাই তাকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তার সন্তান’কে মাথায় তুলে রাখছে। ক্রোধের আড়ালে প্রেরণার মনও তার প্রতি নরম হয়েছে। তবুও শান্তি মেলেনি। ভরসা আসেনি। প্রশান্তির শ্বাস ছাড়েনি। পাহাড়ের সেই চূড়াতে ছোট্ট কুটিরে প্রিয় মানুষ’টার সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই বুক ভার হয়। প্রতিটি রাত স্মরণ হতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মানুষ’টা কত যত্ন নিয়ে ভালোবাসতো তাকে। অমন ভালোবাসা পাওয়ার পর হারিয়ে ফেললে বেঁচে থাকার স্বাদও চলে যায়। স্বাদহীন জীবন বয়ে চলা বড্ড কঠিন৷
গুটিকয়েক দিন কেটে গেল। শাহিনুর ফেরার পরেরদিন ভোরেই মুনতাহা ফিরেছে। এতে প্রেরণা খুশি হওয়ার পাশাপাশি ভীষণ চিন্তিত। কারণ এই মুনতাহা সেই মুনতাহা না। যাকে সে মেজো ছেলের বউ করে ঘরে এনেছিল। এই মুনতাহা আর সেই মুনতাহার মধ্যে আজ বিস্তর ফারাক! তাই শাহিনুর’কে গোপনে সচেতন থাকতে বলেছে। চোখে চোখে রাখতে বলেছে মেয়েকে। ফলে শাশুড়ির প্রতি কিছুটা ভরসা এসেছে তার৷ বাড়ির অন্যরাও ইদানীং মুনতাহাকে ভীষণ ভয় করে চলে। তার স্বভাবটাই আজকাল ভীতিকর অবস্থা তৈরি করছে। বিকেলের সময়টা মুনতাহা পলাশের কবরে গিয়ে বসে থাকে। মাগরিবের আজান না পড়লে সে আসে না।
আজ শুক্রবার। জুম্মার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে সোজা অরণ্যের গভীরে চলে গেছে অঙ্গন। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে একটা দিন সে রোমানাকে দেয়! নামাজ পড়ে কবরের পাশে গিয়ে দোয়া দরূদ পড়ে, তওবা পাঠ করে। সে শুনেছে আত্মহত্যাকারীর জন্য ইস্তেগফার ও ইসালে সাওয়াব করা বৈধ। কীভাবে কয়েক ঘন্টা কেটে গেল টেরও পেলো না। দু-চোখের নোনাপানি কপোল চুইয়ে পড়ছে। নাকের ডগা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চলে আসার সময় কবর থেকে এক চিমটি মাটি নিয়ে এলো। গৃহে প্রবেশের পূর্বে খেয়াল করল পলাশের কবরের পাশে মুনতাহা বসে আছে৷ কাঁদছে সে। আফসোস মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পা বাড়াল শাহিনুরের কক্ষের দিকে।
মেয়েকে দুগ্ধ পান করাচ্ছিল শাহিনুর৷ তার পাশে বসে তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল জেবা। তার ড্যাব ড্যাব চাহনির কবলে পড়ে অস্বস্তি হচ্ছিল ভীষণ। এ বাড়ির সবাই শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকের চোখে অদ্ভুত মুগ্ধতাও প্রকাশ পায়৷ অনেকে আবার হিংসায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। শবনম তো তখন প্রকাশ্যে বলেই ফেলল
-‘মা হয়ে তোমার রূপ আরো খুলেছে নুর।’
যৌবন ছুঁই ছুঁই তারওপর সদ্য মা হয়েছে। সবার নজর একটু বেশিই পড়ছে তার দিকে ৷ শবনম বলেছে, সাবধানে থাকতে। প্রয়োজনে রাতে কাউকে নিয়ে শুতে। যদিও আগের মতো ভয় নেই। পলাশের ছায়া এ বাড়ি থেকে সরে যাওয়ার পর, বাইজি গৃহ তালাবদ্ধ করার পর, পল্লব নিজের দুই বউ ছাড়া কারো কাছে যায়নি। মনে মনে সে ভীষণ অনুতপ্তও বটে। হাজার হোক ভাইদের হারানোর শোক তারও হয়। পুরুষের ভয়ে শবনম তাকে সতর্ক করেনি, সতর্ক করেছে নারীদের ভয়েই। পাছে অনেক কথাই কানে এসেছে কদিনে। সেসব মাথায় রেখেই শাহিনুর’কে সাবধান করেছে।
জেবা দুনিয়াজুড়ে গল্প করা শুরু করল। যার অর্ধেক ছিল নিজের রূপের প্রশংসা। সে গল্প৷ প্রশংসা শুনে বিষাদিত মুখে এক চিলতে হাসলো শাহিনুর। হঠাৎ জেবা নিজের প্রশংসা ছেড়ে শাহিনুরের প্রশংসা শুরু করল। বলল,
-‘তোমার শরীরের বাঁধুনি কিন্তু বেশ ভালো। সখিনার এক পোলা হয়েই সব শেষ।’
লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে আঁচল দিয়ে আরো ভালোভাবে বক্ষজ ঢেকে নিলো শাহিনুর৷ মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে বলল,
-‘বড়ো ভাবি কী করছে?’
জেবা সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
-‘জানো মুন কাল রাতে বড়োম্মাকে কী বলছে?’
মুনতাহার নাম শুনতেই বিতৃষ্ণায় বুকটা ভরে ওঠল শাহিনুরের। জেবা পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
-‘বলেছে প্রণয় না ফিরলে তুমি শরীরের জ্বালা মিটাতে পরকীয়া করবা! তুমি স্বার্থপর। প্রণয় নিখোঁজ হওয়াতে নিরুপায় হয়ে আবার এই বাড়িতে আসছো। এ বাড়ির বাকি দুই ছেলের মাথা খেতে!’
থামলো জেবা। শাহিনুরের চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে ওঠল। দু’চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। নিঃশ্বাসে উত্তাপ বেড়ে গেল। জেবা পুনরায় বলল,
-‘শোনো তুমি অঙ্গনের সাথে অতো কথা বইলো না। অঙ্গনকে জড়িয়ে কু’কথাও কম বলে নাই!’
কেঁপে ওঠল শাহিনুর। দৃষ্টিজোড়া অস্বচ্ছ হতে নিয়েও হলো না। সহসা বাঁকা হেসে জেবাকে বলল,
-‘ডাক্তারসাহেব ছাড়া এ গৃহে আমার নিরাপত্তা নেই। বদনাম রটানোর সুযোগ দেবো না কাউকে। আমি চলে যাব এখান থেকে।’
হতভম্ব হয়ে জেবা জিজ্ঞেস করল,
-‘কোথায় যাবা?’
-‘বাইজি গৃহে। আমার জন্মস্থানে। যতদিন ডাক্তারসাহেব না ফিরবে ততদিন আমি ওখানেই থাকব। তার অপেক্ষা করব।’
বলেই এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না শাহিনুর। মেয়েকে কোলে তুলে কক্ষ থেকে বের হলো। সম্মুখে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল অঙ্গন। মাথা নিচু করে বলল,
-‘আমাকে ক্ষমা করবেন ভাবি। যে অসম্মান আপনি আজ হলেন, তার শতগুণ সম্মান আপনাকে ফিরিয়ে দেবো।’
ভয় পেয়ে গেল জেবা। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল শাহিনুর৷ বুঝল অঙ্গন সব কথা শুনেছে তাই বলল,
-‘অপেক্ষায় থাকলাম ভাই।’
তৎক্ষনাৎ অঙ্গনের মোবাইল ফোন বেজে ওঠল।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল,
-‘মি. অঙ্গন চৌধুরী দ্রুত চলে আসুন। পেশেন্ট রিকোভার করেছে। অবিশ্বাস করবেন না, এমন পেশেন্ট দু’সপ্তাহে রিকোভার করার রেকর্ডও আছে। সেখানে ইনি তিন সপ্তাহে…’