বাইজি কন্যা | পর্ব – ৪৮ (শেষাংশ)

পাঁচফোড়ন গৃহে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর ফলে দু’টো প্রাণ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙলেই তারা যে নিজেদের এক নতুন পৃথিবীতে আবিষ্কার করবে, তা কী ঘুমানোর পূর্বে ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিল? গৃহের সকল ভৃত্যদের আজ ছুটি দেওয়া হয়েছে। ছুটির কারণ জানতে চাইলে পলাশ কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে রুহ কাঁপিয়ে দেয় তাদের৷ আদেশ করে ভোর হওয়ার আগে যেন পাঁচফোড়ন গৃহের আশপাশে তাদের না দেখা যায়৷ এমনই আদেশ দেওয়া হয় চন্দনকেও যে কিনা বিশ বছর যাবৎ এ গৃহের দৌবারিক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছে। বাইজি গৃহের সকল বাইজিদের আজ ছুটি দেওয়ার পাশাপাশি বন্দি করে রাখাও হয়েছে। ভৃত্য রেশমা’কেও ছাড় দেওয়া হয়নি৷ বাইজি গৃহের গোপন কক্ষে সকল বাইজিদের সঙ্গে রয়েছে সে। হঠাৎ তাদের এভাবে বন্দিনী করে দেওয়ার পিছনে কী কারণ কেউ বুঝতে পারেনি৷ তবুও মালিকের আদেশ মানতেই হবে তাদের৷

বাইজি গৃহে প্রবেশ করার পর শাহিনুরে অবচেতন মন টের পেয়ে গেল সবটা। শেষ পর্যন্ত কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। এই চিন্তাধারা মাথায় গেঁথেই সর্ব প্রথম বাইজি গৃহের রান্নাঘরে ঢুকল। তারপর সেখান থেকে দ্রুত চলে গেল তার আম্মার কক্ষে৷ চিরপরিচিত সেই কক্ষ। যে কক্ষের চারিধারে মিশে আছে তার আম্মার শরীরের সুবাস। তার সুপ্ত এক মিষ্টি শৈশব। পুরোনো স্মৃতিতে বেশিক্ষণ বিচরণ করল না৷ দ্রুত দরজা আঁটকে দিল৷ সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে হাতের থাবা পড়ল কাঠের দেয়ালে৷ সারা দেহের সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটজোড়াও তিরতির করে কাঁপছে শাহিনুরের। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে চিৎকার করে একবার ডাকতে ইচ্ছে করছে আম্মা’কে। সত্যি সত্যি চিৎকার করে ডাকল আম্মা’কে। বদ্ধ ঘরে থমথমে এক পরিবেশের সৃষ্টি হলো। আবারও এক চিৎকার দিল, মান্নাত বুবু বলে। এ পর্যায়ে দ্বারে কড়াঘাত থেমে গেল৷ হিংস্র কণ্ঠে পলাশ বলল,
-‘ এই মা*র বাচ্চা দরজা খোল। যদি দরজা ভেঙে আসতে হয় একবারে ছিঁড়া ফালামু তোরে। ‘
শেষবার চিৎকার করে, ডাক্তারসাহেব উচ্চারণ করল শাহিনুর৷ হু হা করে হেসে ওঠল পলাশ। বলল,
-‘ তোর ডাক্তারসাহেব আজ তোকে বাঁচাতে আসবে না রে৷ সে আজ তার রোগি বাঁচাতে ব্যস্ত। তোর কী মনে হয় পলাশ চৌধুরী এতবড়ো উদ্যেগ নিছে পরিস্থিতি হাতে না রেখেই? ‘
হু হু করে কেঁদে ওঠল শাহিনুর৷ কষ্ট হচ্ছে তার তীব্র কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। একটা বার যদি ডাক্তারসাহেবকে জড়িয়ে ধরতে পারতো। একটা বার যদি ডাক্তারসাহেবের হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পেত। তবে বুকের ভিতরের এই তীব্র যন্ত্রণা অনেকটাই কমে যেত৷ রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল শাহিনুর। এবার যদি সে নিজে থেকে দরজা না খোলে তবে সত্যি দরজা ভেঙেই ফেলবে পলাশ৷ কিন্তু সে তা চায় না৷ হয় আজ সে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল নারী হয়ে ধরা দেবে। নয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নারী হয়ে ধ্বংস করবে এই নরপিশাচকে। আর সময় নিল না শাহিনুর৷ মা’য়ের রেখে যাওয়া সেই অস্ত্রের দিকে ধাবিত হলো সে। যে অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে তার মা শিখিয়েছিল কীভাবে অমানুষদের বিনাশ করতে হয়! মায়ের দেওয়া অস্ত্রটি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মান্নাতের খণ্ডিত দেহের সেই বীভৎস দৃশ্যটি মানস্পটে ভেসে ওঠল৷ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না শাহিনুর। প্রচণ্ড হিংস্রতার সঙ্গে গর্জে ওঠে দরজা খুলে ডানহাতে থাকা শুকনো মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিল পলাশের দৃষ্টি বরাবর। একারণেই সে তখন রান্নাঘরে গিয়েছিল। পলাশ চৌধুরীকে দুর্বল করার অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়ছিল মরিচের গুঁড়ো। যা তাকে নৃশংসভাবে পলাশ চৌধুরীকে ধ্বংস করতে সহায়তা করবে৷ এক মুষ্টি মরিচের গুঁড়ো আচমকাই চোখে পড়াতে সহসা দুচোখ চেপে ধরে মেঝেতে গড়াগড়ি শুরু করল পলাশ৷ মুখ দিয়ে বেরোতে লাগল অশ্রাব্য ভাষা৷ দু’হাত চোখে চেপে মেঝেতে তড়পাতে লাগল ঠিকই কিন্তু দুপা দিয়ে শাহিনুরকে আঘাত করারও চেষ্টা করল। শাহিনুরও থেমে রইল না৷ ঘনঘন হিংস্রতার সঙ্গে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে এক হাতে পলাশের প্যান্ট খোলার চেষ্টা করল সে। পলাশ এতটাই চিৎকার করছিল এতটাই তড়পাচ্ছিল যে শাহিনুরের প্রচণ্ড পরিশ্রম হলো প্যান্ট খুলতে। তবুও দমে যায়নি সে৷ বর্বরতার পৃথিবীতে বর্বরতাকেই বেছে নিল। নৃশংস পলাশ চৌধুরী’র পতন নৃশংসভাবে দিতেই মরিয়া হয়ে ওঠল৷ রক্তের নেশায়, খুনের নেশায় তার ভিতরে জেগে ওঠল দশটি নারী সত্তা। যে নারীদের মধ্যে একেক জন একেক কারণ দেখিয়ে দিল পলাশ চৌধুরীকে ধ্বংস করার জন্য৷ ভালোবেসে বিশ্বাসঘাতকতা, দিনের পর দিন নিজের বউকে ঠকানো, নিজের ঔরস্যজাতকে নিজ হাতে খু/ন, নিজের ছোটোভাইয়ের স্ত্রীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা আর কোন কারণের প্রয়োজন পড়ল না৷ এই এতটুকুই যথেষ্ট। দু’হাতে তলোয়ার ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বীভৎস এক চিৎকার দিয়ে পলাশের অণ্ডকোষ বরাবর অগণিত আঘাত করতে লাগল। অথচ এক আঘাতেই মূর্ছা ধরেছে পলাশ৷ মেঝেতে বয়ে যাচ্ছে রক্তের স্রোত। কিন্তু নরপশুটা প্রাণ হারায়নি৷ গরু জবাই করার পর যেমন গরু গোঙায়, ছটফট, ছটফট করে ঠিক তেমনি করছিল পলাশ৷ শাহিনুর মুখ দিয়ে শুধু বীভৎস শব্দ ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ব্যাতিত আর কিছুই বের করতে পারল না। পলাশ তড়পানির এক পর্যায়ে শাহিনুরের হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। শাহিনুর এতে আরো বেশি ক্ষেপে গিয়ে ওর ঘাড় বরাবর তলোয়ার ধরে এক টানে শরীর থেকে মাথাটা ছিন্ন করে ফেলল। এরপরও থেমে রইল না সে৷ একের পর এক আঘাত করতে লাগল পলাশের নিথর শরীরটাতে৷ চারিদিকে ঝকঝকে লাল বর্ণীয় তরল। রক্তে রঞ্জিত শাহিনুরের দেহ৷ প্রকৃতি যেন হুংকার ছেড়ে গান ধরল, -‘ ওরে মানুষরূপি পিশাচ শেষ পর্যন্ত এক বাইজি কন্যার হাতেই প্রাণ দিলি। হেরে গেলি, হেরে গেলি। শেষ যাত্রায় হেরে গেলিরে পলাশ চৌধুরী! ‘

[৮৭]
হাসপাতাল থেকে কোয়ার্টারে ফেরার পথে চন্দনের কল পেল প্রণয়। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শঙ্কিত কণ্ঠে চন্দন বলল,

-‘ প্রণয় বাবা আমি চন্দন। ‘

ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর স্বরে প্রণয় জবাব দিল,

-‘ হ্যাঁ জানি৷ তোমার নাম্বার সেভ আছে আমার ফোনে৷ ‘

চন্দন হাউমাউ করে কেঁদে দিল। টাকার লোভে পড়ে পলাশের সমস্ত আদেশ সে পালন করেছে ঠিকি কিন্তু তার ভেতরের ভালো মানুষটা ঠিক থাকতে পারছে না। তাই পাপকে ঘৃণা করে অবশেষে পূণ্যটাই বেছে নিল সে৷ একে একে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল প্রণয়’কে। প্রণয় তখন তার ফ্ল্যাটের সামনেই ছিল। চন্দনের কথা শুনে তর তর করে পিঠ দিয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু করল তার। ফ্ল্যাটের প্রধান দরজা বাইরে থেকে লাগানো দেখে দ্রুত হস্তে ছিটকিনি খুলল৷ ইতোমধ্যে চন্দনের কথার সমাপ্তি ঘটে গেছে। হাঁসফাঁস চিত্তে কোনরকমে দরজা খুলে সখিনাকে চিৎকার করে ডাকল। সখিনা দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-‘ সখী আমারে আটকাইয়া কই জানি গেল গা। ‘

এবার আর স্থির থাকতে পারল না প্রণয়৷ সখিনা’কে ঠাশ করে একটা থাপ্পড় মেরে চিৎকার করে বলল,

-‘ এটা আমাকে আগে জানানো উচিৎ ছিল।’

আর সময় নষ্ট করল না প্রণয়। মোবাইল থেকে পুলিশ বন্ধু রমেশের নাম্বার বের করতে করতে রওনা দিল পাঁচফোড়ন গৃহের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথেই রমেশকে জানালো দ্রুত তার বাড়ি চলে আসতে। তার ভাই পলাশ’কে গ্রেফতার করতে হবে৷ তার অপরাধ কী সেটা এ মুহূর্তে বলার সময় নেই। যা বলার সামনাসামনি হলেই বলবে৷ এদিকে সখিনা ভয়ে কোয়ার্টার থেকে পালিয়ে গেল৷ প্রণয় তার আত্মাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে পা রাখল পাঁচফোড়ন গৃহে। চারপাশের শুনশান নীরবতায় তার বুকটা থেমে থেমে কাঁপতে শুরু করল। চন্দনের কথাগুলো স্মরণ হতেই শ্বাসরুদ্ধ করে পা বাড়ালো বাইজি গৃহের উদ্দেশ্যে৷ কিন্তু পথেই একটি শাড়ি পড়ে থাকতে দেখল। যে শাড়িটা বিকালেই শাহিনুরের পরনে ছিল! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না প্রণয়। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠল,

‘নুর!’

হাঁটা পা এবার ছুটতে শুরু করল তার। পথে শাহিনুরের রেখে যাওয়া চিহ্নগুলো নজরে পড়তেই মাথা খারাপ হয়ে গেল৷ না জানি কত দেরি করে ফেলেছে সে!

নিস্তব্ধ বাইজি গৃহে প্রবেশ করতেই নিঃশ্বাসের পাশাপাশি শরীরের রক্ত চলাচলও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো প্রণয়ের। দুচোখ বেয়ে যেন নোনাপানির পরিবর্তে রক্তের ফোয়ারা বের হচ্ছে। আরো একবার ‘নুর’ বলে আর্তচিৎকার দিল সে। তার আর্ত ধ্বনি বার বার তার কানে এসেই বাড়ি খেতে লাগল৷ কী করবে কোন দিকে, কোন পথে যাবে ভেবে না পেয়ে পুরো বাইজি গৃহ তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। শেষ পর্যায়ে যখন শারমিন বাইজির কক্ষের সম্মুখে উপস্থিত হলো হৃৎপিণ্ডে ছ্যাঁৎ করে ওঠল তার। দ্বারের বাইরে শুধু রক্তের স্রোত! সহসা চোখ বন্ধ করে ফেলল প্রণয়। নিমিষেই আবার পাগলের মতো ছুটে এলো কক্ষের ভিতর। মেজোভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত খণ্ড দেহের পাশে বিধ্বস্ত চেহেরার শাহিনুর’কে দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল, হাত উঁচিয়ে শাহিনুরকে ডাকতে গিয়ে খেয়াল করল, তার হাত থরথর করে কাঁপছে। কী অবিশ্বাস্য দৃশ্য! প্রণয় চৌধুরীর হৃদয় কাঁপছে, দেহ কাঁপছে, কী নির্মম এই দৃশ্য যা তার সমস্ত সত্তাকেই নাড়িয়ে ছাড়ল। বহুকষ্টে মুখ থেকে উচ্চারণ করল,

-‘ নুর!’

সহসা চোখ তুলে তাকালো শাহিনুর৷ কী ভয়ংকর সেই দৃষ্টি! প্রণয় থেমে থেমে বলল,

-‘ ততুমি ঠিক আছো? ‘

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল শাহিনুর৷ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রণয়৷ কেটে গেল কিছু সময়৷ তারপর হঠাৎ তলোয়ার হাতে ওঠে দাঁড়ালো শাহিনুর৷ তার অর্ধনগ্ন দেহে পলাশের রক্তে মাখামাখি। তবুও ঘাড়ে দেওয়া পলাশের সেই কামড়ের চিহ্ন প্রণয়কে ফাঁকি দিতে পারল না৷ মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল প্রণয়ের। বাঘের মতো গর্জন দিয়ে একটানে শাহিনুর’কে নিজের বুকের মধ্যেখানে জাবটে ধরল। শাহিনুর শক্ত পাথরের ন্যায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল৷ প্রণয় পাগলের মতো চিৎকার করে বলল,

-‘ তুমি ঠিক আছো? ও তোমার কোন ক্ষতি করেনি তো? আমার বা…।’

বাকিটুকু বলার পূর্বেই এক ধাক্কায় প্রণয়কে নিজের থেকে সরিয়ে দিল শাহিনুর৷ অবাক হয়ে দু পা পিছিয়ে গেল প্রণয়৷ কতটা শক্তি খাঁটিয়ে তাকে দূরে সরানো হয়েছে তা ভাবতেই হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠছে তার। তবুও পাগলের মতো আবারও শাহিনুরকে জাবটে ধরল এবার শাহিনুর তলোয়ার দিয়ে তার ঘাড়ে ইশারা করে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,

-‘ আমি একদম ঠিক আছি। আমার ক্ষতি করার আগেই আপনার ভাইকে যোগ্য শাস্তি দিতে পেরে খুব শান্তি পাচ্ছি। ছেড়ে দিন আমায় নয়তো আপনাকেও শেষ করে দেব৷ ‘

প্রণয় তবুও ছাড়ল না। কানেও নিল না শাহিনুরের কঠিন কঠিন কথাগুলো। তার হৃৎস্পন্দন শুনতে শুনতে সহসা ডুঁকরে ওঠল শাহিনুর৷ আর্তনাদ করে বলতে লাগল,

-‘ আমায় ছেড়ে দিন ডাক্তারসাহেব। আমি একজন খু/নি। আপনার ভাইদের খু/ন করে দিয়েছি আমি৷ প্রতিশোধ নিয়েছি আমার আম্মা আর মান্নাত বুবুর মৃত্যুর! ‘

প্রণয় তবুও ছাড়ল না। শাহিনুর এবার শান্ত গলায় বলল,

-‘ ছেড়ে দিন আমায়। আমার শাস্তির বন্দোবস্ত করুন। ‘

প্রণয় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ও’কে। বুকের অতিনিকটে মুখ থুবড়েও শাহিনুর বলল,

-‘ গতকাল রাতে রঙ্গন’কে বিষ দিয়ে মেরেছি। আজ পলাশ চৌধুরীকে তলোয়ার দিয়ে দু টুকরো করে দিয়েছি৷ আমার ফাঁসির ব্যবস্থা করুন ডাক্তার সাহেব। ‘

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ছিটকে সরে গেল প্রণয়। অর্ধনগ্ন রূপে রক্তে রঞ্জিত শাহিনুরের হাতে তলোয়ার দেখতে পেয়ে চমকে ওঠল। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার। ঘাড় বাঁকিয়ে পলাশের খণ্ডিত দেহ দেখতেই সম্পূর্ণ শরীর ছেড়ে দিল সে৷ হাঁটু গেড়ে শাহিনুরের সম্মুখে মাথা নিচু করে বসে পড়ল। লম্বা একটি সময় পর শাহিনুরের দুচোখে অশ্রুপাত ঘটল। খেয়াল করল প্রণয়ের দুচোখ বেয়েও অশ্রু ঝড়ছে। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বলল,

-‘ আমি যাচ্ছি ডাক্তার সাহেব আপনি আসুন থানায় যেতে হবে আমাদের। ‘

আচম্বিতে শাহিনুরের হাত থেকে খপ করে তলোয়ার কেড়ে নিল প্রণয়৷ শাহিনুর চমকে তাকালো তার রক্তিম বর্ণ দৃষ্টিজোড়ায়৷ প্রণয় তর্জনী উঁচিয়ে বলল,

-‘ চুপপ এই খু/ন আমি করেছি। শাস্তি হলে আমার হবে৷ ফাঁসিতে ঝুললে আমি ঝুলব। ‘

বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেল শাহিনুর। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল প্রণয় নিজ দায়িত্বে পুলিশের হাতে তুলে দেবে তাকে। তাই এমন বাক্যে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল,

-‘ ছিঃ আপনার মতো পবিত্র, নিষ্কলঙ্ক মানুষ’কে এমন মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া মানায় না৷ ‘

চোয়াল শক্ত করে প্রণয় বলল,

-‘ খু/ন আমি করেছি৷ এই তলোয়ারে শেষ হাতের ছাপ আমারি আছে। ‘

আঁতকে ওঠে তলোয়ার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল শাহিনুর৷ বলল,

-‘ অপরাধী আমি শাস্তিও আমিই পাবো। ‘

এক প্রকার ধস্তাধস্তি শুরু হতেই তলোয়ার পিছনে ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে শাহিনুরের কোমড় জড়িয়ে ধরল প্রণয়। ঠিক তার তলপেটের কাছে কান পেতে দিয়ে শক্ত করে বাহুবন্ধনে আঁটকে রাখল তাকে। অদ্ভুত এক অনুভূতি পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল শাহিনুর৷ হঠাৎ ভেজা কণ্ঠে প্রণয় বলল,

-‘ আমার যে অংশ এখানে রয়েছে তাকে কেন শাস্তি দেবে নুর? ‘

এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল শাহিনুরের। থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটি সহসা প্রণয়ের মাথায় স্পর্শ করল। প্রণয় আলতোভাবে ওর পেটে চুমু খেল বলল,
-‘ বাবু খুব ভয় পেয়েছে নুর ওর মা’কে ও খুব ভয় পাচ্ছে। এই দেখো আমায় পেয়ে একটু শান্ত হয়েছে। ‘

শাহিনুর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। প্রণয় আবারও বলল,

-‘ আমাদের সন্তান আসছে নুর। তোমার গর্ভে আমার সন্তান রয়েছে। আমি বেঁচে থাকতে আমার সন্তানের মা, আমার সন্তান ফাঁসিতে ঝুলবে? ‘

মুহূর্তেই শরীরের সমস্ত শক্তি কেউ যেন শুষে নিল শাহিনুরের। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সে। মাথা ঘুরতে শুরু করল। প্রণয় ওকে ধরে ফেলল৷ গুমোট পরিবেশ থেকে কিছুটা টেনে কক্ষের বাইরে নিয়ে গেল। পনরায় হাঁটু গেড়ে বসে শাহিনুরের পেট জড়িয়ে ধরল। শাহিনুর তার দুগাল ধরে অসহায় চোখে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

-‘ আমাদের বাচ্চা হবে? ‘

প্রণয় বলল,

-‘ হ্যাঁ আমাদের বাচ্চা আসবে। আর সেই বাচ্চার কসম দিলাম তোমায় আমি এখন যা বলব তাই শুনবে তুমি৷ ‘

মুহূর্তেই শাহিনুরের একটি হাত নিজের তলপেটে চলে গেল৷ থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটি বুঝতে পারল না ওখানে সত্যি বাচ্চা আছে কিনা। তাই বলল,

-‘ কোথায় বুঝি না তো? ‘

এমন পরিস্থিতিতেও বিষাদময় এক চিলতে হাসল প্রণয়৷ বলল,

-‘ বুঝবে। তুমি শুধু আমার কথা অনুযায়ী চলো।’

প্রণয়ের সিদ্ধান্ত বুঝতে পেরে বুকের ভিতরটায় হাহাকার করে ওঠল শাহিনুরের । দুনিয়া বড়োই বিচিত্র। বিচিত্র দুনিয়ার মানুষগুলোও৷ কিন্তু ভালোবাসারও যে বিচিত্র রূপ হয় এ ব্যপারে একটুও জানতো না শাহিনুর। আজ সচক্ষে দেখল ভালোবাসার আরেক রূপ। তার স্বামী নামক মহাপুরুষটির কঠিনতম ভালোবাসায় সারা দেহ, সারা মন সিক্ত হয়ে ওঠল৷ সহসা স্বামী’কে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। বলল,

-‘ এমন করেও ভালোবাসা যায় ডাক্তারসাহেব? ‘

নির্লিপ্ত কন্ঠে প্রণয় বলল,

-‘ এমন করে কেঁদো না নুর আমাদের সন্তান ভয় পাচ্ছে। যতদ্রুত সম্ভব ওর ভয় কাটাতে হবে। আমায় পেয়ে স্বস্তি পেয়েছে এবার দু’জন মিলে ওর ভয় দূর করতে হবে। ‘

এ পর্যায়ে প্রণয়’কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শাহিনুর৷ প্রণয় অনুভব করল, শাহিনুরের বুক কাঁপছে, হাত কাঁপছে, কাঁপছে সারা দেহটাই। কয়েক পল পেরোতেই কম্পিত কণ্ঠে শাহিনুর বলল,

-‘ আমাকে আপনি ক্ষমা করতে পারবেন ডাক্তার সাহেব? আমি আপনার দু’ভাইয়ের নৃশংস হত্যাকারী! ‘

সন্তর্পণে শাহিনুরের হৃৎস্পন্দন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল প্রণয়৷ ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার সরূপ
ধীরে ধীরে ওঠে দাঁড়াল সে। শাহিনুরের দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব স্পষ্ট। সে দৃষ্টিতে সীমাহীন ভালোবাসার, ভরসার দৃষ্টি মেলে ধরে নিজের ডানহাতটা দিয়ে শাহিনুরের নৃশংস, রক্তাক্ত হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল৷ আহত সুরে বলল,

-‘ এ মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো সত্যি হচ্ছে তুমি আমার স্ত্রী। বিয়ের প্রথম রাতেই বলেছিলাম, তুমি আমার অর্ধেক অঙ্গ। অর্থাৎ যা কিছু ঘটেছে তা আমারই অর্ধেক অঙ্গ ঘটিয়েছে। এর সম্পূর্ণ দায়ভার আমারও। অর্ধেক অঙ্গ লড়াই করে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তাছাড়া এই অঙ্গে আমার ছোট্ট একটা অংশ বেড়ে ওঠছে। তোমার এবার বিশ্রাম প্রয়োজন নুর। আমার সন্তান’কে যে ভয় দেখিয়েছো সে ভয় কাটানোর দায়িত্ব দিয়ে গেলাম তোমায়। তোমার লড়াইয়ে পাশে থাকতে পারিনি বলে শাস্তির ভাগ’টা আমারই প্রাপ্য। ‘

-‘ এত ভালো কেন হলেন ডাক্তার সাহেব? আপনি কেন আর সবার মতো স্বার্থপর হলেন না? ‘

স্মিথ হেসে প্রণয় বলল,

-‘ বোকা মেয়ে! স্ত্রী, সন্তানের স্বার্থে কিছু করাকেও তো স্বার্থপরতা বলে৷ আমি একটু ভিন্ন ধাচের স্বার্থপর। ‘

ভিতর থেকে কান্নারা উগ্রে বেরিয়ে এলো শাহিনুরের। আকস্মাৎ প্রণয়কে জাবটে ধরে বিধ্বংসী কান্নায় ভেঙে পড়ল৷ চিৎকার করে বলল,

-‘ আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি ডাক্তারসাহেব। আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি। ‘

শাহিনুরকে অতিযত্নে বুকের মধ্যখানে শক্ত করে চেপে ধরে মাথায়, কপালে, গালে অসংখ্য চুমু খেল প্রণয়। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,

-‘ আমিও তোমায় ভীষণ ভালোবাসি চন্দ্রকান্তা।’

কিছু সময় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাটালো ওরা৷ একে অপরের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে মিলেমিশে একাকার৷ হঠাৎ শাহিনুর বলল,

– ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, ওদের সঙ্গে আপনার রক্তের সম্পর্ক। ওরা আপনার ভাই হয় একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান আপনারা৷ সেই ওদের খু/নি’কে শাস্তি না দিয়ে সেই খু/নের দায় নিজে নিতে চাচ্ছেন? ‘

– ‘ওদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নুর, আর তোমার সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। জানো, রক্তে পচন ধরলে রক্ত পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে। কিন্তু আত্মা পরিবর্তন করার কোন সুযোগ আমাদের কাছে নেই।’

ফুঁপিয়ে ওঠল শাহিনুর৷ প্রণয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-‘ ভয় পাচ্ছো? ‘

-‘ আগে কেন বললেন না ওর কথা? এবার আমি কী করব? ‘

-‘ তোমার নিরাপত্তা দিয়েই আমি যাব নুর।’

আকুতিভরা কণ্ঠে শাহিনুর বলল,

-‘ আর কী কোন উপায় নেই? ‘

থমকানো কণ্ঠে প্রণয় বলল,
-‘ উপায় অনেক আছে তুমি কী চাও বলো? ‘

শাহিনুর প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে জড়িয়ে ধরল প্রণয়কে। বলল,

-‘ ফাঁসিতে ঝুললে দুজন একসাথে ঝুলব। জেল খাটলেও একসাথে। আমরা আপনাকে একা ছাড়ব না ডাক্তারসাহেব। আমরা আপনাকে ছাড়া একা বাঁচতে পারব না।’

চমকে ওঠল প্রণয়। শাহিনুরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত শার্ট খুলে শাহিনুরকে পরিয়ে দিল। বলল,

-‘ তাহলে চলো হারিয়ে যাই কোথাও, যেখানে কেউ খুঁজে পাবে না আমাদের। সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাবা,মায়ের ভালোবাসা পেয়েই পৃথিবীতে আসবে আমাদের সন্তান। যাবে দূর বহুদূর? ‘

শাহিনুর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল৷ না দিয়ে উপায় কী? আজ যদি তার ফাঁসি হয় একটা নিষ্পাপ শিশু প্রাণ হারাবে৷ আর যদি প্রণয়ের ফাঁসি হয় বাবা হারা হবে বাচ্চাটি৷ প্রণয় জানে আজ যদি এই খু/নের দায় সে নেয় তাহলে তার চাকরি জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে৷ ধ্বংস হয়ে যাবে তার একটি স্বপ্ন। তবে এই স্বপ্ন ধ্বংসের পরিবর্তে নতুন এক স্বপ্ন পূরণ করবে সে৷ ভয়াবহ একটি সিদ্ধান্ত নিল প্রণয়৷ সব কিছু তুচ্ছ মনে হলো তার কাছে। তার সকল সুখ,সকল শান্তি উপরওয়ালা যেন সম্মুখের এই মানবিটির মাঝেই ঢেলে দিয়েছে। আর কিছু ভাবতে পারল না চটপট কোলে তুলে নিল শাহিনুরকে। আচমকাই পুরো বাইজি গৃহের বিদ্যুৎ চলে গেল। চারপাশ ছেয়ে গেল ঘন অন্ধকারে। তবে কী তাদের হারিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে সৃষ্টিকর্তাই কী পথ খুলে দিলো?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।