ভোর রাতে খবর এলো জেবার বাবা আর নেই৷ এ যেন মরার ওপর খরার ঘা। খবর পাওয়ার পর দু’বার জ্ঞান হারিয়েছে জেবা৷ তাকে সামলাচ্ছে শবনম৷ পল্লব গেছে ড্রাইভার’কে ডেকে তুলতে। এখনি শশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে তাদের। বেয়াই মারা গেছে বাধ্যতামূলক ভাবেই প্রেরণা আর অরুণা’কে যেতে হলো। জেবার বাবা শবনম’কে একদম নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। তাই শবনমও গেল। তাছাড়া জেবার যা অবস্থা তাকে সামলাতে শবনমের প্রয়োজনীয়তা বেশি। যাওয়ার পূর্বে মুনতাহাকে পলাশের দায়িত্বে রেখে গেল। মেয়েটা অসুস্থ, সুস্থ থাকলেও অবশ্য যেতে পারতো না৷ পলাশ তাকে যেতে দিতো না৷ অঙ্গনের দায়িত্ব দিয়ে গেল ভৃত্যদের ওপর। পলাশ’কে প্রেরণা বলে গেল, সে যেন মুনতাহার খেয়াল রাখে। রঙ্গন এলে যেন বলে দেয় অঙ্গনের খেয়াল রাখতে। এ বাড়ির খবর প্রণয়ের কাছে পৌঁছাতেই সেও একবার জেবার বাড়ি গিয়ে দেখে এলো তাওই মশাইকে। শাহিনুর সাথে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সাথে নেয়নি প্রণয়৷ গতরাতে হাসপাতাল থেকে আসার পর শাহিনুর’কে বিছানায় ছটফট করতে দেখেছে সে৷ কাছে এসে গা ছুঁতেই বুঝতে পারে ভয়াবহ জ্বর হয়েছে তার৷ থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দেখে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর৷ শেষ রাত পর্যন্ত মাথায় জলপট্টি দিতে দিতেই কেটেছে তার। জ্বর যখন অনেকটা কমে এসেছে তখনি পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে জেবার বাবার মৃত্যুর খবর এসেছে৷ এমতাবস্থায় শাহিনুরকে সখিনার দায়িত্বে রেখেই চলে গেছে সে৷
সারাদিন ঘুমে ঘুমেই কাটলো শাহিনুরের। বিকেলের দিকে প্রণয় এসে সময় দিল তাকে। শাহিনুর কেমন গুমিয়ে রয়েছে। শরীর খারাপ ভেবে প্রণয় তেমন কিছু বলল না। শুধু সেবাযত্ন করে গেল। কিছুই খেতে পারছিল না মেয়েটা৷ শেষে নিজহাতে ফল কেটে জোর করে খাওয়ালো৷ খাওয়ার মাঝে অবশ্য একটি প্রশ্ন করল,
-‘ গত মাসে তোমার স্ত্রীরজ মিস গেছে। এ মাসেও গেল অথচ এ বিষয়ে নিজে থেকে কিছুই জানাচ্ছো না আমাকে৷ এটা কী ইচ্ছে করে নাকি না বুঝেই? ‘
কিঞ্চিৎ নড়ে ওঠল শাহিনুর নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রণয়ের দিকে। প্রণয় তার উত্তর পাওয়ার অপেক্ষাতে ছিল কিন্তু হঠাৎ ফোন বেজে ওঠল তার। ইমারজেন্সি পড়ে গেছে। এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে৷ শাহিনুরের থেকে আর উত্তর পাওয়া হলো না৷ শাহিনুরও এ ব্যাপারে খেয়াল দিল না৷ তার মন, মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু রক্তে রঞ্জিত সবুর উদ্দিন, মুখ ভর্তি রক্তে রঙ্গনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মুহূর্ত ঘুরপাক খাচ্ছে। জাগতিক কোন নিয়মের মধ্যে যেন সে নেই। জাগতিক কোন মায়াও যেন স্পর্শ করতে পারবে না তাকে৷ সে কে? সৃষ্টিকর্তা কেন এই ধরণীর বুকে ঠাঁয় দিয়েছে তাকে? তার এই ছোট্ট জীবনের অর্থ কী? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াতেই কেবল মশগুল সে৷
সন্ধ্যার পর বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল শাহিনুর৷ এমন সময় সখিনা এসে জানালো টেলিফোন বাজছে৷ হয়তো প্রণয়ই ফোন করেছে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য৷ রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল শাহিনুর। সে ভেবেছিল প্রণয় ফোন করেছে৷ কিন্তু না ফোন করেছে অঙ্গন! শাহিনুর থমকানো কণ্ঠে বলল,
-‘ অঙ্গন ভাই তুমি! ‘
ওপাশ থেকে অঙ্গনের গোঙানির শব্দ ভেসে এলো। কোন কথাই সে স্পষ্ট ভাবে বলতে পারল না৷ শুধু বলল,
-‘ নতুন ভাবি ভয়, ভয়, ব্যথা, রক্ত… ‘
শাহিনুরের পুরো শরীরে বিদ্যুৎ ঝলকানি দিয়ে ওঠল। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চিৎকার করে ওঠল,
-‘ কী হয়েছে তোমার ভাই? আমি এখুনি আসছি ভয় পেয়ো না, এখুনি আসছি আমি। ‘
সখিনা’কে কিছু বলার মতো সময়ও ব্যয় করল না শাহিনুর। এক প্রকার দৌড়েই বেরিয়ে পড়ল সে৷ তার মস্তিষ্ক এতটাই নীরস ছিল যে সম্ভাব্য বিপদটি নিয়ে বিন্দু পরিমাণও শঙ্কিত হলো না। সখিনা তার পিছু নিতে চাইলে বাইরে থেকে দরজা আঁটকে চলে গেল।
[৮৫]
পাঁচফোড়ন গৃহে প্রবেশ করল শাহিনুর৷ মুহূর্তেই তার সর্বাঙ্গে অদ্ভুত এক শক্তি এসে ভর করল। এই শক্তি তার দেহের না মনের নিজেই বুঝতে পারলো না৷ তবে লক্ষ করল বরাবরের মতো সদর দরজার পাশে আজ চন্দন দাঁড়িয়ে নেই। রাতের সময়টা ঠিক কত জানা নেই শাহিনুরের। তবে আসার পথে এশার আজান শুনতে পেয়েছে সে৷ এমন সময় চন্দন নেই! অবাক হয়ে ধীরপায়ে গৃহের ভিতরে প্রবেশ করল৷ যতো এগুতে লাগল ততই যেন হৃৎস্পন্দন বাড়তে থাকল তার৷ এ যেন ঠিক মরা মানুষ তাজা হওয়ার মতো অনুভূতি। কিন্তু একি আজ পাঁচফোড়ন গৃহটা মৃত্যুপুরীর মতো লাগছে কেন? নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়াতেও তিরতির করে ঘামতে শুরু করল তার সারা দেহ। একজন ভৃত্যকেও নজরে পড়ল না। বারকয়েক কয়েকজন ভৃত্যদের নাম ধরে ডাকল। কিন্তু কারো সাড়া পেল না। যতদূর জানে মুনতাহা গৃহেই রয়েছে তাই কিছুটা স্বস্তি নিয়ে অঙ্গনের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। অঙ্গনের কক্ষের সামনে পৌঁছাতেই বড়োসড়ো এক ধাক্কা খেল শাহিনুর। অঙ্গনের কক্ষের দ্বারে বড়োসড়ো একটি তালা ঝুলছে। প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে ত্বরিতগতিতে খোলা জানালার পাশে গিয়ে কক্ষের ভিতরে উঁকি দিতেই দেখল, অঙ্গন পালঙ্কে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। তার ডানহাত ব্যান্ডেজ করা, ব্যান্ডেজের ওপর রক্তের দাগ স্পষ্ট দেখতে পেল৷ এক ঢোক গিলে মৃদু কণ্ঠে কয়েকবার ডাকল,
-‘ অঙ্গন ভাই, অঙ্গন ভাই। ‘
-‘ অঙ্গন ভাই ডাবল ডোজের ওষুধ খেয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ময়নাপাখি! ‘
হতভম্ব হয়ে সহসা পিছন ঘুরতেই পলাশ চৌধুরীর উদ্ধত চেহেরাটি স্পষ্ট দেখতে পেল৷ নিমিষেই বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে ওঠল শাহিনুরের৷ সম্ভাব্য বিপদটি স্পষ্ট হয়ে ওঠল চোখের সামনে। পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যেতে উদ্যত হতেই পলাশ খাবলে ধরল তার হাত। সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে ওঠল শাহিনুর।
-‘ মেজো ভাবি, মেজো ভাবি আপনি কোথায়? ‘
-‘ পুরো বাড়ি আজ আমার নিয়ন্ত্রণে চলবে। মুনতাহাকেও ডাবল ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে বিছানায় ফেলে রাখছি! ‘
– ‘ আমার হাত ছাড়ুন নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে৷ ‘
-‘ কিছুই খারাপ হবে না সোনাপাখি, আমার ময়নাটা, এত ছটফট করে না। ‘
আচম্বিতে পলাশের হাতে কামড় বসিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল শাহিনুর৷ পলাশ চট করে ওর কোমল উদরে শক্ত হাতে চেপে ধরে একদম নিজের শরীরের সঙ্গে জাবটে ধরল। শাহিনুরের পবিত্র, কোমল দেহের অনেকাংশেই নিজের অশ্লীল হাতের বিচরণ ঘটালো। পাগলা কু/কুরের মতো কামড় বসালো ঘাড়ে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়েও নিজেকে ছাড়াতে পারল না শাহিনুর৷ শেষে বসে পড়ল মেঝেতে৷ পলাশ বিকৃত ভঙ্গিতে হেসে দিয়ে বলল,
-‘ উফফস পুরাই হরিণের বাচ্চা, না না খরগোশের বাচ্চা, না না বাইজির বাচ্চা। আসো তোমার আমার দুর্দান্ত একটি বাসর সাজানো হইছে। এমন সুখ দেব যে আজকের পর পলাশ ছাড়া সব পুরুষের নাম ভুলে যাবা৷ একদম ভুলিয়ে দেবো। তবে আমার আফসোস একটাই তোমার প্রথম রাতের আনাড়িপনায় যে সুখ প্রণয় পাইছে সেইটা আমি পাইলাম না৷ খালি চোখ ভরে দেখেই গেছি! উফফ কী জিনিস মাইরি। ‘
শেষ কথাটায় সহসা দৃষ্টিজোড়া জ্বলে ওঠল শাহিনুরের। লজ্জায়, ঘৃণায় পৃথিবীর সমস্ত মায়া ত্যাগ করতে ইচ্ছে করল৷ মানুষ এতটা নিচ কী করে হয়? তার আর প্রণয়ের পবিত্র সম্পর্কটুকু এই নরপিশাচটা এভাবে অপবিত্র করে দিয়েছে! ছিঃ…
শাহিনুরের দেহের ভাঁজে ভাঁজে কামুক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বিকৃত ভঙ্গিতে হেসে ওঠে পুনরায় পলাশ বলল,
-‘ কী গো ওঠো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো আমার যে আর তর সইছে না৷ ‘
সঙ্গে সঙ্গেই ওঠে দাঁড়িয়ে পালাতে চেষ্টা করল শাহিনুর৷ কিন্তু পারলো না পলাশ তার শাড়ির আঁচল টেনে পুরো শাড়িটাই খুলে নিল৷ নিজের অর্ধনগ্ন দেহটি নিয়ে লজ্জায়, ঘৃণায় পিছমুখী হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো শাহিনুর৷ পলাশ পুনরায় ওর দিকে এগিয়ে আসতে উদ্যত হতেই শাহিনুর চিৎকার করে সাহায্য চাইতে চাইতে গৃহ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু এই অবস্থায় এখন কোথায় যাবে? আশপাশে একটা কাকপক্ষীকেও খুঁজে পাওয়া গেল না। সদর দরজার সামনে যেতেই দেখল সেখানেও বড়োসড়ো তালা ঝুলছে। এবার শাহিনুর আতঙ্কিত হয়ে কাঁপতে শুরু করল। তার মানে পলাশ চৌধুরী পূর্ব পরিকল্পিত ঘটনাই এখন ঘটাচ্ছে! দিশেহারা হয়ে গেল সে৷ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের তীব্র অস্থিরতায় বীভৎস এক শব্দের সৃষ্টি হলো৷ শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুনরায় খু/নের নেশা তীব্র হয়ে ওঠল তার৷ চোখ বন্ধ করে স্মরণ করল আম্মা’কে।
-‘ কথা দে মা জান দিবি তবু ইজ্জত নিতে দিবি না৷ ‘
-‘ কথা দিলাম আম্মা জান নেবো তবুও ইজ্জত নিতে দেবো না৷ ‘
আম্মার আদেশ, আম্মাকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতি স্মরণ হতেই মনে তীব্র সাহস জুগিয়ে দৌড় দিল বাইজি গৃহের পথে৷ শব্দ পেল আরো একজোড়া পায়ের। পলাশ চৌধুরী আসছে। তার ইজ্জত নিতে আসছে। হো হো করে বিকৃত ভঙ্গিতে হাসছে আর বলছে,
-‘ আজ তোমাকে আমার হতেই হবে শাহিনুর শায়লা। এই পলাশ চৌধুরীর না পাওয়া বলতে এক তুমি ছাড়া আর কিছুই নাই৷ কীভাবে নিজের স্বাদ মেটাতো হয় তা খুব ভালো করেই জানে পলাশ চৌধুরী। সেই কবেই তোমাকে পাওয়ার বড়ো স্বাদ জেগেছে মনে৷ কী নিষ্ঠুর আমার ভাই। চোখ ধাঁধানো এই সৌন্দর্য এমন লাস্যময়ী দেহখানি একাই ভোগ করার জন্য কেড়ে নিল৷ কিন্তু আমিও তার বড়ো ভাই৷ তার আগে এই দুনিয়ায় আমি এসেছি। কেড়ে নেওয়াতে তার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ আমি৷ ‘
পলাশ চৌধুরীর বলা কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই শাহিনুর আপনমনে ভাবল, আম্মা’কে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করার সঠিক সময় এসে গেছে৷ আজ হয় মারবে নয়তো মরবে। একজন পুরুষের সঙ্গে পেরে ওঠা সহজ নয়৷ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই একবার ডাক্তারসাহেবকে স্মরণ করল। প্রণয়ের গভীর দৃষ্টিজোড়া, আদুরে স্পর্শ স্মরণ হতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো, বুকের মধ্যখানে কেঁপেও ওঠল। তার দৃঢ় বিশ্বাস প্রণয় ঠিক তাকে খুঁজতে আসবে, তার বিপদের কথা স্মরণ হলে রক্ষা করতেও আসবে। এমন বিশ্বাস মনে আসতেই ত্বরিতবেগে দুহাতের কব্জিতে থাকা চুড়িগুলো খুলে সরু পথের পাশে চিহ্ন হিসেবে রাখল। যদি প্রণয় এ পথে আসে অবশ্যই এই চুড়ি দু’টো দেখে নিশ্চিত হতে পারবে৷ কয়েক পা ছুটে আবারও কানের দুলজোড়া খুলে দ্রুত ফেলে বাইজি গৃহের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল৷ একবার ডাকল, রেশমা খালাকে সাড়া না পেয়ে দ্রুত চুল থেকে খোঁপা খুলে সদর দরজার এক পাশে শেষ চিহ্ন হিসেবে রেখে ভিতরে ঢুকে পড়ল।