প্রণয় এলো রাত এগারোটার পর৷ আসা মাত্রই এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি সামনে ধরল শাহিনুর। প্রণয় অবাক হয়ে প্রগাঢ় চাহনিতে তাকাল। প্রণয়ের সুগভীর দৃষ্টিজোড়ায় নম্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শাহিনুর। ইশারায় পানির গ্লাস নিতে বলল৷ প্রণয় একইভাবে তাকিয়েই গ্লাস ধরে পানি পান করল। হরিণাক্ষী দৃষ্টিজোড়ায় ডুবে গিয়ে বোঝার চেষ্টাও করল প্রেয়সীর হৃদয়ে চলা ভাবনাগুলোকে। সম্পূর্ণভাবে বুঝে ওঠার আগেই গ্লাস ফেরত নিয়ে মৃদু পায়ে চলে গেল শাহিনুর৷ যাওয়ার আগে অবশ্য বলে গেল, তার জন্য খাবার প্রস্তুত করবে, সে যেন পোশাক পরিবর্তন করে দ্রুত খেতে যায়৷
পোশাক পরিবর্তন করে খেতে এলো প্রণয়। এসেই দেখল অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে খাবার বাড়ছে তার অতি সুদর্শনীয় বধূটি। তার দিঘল কালো চুলগুলো বাঁধনছাড়া হওয়াতে বারবার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইছে। শুভ্র মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। যা তার সৌন্দর্যের মাত্রা আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সব গুছিয়ে লেবু কাটার জন্য রান্নাঘরে গেল সে৷ প্রণয় একমনে তাকিয়ে দেখতেই থাকল তাকে। পুনরায় যখন ভোজনালয়ে ফিরে এলো শাহিনুর তাকে আগাগোড়া দৃষ্টিপাত করে প্রণয়ের দৃষ্টি যেন ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হলো, মস্তিষ্কও কেমন অসাড় হয়ে গেল। আনমনেই ভাবল, আজ কী পূর্ণিমা? পূর্ণিমা ছাড়াই এমন শুভ্রাংশু কাছে পাওয়ার মতো ভাগ্যবান পুরুষ কী সত্যিই সে! খাওয়ার প্রতি মনোযোগ ছিল না। তবুও খেতে হলো, খাওয়ার ফাঁকে একবার প্রশ্ন করল,
-‘ এই গরমে চুল খুলে রেখেছ কেন? এমনিতেই ফাঁপর লাগে এভাবে থাকলে আরো সমস্যা হবে। ‘
সখিনার সঙ্গে যা সব ঘটনা ঘটল আজ, নিজেকে স্বাভাবিক করতে করতে আর চুল বাঁধার সময় পায়নি সে৷ সেসব কথা চেপে গিয়ে শান্ত গলায় বলল,
-‘ শোবার আগে বেঁধে নিব। ‘
আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল প্রণয়। শাহিনুর নিঃশব্দে একবার সখিনার ঘরে উঁকি দিল। সখিনা ঘুমিয়ে পড়েছে, তার হাতে থাকা সাদা ব্যান্ডেজটার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে রইল সে। যা সে নিজেই বেঁধে দিয়েছে। আহত হাতটি দেখে তাচ্ছিল্য হেসে বিরবির করে বলল,
-‘ আমি যেমন ভালোবেসে কাছে টানতে পারি তেমন তীব্র ঘৃণায় ছুঁড়ে ফেলতেও পারি। প্রয়োজনে আঘাত করতেও জানি, প্রয়োজন ফুরালে সে আঘাত সারিয়ে তুলতেও পারি! ‘
ভেবেই হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল সে। চুল বেঁধে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে নিতে ঘন্টাখানেক সময় ব্যয় হলো। মাঝরাত তখন, প্রণয়ের পাশে গিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল শাহিনুর। প্রণয় টের পেলেও চুপ করে রইল। হঠাৎ শাহিনুর এক হাত বাড়িয়ে প্রণয়ের কাঁধ স্পর্শ করল। বলল,
-‘ ঘুমিয়ে পড়েছেন? ‘
সঙ্গে সঙ্গেই প্রণয় জবাব দিল,
-‘ বলো? ‘
-‘ এদিকে ফিরুন। ‘
ফিরল প্রণয় শাহিনুর মৃদু হাসল। প্রণয়ের দু’হাত টেনে ধরে বুকের ভিতরটা ফাঁক করে নিজের জায়গা করে নিল। তারপর গুটিশুটি হয়ে বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সহসা এমন আচরণ পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল প্রণয়। হুটহাট দূরে যাওয়া আবার হুটহাট কাছে আসা বড়োই অদ্ভুত লাগে তার। রাগও হয় সে রাগ থেকেই নিজে থেকে ধরল না। শাহিনুর মৃদু স্বরে বলে ওঠল,
-‘ ডাক্তারসাহেব আপনাকে যে খুব ভালোবাসি। ‘
হৃৎস্পন্দন কেঁপে ওঠল প্রণয়ের। আচমকাই দু’হাতে পিঠ চেপে ধরে বুকের আরো গভীরে টেনে নিল প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী’কে। আদুরে স্পর্শে মাথায় আলতো চুমু খেলো বলল,
-‘ ভালো যখন বেসেই ফেলেছ দূরত্ব আনার বৃথা চেষ্টা করো না। তোমার আমার ভালোবাসায় দূরত্ব মানায় না চন্দ্রকান্তা। ‘
দুর্বল কণ্ঠে পুনরায় শাহিনুর বলল,
-‘ ডাক্তারসাহেব ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে ।’
হেসে ফেলল প্রণয়। কিঞ্চিৎ দূরে ঠেলে শাহিনুরের ক্রন্দনরত মুখশ্রীতে দৃষ্টি বোলালো। বুকের ভিতর অতিরিক্ত সুখ অনুভূত হওয়াতে উন্মাদ হয়ে ওঠল। শাহিনুরের লালচে নাকের ডগায় আলতোভাবে কামড় দিয়ে বলল,
-‘ পুড়িয়ে পুড়িয়ে সোনা খাঁটি করছেন বেগমসাহেবা?’
সহসা চমকে ওঠল শাহিনুর। অশ্রুসিক্ত নয়নে এক পলক প্রণয়কে দেখেই পাশফিরে শুয়ে রইল। মুচকি হেসে গভীর হলো প্রণয় কিন্তু ফিরল না শাহিনুর। ধীরেধীরে কানের কাছে মুখ নিয়ে আবারও প্রণয় বলল,
-‘ কাছে ডেকে দূরে সরে যাও এ কেমন ছলনা তোমার বেগমসাহেবা ? ‘
আচম্বিতে ফিরে তাকিয়ে আবারও জড়িয়ে ধরল শাহিনুর। কাঁপা গলায় বলল,
-‘ আপনার বুকে শান্তিতে ঘুমাতে চাই, আমার খুব ক্লান্ত লাগছে আমি একটু আরাম চাই। ‘
হাসলো প্রণয় পরম স্নেহে, ভালোবাসায় ঘাড়ে অধর ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘ তোমার স্থানে তুমি ঘুমাবে বাঁধা কোথায়? ‘
শেষরাত অবধি বুকের মধ্যেখানে আগলে রাখল শাহিনুর’কে। নিভৃতে যতনে পরম সুখে তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো শাহিনুর। সারারাত মাথায় হাত বুলিয়ে দিল প্রণয়। অনুভব করল তার বউ একটু যত্ন, একটু ভালোবাসার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল। যা মিটিয়ে দিতে একটুও কৃপণতা করেনি সে।
ভোররাতেই ঘুম ভেঙে যায় শাহিনুরের। দেখতে পায় প্রিয়তমের উষ্ণ বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছিল সে। প্রণয়ের ভারি নিঃশ্বাসের শব্দে টের পায় মানুষটা ঘুমাচ্ছে। অল্প মাথা উঁচিয়ে চট করে স্বামীর ললাটে চুমু খেয়ে আবারও মাথা রাখে তার উষ্ণময় উন্মুক্ত
বুকটায়৷ পরম শান্তিতে দুচোখের পাতা এক করে সে। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই আচম্বিতে মস্তিষ্কে বিচরণ শুরু হয় গতরাতে সখিনার বলা সেই কথাগুলোর। যা তার সমস্ত সত্তাকেই ভয়ানকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
[৮২]
***
সত্যের শক্তি এতটাই ধারালো হয় যে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা মিথ্যা দিয়ে আঁটকে রাখা সম্ভব হয় না৷ মিথ্যা,জড়বস্তুর মতো, তাকে যেভাবে যেখানে ছুঁড়ে দেওয়া হবে সেখানেই ঠাঁয় পাবে। কিন্তু সত্যি নিজ ক্ষমতায় প্রতিনিয়ত হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে প্রকাশ পায়। এটাই বাস্তবতা, এটাই চিরন্তন সত্য। যেমন সত্য চন্দ্র, সূর্য তেমন সত্য সত্যের শক্তি।
নিস্তব্ধ, থমথমে পরিবেশে গতকাল যখন সর্বশেষ পর্যায়ে গিয়েও সখিনা প্রণয়ের নাম বলছিল, অগ্নিকন্যার রূপে শাহিনুর ও’কে শেষ বিদায় দেওয়ার জন্য শেষ একটা কথাই বলেছিল,
-‘ বিশ্বাসঘাতকদের আমি বাঁচতে দেই না সখী। যেমনটা দেইনি সবুর উদ্দিন’কে। সবুর উদ্দিন’কে যেমন দু’টুকরো করে বাইজি গৃহের সামনে ফেলে এসেছিলাম। ঠিক তেমনি আজ এ মুহূর্তে তোকে দু’টুকরো করে বস্তা ভরে জমিদার বাড়িতে পাঠাব! ‘
কথাগুলোর সমাপ্তি দিয়ে গলা বরাবর বটিটা হিংস্রতার সঙ্গে স্পর্শ করতেই চোখমুখ শক্ত করে, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে ওঠে সখিনা,
-‘ ডাক্তারবাবু না, ডাক্তার বাবু না এই বাচ্চা রঙ্গনের এই বাচ্চা তোর বাঁশিওয়ালার! ‘
ফুঁসে ওঠা অগ্নিশিখা ধপ করে নিভে গেল। নির্লিপ্ত ভণিতায় সখিনার থেকে সরে গেল শাহিনুর। মেঝেতে নিথর রূপে বসে দৃষ্টি অনড় রাখল সখিনার দিকে।
তার বীভৎস চেহেরায় ভয়াতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রমশ কাঁপতে শুরু করল সখিনা৷ সবুর উদ্দিন’কে শাহিনুর খু/ন করেছে ভাবতেই তার শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে তেজস্বী কণ্ঠে শাহিনুর বলল,
-‘ এবার তোদের পরিকল্পনাটা বলে ফেল। ‘
শাহিনুরের হাতে তখনো বটিটা রয়েছে। যার দিকে এক বার তাকিয়ে বারকয়েক ঢোক গিলল সখিনা৷ ধীরে ধীরে সমস্ত ঘটনাই বলতে শুরু করল,
-‘ রঙ্গনের সাথে আমার সম্পর্ক হইছে তোর বিয়ার পরে৷ আর সবার মতো কইরা সেও বাইজি গৃহে আসতো৷ শুরুতে তোর কথা জিগাইতো। তারপর আস্তে আস্তে আমার সাথে বইসাও গল্পগুজব করতো। আমার জানি কেমন ভালা লাইগা গেল৷ মনে মনে স্বপ্ন দেখলাম তুই যেমন জমিদার বাড়ির বউ হইছোস আমিও হমু। আমার স্বপ্ন আরো গাঢ় হইল যেদিন রঙ্গন মদ খাইয়া মাতাল হইয়া আমারে জড়াই ধরল। বলল, সে আমারে ভালোবাসে৷ তারপর থিকাই আমাদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়। প্রতি রাতে তার কুটিরে যাওয়া,আসা শুরু করি৷ একদিন মাতাল হইয়া সে আমারে বেশি গভীর কইরা চাইল। আমিও আর ফিরাইতে পারি নাই৷ সকালে ওইঠা আমারে কথাও দিছিল বিয়ে করবো আমারে। ‘
তীব্র ঘৃণায় মূর্ছিত হওয়ার উপক্রম হলো শাহিনুর। সখিনার থেকে কিঞ্চিৎ দূরে সরে গিয়ে অস্ফুটে স্বরে বলল,
-‘ তোরা সব কয়টা একেক টা শয়তান। এবার বল আমাদের সংসার ভাঙার জন্য ঠিক কী কী পরিকল্পনা করেছিস তোরা। ‘
সখিনা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। বলল,
-‘ বিশ্বাস কর তোর কোন ক্ষতি করবার চাই নাই আমি। কিন্তু যেদিন থিকা জানবার পারছি আমার পেটে ওর বাচ্চা আসছে, সেদিন থিকা ওরে চাপ দিতাছি আমারে বিয়ে করার জন্য৷ কিন্তু ও খালি সময় চায়। শেষে তো আমারে ফিরাইয়া দিল, বলল বাচ্চা নষ্ট কইরা দিতে! কিন্তু আমার খুব ভয় করে এইসবে আমি রাজি হই না। একমাস আগে হঠাৎ আমারে বলল, এই বাচ্চা রাখব, আমারে বিয়াও করব শর্ত একটাই তোর মন থিকা ডাক্তারবাবুরে মুইছা দিতে হবো৷ যদি পারি তাহলেই সে আমারে বিয়ে করবো। ‘
সহসা শব্দ করে হেসে ওঠল শাহিনুর। বীভৎস সেই হাসির শব্দ শুনে পিছিয়ে গেল সখিনা। মাত্রাতিরিক্ত কাঁপতে থাকল তার কাঁটা রক্তাক্ত হাতটি। তা দেখে হাসিটা চওড়া করে শাহিনুর বলল,
-‘ আর কত বোকা হবি তোরা? তোর কী মনে হয় মিথ্যা ঘটনা দিয়ে ডাক্তারসাহেবকে ফাঁসাবি আর সে হাত,পা গুটিয়ে বসে থাকবে? জানিস তোর পরিণতি কী হতো? ডাক্তারসাহেবকে ফাঁসাতে গিয়ে যখন ধরা খেতি তখন সত্যিটা বললেও কেউ বিশ্বাস করতো না। নিজেই ফেঁসে যেতি। মাঝখান থেকে কাজ হাসিল হয়ে যেতো ওদের৷ ‘
শাহিনুর ঘাড় নিচু করে সখিনার দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘ তারপরের পরিকল্পনা কী ছিল? আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে তার কী লাভ? ‘
-‘ পলাশ চৌধুরীর কথায় এসব করছে। ‘
শাহিনুর আগের স্থানে নিশ্চিন্ত মনে বসল। চোখ বন্ধ করে সেই রাতের কথা ভাবল, যে রাতে প্রণয় ভয়ানক শাস্তি দিতে যাচ্ছিল রঙ্গন’কে। সহসা চোখ খুলল সে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-‘ কু/ত্তার লেজ কোনদিন সোজা হয় না। ‘
ওঠে দাঁড়াল শাহিনুর। প্রণয়ের চিকিৎসা বাক্স এনে সখিনার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে বলল,
-‘ তোকে ব্যবহার করে করে ঠিক সময় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। তুই এখনো ঐ রঙ্গন চৌধুরী’কে চিনতে পারিসনি। সে হচ্ছে জমিদার বংশের সুপ্ত ঘাতক। তার সম্পর্কে যা যা জানিস সবটা খুলে বল, তোকে সহ তোর বাচ্চা’কে আমি বাঁচিয়ে দেব। ‘
সখিনা প্রথমে কিছু বলল না৷ শাহিনুরও দৃঢ়তার সঙ্গে তার পাশ থেকে ওঠে দাঁড়াল। এক পা দু পা করে চলে যেতে শুরু করল সে। হঠাৎ সখিনা ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল,
-‘ তোর আম্মারে কে মারছে শুইনা যাবি না সখী? ‘
মুহুর্তেই পা দুটো থেমে গেল, সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল শাহিনুরের৷ মাথাটা ঝিমঝিম ঝিমঝিম করে ওঠল। বক্ষস্থলের তীব্র কম্পন কোনক্রমেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না সে। কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-‘ পলাশ না রঙ্গন? ‘
ভাঙা কন্ঠে সখিনা জবাব দিল,
-‘ রঙ্গন। ‘
নিমিষেই দৃষ্টিজোড়া বদ্ধ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ত্যাগ করল শাহিনুর৷ দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
-‘ তুই কীভাবে জানলি? ‘
-‘ মদ খেয়ে নেশা ধরলে রঙ্গনের কোন হুঁশ থাকে না। তখন সে যা ইচ্ছা তাই করে যা ইচ্ছা তাই বলে। এক রাতে নেশারঘোরে যখন আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হইল তখন আবল তাবল অনেক কথা বলল। সেকথার মধ্যেই একটা ছিল, ” পিছন থেকে তরবারি ঢুকালাম আর বের করলাম না৷ কত্তবড়ো সাহস আমার আব্বারে আঘাত করছে, আমার বড়োভাইকে আঘাত করতে চাইছে। আমি সহ্য করতে পারিনি। ওরে মেরেও শান্তি পাচ্ছি না৷ রাতের পর রাত জ্বালিয়ে মারছে। ঐ রাতটা ভুলার জন্য নিজের হাতে করা প্রথম খু/নটা’কে মন, মস্তিষ্ক থেকে মুছার জন্য কত চেষ্টা করছি পারছি না। বোতলের পর বোতল খালাস করছি, একের পর এক দেহ ভোগ করছি শালার বাইজিডা মাথা থেকে গেল না! এক খু/নের এত জ্বালা না থাকলে আরো কয়েকটা করে ফেলতাম। তখনই আমি পরিষ্কার হই যে শারমিন খালারে রঙ্গনই মারছে! ‘
[৮৩]
কথিত আছে – চোরের দশদিন গিরস্থের একদিন। শাহিনুর জানতো রঙ্গন আবারও ডাকবে সখিনা’কে। তাই সেই মোক্ষম সময়েরই অপেক্ষাতে ছিল সে। রাত তখন দশটা ছুঁই ছুঁই। ইমারজেন্সি ডিউটি পড়ায় ঘণ্টা দুয়েক আগেই হাসপাতালে চলে গেছে প্রণয়। যাওয়ার পূর্বে শাহিনুর’কে বুঝিয়ে গেছে তার জন্য অপেক্ষা না করে যেন ঘুমিয়ে পড়ে। তার ফিরতে ফিরতে সকালও হতে পারে৷ স্বামীর আদেশ অনুযায়ী ঘুমাতেই যাচ্ছিল সে। এমন সময় হঠাৎ ভয় মিশ্রিত মুখে ঘরে প্রবেশ করল সখিনা। তাকে দেখে শাহিনুর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
-‘ ও ফোন করেছে? ‘
দেরি না করে তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়লো সখিনা। শোয়া থেকে সটান হয়ে বসে পড়ল শাহিনুর। রহস্যঘন একটি হাসি দিয়ে পুনরায় শুধাল,
-‘ ঐ কুটিরেই যেতে বলেছে। ‘
পূর্বের ন্যায় মাথা নাড়লো সখিনা৷ শাহিনুর ওষ্ঠাধরে হাসিটুকু বজায় রেখেই আদেশ করল,
-‘ বলে দে যাবি। ‘
সখিনা কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-‘ যাবার আগে বাইজি গৃহ থেকে দুই বোতল কস্তুরী নিতে বলছে। ‘
শাহিনুর মুচকি হেসে বলল,
-‘ তিন বোতল নেবো তুই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়। ‘
অমবস্যার দ্বিতীয় রজনি। পুব আকাশে খণ্ডিত চাঁদটি স্পষ্ট হয়ে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। হাসপাতাল গেট থেকে এক মিনিট পথ হেঁটে গিয়ে একটি সিএনজি’তে ওঠল শাহিনুর। উদ্দেশ্য বাইজি গৃহ। তার পরনে ছাই রঙা একটি সূতি শাড়ি, মাথা থেকে কোমড় অবধি বড়োসড়ো উড়ানি দিয়ে মোড়ানো। যার ফলে সহজে চেনার উপায় নেই সে কে? সতের মিনিটের মাথায় বাইজি গৃহে পৌঁছাল শাহিনুর। সেখানে গিয়ে দেখা করল বাইজি গৃহের ভৃত্য রেশমার সঙ্গে। সখিনার জন্মদাত্রী রেশমা খাতুন। প্রধান ফটকের ডান পাশে চৌচালা ছোট্ট একটি ঘরে ছিল রেশমা খাতুন। শাহিনুর দেখল সে শিল দিয়ে পাটাতে ফিকে সবুজ রঙের ফলগুলো পিষে রস বের করে একটি বাটিতে রাখছে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃঢ় পায়ে রেশমার দিকে এগিয়ে এলো শাহিনুর। মৃদু হেসে বলল,
-‘ তৈরি? ‘
রেশমা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। শাহিনুর আর দেরি করল না উড়ানির ভেতর থেকে একটি কাঁচের বোতল বের করে বাটিতে থাকা সমস্ত রস বোতলে ঢেলে নিল। রেশমা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-‘ আমার ডর করে রে মা। ‘
মৃদুহাস্যে শাহিনুর জবাব দিল,
-‘ আমি যদি ভয় না পাই তোমরা কেন ভয় পাবে? তোমাদের গা’য়ে একটা আঁচও লাগতে দেব না। বিশ্বাস রাখো। ‘
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বোতলে মুখ মেরে উড়ানির ভেতর থেকে আরো দু’টি বোতল বের করল। হঠাৎ রেশমা শাহিনুরের হাত চেপে ধরে বলল,
-‘ তুই স্বামী, সংসার সব হারাবি দেখিস। ‘
-‘ এটা আমি জানি এই হারানোর সুর পুরোনো নতুন নয়। ‘
রেশমা’কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল শাহিনুর৷ রেশমা আঁচলে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ওঠল। জোৎস্নার রাত্রিতে ঘন জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শাহিনুর। বুকের ভিতরটা তীব্র উত্তেজনায় কাঁপছে তার। তবু দমে নেই সে। চারপাশে ছোটবড়ো অগণিত গাছপালা। যত এগুচ্ছে ততই যেন গভীর অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। সহসা মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক বন্য পাখিরা উড়ে গেল। আতঙ্কিত হয়ে বুকের ভিতরে ধড়াস করে ওঠল। বারকয়েক ঢোক গিয়ে স্মরণ করল আম্মাকে, আম্মার কথাগুলো’কে। আপনমনেই বলে ওঠল, “বাঘ কখনো বাঘ মারে না, কুকুর কখনো কুকুর মারে না, কিন্তু মানুষ মানুষ মারে!” পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল শাহিনুর। দূরবর্তী স্থানে গুটিকয়েক শিয়ালদের চিৎকার শুনতে পেল। যার ফলে তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত চলতে লাগল। হঠাৎ চলতি পা থামিয়ে দিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিল, আকাশ পানে তাকিয়ে জ্বলজ্বল করে ওঠা তাঁরাদের দিকে দৃষ্টিপাত করল। শরীর এবং মনে তাজা হয়ে ওঠল খু/নের নেশা। আর দেরি সইতে পারল না। প্রায় ছুটেই উপস্থিত হলো রঙ্গনের ছোট্ট কুটিরের সামনে। যেখানে অল্পস্বল্প অনেক স্মৃতিই রয়েছে তার এবং তার বাঁশিওয়ালার। নাহ তার বাঁশিওয়ালা নয়, তার বিশ্বাস হত্যাকারীর!
শাহিনুর কুটিরের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল নেশায় বুঁদ হয়ে বসে আছে রঙ্গন৷ অতিরিক্ত নেশা হয়ে যাওয়ার ফলে তাকে দেখে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না৷ কেবল ঢুলো ঢুলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। শাহিনুর তার ধারালো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে গিয়ে শান্তভাবে তার পাশে বসল। তৎক্ষনাৎ রঙ্গন দু’হাতে তার চোয়ালজোড়া চেপে ধরে বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠল,
-‘ তোমার মাঝে আমি আজকেও নুর’কে দেখতে পাচ্ছি সখিনা। ‘
মেকি হেসে নিজের গালে চেপে ধরা রঙ্গনের হাত দু’টো জোর পূর্বক ছাড়িয়ে শাহিনুর বলল,
-‘ নুর’কে কেন? মুনতাহাকে দেখা উচিৎ ছিল, তাকে তো তুমি ভালোবাসো। ‘
বিমর্ষ মুখে রঙ্গন বলল,
-‘ শরীর বেশ গরম আছে এমন সময় অমন লাস্যময়ীকেই তো মনে পড়বে। ‘
অশ্লীল ভণিতায় কথাটা বলতেই শাহিনুরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-‘ তোর এই জঘন্য রূপটা কোন খোলসের আড়ালে রেখেছিলি। ‘
রঙ্গন চুপ হয়ে গেল। পরোক্ষণেই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘ হ্যাঁ আমি জঘন্য, আমি খুব খারাপ। কেউ ভালোবাসে না আমাকে কেউ না। ‘
তাচ্ছিল্য হেসে শাহিনুর বলল,
-‘ তোমার মতো কাপুরুষ কারো ভালোবাসা পায় না। ‘
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো অবস্থা করে রঙ্গন ফিরে তাকিয়ে বলল,
-‘ আরেব্বাস তোমার কণ্ঠও তো নুরের মতো লাগছে।’
বলেই সটান হয়ে ওঠে দাঁড়াল। দু’হাত কোমড়ে রেখে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শাহিনুর’কে দেখতে লাগল। মুহূর্তেই ওষ্ঠাধরে দুরন্ত হাসি ফুটে ওঠল তার। ধপ করে পুনরায় শাহিনুরের পাশে বসে পড়ল। এক হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ চেপে ধরল। অপরহাতে সামনে থাকা তিনটে বোতলের মধ্যে একটি বোতল ওঠিয়ে দাঁত দিয়ে বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে তরল পদার্থ পান করতে লাগল। এক নিমিষেই বোতল খালি করে ছুঁড়ে ফেলে শাহিনুরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-‘ তুমি তুমিই এই যে বোতলগুলো দেখেই বুঝেছি তুমি কে? ‘
হুহা করে হেসে ওঠে হাত বাড়িয়ে আরেকটি বোতল তুলে নিল। নিঃস্তব্ধ হয়ে বসে আলগোছে কাঁধ থেকে রঙ্গনের হাত ছাড়িয়ে নিল শাহিনুর৷ বলল,
-‘ এই দুনিয়াতে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর অভাব নেই। তার মধ্যে একটি ধ্বংস হয়ে গেলে লাভও হবে না, ক্ষতিও হবে না। তবে কারো প্রতিশোধ পরায়ণ আত্মায় শান্তি মিলবে। ‘
দ্বিতীয় বোতলটি অর্ধেক খালি করেই গলা চেপে ধরল রঙ্গন। তার শুভ্র শরীরটা হঠাৎই বিবর্ণ রূপ ধারণ করতে শুরু করল। অতিরিক্ত নেশা হয়ে যাওয়ার ফলে বিষক্রিয়ায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতেও কষ্ট হলো। কিন্তু তার হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে শাহিনুর বলে ওঠল,
-‘ বাঁশিওয়ালা? ‘
দু’হাতে গলা চেপে ধরে চমকে তাকালো রঙ্গন। কাঁপা গলায় বলল,
-‘ শাহিনুর! ‘
আর কথা বলার শক্তি পেল না রঙ্গন। ধপাস করে মাটিতে শুয়ে পড়ল, দুর্বল চিত্তে তড়পাতে তড়পাতে শুধু এটুকু বলল,
-‘ আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।’
সেসব কোন কথাই কানে নিল না শাহিনুর। সে বেশ উৎসাহের সহিত রঙ্গনের দিকে ঝুঁকে বলল,
-‘ এই বোতলটা, যেটায় তুমি সর্বপ্রথম কস্তুরী ভেবে পান করলে ওখানে কী ছিল জানো? ধুতুরাফলের রস ছিল। যা আমি বেশ পরিকল্পনা করেই তৈরি করে এনেছি তোমার জন্য। তোমার আম্মা, মানে আমার শাশুড়ি আম্মার কাছেই শুনেছিলাম, ধুতুরাফুলে, ধুতুরাফলে নাকি বিষ থাকে, যার গন্ধ নাকে এলেও মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে আর আমি ওসবের রস তোমার শরীরে প্রবেশ করিয়েছি। কেন জানো? প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য৷ আমার আম্মা’কে তুমি পেছন থেকে আঘাত করেছো, আড়ালে থেকে আমার ডাক্তারসাহেব কে কলঙ্ক দিতে চেয়েছো। সেসবের প্রতিশোধই আজ নিতে এসেছি আমি। এক নারীর প্রতিশোধ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে নিশ্চয়ই টের পাচ্ছো জমিদারের ছোটো পুত্র। ‘
কিঞ্চিৎ উচ্চকণ্ঠে বলল,
-‘ আমি শারমিন শায়লার কন্যা, বাইজি শারমিন শায়লার কন্যা শাহিনুর শায়লা। মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে এসেছি। আমি ডাক্তার প্রণয় চৌধুরীর অর্ধাঙ্গিনী। তার চরিত্রকে কলুষিত করার চেষ্টা করেছো বলে তার শাস্তি দিতে এসেছি। ‘
মুখ ভরে রক্ত বমি করল রঙ্গন। ঘৃণায় ছিটকে সরে গেল শাহিনুর৷ রঙ্গন গোঙাতে শুরু করল। গোঙাতে গোঙাতে অস্ফুটস্বরে বলল,
-‘ আমাকে বাঁচাও, মেরো না আমাকে। ক্ষমা করো নুর ক্ষমা করো। আমি খারাপ না, আমি খু/নি না। আমি ইচ্ছে করে কিছুই করিনি। ‘
ক্রোধে মাটিতে এক পা দিয়ে আঘাত করে দাঁত কিড়মিড় করে চিৎকার করে ওঠল শাহিনুর,
-‘ তুই কেমন পুরুষ? কেমন মানুষ তুই যে বার বার তোকে দিয়ে অন্যায় করানো হবে আর তুই করবি৷ তোর মতো মানুষের তো আত্মহত্যা করে মরা উচিৎ। ভাবতেই ঘৃণা হয় আমার কিশোরী মনের ভুল অনুভূতি তুই ছিলি। তুই একটা মেরুদণ্ডহীন প্রাণী৷ যার কিনা নিজের কোন সত্তা নেই। যে কিনা এক ভাইয়ের প্ররোচনায় দিনের পর দিন আরেক ভাইয়ের ক্ষতি করে যাচ্ছিল৷ তোর কোন ব্যক্তিত্ব নেই। তুই এক মুখোশধারী কালসাপ। ভাইয়ের কথায় যখন আরেক ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারিস। তাহলে ভাবির দেওয়া এই মৃত্যুকেও হাসিমুখে গ্রহণ করে নে। বাঁচার জন্য আকুতি করিস না৷ এ পৃথিবীতে তোর কোন প্রয়োজন নেই। ‘
একদমে কথাগুলো শেষ করতেই ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল শাহিনুর৷ রঙ্গনের তীব্র যন্ত্রণাটুকু খুব কাছ থেকে অনুভব করার চেষ্টা করল। চোয়াল বেয়ে নোনাপানির স্রোত নামছে তার৷ রঙ্গনের শেষ পরিণতি দেখে একদিকে যেমন কষ্ট হচ্ছে অপরদিকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,
-‘ তুই আমার মা’কে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিস। তোর জন্য আজ আমি মাতৃহারা। ‘
কিন্তু কণ্ঠনালি থেকে আর অল্প আওয়াজও বের হলো না তার। ডুঁকরে ওঠল সে। সম্মুখের দৃশ্য দেখে সর্বাঙ্গে কেঁপে ওঠল। দু’হাতে মাটি খামচে, দাঁত দিয়ে মাটি কামড়ে শুয়ে আছে রঙ্গন৷ তার শ্বাস খুব দ্রুত চলছে। হয়তো কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে সে৷ এমন সময় হুট করে কাছে গিয়ে রঙ্গনের মাথা উঠিয়ে নিজের কোলে শোয়ালো। দুগালে মৃদু থাপ্পড় দিতে দিতে চিৎকার করে বলল,
-‘ রঙ্গন, এই রঙ্গন আমার আম্মা’কে কেন তুমি মারলে? রঙ্গন এই রঙ্গন কেন তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমার সাথে? কেন তোমার বড়ো ভাইয়ের বিরুদ্ধে এতোবড়ো ষড়যন্ত্র করলে? এই রঙ্গন তুমি ডাক্তারসাহেবের খুব আদরের রঙ্গন… রঙ্গন…।’
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেই চিৎকার করে ওঠল শাহিনুর৷ হাউমাউ করে কেঁদেও ওঠল। আম্মা বলে আর্তচিৎকার দিয়ে সহসা চুপ মেরে গেল। আর একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। দু’টো খু/ন হয়ে গেল তার দ্বারা। দু’টো প্রাণ নাশ করল সে। অথচ এসব না হলেও পারতো৷ সে নারী, সে মায়ের জাত। তার দ্বারা সৃষ্টি ঘটবে ধ্বংস নয়। অথচ নিষ্ঠুর নিয়তি তার দ্বারা দু দুটো ধ্বংস ঘটিয়ে ফেলল। শ্বাসরুদ্ধ করে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে রঙ্গনের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকালো। কম্পিত হাতে রঙ্গনের মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে দিল। মায়ের খু/নিকে নিজহাতে শাস্তি দিতে পেরে কষ্ট, গর্ব উভয়ই হচ্ছিল তার। তাই রঙ্গনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘ তুমি ছিলে সুপ্ত ঘাতক, তোমার পুরো জীবনটাই ছিল অন্যের ব্যবহৃত ঠিক জড়োবস্তুকে যেমন ব্যবহার করা হয়। আর কতকাল অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হবে, অন্যের পাপে পাপি হবে, এমন অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে দিলাম তোমায়, চিরতরে মুক্তি! ‘
নিস্তব্ধ রজনিতে গহীন অরণ্যের এক ছোট্ট কুটিরে এক ষোড়শী কন্যার হাতে প্রাণ হারালো জমিদারের ছোটো পুত্র, প্রেরণা চৌধুরীর বুকের ধন, প্রণয় চৌধুরীর সবচেয়ে আদুরে ছোট্ট ভাইটি। শেষ দফায় যখন শাহিনুর কাঁদল তখন একটি বাক্যই আওড়াল,
-‘ আমাদের ভবিতব্য এমন হওয়ার কথা ছিল না বাঁশিওয়ালা। ‘
..
..
নিয়তি বড়োই নিষ্ঠুর হয়৷ ভাগ্যের লীলাখেলা বোঝা খুবই মুশকিল। কে জানতো? এই মৃতদেহ পঁচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পৌঁছে দেবে তার মৃত্যুর খবর। কে জানতো? প্রণয় চৌধুরীর সবচেয়ে কাছের মানুষটির দ্বারাই প্রাণ হারাবে তার আদরের ছোট্ট ভাইটি। কে জানতো, পরপর দু’টো সন্তান’কে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে প্রেরণা চৌধুরী?