মানুষ’কে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত। যার অর্থ মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা সৃষ্টির সেরা৷ বইয়ের পাতায় এই দু’টো লাইন দেখে শাহিনুরের অধর কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠল৷ মনটা একদম ভালো নেই তার। সকালের নাস্তা ছেড়ে প্রণয় হাসপাতালে গেছে। সখিনা গেছে বাইজি গৃহে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে৷ একা সময় পার করার জন্য প্রণয়ের একটি বই পড়ছিল সে৷ পড়তে পড়তে এই লাইনটি দেখে আফসোস মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। হঠাৎই বই বন্ধ করে অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে৷ নিজের জীবনের শুরুটা ভাবতে ভাবতে চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সহসা ফুঁপিয়ে ওঠে বলল,
-‘ আম্মা ও আম্মা… তুমি কই আম্মা। ‘
এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠল। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে দ্রুত ওঠে গেল সে।
-‘ নুর আমি বড়ো ভাবি বলছি। ‘
-‘ আপনি কেমন আছেন বড়ো ভাবি? ‘
-‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ ওদিকের সব খবর ভালো? ‘
বিমর্ষ মুখে শাহিনুর জবাব দিল,
-‘ হ্যাঁ। ‘
অনেকটা সময় দু’জন দু’জনের খোঁজখবর নিল। শাহিনুর সকলের খোঁজ শেষে অঙ্গনের খোঁজ নিল৷ মাঝে মাঝে নাকি শাহিনুর’কে অনেক ডাকাডাকি করে। যদি কেউ শান্ত ভাবে বুঝিয়ে বলে একাই চুপ করে যায়। হঠাৎ শাহিনুর বলল,
-‘ ভাবি জানেন আজ আমি আম্মা’কে স্বপ্নে দেখেছি।’
-‘ এ’বাবা তুমি কাঁদছো কেন? এটাতো ভালো কথা। কী দেখেছো, মাইয়োই মা কিছু বলেছে টলেছে নাকি?’
-‘ আমি আর ডাক্তার বাবু শুয়ে ছিলাম হঠাৎ আম্মা এসে আমাদের দু’জনের মাঝখানে শুয়ে পড়ল। আমি বললাম, আম্মা তুমি এসেছো? এই বলে কেঁদে ফেললাম সাথে সাথে আম্মাও কেঁদে ফেলল। তারপরই ঘুমটা ছুটে গেল। ‘
এই স্বপ্ন কিসের ইঙ্গিত কিঞ্চিৎ টের পেল শবনম। তাই কিছু প্রশ্ন করতে উদ্যত হতেই মুনতাহার চিৎকার শুনতে পেল৷ আকস্মাৎ এমন চিৎকারে ভয়ে শিউরে ওঠল শবনম৷ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শাহিনুর’কে বলল,
-‘ নুর আমি তোমাকে পরে আবার ফোন করব। মুনতাহার বোধহয় ব্যথা ওঠেছে। যাই আমি। ‘
শবনম ফোন রাখতেই শাহিনুর দ্রুত প্রণয়’কে ফোন দিল। প্রণয় হ্যালো বলতেই সে বলল,
-‘ বড়ো ভাবিকে ফোন দিয়েছিলাম, মেজোভাবির ব্যথা ওঠেছে বোধহয় আপনি ডাক্তার পাঠান তাড়াতাড়ি। ‘
প্রণয় শান্ত স্বরে বলল,
-‘ তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেন সব রকম ব্যবস্থা আছে ওখানে৷ তারপর যদি সিরিয়াস হয় তাহলে আমি আছি। তুমি চিন্তা করো না, সাবধানে থেকো। ‘
শাহিনুর’কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল প্রণয়।
ঠিক দু’ঘন্টা পর সখিনা এলো। সঙ্গে খবর নিয়ে এলো, মুনতাহার বাচ্চাটা নাকি পেটের ভিতরেই মরে ছিল৷ অনেকে ধারণা করেছিল বাড়িতে রাখার জন্য এমন হয়েছে। কিন্তু প্রণয় জানিয়েছে বাচ্চাটা আরো একমাস আগেই মারা গেছে! এসব শুনে শাহিনুরের
শরীরের প্রতিটি লোমকূপ কেঁপে ওঠল। কাঁপা কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল,
-‘ মেজোভাবি এখন কোথায়? ‘
-‘ হাসপাতালে নিয়া আসছে। বাড়িতে হইল না বইলাই তো শেষে হাসপাতাল নিয়া আসলো। কিন্তু সিজার করার পর দেখে মরা বাচ্চা! আহারে ছেলে ছিল। কি সুন্দর ধবধবা ফর্সা, ছোট চাচার মতো হইতো মনে হয়। ‘
আর অপেক্ষা করল না শাহিনুর৷ সখিনা’কে নিয়ে তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে চলে গেল সে। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে পলাশের মুখোমুখি হতেই তার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠল। প্রণয়ের স্বপ্নের কথা শুনে যেমনটা দিয়েছিল ঠিক তেমনইভাবে। কিন্তু এবার সে জ্ঞান হারালো না। নিজেকে সামলে নিল সহজেই। কিন্তু সহসা সেই রাতের কথা স্মরণ হলো, যে রাতে গর্ভপাত করানো হয় মান্নাত বুবু’কে। তারপর থেকে প্রতিটি স্মৃতি মনে পড়তে পড়তে শেষ দৃশ্যটুকু স্মরণ হতেই শরীরের শিরায় শিরায় জ্বলতে শুরু করে তার৷ এসেছিল মুনতাহাকে দেখতে কিন্তু পলাশকে দেখে তার বুকটা বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠল। মুনতাহা পর্যন্ত যাওয়ার পূর্বেই প্রণয় এসে সামনে দাঁড়ালো। তার অনুমতি ছাড়া এভাবে হাসপাতালে আসাতে প্রচণ্ড রেগেও গেল৷ সকলেই জানল, শাহিনুর এসেছিল কিন্তু কেউই তার সঙ্গে কথা বলতে পারল না৷ সেই সুযোগটুকুও দিল না প্রণয়৷ জোর পূর্বক শাহিনুর’কে কোয়ার্টারে রেখে সখিনা’কে কড়া ভাষায় বলে এলো, পরবর্তী’তে তারা যেন এই ভুল না করে। শাহিনুর’কে বলল,
-‘ এভাবে ওখানে গিয়ে ভুল করেছো তুমি। তোমার উচিৎ ছিল একবার হলেও আমাকে জানানো। ‘
অন্য সময় হলে শাহিনুর রাগ করতো, জেদ দেখাতো৷ কিন্তু আজ আর সেসবের কিছুই করল না। তার মাথা ঝিম ধরে আছে। মান্নাত বুবুর খু/নি’কে চোখের সামনে দেখেও কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস লাগছে৷ সবশেষে এখনো সে জানতে পারেনি তার মা’য়ের মৃত্যু রহস্য। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল, মান্নাত বুবুর মতোই তার মা’কেও পলাশ চৌধুরী খু/ন করেনিতো?
দু’হাতে মাথা চেপে ধরল শাহিনুর৷ তার এক সত্তা টানছে প্রণয়ের দিকে। আরেক সত্তা টানছে আম্মা, বুবুর খু/নির দিকে। যে কোন একটা পথ বেছে নিতে হবে তাকে৷ হয় প্রণয় নয় তো ফাঁসি। হ্যাঁ শেষ পরিণতি তার ফাঁসিই হবে। সবুর উদ্দিন’কে খু/নের শাস্তি তাকে পেতেই হবে। প্রণয় ছাড়া কেউ জানে না এই সত্যিটা৷ কিন্তু একদিন না একদিন সবাই’কে জানতে হবেই। সে নিজেও চায় শাস্তি হোক তার৷ কিন্তু তার শাস্তি হলে প্রণয়ের কী হবে? এই প্রশ্নটা তার সমস্ত সত্তা’কেই দুমড়েমুচড়ে দেয়।
[৭৬]
উত্তপ্ত দুপুরে ক্লান্ত মুখে গৃহে ফিরল প্রেরণা৷ সঙ্গে ছিল রঙ্গন। তাদের বংশধর মুনতাহার মৃত ছেলেটা’কে হাসপাতালেই রেখে এসেছে। কিছুক্ষণ পর হয়তো নিয়ে আসা হবে। প্রথম এবং শেষ গোসল করিয়ে অলিওর চৌধুরীর পাশেই চিরকালের মতো রেখে আসা হবে৷ গৃহে ঢুকেই মা’কে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল রঙ্গন। যে কষ্ট সে সহ্য করতে পারে না, সেই কষ্টই বার বার মৃত্যু অনুভূতি দেয় তাকে৷ রঙ্গন’কে এভাবে দেখে শোকের ছায়াটা ঘন হয়ে ওঠল৷ প্রেরণা আফসোসের সুরে বলল,
-‘ যার সন্তান গেল তার তো কোন হেলদোল নাই গো বাবা। তার কোন হেলদোল নাই৷ কত আশা ছিল বংশের বাতি জ্বলব। বাতি জ্বলার আগেই নিভা গেলো। ‘
পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে শোকের ছায়া যেন সরছেই না৷ প্রেরণার আজ মনে হচ্ছে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার অভিশাপেই শুরু হয়েছে ধ্বংসলীলা। একেবারে ধ্বংস স্তুপে পরিণত না হওয়া অবধি এই লীলাখেলা চলতেই থাকবে৷ পৃথিবীর সমস্ত জায়গা আলো রয়েছে শুধু পাঁচফোড়ন গৃহই ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে৷ হঠাৎ প্রেরণা চিৎকার করে ওঠল,
-‘ হে আল্লাহ আমার সন্তানদের জীবনে রাতের কী শেষ নাই? ‘
এমন সময় এক ভৃত্য বলে ওঠল,
-‘ আল্লাহ ভালা জানে এই জমিদার বংশ নির্বংশই হয় কিনা! ‘
চলবে…
®জান্নাতুল নাঈমা
( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ)#বাইজি_কন্যা
#পর্ব_৪৫ ( বর্ধিতাংশ )
পুবের আকাশে সূর্যটা হেলে পড়েছে আধঘন্টা আগে।ধীরেধীরে চারদিক ঝাপসা হতে হতে একেবারে অন্ধকার নেমে এলো। আসর ওয়াক্তের পরপরই জানাজা শেষে পলাশ এবং মুনতাহার মৃত পুত্র’কে কবর দেওয়া হয়। আটমাসের বাচ্চা ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো – বাচ্চাটার পুরো শরীরের বর্ণ ছিল নীল৷ বিষয়’টা প্রণয় খেয়াল করেছে হাসপাতালে থাকা কালীনই তাই কিছু টেস্ট করাতে ভুলেনি সে৷ চাচা হিসেবে, একজন ডাক্তার হিসেবে অন্তত বাচ্চার মৃত্যুর কারণটা তার জানা উচিৎ। বাচ্চার দেহের দৃশ্য দেখে একজন ডাক্তার হিসেবে বেশ সন্দেহ জনক লেগেছে তার কাছে। এশার আজানের পূর্বমূহর্ত। আকাশের অবস্থা সুবিধার না৷ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। গোরস্থানে তখন রঙ্গন আর প্রণয় ছিল। কবরের ওপর খেজুরের ডাল কেটে দিয়ে পাশেই বসে আছে রঙ্গন। তাজা মাটিতে হাত বুলিয়ে আদর করছে সে। বিরবির করে আওড়াচ্ছে,
-‘ আমার মুনের অংশ ছিলি তুই। তোকেও আমি খুব ভালোবাসিরে… এভাবে মুনের বুক খালি করে কেন চলে গেলি? ‘
প্রণয় বিরক্তি চাহনিতে তাকালো রঙ্গনের দিকে। গম্ভীর স্বরে বলল,
-‘ মেজোভাইয়ের সামনে এই আচরণ প্রকাশ করিস না। তাহলে মুনের কপালেই দুঃখ হবে। ‘
সঙ্গে সঙ্গে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছলো রঙ্গন৷ চোখ, মুখ লাল করে প্রণয়ের দিকে তাকালো। অন্ধকারে আবছা দেখতে পেল, প্রণয়ের মুখটাও বেশ বিষণ্ন হয়ে আছে। তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
-‘ আমাকে বাড়ি দিয়ে আসবে ভাই? আমার শরীর’টা অবশ হয়ে আসছে। ‘
চাপা নিঃশ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে রঙ্গন’কে ধরল প্রণয়। ভরসা দিয়ে বলল,
-‘ চল। ‘
গৃহে পৌঁছাতে পৌঁছাতে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে দু’ভাই অনেকটা ভিজে গেল। হঠাৎ আকাশ, মাটি কাঁপিয়ে বজ্রপাত ঘটল। শুরু হলো ভারী বর্ষণ। প্রণয়, রঙ্গন তখন পাঁচফোড়ন গৃহের সদর দরজায় উপস্থিত হয়েছে। বৈঠকখানা ব্যতীত পুরো গৃহের কোন কক্ষেই আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। প্রেরণার ঘর থেকে শুধু কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। অন্ধকার পরিবেশে এই কান্না পুরো গৃহের পরিবেশ শোক বিহ্বল করে তুলেছে৷ মুহূর্তের মধ্যেই প্রণয় অনুভব করল, পুরো দুনিয়ার মতো করেই পাঁচফোড়ন গৃহও ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। সকাল হতেই দুনিয়াতে আলো ফিরে আসবে। কিন্তু এই গৃহে কবে আলো ফিরবে তার কোন হদিস নেই। ভারী বর্ষণের শব্দ কর্ণকুহরে বাড়ি খেতেই মনে হলো – তার মা’য়ের মতো করে, হাসপাতাল বেডে শুয়ে থাকা মুনতাহার মতো করেই বুক ভাসিয়ে আজ আকাশ কাঁদছে। আকাশের কান্নায় কেঁপে ওঠছে মাটি, হয়তো মুনতাহার কান্নায়ও কেঁপে ওঠছে প্রতিটি মাতৃ হৃদয়! রঙ্গন’কে পৌঁছে দিয়ে প্রেরণার কক্ষে প্রবেশ করল প্রণয়। ভাগ্যের করুণ দশায় প্রণয়’কে কাছে পেয়ে আরো ভেঙে পড়ল প্রেরণা৷ দীর্ঘসময় ছেলের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদলো। বার বার ক্ষমা চাইল ছেলের কাছে। যার কোন অর্থ খুঁজে পেল না প্রণয়। খুঁজে পেলেও স্বীকার করল না। হাজার হোক মা তো…। প্রেরণার ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর বুকের ভিতর যন্ত্রণা দিল খুব৷ তার আম্মা’কে যে সে ভীষণ ভালোবাসে। রাগ, অভিমান শেষে সত্যি এটাই প্রেরণা তার জন্মদাত্রী, সকল নারীর ঊর্ধ্বে তাকেই অনেক বেশি ভালোবাসে সে৷ প্রণয়ের সান্নিধ্য পেয়ে কান্না থামলেও ফোঁপাতে লাগল প্রেরণা। প্রণয় তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
-‘ আম্মা শান্ত হন। যিনি দিয়েছিল তিনিই নিয়ে গেছেন। তার দয়া হলে আবার দেবেন। এভাবে কাঁদবেন না আম্মা। ‘
প্রণয়ের শার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে আর্তনাদ করে ওঠল প্রেরণা। বলল,
-‘ তোর বাবার বংশ কী নির্বংশ হবোরে প্রণয়? পল্লবের সন্তান নাই, পলাশের কী সর্বনাশ ঘটলো। আমার অঙ্গন টা কেমন হয়ে গেল। ‘
প্রেরণার আহাজারিতে অধৈর্য হয়ে প্রণয় বলল,
-‘ আম্মা শান্ত হন। আপনার আরো দু’টো সন্তান আছে আপনি এমন করছেন কেন? তাছাড়া মেজো ভাবি আবার সন্তান নিতে পারবেন। আমি আছি, রঙ্গন আছে। আপনি, আপনারা নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে পারবেন। এই বংশ নির্বংশ হবে না। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে। ‘
ছেলের স্বান্তনা পেয়ে কিছুটা শান্ত হলো প্রেরণা। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে তাই বেশি দেরি করতে পারল না প্রণয়৷ মায়ের কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-‘ নুর অপেক্ষা করছে আম্মা। যেতে হবে আমায়। ‘
আবারও বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল প্রেরণা। বলল,
-‘ আমারে রেখে যাইস না বাবা। তোর বউয়ের কাছে আমি ক্ষমা চাই তাও যাইস না। ‘
সহসা প্রণয় মৃদু ধমকে ওঠল। বলল,
-‘ কী বলছেন এসব আম্মা৷ আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন ? ভুল হতেই পারে তাই বলে আপনাকে ছোটো করতে পারি না আমি। ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই মাথাসমান। ‘
বলেই প্রণয় ওঠে দাঁড়াল। প্রেরণা হাত টেনে ধরল৷ মা’য়ের পানে তাকাতেই আঁতকে ওঠল সে। এক অসহায় নারীর প্রতিচ্ছবি আজ তার মা’য়ের মুখশ্রীতে স্পষ্ট ভেসে ওঠেছে। প্রেরণা অনুনয় করে বলল,
-‘ আব্বা আমারে রেখে যাইয়ো না। ‘
পুনরায় মা’য়ের পাশে বসল প্রণয়। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল,
-‘ আমার সাথে যাবেন আপনি ? ‘
অসহায় কণ্ঠে প্রেরণা বলল,
-‘ আমি গেলে অঙ্গনের কী হবো? ‘
চিন্তিত হয়ে প্রণয় বলল,
-‘ আপনাকে যেতে হবে না। আপনি অপেক্ষায় থাকুন আমরাই আসব৷ এবার আমি আর শাহিনুর কিন্তু একা আসব না। গিয়েছি দু’জন কিন্তু ফিরব তিনজন ইনশাআল্লাহ। ‘
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠল প্রেরণার। বলল,
-‘ তাই জানি হয়, আমি অপেক্ষায় থাকলাম আব্বা। ‘
[৭৭]
পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে বেরিয়ে প্রথমে হাসপাতালে যায় প্রণয়৷ মুনতাহার মনের অবস্থা ঠিক নেই৷ অরুণা, শবনম, আর জেবা ছিল তার কাছে। জেবা কিছুক্ষণ আগে পল্লবের সঙ্গে গৃহে ফিরে গেছে। রয়েছে শুধু শবনম আর অরুণা৷ এমন সময় মুনতাহাকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে সেখানে ঢুকল প্রণয়৷ অরুণা আর শবনমকে বলল, সে কিছু কথা বলতে চায় মুনতাহা’কে। ডাক্তার হিসেবে কিছু কথা জানা খুব প্রয়োজন তার৷ প্রণয়ের কথা শুনে দু’জনই বেরিয়ে যায়। ইতোমধ্যে সকলের কানেই এসেছে, পলাশ কোন এক কাজের বাহানা দিয়ে ঘন্টা দুয়েক আগে ঢাকা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সদ্য জন্মানো মৃত বাচ্চাটিকে কবর দেওয়ার পর হাসপাতালে অসুস্থ বউ রেখে কোন বাবা, কোন স্বামী জরুরি কাজে ঢাকা চলে যেতে পারে জানা ছিল না প্রণয়ের। এ মুহূর্তে মুনতাহার পাশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুনতাহার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলল প্রণয়৷ জানল অনেক না জানা বিষয়ও। সব কিছু জানার পর প্রণয় নিজে থেকে কিছুই বলতে পারল না। শেষে মুনতাহার মাথায় হাত রেখে শুধু এটুকু বলল,
-‘ তুমি খুব ভালো মেয়ে। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করবেন। ইনশাআল্লাহ আবারও মা হবে তুমি। ‘
কিন্তু সত্যি দ্বিতীয়বার মা হতে পারবে তো? যে বাবা আটমাসের বাচ্চার এই পরিণতি করতে পারে, সে বাবা কী দ্বিতীয় সন্তান আনতে চাইবে?
কাকভেজা হয়ে কোয়ার্টারে ফিরল প্রণয়৷ প্রায় দু’ঘন্টা সময় রাস্তায় বসে বৃষ্টিতে ভিজেছে সে আজ।তার মতো শক্ত ধাচের মানুষেরও চোখে অশ্রু ঝরে। সেই অশ্রুকণাগুলোকে বৃষ্টির সঙ্গে ভাসিয়ে দিয়েই ঘরে ফিরল সে। জানল না কেউ, জানতে দিল না কাউকেই। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। একজন মহীয়সী নারীর কাছে নিখুঁতভাবেই ধরা পড়ে গেল। এ পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক থাকে। যে সম্পর্কগুলোতে রক্তের টান থাকে না, থাকে শুধু আত্মার টান৷ সেই টানেই শাহিনুর টের পেয়ে গেল৷ মধ্যরাতে কাকভেজা হয়ে ঘরে ফিরেছে স্বামী। প্রথমে ভেবেছিল রাগ করবে৷ তারপর ভাবল, নাহ রাগ করলে সম্পর্কে গভীরতা বাড়বে। তাই কিছুই বলবে না চুপচাপ শুয়ে পড়বে৷ করলোও তাই৷ প্রণয়ের প্রতি বিন্দু দরদ না দেখিয়ে, কোন প্রশ্ন না করে চুপচাপ শুয়ে পড়ল৷ অথচ এই মেয়েটাই ঘন্টার পর ঘন্টা তার জন্য বারান্দায় গিয়ে অপেক্ষা করছিল। আসার পরই শুরু করল অভিনয়৷ কিন্তু সে অভিনয় দীর্ঘ করতে পারল না। লুকিয়ে লুকিয়ে যতবার বিধ্বস্ত প্রণয়ের মুখ দেখল ততবার বুকের ভিতরটা ছটফটিয়ে ওঠল৷ প্রণয় তখন স্থির হয়ে ডিভানে বসে ছিল। শাহিনুর শোয়া থেকে ওঠে সহসা প্রণয়ের পাশে গিয়ে বসল। প্রণয় তখনো নিশ্চল। তার নিঃশ্বাস চলছে কিনা এটুকুনিও বুঝতে পারল না শাহিনুর। শেষে ভয় পেয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে প্রণয়ের কাঁধ স্পর্শ করে বলল,
-‘ আপনার কী খুব মন খারাপ? ‘
জবাব দিল না প্রণয়৷ শাহিনুর ধীরে ধীরে প্রণয়ের কোলে ওঠে বসল। দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘ আমার খুব ভয় করছে ডাক্তারসাহেব আপনি কথা বলুন আমার সঙ্গে। ‘
এবারেও ব্যর্থ হলো শাহিনুর। দু’হাতে প্রণয়ের চোয়ালজোড়া ধরে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো। প্রণয়ের রক্তিম, ঝাপসা দৃষ্টিজোড়া দেখে বুকের ভিতরটা কেমন হুহু করে কেঁদে ওঠল। বিধ্বস্ত মুখটা দেখে
মনে হলো একদিনের ব্যবধানে মানুষটার বয়স বেড়ে গেছে খুব। প্রিয় অর্ধাঙ্গের এই রূপ সহ্য করতে না পেরে চোখের অশ্রুবিসর্জন দিয়ে বলল,
-‘ আপনার কী খুব কষ্ট হচ্ছে? ‘
আচম্বিতে প্রচণ্ড শক্ত করে শাহিনুর’কে জড়িয়ে ধরল প্রণয়। ঘোর সংকটে পড়ে মুখ ফসকে বলে ফেলল,
-‘ মেজোভাই কী করে পারল নিজের সন্তান’কে খু/ন করতে? ‘
সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল শাহিনুরের। কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,
-‘ খু/ন! ‘
প্রণয় আরো শক্ত করে শাহিনুর’কে জড়িয়ে ধরল৷ বলল,
-‘ হ্যাঁ খু/ন মেজোভাবির সামনে মুখোশ পড়ে বাচ্চার প্রতি ভালোবাসার অভিনয় করে নিখুঁত কৌশলে বাচ্চাটাকে খু/ন করেছে মেজোভাই৷ মেজোভাই স্বাভাবিক মানুষ হতে পারে না। আজ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ও স্বাভাবিক নয়। ও স্বাভাবিক হতে পারে না। যদি বাচ্চাটা শেষ করারই ছিল আগেই করতে পারতো। কিন্তু শুরুতে কিছু করেনি হয়তো করার ইচ্ছে হয়নি। শেষে ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছে। একজন বাবা এতটা নৃশংস কী করে হতে পারে? আমার মাথা কাজ করছে না। ‘
উত্তেজিত কণ্ঠে বলা প্রতিটি কথাই মস্তিষ্ক চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল শাহিনুরের। নিঃশব্দে প্রণয়ের থেকে দূরে সরে গেল সে। নিমিষেই চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠল তার। বুকের ভিতর তীব্র কম্পন শুরু হলো। নিজেকে শান্ত করে দৃঢ় কণ্ঠে শুধাল,
-‘ সবটা খুলে বলুন আমি বুঝতে পারছি না। ‘
-‘ মেজোভাবি বলল, একমাস ধরেই বাচ্চাটা নড়াচড়া করছে না৷ ব্যথাও করেছে কিন্তু হওয়ার সময় হয়নি বলে এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েছে। কাউকে কিছু জানায়ওনি শুধু মেজোভাই কে ছাড়া৷ বাচ্চার জন্য মেজোভাই নাকি বেশ উত্তেজিত ছিল৷ কয়েকমাস ধরে ভীষণ যত্নও নিতো৷ যখনই ঘরে ফিরতো বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে আসতো। এসব ভাবি বললেন, আমি শুনলাম। কিন্তু আমি তাকে বলতে পারলামনা বাচ্চাটাকে তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে পয়জন মিশ্রিত খাবার দিয়েছে। যা মায়ের ক্ষতি না করলেও বাচ্চার ক্ষতি করেছে। ‘
শাহিনুর বলল,
-‘ আরে স্পষ্ট করে বলুন আমি বুঝতে পারছি না। ‘
-‘ কিছু ফলমূল রয়েছে যেগুলোতে পয়জন থাকে মানে বিষ। ওরকমই কিছু খাওয়ানো হয়েছে মেজোভাবি’কে। টেস্টে যে বিষ ধরা পড়েছে তার নাম হাইড্রোজেন সায়ানাইড বিষ৷ আমার ধারণা ও’কে অতিরিক্ত আপেলের বিচি খাওয়ানো হয়েছে। কারণ প্রতি রাতেই এক গ্লাস আপেলের জুস খাওয়াতো ওকে৷ শরীরের উপকারের কথা ভেবে সে খেতো কিন্তু জানতো না, আপেলের বিচিতে হাইড্রোজেন সায়ানাইড নামক বিষ থাকে। আমরা সাধারণত আপেলের বিচি খাই না এবং একটা আপেলে খুব বেশি বিচি থাকেও না। কিন্তু আপেলের বিচি কোন কারণে বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেললে ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই আপেলের জুস তৈরির সময় বিচি যেন না যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়৷ মেজোভাই নিশ্চয়ই এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। বেচারি বুঝতেও পারেনি মুখোশের আড়ালে কি চলছিল। ‘
-‘ আপনি বলেননি? ‘
-‘ বিশ্বাস করবে না। ‘
-‘ আপনার কাছে প্রমাণ আছে। ‘
-‘ কোন লাভ নেই নুর। ‘
সহসা প্রণয়ের দু’টো পা জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করল শাহিনুর,
-‘ ঐ নিষ্পাপ শিশুর খু/নীকে মাফ করবেন না ডাক্তার। ভাই হয়ে আপনি কিছু না করুন আমি করব। আমি আইনের সহায়তা নিয়ে শাস্তি দেব ঐ পশুটাকে। ‘
একটু থেমে আবার বলল,
-‘ আপনি আমাকে সাহায্য করুন। ‘
-‘ আমি করলেও মুনতাহা করবে না নুর। পাগলামি বন্ধ করো। ‘
-‘ আমি পাগলামি করছি না। আমি ঐ জানোয়ারটার শাস্তি চাই। ‘
হঠাৎ ক্ষিপ্ত মেজাজে শাহিনুরের থেকে পা ছাড়িয়ে নিল প্রণয়। ওঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠল,
-‘ কী করবে তুমি? এসব প্রমাণ দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি তুমি চাইলেও মুনতাহা চাইবে না। ‘
-‘ একজন মা তার সন্তানের জন্য সব পারে। ‘
নির্লিপ্ত দৃষ্টি তে তাকিয়ে বলল শাহিনুর৷ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে প্রণয় বলল,
-‘ বাঙালী নারীদের তুমি চেনো না। ‘
-‘ আমি কী বাঙালী নারী না? ‘
শাহিনুরের দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে ওর সম্মুখে দাঁড়াল। দুহাত বাড়িয়ে চোয়ালজোড়া আবদ্ধ করে নিয়ে নরম সুরে বলল,
-‘ তুমি তো অনন্য। ‘
অসহায় কণ্ঠে শাহিনুর বলল,
-‘ মান্নাত বুবুর খু/নীকে শাস্তি পেতে দিন না ডাক্তারসাহেব। ‘
সহসা দূরে সরে গেল প্রণয়। বলল,
-‘ তোমায় নিয়ে খুব সাধারণ একটা জীবন কাটাতে চাই নুর৷ তুমি আমাকে এভাবে ভেঙে দিও না। ‘
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শাহিনুর। মনে মনে ভাবলো,
-‘ আমাদের ভাগ্য সহায় হবে না। অন্তত আজকের সত্যিটা জানার পর ও’কে আমি ছাড়ব না।’