হালকা হালকা আলোর মাঝে চুপ হয়ে বসে আছে প্রানেশা। মনের অসংখ্য প্রশ্নগুলোকে দমিয়ে অপেক্ষা করছে রেয়ানের মতো দেখতে বহুরূপীর। এক ঘন্টা হলো প্রানেশাকে রুমে এনে বসানো হয়েছে। পরিবেশ ঠান্ডা হলেও ভারি শাড়ি পড়ে শ্বাস ছাড়তেও নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে প্রানেশার। খট করে আওয়াজ হতেই প্রানেশা দরজার দিকে তাকালো। হ্যা, বহুরূপী লোকটি এসেছে। এবার প্রানেশা কোমর বেঁধে নেমেছে, কিছুতেই সত্য না জেনে থাকবেনা।
সামনে তাকিয়ে দেখলো খাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাক্তিটি। হালকা আলোয় কেমন যেন অপার্থিব দৃশ্য মনে হচ্ছে লোকটিকে দেখে৷ এই জায়গায় রেয়ান থাকলে আজ প্রানেশা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো৷ একই চেহারা হলেও তা হতে পারছেনা সে৷ উঠে দাড়িয়ে লোকটির সামনে দাঁড়াতে নিয়েও পারলোনা প্রানেশা। তার আগেই লোকটা প্রানেশার বাহু চেপে বসিয়ে পাশে বসে পড়লো। প্রানেশা রেগে বললো –
‘সমস্যা কী আপনার? বারবার কেনো এমন করছেন? ‘
ব্যাক্তিটি অধর কোণে বাকা হাসি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বললো-‘কোনো সমস্যা নেই প্রাণ। সব সমস্যার সমাধান হয়েছে আজ। সব হিসেব পূর্ণ হলো ‘
প্রানেশা বাকা উত্তরের তেমন কোনো অর্থ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলো৷ হাত ছাড়াতে ধস্তাধস্তি শুরু করলো। ব্যাক্তিটি একসময় জোরে ধমক দিলো।
‘হয়েছে কী!এমন করছো কেনো? আর একবার ছাড়ানোর চেষ্টা করলে পরিণতি কিন্তু ভাবতেও পারবেনা ‘
প্রানেশা কড়া ধমকে চুপ হলেও চোখে পানি এসে পড়লো৷ ছোট বেলা থেকেই ভীষণ আদরের সে। বাবা মা এমনকি পুরো নানা দাদার পরিবারে সকলের চোখের মণি। একবেলা তাকে খাওয়ানোর জন্য তিন জন মানুষ লেগে থাকে। এত জোরে তাকে কখনোই কেউ বকেনি। তাই খুব অভিমান হলো প্রানেশার। তার কথা হলো এভাবে কেনো বকবে! হাত ছাড়াতে এবার আরও জোর দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু হলো প্রানেশা। ব্যাক্তিটি ভরকালো না। বুঝতে পারলো তার প্রাণের অভিমান হলো। জোর করে টেনে কোলে বসিয়ে চোখ মুখ মুছে দিলো। সারাদিনের দুশ্চিন্তা আর ধকলে মুখটা ভীষণ শুকনো লাগছে। ব্যাক্তিটি উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো । প্রানেশা হা করে তাকিয়ে আবার মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। ব্যাক্তিটি ঘরে আসতেই প্রানেশা দেখলো হাতে একটা প্লেট, তারমধ্যে ভাত আর মুরগীর ভাজা মাংস সাথে ডাল ৷ প্রানেশা মনে মনে ভাবলো ‘এই লোক কীভাবে জানলো আমার ভাতের সঙ্গে ডাল আর মুরগীর মাংস দিয়ে খেতে ভালোবাসি! ‘
লোকটা হাত ধুয়ে এসে প্লেট থেকে এক লোকমা ভাত মাখিয়ে প্রানেশার মুখের সামনে ধরলো। প্রানেশার ক্ষুধা লাগলেও অভিমানী স্বরে বললো –
‘আমি খাবো না, আগে বলুন কে আপনি?’
ব্যক্তিটি শক্ত গলায় বললো –
‘আগে চুপচাপ খাও তারপর বলবো’
প্রানেশা সত্যি জানার জন্য ব্যকুল হয়ে দ্রুত ভাতের লোকমাটা মুখে নিলো৷ অর্ধেক খাওয়ার পর প্রানেশা বাচ্চাদের মতোন দুইহাত দিয়ে না দেখালো, বোঝানোর চেষ্টা করলো-‘আমার পেট ভরে গেছে’
ব্যক্তিটি বুঝতে পেরে প্লেট সহ উঠে দাড়িয়ে যেতে যেতে আদেশের সুরে বললো -‘বেড বক্স থেকে পানিটা খাও ‘
প্রানেশার কেনো জানি মনে হলো লোকটা ভীষণ কেয়ারিং। যেমনটা সে রেয়ান আর তার প্রেমের প্রথম দিকে চাইতো ঠিক তেমন। রেয়ান খেয়াল তার খেয়াল রাখলেও মাঝে মাঝে কেমন একটা উদাসীন ভাব অথচ সম্পর্কের শুরুর দিকটা ছিলো স্বপ্নের মতোন। ভাবতে ভাবতে পানিটা খেয়ে চুপ করে বসলো। আবার ভাবলো লোকটা আসতে আসতে কাপড়টা চেঞ্জ করে ফেলি। ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে বদলিয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলো৷ টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতেই ব্যাক্তিটি ভেতরে ঢুকলো৷ প্রানেশা টাওয়াল রেখে এগিয়ে গেলো লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে হাত ভাজ করে বললো -‘ এবার বলুন ‘
লোকটি ড্রেসিং টেবিলের দিকে ফিরে পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে বললো-‘কী বলবো? ‘
প্রানেশার এমন ইয়ার্কি পছন্দ হলো না। পাঞ্জাবি খুলে ফেলতে দেখে চোখ মুখ ঢেকে চিৎকার করে বললো-
‘লজ্জা শরম নেই! অপরিচিত মানুষের সামনে জামা কাপড় খুলে ফেলেন ‘
ব্যাক্তির এমন অযাচিত কথা অপছন্দ হলো৷ উদাম গায়ে এগিয়ে এসে প্রানেশার পিঠে একহাত রেখে গালে চুমু খেয়ে বললো-
‘ প্রথম কথা আমি জামা কাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে যায়নি টাউজার আছে। দ্বিতীয়ত, তোমার স্বামী অপরিচিত কারো সামনে জামা খোলে না মিসেস সুফিয়ান তেহজিব ‘
প্রানেশার চোখ সুফিয়ানের উদাম গা দেখে পুড়ে যেতে চাইলো৷ এত ফর্সা ত্বকের সাথে ব্যায়াম পুষ্ট দেহ চোখে লাগছে। প্রানেশার চোখ মুখ খিচে বললো –
‘দূরে যান বলছি । আপনি দেখছি উচ্চ লেভেলের বেহায়া! ‘
সুফিয়ান হেসে সরে গেলো৷ গায়ে কফি কালারের শার্ট চাপিয়ে গম্ভির গলায় বললো-
‘শোনো প্রাণ, আজ থেকে তোমার একটাই পরিচয়। তুমি সুফিয়ান তেহজিবের স্ত্রী। তোমার অতীতে কে ছিলো কে ছিলো না আমি এতকিছুর ধার ধারি না। আর হ্যা, তোমার রেয়ান সম্পর্কে আমার ছোট ভাই। দুই বছরের বড় আমি তার। তাই এখন থেকে তাকে শুধু একটা নজরেই দেখতে পারো, দেবর ‘
প্রানেশা খাটের উপর ধপ করে বসলো৷ চোখ লাল হয়ে আসছে, কী অসহ্য যন্ত্রণা! যে মানুষটা জীবনের প্রথম প্রেম হিসেবে এলো তাকে কী করে প্রানেশা স্বামীর ছোট ভাই মানবে? চিৎকার করে বললো-
‘আপনার লজ্জা করলো না ছোট ভাইয়ের ভালোবাসায় কুনজর দিতে? ‘
সুফিয়ান প্রানেশার গাল চেপে ধরলো । রাগে কাঁপতে
কাঁপতে অদ্ভুত ভাবে সাইকোর মতো হেসে বললো –
‘নাহ, করলো না। ভালোবাসা তুই আমার, বলেছি না? প্রাণ শুধু আমার! তোর নেশায় পুরে অঙ্গার হয়েছি আমি, তোকেও হতে হবে এই অঙ্গারের নেশা‘