অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ২২

গৌধুলি পেরিয়ে সন্ধ্যার ঘ্রাণ ঘনিয়ে আসছে। দিক দিগন্তের নানান মানুষ হালকা আনাগোনা শুরু করেছে, তাদের বেশীর ভাগই সদ্য বিবাহিত। তাই প্রেমও মাখোমাখো। কেউ একে অপরকে জড়িয়ে সূর্য ডোবার সোনালী আভায় ছড়িয়ে থাকা আকাশের দিকে মনোনিবেশ করে আছে তো কেউ আবার ভেজা বালির উপর হাতে হাত রেখে হেঁটে বেরাচ্ছে। সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রানেশা। দৃষ্টি তার শান্ত নিথর। তার তিন হাত দূরে এক হাঁটু উঁচু করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সুফিয়ান। প্রানেশা একবার পেছন ফিরে চাইলো, এখনো সে পুরোটাই ভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা যে পাঁচ পাঁচটে বছর সে ধোঁকায় পড়ে ছিলো। রেয়ানের সঙ্গে মনের মিল কখনোই ছিলো না, সম্পর্কটা টিকে ছিলো রেয়ানের ধূর্ততা আর প্রানেশার মনে দাগ কেটে যাওয়া প্রথম ছয় মাসের ফোনালাপ। প্রানেশা ধীরস্থ পায়ে হেঁটে সুফিয়ানের সামনে দাঁড়ালো। সুফিয়ান মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো। প্রানেশার থমথমে মুখটা দেখে নিজের দুই হাত দিয়ে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নিলো। প্রানেশা চেয়ে আছে অনুভূতিহীন ভঙ্গিতে। চোখের পাপড়ি ভেজা ভেজা। অতিরিক্ত ফর্সা ত্বকটা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে আছে৷ প্রানেশার সাদা গালটায় ডান হাতে ছুঁইয়ে বললো-
‘প্রাণ! ‘
‘হু?’
‘ সেই অঙ্গারের কথা কখনো মনে পড়েনি? ‘
প্রানেশার গাল বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। সুফিয়ান হাত পেতে জলটুকু ধরে নিজের টিশার্টের ডান পকেটে এমন ভঙ্গিতে গুঁজে রাখলো যেনো ওটা মহামূল্যবান কোনো বস্তু। প্রানেশার গলা রোধ হয়ে আছে,অদৃশ্য কিছু একটা যেনো গলা শক্ত হাতে চেপে রেখেছে। কোনো রকম মাথা নাড়িয়ে বললো-
‘পড়েছে, খুব পড়েছে ‘
সুফিয়ান যেনো তাচ্ছিল্য হাসলো। প্রানেশাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলো। সমুদ্রের ঠান্ডা পানির স্রোত হাঁটুতে ধাক্কা লাগাচ্ছে। প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ানের চাপা কষ্ট। ঠিকই তো, এতগুলো দিন সুফিয়ান একাই তাকে ভালোবেসে গিয়েছে আর তাকে কী দিতে পেরেছে প্রাণেশা! নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো সে। দুই হাতে চোখ মুছে সুফিয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো-
‘ রেয়ানকে আমার সন্দেহ হতো মাঝে মাঝে। প্রথম যেদিন আমার সঙ্গে দেখা হলো সেদিন আমার একটু সন্দেহ লেগেছিলো কারণ অঙ্গার তো আমাকে বলেছিলো সে এসে প্রথম আমার দিকে একমুঠোভর্তি তাজা বেলীফুল এগিয়ে দেবে। কিন্তু রেয়ান এসে আমার সঙ্গে ফরমাল আলাপ করেছিলো, তার চারদিন পর আমার মোবাইল থেকে নিজেই অজানার নাম্বার সহ ডিটেইলস ডিলিট করে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলে বলে এই নাম্বারটা এখন আর সে ইউজ করে না, এক মামাতো ভাই এই সিম নিয়ে নিয়েছে। আর তাই আমিও বিশ্বাস করে নেই আমার অজানাকে ভেবে। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অঙ্গার মানে কী? সে সাধারণ ভাবে উত্তর দিয়েছিলো ‘কয়লা ‘। সেই কথার মাঝে আমি মিষ্টতা খুঁজে পাইনি। সম্পর্ক ভাংতে চেয়েও পারছিলাম না, কীভাবে পারবো! আমার সেই কৈশোরের স্মৃতিতে যে সিলমোহর মেরে বসে আছে সেই ছয় মাসের প্রমালাপ’
কথাগুলো বলে কেঁদে উঠলো প্রানেশা। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। ভালোবাসার বিনিময়ে সে যে কিছুই দিতে পারলো না। সুফিয়ান ব্যাথিত হয়ে তাকিয়ে আছে। সে যে তার প্রাণেশ্বরীর কান্না সহ্য করতে পারে না, তার বুকে যে খুব ব্যাথা করে এই কান্নায়। প্রাণেশার কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সুফিয়ান, আদুরে কন্ঠে বললো –
‘ প্রাণ, আর কেঁদোনা। বুকে যে খুব ব্যাথা করে! ‘
প্রানেশা কাঁদতে কাঁদতে হেঁসে ফেললো৷ সুফিয়ান গাঢ় চুমু খেলো প্রাণেশার কপালে।লম্বা চুলগুলো হাতের পিঠে পেচিয়ে খেলতে খেলতে বললো-
‘চলো রুমে চলো৷ দেখেছো পুরনো কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে! ‘
প্রানেশা বুকে মাথা গুজে থেকে বললো-
‘পাঁচ বছরে আপনি একবারও আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি?’
সুফিয়ান খপ করে প্রানেশাকে ছাড়িয়ে আলগোছে কোলে উঠিয়ে নিলো। প্রানেশা হকচকিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললো-
‘আরে করছেন কী! ছি ছি! সবাই কী মনে করবে! ‘
সুফিয়ান ভ্রু কুচকে বললো-
‘কে কী মনে করলো এই নিয়ে বসে আছি নাকি আমি! ওই দেখো ওরা আমাদেরও ছাড়িয়ে গেছে তো কেউ কিছু বলেছে নাকি? ‘
প্রানেশা সুফিয়ানের ইশারা বরাবর তাকাতেই লজ্জায় লাল নীল হয়ে উঠলো। দুটো ছেলে মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে কিস করছে৷ প্রানেশা চোখ খিঁচে বন্ধ করে সুফিয়ানের বুকে কিল বসিয়ে দিলো। সুফিয়ান মেকি আর্তনাদ করে বললো –
‘উফ ব্যাথা পেয়েছি! ‘
প্রানেশা জানে এই হৃষ্টপুষ্ট দেহে নরম হাতের একটা কিল চামড়াও ভেদ করবে না। সুফিয়ান ভেতরে যেতে যেতে বললো-
‘এখানে থাকলে তুমি প্রশ্ন করতেই থাকবে। তাই এখন আমরা রুমে যাবো তারপর ফ্রেশ হবো, খাবো তারপরে তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবো ‘
প্রানেশা অবাক হয়ে আছে ৷ নিজেকে খুব খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে তার। সে তো এতো সুখ পাবে কল্পনায়ও করেনি। যতকিছুই হোক সৃষ্টিকর্তা সেই আকাঙ্খিত পুরুষকে তার ভাগ্যে লিখে দিলো।
রুমে যেয়ে প্রাণেশা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো সুফিয়ান খাবার রেডি করছে। প্রানেশা টাওয়াল পাশে রেখে খাটে বসতেই সুফিয়ান তার চিরচেনা মনোমুগ্ধকর হাসি উপহার দিয়ে বললো-
‘প্রাণ,তুমি খেতে শুরু করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ‘
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে। আর প্রানেশা! সে তো সেভাবেই থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম বার বোধ হয় তার হার্টবিট দ্বিগুণ বেগে চলতে শুরু করলো। সুফিয়ান তো তার সামনে এর আগেও বহুবার হেঁসেছে। কিন্তু কখনোই হার্টের গতি বেড়ে যায়নি! আনমনেই কপাল চুলকে প্রানেশা বললো-
‘তবে, আমি প্রেমে পড়ে গেলাম! ‘
সুফিয়ান বের হয়ে এসে প্রানেশাকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে ভাজ ফেলে চোখ ছোট ছোট করে বললো-
‘কী হয়েছে প্রাণ? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ‘
প্রানেশা অপ্রস্তুত হেঁসে ‘না’ বোধক মাথা নাড়লো। সুফিয়ান প্রানেশার সঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে বিছানা ঝেড়ে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লো। প্রাণেশা হাতে পায়ে লোশন লাগিয়ে শুতেই শরীরে কম্পন শুরু হলো। বাম পাশে শুয়ে আছে সুফিয়ান। নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বটে, কিন্তু তবুও প্রানেশার কাছে সবকিছু কেমন যেনো নতুন মনে হচ্ছে। এ বুঝি প্রেমে পড়ার সংকেত! সুফিয়ানের আরেকটু কাছে এসে প্রানেশা বাচ্চাদের মতো মিনমিন করে বললো-
‘আমি আরেকটু কাছে এসে শুই? ‘
সুফিয়ান মিটমিট করে হেসে বললো –
‘শোও ‘
দুই মিনিট যেতেই আবারও প্রানেশা বললো-
‘আমি একটু বুকে মাথা রাখি? ‘
‘রাখো ‘
সুফিয়ানের মুখে প্রাপ্তির খুশি। মনে আনন্দের ঢেউ। এর থেকে কত কাছে এসেছে! তারপরও মনে হচ্ছিলো কোথাও কী যেনো ফাঁকাফাঁকা। বুকে এলিয়ে থাকা মাথাটার দিকে তাকিয়ে সুফিয়ান নিজস্ব ভঙ্গিতে বললোঃ
এ ব্যাথা লাল নীল,
থাকুক না চিরদিন!
কথারা শব্দহীন,
যেনো তা তুমিহীন!
বসন্তের ঘ্রাণ নেই,
যেখানে তুমি নেই।
প্রেমেরা রঙহীন!
আমি আজ দিশাহীন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।