অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ২১

এক্সিডেন্ট হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা পর ডাক্তাররা সুফিয়ানের পরিবারকে জানালো, আল্লাহর রহমতে সুফিয়ান বেঁচে থাকলেও গলায় জখম হওয়ায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই, সুফিয়ানের গলা রিকোভার করতে কয়েক মাস সময় লাগবে। রিকোভার হওয়ার পর কথা বলতে পারলেও গলায় চাপ পড়ে এমন কিছু করা যাবে না। সুফিয়ান তখনও হসপিটালের বেডে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মাথায় বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে, তাই তার জ্ঞান ফিরতে চার পাঁচ দিয়ে দিন সময় লাগবে। জ্ঞান ফেরার পর এক মাস বেড রেস্টে থাকতে হবে। রাহাত সাহেব আর মিসেস অদিতি ছেলে বেঁচে আছে এটাতেই খুশি হয়ে গেলো। যতদিন লাগে ততদিন রেস্ট করুক৷ কিন্তু দুইদিন যাওয়ার পরই কনসার্টের জন্য মিটিং করে দিন নির্ধারিত হলো। সুফিয়ান চুক্তিবদ্ধ ছিলো প্রডিউসারের সঙ্গে। এখন যদি সুফিয়ান কনসার্টে না যায় তাহলে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে, তারচেয়ে বড় কথা সুফিয়ানের নাম অপ্রকাশিত থাকলেও একটা ছবি নেটে ভিডিও সহ আপলোডও হয়েছে। মূলত সুফিয়ানের গানে মুগ্ধ হয়েই কনসার্টের আয়োজন। প্রডিউসার মিস্টার দামান অকূলপাথারে পড়ে সুফিয়ানের বাড়িতে এসে হাজির হলেন। মিস্টার রাহাত আর মিসেস অদিতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন -‘আপনি এখানে কী করছেন?’
দামান সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন –
‘কেনো! আপনারা জানেন না? সুফিয়ানের সঙ্গে আমার কন্ট্রাক্ট সাইন হয়েছে কাল কনসার্টের জন্য। ‘
রাহাত আর অদিতি দুজনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো হতাশার শ্বাস। রাহাত সাহেব এই বাড়িতে আসার পর থেকেই সুফিয়ান নিজেদের কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের জানায়না। যত বড় কিছুই হোক নিজের ভেতর চেপে রাখে। অদিতি ব্যাপারটা আড়াল করে বললো –
‘ওহহ, হ্যা বলেছিলো তো। কিন্তু সুফিয়ানের এক্সিডেন্টের চিন্তায় ভুলে গেছিলাম আমি। ‘
‘আচ্ছা, কিন্তু এখন যে আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। সুফিয়ান তো শুনেছি খুব অসুস্থ। তাহলে, কাল কনসার্টের কী হবে!’
পেছনে থেকে একজন বলে উঠলো –
‘আমি হয়তোবা আপনার সাহায্য করতে পারি ‘
সবাই অবাক চোখে পেছনে তাকিয়ে দেখলো রেয়ান দাঁড়িয়ে আছে৷ দামান সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন-
‘আপনি! কীভাবে? ‘
রেয়ান ধীরে সুস্থে এগিয়ে এলো৷ সোফার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হালকা ব্যাথিত গলায় বললো –
‘ সুফি ভাই তো খুব অসুস্থ। মনে হয় না কনসার্টে অংশ নিতে পারবে। তাছাড়া এই মাসেই নাকি পরপর দুটো অনুষ্ঠানে গাওয়ার কথা। কিন্তু সুফি ভাইয়ের গলায় রক্তক্ষরণ হওয়ায় আর কখনো গাইতে পারবে না ‘
‘সে কী! একেবারে গলা নষ্ট হয়ে গেছে! কথা বলতে পারবে তো?’
‘কথা বলতে পারবে। কিন্তু আর কখনো গান করতে পারবে না অর্থাৎ সুর আসবে না ‘
দামান সাহেব অবাক হয়ে বললো-
‘তাহলে এক্ষেত্রে আপনি কীভাবে হেল্প করবেন?’
রেয়ান নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসলো৷ কপালে ডান হাতটা ঘষে বললো-
‘ হ্যা, আমি জানি সুফি ভাইয়ের মতো গান করতে পারিনা। কিন্তু, সুফি ভাইকে দেখে আমি মোটামুটি গান শিখে নিয়েছিলাম। প্রেকটিস করিনি, আগ্রহ ছিলো না। এখন যেহেতু ভাই অসুস্থ তাহলে সেক্ষেত্রে আমি পার্টিসিপেট করতে পারি। ‘
দামান সাহেব হালকা তাচ্ছিল্য করে বললো –
‘ গান পারলেই হবে না, তার সাথে চেহারাও থাকতে হবে। আপনার চেহারা দেখেই তো মানুষ চলে যাবে ‘
রেয়ানের ভেতরের রাগ আবারও উপচে উঠলো। এতক্ষণ সে ভাবছিলো আলাদা মাস্ক বানিয়ে সেটা দিয়েই শো করবে কিন্তু সেই একই খোঁটা! চেহারা! রেয়ানের ক্রুদ্ধ মন খলবলিয়ে বললো-‘ চেহারা নিয়েই এতো সমস্যা তো! এই চেহারাই আমি সারাজীবনের জন্য পাল্টে ফেলবো। সুফি ভাই সত্যিই আমাকে সবসময় নিচে নামিয়ে রেখেছে। এবার সুফি ভাই বুঝবে অধিকার না পাওয়ার ব্যাথা , সরি ভাই কিন্তু এটা আমায় করতেই হবে। নিজের জন্য একবার স্বার্থপর হয়ে দেখতে চাই আমি ‘
মনকে শান্ত করে মাথা উঠিয়ে বললো-
‘সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। তিনদিন পর যথাসময়ে কনসার্টে আমি এসে পড়বো৷ আর চেহারাটাও কোনো প্রভাব ফেলবেনা এতে ‘
‘কিন্তু এটা কীভাবে..? ‘
‘আহা, আপনি এতো চিন্তা করছেন কেনো! আপনি যান ‘
মিস্টার দামান একরাশ চিন্তা বোঝাই করে বেরিয়ে গেলেন। কীভাবে কী হবে, ভেবেই তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷
তিনদিন পর, কনসার্ট শুরু হতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। কিন্তু এখনো রেয়ান এসে পৌঁছাতে পারেনি। দামান সাহেব ভাবছেন ঘোষণা করবেন যে সুফিয়ান আসতে পারবেনা। মাইক হাতে নিয়ে স্টেজে উঠতে গেলেই পেছনে কেউ তাকে ডাকলো৷ বিরক্ত হয়ে তাকাতেই হাত থেকে মাইক পড়ে গেলো। এ কীভাবে সম্ভব! স্বয়ং সুফিয়ান! কিন্তু সে তো..
লোকটি সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেললো৷ হালকা হেসে বললো –
‘কী দামান সাহেব? অবাক হলেন?’
দামান সাহেব বাকহারা হয়ে তাকিয়ে আছেন। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ব্যাক্তিটি তুড়ি বাজিয়ে বললো-
‘আরে এতো অবাক হচ্ছেন কেনো?
‘অবাক হবো না?সুফিয়ানের মতোন কী করে! ‘
‘আপনি বোধ হয় জানেন না, এটা আর সেই আদি কাল নেই। ‘
‘প্লাস্টিক সার্জারি! ‘
‘ইয়েস। শো করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে মনে হয় ‘
চেহারায় অমিল হলেও কন্ঠ সুফিয়ানের সঙ্গে কিছুটা মিলে যায় রেয়ানের। এটার সুযোগ নিয়েই কাজটা করলো রেয়ান। দুই ঘন্টা পর শো শেষ করে বের হতেই দেখলো বাহিরে গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইভানান। রেয়ান হাসলো। হাসিতে বিজয়ের উচ্ছ্বাস। ইভানানকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো সে। ইভানান কাঁধ চাপড়ে গর্বিত গলায় বললো –
‘ এই হলো সাহসী ছেলে! পুরাই বাজিমাত করে দিলি’
রেয়ানও অহংকারে লেপটে থাকা হাসি হাসলো। তার ধারণা হলো, এবার তার চেহারা আছে। কেউ আর তাকে ঠেকাতে পারবে না। অথচ এটা বুঝতে পারলো না যে সে নিজেকেই হারিয়ে ফেললো। ইভানান পকেট থেকে একটা ছবি বের করে রেয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-‘ কাল রাতে যেসব ইনফরমেশন দিয়েছিলাম সেসব মুখস্থ করেছিস তো?’
রেয়ান ছবিটি দেখতে দেখতে বললো –
‘হুম ‘
‘তাহলে এখন যা, ঠিকানা মেসেজ করে দিয়েছি তোর ফোনে। সব ঠিকঠাক ভাবে করিস ‘
‘ঠিক আছে, কিন্তু ইভ ভাই একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। ‘
‘কী?’
‘এই মেয়ের সঙ্গে নাটক করলে তোমার কী লাভ?তুমি বলেছিলে দ্রুত সার্জারি করানোতে আমাকে সাহায্য করবে তার বদলে আমাকে এই মেয়ের সঙ্গে প্রেমের নাটক চালাতে হবে ‘
‘উফ, বেশী কথা বলিস না। তুই যা আর যা বলেছি সেসব কর ‘
রেয়ান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো সেই ঠিকানায়।
যেতেই ইভানান ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো৷ আড়মোড়া ভেঙে গাড়ির উপর লাফ দিয়ে বসে উপর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো-
‘এবার তুই বুঝবি সুফিয়ান, আপন মানুষ ধোঁকা দিলে ঠিক কতটা কষ্ট হয় ‘
বটতলার নিচে একটা সিটে বসে অনবরত হাত কচলাচ্ছে প্রানেশা। কী ভীষণ আনন্দের অনুভূতি ! সাথে কিছুটা লজ্জাও লাগছে। মনে মনে নানা কল্পনা জল্পনা করছে৷ কেমন দেখতে মানুষটা! আনমনেই হেসে উঠলো প্রানেশা। ক্ষন বাদেই একটা গাড়ি এসে থামলো। প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে গেলো। গেট খুলে বেরিয়ে আসলো ফর্সা ত্বকের এক মানবী। শব্দ করে হেঁটে এসে প্রানেশার সামনে হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে বললো
‘ কেমন আছো প্রানেশা? বেশি অপেক্ষা করাইনিতো?
আমি রেয়ান তেহজিব। যার সাথে তুমি এতদিন কথা বলেছো ‘

[বিঃদ্রঃ গল্প যখন আমি লেখা শুরু করেছিলাম তখন আমি চেয়েছিলাম এটা তিন পর্বের একটা অনুগল্প করতে। কিন্তু, সবার এতো আগ্রহ ছিলো তাই গল্পটা বড় করতে হলো। এটা আমি আগেও বলেছি।
সমস্যা হচ্ছে প্রতিটি গল্পের থিম লাইন আমি গল্প লেখার আগেই সাজিয়ে ফেলি৷ কিন্তু এই গল্পটা যেহেতু আমি হুটহাট লিখি তাই এটার থিমও কিছুটা বদলে গেছে। কিছু পয়েন্ট ছিলো যা প্রথমে ভাবিনি কিন্ত লেখার সময় গল্পের প্রয়োজনে লিখতে হয়েছে। তাই এখানে আমাকে একটু বিপাকে পড়তে হলো।
তো সব মিলিয়ে আমি ঠিক করেছি, অতীতের কাহিনিটা পাঁচ বছর আগের হবে। অর্থাৎ, সবকিছু ঠিকই থাকবে শুধু সময়কালটা বেশি। এটা কেনো করলাম তা পর্বের লাস্টে বুঝতে পারবেন। দুঃখিত, এটা আমার আগেই খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। ]

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।