অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ২০

লাইব্রেরির একটা কোণায় বই হাতে বসেছিলো রেয়ান। মন দিয়ে প্রতিটা লাইনে ডুবে আছে। টেবিলের সামনে দুই জোড়া জুতোআলা পা দাঁড়াতেই উপরে মাথা তুললো রেয়ান। দেখা গেলো নীল চোখের পুরুষকে, অর্থাৎ ইভানান। চোখে প্রতিদিনের মতোন চশমা নেই। গায়ে একটা জার্সি দেখা যাচ্ছে লাল রঙের। রেয়ান নিষ্পাপ হাসলো। ইভানানও হালকা হেসে পাশের প্লাস্টিকের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে রেয়ান বললো-
‘কিছু বলবে ইভ ভাই?’
ইভানান গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো। রেয়ান ইশারায় বললো-‘তো বলো ‘
ইভানান হাত ভাজ করে শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে বসে রইলো তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো –
‘তোর মনে হয় না? তুই নিজের অধিকার এখনো বুঝে উঠতে পারিসনি! ‘
রেয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘কীসের অধিকারের কথা বলছো?’
‘আরে বোকা ছেলে! নিজের ব্যাক্তিগত অধিকারটাই তো পেলিনা তুই’
‘ব্যাক্তিগত অধিকার! ‘
‘হ্যা, এই যেমন দেখ ঘরেও তোর কোনো মর্যাদা নেই আবার বাহিরেও কোনো মূল্য নেই। সব জায়গায় তো সুফিয়ানেরই জয়গান চলে ‘
রেয়ান প্রতিবাদ স্বরে বললো-
‘এসব কী বলছো! সুফিয়ান ভাইয়ের তো কোনো দোষ নেই এতে’
‘আহা! উল্টো বুঝিস কেনো?আমি কী বলেছি নাকি, যে সুফিয়ানের কোনো দোষ আছে! সুফিয়ান তো প্রাণের বন্ধু, ভাই। কিন্তু তুইও তো আমার ভাই হোস। তোকেও আমি ভালোবাসি। তাই চাই তুইও ভালো থাক।’
‘আমি তো ভালো আছি ইভ ভাই ‘
‘সত্যিই ভালো আছিস? একটু ভেবে দেখ তো? ‘
রেয়ান স্মৃতির পাতা হালকা উল্টোতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সবার করা অপমান, তাচ্ছিল্য৷ তারপরও মুখে হেসে বললো –
‘এমন কিছুই নেই ইভ ভাই। ভালোই তো আছি আমি সুফিয়ান ভাই কত ভালোবাসে আমাকে, আমি খেতে পারছি, মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে। এইবা কয়জন পায় বলো?’
ইভানান বিরক্তিস্বরে বললো-
‘তোর এই বোকামির কারণেই তুই পিছিয়ে আছিস। দেখবি একদিন তুই কিছুই পাবিনা। ‘
‘মানে? ‘
‘ যেমন, তোর বাবার কথাই দেখ। তোর সাথে ঠিক মতো কথা বলে? সুফিয়ানের কটুবাক্য শুনেও চেষ্টা করে ওর সাথে কথা বলার। তোর মা? কখনো তোর আলাদাভাবে ভালো লাগা মন্দ লাগার খোঁজ নেয়? নেবে কী করে সুফিয়ান আছে না? আরে ভাই, ইউনিভার্সিটিতে যখন হরেক রকম প্রতিযোগিতা, রেস, অনুষ্ঠানে সবার প্রথমে কার ডাক পড়ে? ‘
রেয়ান সম্মহিতের মতোন বললো-
‘সুফি ভাই? ‘
‘এক্সাক্টলি! সুফিয়ানের রূপ, গুণের একটাও তোর মাঝে নেই বলেইতো তুই এখনো পিছিয়ে আছিস ‘
‘তাহলে এখন কী আমার সুফিয়ান ভাইয়ের গুণগুলো আমার মাঝে আনা উচিত? ‘
‘শুধু গুণই নয় রূপও খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেখ, সুফিয়ানের জন্য কত মেয়ে পাগল। অথচ এই পর্যন্ত একটা মেয়েও তোর দিকে ভালো মতো তাকায়নি ‘
রেয়ান মন খারাপের সুরে বললো –
‘গুণগুলো নাহয় আমি আমার আয়ত্তে আনতে পারবো কিন্তু রূপ তো আল্লাহর দান। সুফি ভাই মায়ের মতোন হয়েছে। আমি তো বাবার মতোন ‘
‘হুম, তা ঠিক যদিও। কিন্তু এখন তো আর আগের যুগ নেই, চাইলেই কত কিছু করে চেহারা পাল্টানো যায়! নায়ক নায়িকারাও করে অনেক সময়। তবে তোর করার কোনো দরকার নেই। তুই যেভাবে আছিস, সেভাবেই থাক। কী দরকার এসবের! ‘
বলেই চেয়ার টেনে আগের জায়গায় রেখে শিশ বাজাতে বাজাতে বাহিরে চলে গেলো। পেছনে থম মেরে বসে রইলো রেয়ান, মাথায় বারবার ইভানানের কথাগুলো ক্রমাগত গর্জন করে উঠছে৷ নিজমনেই বিরবির করে বললো -‘ প্লাস্টিক সার্জারি করলেই কী আমি বদলে যাবো! ‘ আবার আরেকমনে বললো-
‘ নাহ, কী উল্টো পাল্টা ভাবছি! জমজ হলে আলাদা কথা ছিলো। আমি সুফি ভাইয়ের ছোট। তাছাড়া সুফি ভাইয়ের মতো হওয়ার কী দরকার ‘
বলেই নিজের হাতে আবার বইটা নিয়ে নিলো কিন্তু মনোযোগ দিতে পারলো না। কোনো খাবারের একটা পাশে যদি পোকা পড়ে তাহলে আমাদের পুরো খাবারটার উপর অরুচি ধরে যায় তেমন মস্তিষ্কে নেগেটিভিটি টাই সবচেয়ে বেশী ছড়িয়ে পড়ে।
একসপ্তাহ পরের কথা, রাহাত সাহেবের অনুরোধে আজ ডাইনিং টেবিলে বসেছে ৷ সাধারণত রেয়ান নিজের রুমে খায়, সুফিয়ান কখনো বাহিরে থেকে খেয়ে আসে তো কখনো না খেয়েই কাটিয়ে দেয়, বাকি থাকেন রাহাত সাহেব আর মিসেস অদিতি তারা একসঙ্গে বসে খান। কিন্তু, সবাইকে অনুরোধ করে বলেছেন, আজ যেনো সবাই একসঙ্গে বসে। কারণ তিনি একটি জরুরি কথা বলবেন। সুফিয়ান আসতে না চাইলেও মায়ের হাতজোর করায় না এসে পারলো না। রেয়ান একবার বলার পরই এসে পড়লো৷ সুফিয়ান মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বসে একটা স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পরই রাহাত সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন –
‘আমি তোমাদের সবাইকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ডেকেছি ‘
সুফিয়ান অনাগ্রহ নিয়ে বললো-
‘তো বলুন দ্রুত। সেই কখন থেকে বসিয়ে রেখেছেন ‘
রাহাত সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন-
‘হুম বলছি। কথা হচ্ছে, তুমি বড় হয়েছো। আমার বয়স বেড়েছে। তাই আমি চাই তুমি ব্যবসার হাল ধরো। ব্যবসা তো তোমারই ‘
রেয়ানের কপালে হালকা ভাজ পড়লো। তার কারণ হলো ব্যবসা সুফিয়ানের বলায়। সুফিয়ান বললো –
‘ আমার থেকে এইসবের এক্সপেকটেশন না রাখাই রীতিমত বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি আপনার ব্যবসাশ একরত্তিও হাত দেবো না। তাই নেক্সটে এসব বলে আমার টাইম ওয়েস্ট করবেন না ‘
রাহাত সাহেব আহত দৃষ্টি দিয়ে বললেন –
‘তুমি আমার বড় ছেলে। যদি এসবের দায়িত্ব তুমি না নাও তো কী করে হবে?’
রেয়ানের মনে সৃষ্টি হলো একরাশ অভিমান। আর তা মস্তিষ্কে গিয়ে তৈরি হলো গভীর ক্রোধানল। মনে বারবার একটাই প্রশ্ন আসছে’ সে নাহয়, দেখতে একটু খারাপই, কিন্তু পড়াশোনা যোগ্যতায় তো কম নয়। তাহলে সব জায়গায় কেনো তাকে হেট করে নিচু দেখানো হয়! সুফি ভাইকেই কেনো চোখে পড়ে? সেও তো তার ছেলে তাহলে ব্যবসা কেনো সুফিয়ানের একারই হবে! ‘
কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না রেয়ানের ক্রুদ্ধ মন৷ হিংসা মানুষকে ঠিক কতটা খারাপ বানাতে পারে তা রেয়ান জানতো না। খাবার পুরোটা না খেয়েই হনহন নিজের রুমে চলে গেলো। সুফিয়ান সহ সবাই কথায় ব্যাস্ত ছিলো তাই সেদিকে খেয়াল করেনি কেউই। রেয়ানের মস্তিষ্কে শুধু চিন্তা এলো, যে সুফিয়ানকেই সবাই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে আর তাকে মনে করে অযোগ্য তাই তো তাকে ব্যবসার কিছু বলা হলো না। কিন্তু সে এটা একবারও চিন্তা করেনি, যে সুফিয়ানের সঙ্গে তফাৎ কম হলেও সত্য এটাই যে সুফিয়ান বড়। তা-ই রাহাত সাহেব সুফিয়ানকে বলেছে। তার উদ্দেশ্য যে রেয়ানকে ব্যবসা না দেয়ার ছিলো না তা রেয়ানের বোকা মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারেনি।
সব কথা শেষে সুফিয়ান নিজেই বলে দিয়েছিলো যে সে কোনো দায়িত্ব নিতে পারবে না। তাই রেয়ানকে এসব বুঝিয়ে দেয়া হোক। রাহাত সাহেবও ভাবলেন জোর করে তো আর কিছু হয়না তাই দায়িত্বটা রেয়ানকেই দেয়া হবে। সুফিয়ান নির্লিপ্ত ভাবে নিজের রুমে চলে গেলো। তার একমাত্র মনোনিবেশ শুধুমাত্র গান। কয়েকদিন আগেই একজন প্রডিউসারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তার কয়েকটি গান জমা দিয়েছিলো সে। প্রডিউসার জানিয়েছে একটা কনসার্টে তাকে গান গাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। তারপরই তার প্রাণের সঙ্গে দেখা করবে। অর্থাৎ একদিকে কনসার্ট শেষ হবে তারপরই যাবে প্রাণের সঙ্গে দেখা করতে। ফোন করে জানাতেই প্রানেশাও হ্যা বললো। সেও খুব করে চায় মনের মানুষটাকে একবার দেখতে। যেখানে দুইজন মানব মানবী নিজেদের প্রেম নিবেদনের উচ্ছলতায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো। মত্ত ছিলো নিজেদের প্রথম দেখা, প্রথম হাতে হাত রাখা, একসঙ্গে প্রথমবারের মতোন চোখে চোখ রাখা নিয়ে। কিন্তু তারা কী জানতো? যে তাদের আলাদা করতে প্রকৃতি নতুন খেলায় মেতেছে?
চারদিন পরই রাস্তায় ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে বড় একটা এক্সিডেন্ট হলো। সেই গাড়িতেই ছিলো সুফিয়ান। গাড়ি ট্রাকের সঙ্গে এক্সিডেন্ট হয়ে সুফিয়ানের মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে গেলো।

চলবে…..

আজকের পর্বে কিছু বিষয় ক্লিয়ার করলাম। এই পর্বে কারো কোনো কনফিউশান??

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।