অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ১২

এক হাতে প্রানেশাকে জড়িয়ে আরেক হাত পকেটে গুঁজে হাঁটছে সুফিয়ান। প্রানেশা বেজায় খুশি। এক্সাইটমেন্টে তার হাত পা কাপছে। অনলাইন, ম্যাগাজিন, টিভি নিউজে বিভিন্ন জায়গায় নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ডের সৌন্দর্যের বিস্তারিত শুনেছে। বিশ্বাসই হচ্ছেনা তার, যে আজ সেও এই জায়গা ঘুরবে, হাত দিয়ে ছুয়ে দেবে। প্রানেশার মনে পড়লো দুই বছর আগে একদিন রেয়ানকে বলেছিলো, বালিতে তাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার। ভেতরের দীর্ঘ শ্বাসকে ভেতরে রেখেই মুখে হাসি টেনে নিলো। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে রেয়ানকে মনমস্তিষ্ক থেকে দূরে রাখতে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় বাঁধাই হলো মুখ অবয়ব। দুই জনের চেহারা এক হওয়ায় কিছুক্ষণ বাদে বাদেই মনে পড়ে যায়। তবে, এখানে এসে প্রানেশা আবিস্কার করছে নতুন সুফিয়ানকে। ভালোবাসা, কেয়ার, আবদার, পজেসিভনেজ সবকিছুতেই নতুন ভাবে প্রেমে পড়ছে প্রানেশা। তবে, ওভার পজেসিভনেসে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হচ্ছে প্রানেশা। এই যেমন হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় প্রানেশা জিন্স শার্ট পড়েছিলো। জিন্স শার্ট যদি ও অনেক বড় আর ঢোলা ছিলো৷ তারপরও সুফিয়ান ভীষণ রেগে বলেছিলো –
‘এসব কী পড়েছো?’
প্রানেশা অবাক হয়ে বললো-
‘কী পড়েছি মানে!সবসময় যা পড়ি। ‘
সুফিয়ান কিছু না বলে একটা প্যাকেট থেকে লম্বা গাউন ও একটা গার্লস ট্রাউজার বের করে দিলো। প্রানেশা না করেনি। চুপচাপ পড়ে নিয়েছিলো৷ এমন নয়,যে প্রানেশা উশৃংখল, আলট্রা মডার্ণ। ছোটবেলা থেকেই যা পড়েছে সেভাবেই ড্রেস কোড ফলো করে। ক্ষমতাবান বাবার মেয়ে হওয়ায় পাওয়ার তো ছিলোই সাথে আবার কাজিনদের সবার ছোট। বংশে দুই মেয়ের বড়জন। তাছাড়া সবাই ভাই । সব ভাই বড় আদরে মানুষ করেছে। তাই, হ্যারেসের মতো ছোটখাটো জিনিসেরও শিকার হওয়ার সুযোগ পায়নি।
কিন্তু তাই বলে সে অবাধ্য নয়। গাউন পড়ে এসে সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে প্রানেশা জিজ্ঞেস করলো –
‘ আমি তো ওগুলো পড়েই যেতে পারতাম, তাহলে এসব কেনো?’
সুফিয়ান জানে প্রানেশার ধর্মীয় আচারের তেমন কোনো জ্ঞান নেই। তাই কোনো প্রকার রাগারাগী না করে মৃদু হেসে বললো –
‘প্রাণ, একটা বইকে তো কভার ছাড়াই বিক্রি করা যায়। কিন্তু তারপরও কভার লাগিয়ে প্যাকিং করে কেনো বিক্রি করে? ‘
‘নরমাল, কারণ কভার লাগানোতে বইয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি তো হয়ই। সঙ্গে ছিড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না, মূলত সেফ থাকে ‘
‘কারেক্ট, তুমি যদি ওগুলো পড়ে যেতে তেমন কিছু হতো না। কিন্তু এই যে, তুমি এগুলো পড়াতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি হলো। নিজেকে ঢেকে হেফাযতে রাখা সুন্নত। এতে তোমার সম্মান, পবিত্রতা বাড়বে। তুমি খারাপ নজর থেকে সুরক্ষিত থাকবে । ‘
প্রানেশা পুরোটা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকালো। সুফিয়ানের মতো করে তাকে কেউ বোঝায়নি। সে যা পড়েছে তাতেই সমর্থন দেয়ায় ভুল আর সঠিকের পার্থক্য বোঝেনি। এভাবেই যদি কেউ বোঝাতো তাহলে ঠিকই বুঝতে পারতো৷ স্বামীদের দায়িত্ব স্ত্রীকে হেফাজতে রাখা। ভূল পথ থেকে সড়িয়ে আনা। স্ত্রীরা ভুল করবেই,কারণ আপন মানুষ ছেড়ে নতুন জায়গায় মানিয়ে নেয়া খুব কষ্টের ব্যাপার। ভুল ত্রুটিগুলো সুধরে নেয়া তাদের দায়িত্ব। এখন যদি সুফিয়ান প্রানেশাকে না বুঝিয়েই সম্পূর্ণটা চাপিয়ে দিতো তাহলে হয়তো প্রানেশা বুঝতো তো পারতোইনা সঙ্গে আঘাত পেতো৷ প্রানেশার মনে সুফিয়ানের জন্য সম্মানের জায়গা তৈরি হলো। তারপর সুফিয়ানের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো। বের হওয়ার পর দেখলো বাহিরে তিনজন গার্ড সহ একজন নতুন ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা এই পজেসিভনেস দেখে বিরক্ত হয়েছিলো। ঘুরতে যাওয়ার সময় যদি এভাবে রোবটের মতোন পেছনে পেছনে ঘুরে তাহলে তো বিরক্ত হবেই। সুফিয়ানের মুখের দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বলেছিলো –
‘শুনুন?’
সুফিয়ান ভাবলো হয়তো প্রানেশার খারাপ লাগছে তাই অস্থির ভাবে বললো –
‘খারাপ লাগছে প্রাণ? ‘
‘উমহু,এই পেছনে আর সামনের বডিগার্ডদের যেতে বলুন না! ‘
সুফিয়ান গম্ভীর মুখভঙ্গিতে বললো-
‘না প্রাণ, সম্ভব নয়। এরা সাথেই থাকবে’
প্রানেশা মুখ লটকে হাঁটতে লাগলো। সুফিয়ান প্রানেশাকে আরও ভালো করে জড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। প্রানেশার পাঁচের মতোন মুখটা দেখে মনে মনে বললো -‘তোমার জন্যই তো এসব প্রাণ, তুমি জানোনা তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে কত হায়নারা ওত পেতে আছে। কষ্ট হলেও এতে অভ্যস্ত হতে হবে তোমায় ‘
গাড়িতে করে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দশটা বাজলো। গিলি গেটওয়ে নামক জায়গা থেকে নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ড যেতে হয়। গিলি গেটওয়েতে এসে প্রানেশা দেখলো সমুদ্রের মাঝে অনেকগুলো স্পিডবোটের মতোন কিছু। কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো -‘ ওটা কী স্পিডবোট? ‘
সুফিয়ান সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো। প্রানেশা জিজ্ঞেস করতেই বললো-
-‘না, ওটা রুকি। নুসা লেম্বগান যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা ট্রান্সপোর্ট আছে। তারমধ্যে রুকি সবচেয়ে ভালো। সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রান্সপোর্ট এটি স্পিডবোর্টের মতোন দেখতে হলেও আকারে আরও বড়। আমরা এটাতেই যাবো। ‘
-‘ ওয়াও! ‘
সুফিয়ান বাঁকা হেসে বললো –
-‘এখন ওয়াও ওয়াও করছো। ওঠার পর ওয়াও ছুটে যাবে ‘
প্রানেশা শুকনো ঢোক গিলে বড় বড় চোখ করে বললো-
-‘মানে! ওইযে সামনে কত মানুষ চড়ছে। তারা তো চুপ করে বসে আছে।আপনি ভয় দেখাচ্ছেন আমায় হুহ! ‘
-‘প্রাণ,তারা এখানে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। বাসে যেমন অভ্যাস হয়ে যায় তেমনই তাদেরও অভ্যাস হয়ে গেছে ‘
প্রানেশা মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। সুফিয়ান ঠোঁট চেপে হাসছে৷ প্রানেশা যে কী পরিমাণ ভীতু! এটা তার থেকে ভালো কে জানে?
রুকিতে উঠে কাচুমাচু মুখ ধুয়ে বসলো প্রানেশা। সিট খামচে ধরে বসে আছে সে। সুফিয়ান সামনে বরাবর বসে আছে, আর প্রানেশার মুখ দেখে মিটমিট করে হাসছে। পেছনের রুকিতে বডিগার্ডরা বসেছে। প্রানেশা
উপর দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলছে-
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দাও। একদম ভালো হয়ে যাবো, কখনো মিথ্যা বলবো না, হুজুরনী হয়ে যাবো, বেশী কথা বলবো না, তছবী হাতে ঘুরবো ‘
সুফিয়ানের পেট ফেটে হাসি আসতে চাইছে। এত বাচ্চামো কেউ করতে পারে! আবার বলছে বেশি কথা বলবে না অথচ ননস্টপ বকবক করছেই। এমনিতে যথেষ্ট বুঝদার। ভয় পেলে সব বুঝাবুঝি শেষ। রুকি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করতেই প্রানেশা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে চিৎকার করে বললো-
‘আল্লাহ গোওওও!আমি নেমে যাবোওও। আমাকে নামিয়ে দাওওও৷ নাতি পুতির মুখ দেখা আমার আর হলোনা বুঝিইই ‘

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।