খাবার চেয়েছে সেই কখন, শ্রাবণ নিজেকে সামলে নিয়ে একটু দেরি করেই গেছে খাবার নিয়ে। সাদাফের একার খাবার দেখে বললো,
“তোমার খাবার কোথায়?”
বিনা ভাবনায় থতমত খেয়ে শ্রাবণের মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
“আমি খেয়েছি।”
“এতো আগেই খেয়ে নিয়েছো? ঘুমানোর আগে আবার খেয়ো।”
শ্রাবণ নিশ্চুপ সব গুছিয়ে দিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে। বেশ বুঝতে পারছে আজ তার গলা দিয়ে খাবার নামবে না। কিন্তু পেট যে সইবে না! এ অবস্থায় সে করবেই বা কি! বেশ কিছুক্ষণ অযথা দাঁড়িয়ে থেকে তবুও কিছু ভাত প্লেটে নিলো। সাদাফ ডেকেছিলো কিন্তু সে শুনেনি, ধ্যান তার অন্যদিকে। মুখে খাবার তুলছে তো তুলছে না। খাওয়া শেষ হলে সাদাফ নিজেই বাটি প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে চলে এলো। তাকে খাবার নিয়ে বসে থাকতে দেখে বললো,
“তুমি না খেয়েছো বললে? এতো তাড়াতাড়িই ক্ষুধা লেগে গেলো?”
হঠাৎ তার উপস্থিতিতে কেঁপে উঠেছে শ্রাবণ। সাদাফ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো অযথা তার কাপুনি দেখে। শ্রাবণ জবাব না দিয়ে প্লেটে তাকিয়ে ঘন ঘন হাত নেড়ে খেতে লাগলো৷ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
“খেয়েদেয়ে চলে এসো। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে থাকবো।”
কথামতো এসেছে ঠিকই, ভয়ে ভয়ে তার পাশেও অবস্থান করেছে। কিন্তু ঘুম যে ছুটিতে! সাদাফ লেপ মুড়ি দিয়ে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে। অন্যসময় যেখানে ভালোলাগা, ভালোবাসা অনুভব করতো, আজ সেখানে ভয় ছাড়া কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না শ্রাবণ। বারবারই চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ভয়ংকর অস্ত্রগুলো। সেগুলোর উপর হাত পড়ে গেছে, তা দেখেও সাদাফ কিছু বললো না কেন? তাকে একটুও বকাঝকা করলো না কেন? উল্টো এতো আদরযত্নে কেন রাখতে চাইছে? সে কি সত্যিই আদরযত্নে রাখছে নাকি যখন তখন মেরে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে? সে ঘুমালে, ঘুমের মধ্যে মেরে ফেলবে না তো আবার? এ তো সাংঘাতিক লোক। সবসময় শান্ত থাকে, আর হঠাৎ হঠাৎ ঝড় তুলে বসে। অযথা এখানে রেখে খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে, আপন করে নিয়ে আদর যত্ন করছে ঠিক কোন স্বার্থে? ভেবে ভেবে জ্ঞানশূন্য হয়ে যাচ্ছে সে। ঘুমালে যদি মেরে ফেলে সেই ভয়ে চোখ বুজতেও ভয় পাচ্ছে শ্রাবণ। দৃষ্টি সজাগ রাখার চেষ্টা করতে করতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো এবং ভয়ার্ত নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। অন্ধকার ঘরে সাদাফের সাথে জড়ো হয়ে আছে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো সে এখনো জীবিত আছে৷ আবারও কিছুক্ষণ কেটে গেছে ভয়ার্ত দৃষ্টি সজাগ রেখে। এরপর আবারও ঘুম নেমে এসেছে চোখে। ভোরে সাদাফ ঘুমের মধ্যেই তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্যপাশে ফিরে শুতেই আবার ঘুম ভেঙে গেছে তার। এবার বুঝতে পারছে সাদাফ মুক্তি দিয়েছে তাকে। শ্রাবণ উঠে বসে পড়লো। সূর্য উঠেনি, এমনকি উঠার সময়ও হয়নি তবে উঠে যাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। যদিও কুয়াশার বুক ভেদ করে জনসম্মুখে পৌঁছতে অনেক দেরি! দরজার ফাঁকে তাকিয়ে বুঝতে পারছে বাইরে আলো ফুটেছে। সে ধীর পায়ে নেমে এলো। বুক ভরা ধুকপুক কম্পন নিয়ে নিজের কাপড়চোপড় হাতে তুলে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বাইরে এসে ব্যাগটা আঁচলের নিচে গুটিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে পা ফেলতে লাগলো অজানা পথে। কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে জানে না সে। তবে এখানে আর এক মুহুর্তও থাকা সম্ভব হবে না তার পক্ষে। হয় কলিজা ফেটে নাহয় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে ঠিক মারা যাবে সে। তাতেও যদি দেরি হয় তো নিশ্চিত খুন হতেই হবে সাদাফের হাতে। গত কয়েকটা ঘন্টা কিভাবে কাটিয়েছে নিজেও ধারণা করতে পারছে না। এখন বাঁচতে হলে পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।
হাটতে হাটতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে সে। কুয়াশা কমছে, রাস্তাঘাটে জনবহুল বাড়ছে, ব্যস্ততায় ছুটে বেড়াচ্ছে যানবাহন ও জনপদ। গলাটা শুকিয়ে আছে। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পানির বোতল নিয়ে একটা মসজিদ থেকে পানি নিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়েছে। বোতল ভরে পানি নিয়ে সযত্নে রেখে দিলো পরেরবার পানের প্রত্যাশায়। নিজের কাছে কিছু টাকা আছে, তা দিয়ে সকালের নাস্তা দুপুরে সাড়লো। হাটতে হাটতে চলে এলো স্টেশনের কাছে। এতোটা সময় হাটাহাটি করে অস্থির হয়ে পড়েছে শরীর। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোথাও আশ্রয় নেওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারলো না। এ শহরের মানুষ বড়ই অদ্ভুত। আশ্রয়ের নাম করে তারা দেখায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভয়ার্ত রূপ। সেই ভয়ার্ত রূপের ভয়ে সারাটা দিনেও কারো কাছে আশ্রয় চাইলো না সে। ভয় জিনিসটা কি অদ্ভুত! ভালোবাসাকেও পিছু হারিয়ে দিতে জানে সে! একটুও মন কাঁদেনি সেই ভালোবাসার লোকটাকে ছেড়ে চলে আসতে। বরং যত এগিয়ে এসেছে তত প্রশান্তি অনুভব করতে পারছে। যদিও ডানে বামে ভয়ও তার পথের সঙ্গী। আপাতত এ শহর ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে পারলেই পুরোপুরি বেঁচে যায় সে।
স্টেশনে কতশত লোক। কেউ ট্রেনের অপেক্ষায়, কেউ জীবন-জীবিকা নির্বাহের তাড়নায় সময় কাটাচ্ছে। আবার কারো কারো ভিটে বাড়িই এই ঠিকানা। যেখানে সম্ভব হয়েছে, সেখানেই ঠাঁই পেতে বসে পড়েছে। নিয়ে নিয়েছে নিজ দখলে। এ-ই তার বাড়ি, এ-ই তার ঘর। এখানে নেই কোন, কেউ কারো আপন কিংবা পর।
সন্ধ্যার পর একটা ট্রেন এলো। শ্রাবণ ভেবেছিলো এটায় চড়েই কোথাও পাড়ি জমাবে। এরপর কোথাও না কোথাও নেমে পড়বে। আল্লাহ কোনো না কোনো একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দিবেন। এ পৃথিবীতে কাউকেই তিনি না খায়িয়ে রাখেন না। সকলের সামনেই একটা পথ খোলা ঠিকই রেখে দেন। কিন্তু লোকজন এতো ঠেলাঠেলি করে উঠছিলো যে ভীড় ঠেলে ট্রেনে উঠার সাহস পেলো না সে। উঠবেই কি করে, কিছু মানুষ তো ঝুলন্ত অবস্থায়ই চড়ে বসেছে! শ্রাবণ অপেক্ষা করতে লাগলো পরবর্তী ট্রেনের। কিন্তু আর কোন ট্রেনই পেলো না সে। যা-ই এগারোটার দিকে একটা এসেছিলো, সে খাওয়ার জন্য হোটেল খুঁজতে গিয়ে ট্রেন মিস করে ফেলেছে। রাতটা কাটলো স্টেশনে, আর দশটা অসহায়দের ন্যায় তাদেরই সাথে। কিন্তু কারো সাথে সাক্ষাৎ করেনি আবার না পড়ে যায় কোনো বিপদে! ঠান্ডায় প্রচুর কষ্ট করতে হলো রাতটা। আর কখনো এমন কষ্টে রাত পাড় করেনি সে। সকালে খোঁজ নিয়ে জানলো কুয়াশাচ্ছন্ন পথে কোনো ট্রেন নেই, বারোটার দিকে একটা আসবে। এতোক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন আবারও ট্রেনের সেই করুণ অবস্থা নজরে পড়লো, তখন বাদ দিলো ট্রেনে উঠার পরিকল্পনা। বাসের সাহায্যে নাহয় শহর ছাড়া যাক। ঘুরতে ঘুরতে বাস স্ট্যান্ড খুঁজে পেতেও তার দুপুর গড়িয়ে গেছে। কারো কাছে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করেনি, যদি ভুল ঠিকানায় পাঠিয়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে দেয় সেই ভয়ে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটলো শ্রাবণ, ভাড়া মাত্র দশ টাকা। যদিও জায়গা তার অচেনা। তবে একটু আধটু করে চলে যাবে এই ধারণা নিয়ে বাস আসতেই একটু ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়লো। টিকিট অনুযায়ী হেল্পার নামিয়ে দিতেই পথঘাট দেখে আবার হাটতে লাগলো। দুপুরে খাওয়া হয়নি তাই ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর। প্রায় দুটো দিন কেটে যাচ্ছে ভালো মতো খাওয়া হয় না তার। এমনকি থাকার মতো কোনো একটা জায়গাও ঠিক হয় না। দুমুঠো ভাত খেতে হোটেলের উদ্দেশ্যে আরও কিছু পথ এগিয়ে যেতেই জায়গা পরিচিত মনে হতে লাগলো। সে কি এসব জায়গা অতিক্রম করেই কাল পথ পেরিয়েছিলো? একটা সিনেমাহল সামনে পড়তেই নিশ্চিত হলো গতকাল তো সে এই রাস্তা দিয়েই গেছে! বাস এ কোথায় এনে নামিয়ে দিলো তাকে! তাদেরই বা কি দোষ! সে যে জায়গার টিকিট কাটবে সেখানেই তো নামাবে! আজ রাত কোথায় থাকবে ভাবতে ভাবতে ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের ধারে এসে বসলো। ট্রাফিক পুলিশ এসে তাকে এখান থেকে উঠিয়ে দিলো। সে রাস্তা পাড় হয়ে দোকানপাটের ওদিকটায় চলে গেলো। দুইটা টোস্ট কিনে বন্ধ রাখা এক দোকানের পাশে সিড়িতে কাচুমাচু হয়ে বসলো। পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ছোট গলির একটা সরু রাস্তা। এদিকে বাড়িঘরও কম, মানুষজনও ততটা আসাযাওয়া করছে না। কিছু টাকা আছে তার কাছে, এভাবে চলতে থাকলে তো আর দুতিনদিনের বেশি যাবে না এই টাকায়। তারপর কি হবে? নানান চিন্তায় মগ্ন হয়ে বিস্কুট খেতে লাগলো শ্রাবণ। খাওয়া শেষ হলে পানি পান করে সিড়ির শেষ প্রান্তে ঝুঁকে মুখে পানি ছিটিয়ে গলির রাস্তার ভেতরের দিকে তাকালো। আবছা অন্ধকারে একটা লোক কোনোকিছুর বস্তা হস্তান্তর করছে অন্য লোকের হাতে। শ্রাবণ ওদিকে তাকাতেই বস্তা প্রদান করা লোকটার চোখাচোখি হয়ে গেছে। লোকটা ব্রু কুচকে এগিয়ে এসে বললো,
“কি দেখোছ?”
শ্রাবণ দুদিকে ঘনঘন মাথা নেড়ে জানালো কিছু দেখে না সে। কিন্তু ঘনঘন নাড়ানো মাথা যেনো আরও বেশি সন্দেহ গড়ে তুললো লোকটার চোখে। লোকটা হুট করেই তার ব্যাগটা টেনে দুই কদম রাস্তার ভেতরের দিকে পিছিয়ে বললো,
“কি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস দেখি।”
শ্রাবণ দ্রুত বসা থেকে উঠে তার কাছে গিয়ে ব্যাগ টেনে নিতে নিতে বললো,
“আমার ব্যাগ নিচ্ছেন কেন! আমার কাপড়চোপড় এসব।”
হুট করেই শ্রাবণের মাথায় ছোট আকৃতির বন্দুক ঠেকিয়ে ধরলো লোকটা। তাকে আড়ালে আনতেই অযথা ব্যাগটা টেনে নিয়েছিলো যা বুঝতে বাকি নেই শ্রাবণের। লোকটা চোখ রাঙিয়ে বললো,
“তুই এতোক্ষণ যাবত ফলো করছিলি আমাগো? এখন ভং ধরছ? একটা শব্দ করবি এখনই শেষ করি দিমু!”
শ্রাবণ ভয়ে কাতর! এসব হচ্ছে কি তার সাথে! যেদিকে যায় সেদিকেই অস্ত্র! যেসব এড়িয়ে যেতে চায় সেসবই তার পিছু কেন নেয়! এক বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে যে আরেক বিপদ ডেকে আনলো! এখন কি হবে তার! চিৎকার করলেই তো মাথা উড়িয়ে দিবে! ওদিকে তাদের দলের আরেকজন এসে হুট করেই তার মাথা কোনো বস্ত্র দ্বারা ঢেকে মুখ চেপে তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলো। যেতে যেতে বলছে,
“এর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। নইলে পুলিশের কাছে মুখ খুইলা দিবো।”
শ্রাবণ কোনো শব্দই করতে পারছে না। নিরব পথ এমনিতেই অন্ধকার, তারউপর তার দুনিয়াই অন্ধকার করে রেখেছে কাপড়টা। সে ছোটার জন্য হাত পা নাড়াচ্ছে, কিন্তু কোনো উপায় করে উঠতে পারছে না। দমই যেন বন্ধ হয়ে আসছে তার!