অঙ্গনে হৃদরঙ্গন | পর্ব – ১১

হসপিটাল থেকে ফেরার পথে সারাটা পথ মনের সাথে আলাপ করেছে সে। যে মেয়েটা তার যত্ন নিতে ব্যস্ত ছিলো দিনের পর দিন, তাকে সে কিভাবে এতোটা আঘাত করতে পারলো! তার সকল কাজ অনায়াসে করে দিতো মেয়েটা, আর তাকেই কি না সে এতোটা মেরেছে! কি হয়েছিলো এমন, সাধারণ বাঁধাই তো দিয়েছিলো। তাই বলে এভাবে ব্যাথা দিলো! কি করে ঘটলো তার দ্বারা এসব! ভেবে ভেবে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার। চলছে মনে মনে কথা, হৃদয়ে বাড়ছে ব্যাথা। শ্রাবণের জন্য আজ তার হৃদয়টাও নেড়ে উঠেছে। অকারণে শাস্তি দিয়ে বড্ড বেশি অপরাধ বোধ করছে। বারবার ফিরে তাকাচ্ছে শ্রাবণের সেই ব্যাথায় কাতর মুখখানায়। রিকশা থেকে নেমে শ্রাবণ ধীরে ধীরে হাটতে পারছে কিন্তু সম্পূর্ণ শরীর যেন লুটিয়ে পড়তে চাইছে। সাদাফ তাকে ধরে ধরে হেটে শ্রাবণের রুমে নিয়ে এলো। তাকে দাঁড় করিয়ে নিজেই দ্রুত মাদুরটা বিছিয়ে তার উপর মোটা কাঁথাটা বিছিয়ে দিলো। তারপর শ্রাবণকে বসিয়ে রেখে নিজেই প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে আবার রুমে এলো। তার সামনে প্লেট দিয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি খাও। ওষুধ খেতে হবে।”
শ্রাবণ দৃষ্টি নত রেখে মলিন মুখে নিশ্চুপ বসে আছে। সাদাফ বাটি এনে নিজেই তার হাত ধুয়িয়ে দিয়ে আবার বললো,
“তাড়াতাড়ি খাও, শ্রাবণ। ওষুধ না খেলে সুস্থ হবে না। আমি বরফ নিয়ে আসছি। বরফ লাগাতে বলেছে ডাক্তার।”
সাদাফ বেরিয়ে গেলো দোকান থেকে বরফ কিনে আনতে। শ্রাবণ ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ধীরে ধীরে ভাত খেয়ে নিলো। সাদাফ ফিরে এসে দেখলো অর্ধেক খাওয়া হয়েছে। পুরো খাবার শেষ হওয়া পর্যন্ত মাদুরের একপাশে বসে অপেক্ষা করলো সে। তারপর তাকে কখন কোন ওষুধ খেতে হবে বুঝাতে লাগলো। শ্রাবণ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সাদাফ থেমে গেলো। ভাবলো পরে বুঝিয়ে দিবে৷ আপাতত তার নির্দেশনা অনুযায়ী খায়িয়ে দিলো। তারপর নিজেই তার কাছে অগ্রসর হলো কাঁধে বরফ লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। শ্রাবণ বাঁধা দিয়ে নিজ হাতে নিয়ে নিলো বরফের টুকরো। সাদাফ কি রেখে কি করবে তা যেন বুঝতেই পারছে না। সে শ্রাবণের হাত ধরে বললো,
“তোমার কি অনেক বেশি ব্যাথা লাগছে?”
শ্রাবণ শুধু দৃষ্টি নত করে রাখলো। সাদাফ তার আঘাতপ্রাপ্ত কাঁধে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। বড্ড চিন্তিত তার মুখখানা। শ্রাবণ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে তার দৃষ্টি এবং স্পর্শে। এক পর্যায়ে সাদাফ আরও এগিয়ে এসে তার মুখখানা আলতো করে ধরলো এবং তার গালের সাথে নিজের গালটা ছোঁয়াতে চেষ্টা করলো। আর নিতে পারছে না শ্রাবণ। সে কাঁপতে কাঁপতে ডান হাতটা তুলে সাদাফকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো,
“কি করছেন আপনি! এসব পাপ। আপনি পরপুরুষ, আমি পরনারী। আপনি মালিক, আমি দাসী। পর নারীপুরুষের একে অপরকে স্পর্শ করা পাপ। আমি তো বিক্রিত পন্যও নই, কেন করছেন এমন?”
বলতে বলতে আবারও ফুপিয়ে উঠলো সে। সাদাফ যেন এবার হুশে ফিরে এলো। নিজেই লজ্জিত হয়ে উঠে সরে এলো। কি করছিলো সে! ভাবতে ভাবতে দিকবিক না তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো। শ্রাবণ উঠে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো সাথে সাথেই। এদিকে সাদাফ নিজের রুমে এসে শুধু ভেবেই যাচ্ছে, শ্রাবণ তাকে বাঁধা দিলো কেন? এভাবে দূরে কেন ঠেলে সরিয়ে দিলো? সে কি শ্রাবণের কাছে যাওয়ার অধিকার রাখে না? আর তারই বা কি হয়েছে? সে শ্রাবণের কাছে কেন চলে গেলো? শ্রাবণের জন্য ভেতরটা সেই কখন থেকে ছটফট কেন করছে? শ্রাবণের জন্য কেন ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে তার? বারবার শ্রাবণের কাছে কেন যেতে চাইছে সে? তাহলে কি শ্রাবণকে তার প্রয়োজন? হ্যাঁ, প্রয়োজন না হলে তার প্রতি আকর্ষণ জাগতো না নিশ্চয়ই!
ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে সে আবার শ্রাবণের রুমের সামনে এলো। বন্ধ দরজায় নক করলো,
“শ্রাবণ…? শ্রাবণ…? ঘুমিয়ে পড়েছো?”
ঘুমাচ্ছে ভেবে ফিরে এলো সে। দরজা লাগিয়ে রুমের মাঝামাঝিতে চেয়ারে বসে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ তো ঘুমাচ্ছে কিন্তু বেশ বুঝতে পারছে আজ তার ঘুম হবে না। বুঝতে পারছে, শ্রাবণকেই তার প্রয়োজন। আর সে কথা শ্রাবণকে বলা না পর্যন্ত, তার মতামত না নেওয়া পর্যন্ত তার ঘুম নামবে না চোখে।
ওদিকে শ্রাবণ জেগে থেকেও সাড়া দেয়নি। এখন যদি দরজা খুলতে বলে, যদি আরও কাছে আসতে চায়, যদি সে বাধা দিতে গিয়ে হেরে যায়! তখন কি হবে তার! নাহ! সব ভালো, ভালো হয় না। ভালোরাও সময় সুযোগে বদলে যায়। শ্রাবণ চোখের পানি ফেলছে নিরবে। সমস্ত শরীরে ব্যাথা দৌড়াচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ঘুমই নামছে না তার চোখে। তবে বহু অপেক্ষার পর ঘুম ডেকে এনতে সক্ষম হয়েছে। আবার প্রতিদিনকার অভ্যাসে সকাল সকালই ঘুম ভেঙেছে তার। বেরিয়ে বাথরুমে গেলো সে। গতরাতের তুলনায় এখন ব্যাথাটা একটু কম। নিজে নিজে চলাফেরার শক্তি পাচ্ছে। ওষুধে কাজ করেছে বোধহয়। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখলো সাদাফ দাঁড়িয়ে! এতো সকালে তাকে কোনোদিনই উঠতে দেখা যায়নি। গত রাতের ঘটনা মনে হতেই একটু সংকুচিত হয়ে গেলো শ্রাবণ। সে চাদর ন্যায় জড়ানো ওড়নাটা শক্ত মুঠে টেনে ধরলো। যেন খুব শীত লাগছে তার। সাদাফ তাকে দেখেই বলে উঠলো,
“শ্রাবণ, তোমাকে আমার প্রয়োজন।”
শ্রাবণ বিস্মিত হয়ে তাকালে সে এগিয়ে এসে আবার বললো,
“হ্যাঁ, তোমাকে আমার প্রয়োজন। কাল সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি তোমার চিন্তায়। রাতেই দুইবার এসে ডেকে গিয়েছি বলার জন্য। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তুমি কি আমার হবে? আমরা বিয়ে করে নিবো, একসাথে থাকবো। তোমাকে আর কখনো এভাবে মারবো না।”
শ্রাবণের গলা শুকিয়ে আসছে। এ কেমন প্রস্তাব! হ্যাঁ, মনে ধরেছিলো লোকটাকে। কিন্তু গতরাতে তার হিংস্র রূপ দেখে পুরোই ভরকে গেছে সে। একবার তো ভেবেছিলো চলে যাবে এখান থেকে। কিন্তু সে তো আরও বেঁধে রাখার অনুমতি চাইছে! তার ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে সাদাফ হুট করেই তার হাত ধরে বললো,
“বলো, করবে না বিয়ে? নিবে না আমার যত্ন সবসময়? হবে না আমার?”
শ্রাবণ তার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি নত করে ফেললো। তার মৌনতায় যেন সাদাফ সম্মতি খুঁজে পেলো। তাই বললো,
“আমি হুজুর নিয়ে আসি তাহলে?”
শ্রাবণ বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এখন বিয়ে!”
“হ্যাঁ, এখনই। আমি যাচ্ছি কিন্তু। দেনমোহর কত চাই তোমার?”
শ্রাবণের হৃদয় ধুকপুক করে কাঁপছে। সাথে একরাশ লজ্জাও ঘিরে ধরেছে তাকে। সে লজ্জিত দৃষ্টি নিচে নামিয়ে সাদাফের প্রশ্নের জবাবে বললো,
“একটা টুকটুকে লাল শাড়ি।”
“শাড়ি চাই দেনমোহরে? এখন শাড়ি কোথায় পাবো! কাল এনে দেই।”
শ্রাবণ বায়না জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“লাল টুকটুকে শাড়ি ছাড়া আমি কবুল বলবো না।”
সাদাফ চলে গেছে। হ্যাঁ না কিছুই বলে যায়নি। কোথায় যাচ্ছে তা-ও বলে যায়নি। শ্রাবণ রান্নাবান্নার আয়োজন করলো। কাজ করছে, লজ্জায় মিটিমিটি হাসছেও। শরীর খারাপ থাকলেও মনটা ধেইধেই করে নেচে বেড়াচ্ছে। ভুলেই গেছে তার অসুস্থতার কথা। মাঝে মাঝে অসাবধানতার সাথে একটু নড়াচড়া করতে গেলে ব্যাথায় কেঁপে উঠছে আর তখন মনে আসছে ব্যাথার কথা। ধীরে ধীরে কাজকর্ম সেড়ে নিচ্ছে সে। রান্নাবান্না শেষ করে থালাবাটি ধুয়ে নিচ্ছে। এমন সময় কেউ গেইটের কাছে থেকে সাদাফের নাম ধরে ডেকে উঠলো। শ্রাবণ বেরিয়ে এসে দেখলো অর্ডারকৃত তোশক বালিশ নিয়ে হাজির হয়েছে ভ্যান ওয়ালা! কিন্তু সাদাফ যে বাড়িতে নেই, এগুলো রিসিভ করবে কে! লেনদেনের ব্যাপার স্যাপার সম্পর্কেও তো কিছু জানে না সে! সে লোকটাকে একটু অপেক্ষা করতে বললো। এরইমধ্যে সাদাফ চলে এলো। সাথে হুজুর ও একজন সঙ্গী! শ্রাবণ মাথায় ভালোভাবে কাপড় টেনে দ্রুত রান্নাঘরে চলে গেলো। সাদাফ বালিশ তোশক সবটাই নিজের রুমে নিয়ে গেলো এবং ভ্যানওয়ালাকে বিদায় করলো। এরপর সাদাফের ঘরেই তাদের বিয়ে পড়ালেন হুজুর। লাল টুকটুকে শাড়ির প্যাকেট কোলে নিয়েই কবুল বললো শ্রাবণ। সাদাফ শাড়ি এবং মিষ্টি কিনে নিয়ে এসেছে সাথে। দুজনেরই পরিবারের অনুপস্থিতিতে বিয়েতে সাক্ষী হয়ে থাকলেন হুজুর নিজেই এবং হুজুরের সাথে আসা লোকটি। আলাদা কোনো সাক্ষ্য নেই। আলাদা সাক্ষীর আর কি প্রয়োজন, বিয়ে করে তারা পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে সেটাই তো অনেক তাদের কাছে। আশেপাশের কেউ জানেই না এ ব্যাপারে। যেন জানার প্রয়োজনও বোধ করে না কেউ, কাউকে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি সাদাফ। এতো বছর ধরে এখানে বসবাস করছে, আশেপাশে কত লোক ভাড়াটিয়া হয়ে আসছে যাচ্ছে কিন্তু কারো সাথেই তার সাক্ষাৎ নেই। এমনকি বাড়িওয়ালার সাথেও বিল আদান-প্রদান ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই।
বিয়ে সম্পন্ন হলে যেন নিমেষেই অপরাধবোধ কমে এলো সাদাফের। বিয়ে করে বউ পেয়েছে সেই ব্যাপারটা তাকে মোটেও উৎফুল্ল করে তুলতে পারছে না। এমনকি একটা বউ প্রয়োজন কিংবা বিয়ে করা প্রয়োজন সেসব নিয়েও ভাবেনি কখনো। গত রাতেই হঠাৎ সে কেবল বুঝতে পেরেছে যে শ্রাবণকেই তার প্রয়োজন তাই সকাল হতেই আপন করে নিয়েছে। এরপর থেকে নিশ্চয়ই শ্রাবণের কাছে যাওয়ার অধিকার সে রাখে। পাপ পাপ বলে দূরে ঠেলে দিবে না তাকে। ব্যাথায় সমব্যথী হতে দিতে নিশ্চয়ই আপত্তি রাখবে না শ্রাবণ। ভেবে ভেবে মন হালকা হয়ে গেছে সাদাফের।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।