আমি পদ্মজা | পর্ব – ৩১

সকাল থেকে বাতাস বইছে। কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে এমন আমেজ সেই বাতাসে। একটু শীতেল চারপাশ। গরু গাড়ি চড়ে পদ্মজা যাচ্ছে বাপের বাড়ি। পাশে আছে আমির এবং লাবণ্য। পদ্মজার পরনে সবুজ শাড়ি। ভারী সুতার কাজ। গা ভর্তি গহনা। এসব পরে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু ফরিনা বেগমের কড়া নিষেধ, কিছুতেই গহনা খোলা যাবে না। আমির পদ্মজার এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ছেড়ে দিলেই যেন হারিয়ে যাবে। আমিরের এহেন পাগলামি পদ্মজাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে। সে চাপা স্বরে বলল, ‘কোথাও চলে যাচ্ছি না,আস্তে ধরুন।’

আমির চটপট করে নরম স্পর্শে পদ্মজার হাত ধরল। পদ্মজা বলল, ‘মনে আছে তো কি বলেছিলাম?’
‘কী?’
সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা হায় হায় করে উঠল, ‘ওমনি ভুলে গেছেন?’
আমির শূন্যে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করল। সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখল, পদ্মজা নতুন শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। আমির মিষ্টি করে হেসে ডাকল, ‘এদিকে আসো।’
পদ্মজা ছোট ছোট করে পা ফেলে আমিরের পাশে দাঁড়ায়। আমির খপ করে পদ্মজার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘কখন উঠেছো?’
‘যেভাবে টান দিলেন। ভয় পেয়েছি তো।’
‘এতো ভীতু?’
‘কখনোই না।’
‘তা অবশ্য ঠিক।’
‘উঠুন। আম্মা আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’
‘কেন? জরুরি দরকার নাকি?’
‘আমি জানি না। উঠুন আপনি।’
‘এই তুমি তো কম লজ্জা পাচ্ছো ।’

পদ্মজার মুখ লাল হয়ে উঠে। সে বিছানা থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। মাথা নত করে বলল, ‘ আপনি লজ্জা দিতে খুব ভালোবাসেন।’
আমির হাসতে হাসতে বিছানা থেকে নামল। বলল, ‘ তোমার চেয়ে কম ভালোবাসি। আচ্ছা, তুমি কবে ভালোবাসবে বলো তো?’

পদ্মজা পূর্ণ-দৃষ্টিতে আমিরকে দেখল। আমির আবার হাসল। তারপর পদ্মজার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘ যেদিন মনে হবে তুমিও আমাকে ভালোবাসো,বলবে কিন্তু। সেদিনটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হবে।’

পদ্মজা তখনও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমির হাত নাড়িয়ে পদ্মজার পলক অস্থির করে বলল, ‘ কী ভাবছো?’
‘কিছু না।’
‘কিছু বলবে?’
‘আজ ওই বাড়ি যাব আমরা।’
‘এটাই তো নিয়ম।’
‘আপনি একটু বেশরম।’

আমির চকিতে তাকাল। পদ্মজা ঠোঁট টিপে হেসে চোখ সরিয়ে নিল। আমির আমতাআমতা করে বলল, ‘তা..তাতে কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘কি বলতে চাও, বলো তো।’
‘বড়দের সামনে আমাকে নিয়ে এতো কথা বলবেন না। মানুষ কানাকানি করে। আপনাকে বেলাজা,বেশরম বলে।’
‘আমার বউ নিয়ে আমি কী করব, আমার ব্যাপার।’
‘কিন্তু আমাকে অস্বস্তি দেয়।’ পদ্মজা করুণ স্বরে বলল।
আমির নিভল, ‘ আচ্ছা,ঠিক আছে। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব।’
‘সত্যি? আমার আম্মার সামনে ভুলেও পদ্মজা, পদ্মজা করবেন না।’
‘ইশারা দিতেই চলে আসবে। তাহলে ডাকাডাকি করব না।’
পদ্মজা হাসল। আমির ইষৎ হতচকিত। বলল, ‘হাসছো কেন?’
‘এমনি। মনে রাখবেন কিন্তু।’
‘তুমিও মনে রাখবে।’

সকালের দৃশ্য থেকে বেরিয়ে আসে আমির। পদ্মজাকে বলল, ‘মনে আছে। তোমার অস্বস্তি হয় এমন কিছুই করব না।’
আমিরের কথায় পদ্মজা সন্তুষ্ট হয়। নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। উত্তেজনায় কাঁপছেও। মা-বাবাকে দেখবে দুই দিন পর। দুই দিনে কী কিছু পাল্টেছে? পদ্মজা মনে মনে ভাবছে, ‘আম্মা বোধহর শুকিয়েছে। আমাকে ছাড়া আম্মা নিশ্চয় ভালো নেই।’

পদ্মজার খারাপ লাগা কাজ করতে থাকে। ছটফটানি মুহূর্তে বেড়ে গেল। আমির জানতে চাইল, ‘পদ্মজা, শরীর খারাপ করছে?’
‘না।’
‘অস্বাভাবিক লাগছে।’
‘আম্মাকে অনেকদিন পর দেখব।’
‘অনেকদিন কোথায়? দুই দিন মাত্র।’
‘অনেকদিন মনে হচ্ছে।’
‘এইতো চলে এসেছি। ওইযে দেখো, তোমাদের বাড়ির পথ।’

আমির আঙ্গুলে ইশারা করে। আমিরের ইশারা অনুসরণ করে পদ্মজা সেদিকে তাকাল। ওই তো তাদের বাড়ির সামনের পুকুর দেখা যাচ্ছে। আর কিছু সময়,এরপরই সে তার মাকে দেখবে। পদ্মজা অনুভব করে তার নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। সে আমিরের এক হাত শক্ত করে ধরে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

__________
হেমলতা নদীর ঘাটে মোর্শেদের সাথে কথা বলছেন। তিনি মোর্শেদকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন। মোর্শেদ কিছু জিনিষ ভুলক্রমে আনেননি। তা নিয়েই আলোচনা চলছে। ঠিক আলোচনা নয়। হেমলতা বকছেন,মোর্শেদ নৌকায় বসে শুনছেন। তিনি কথা বলার সুযোগই পাচ্ছেন না। হেমলতা নিঃশ্বাস নিতে চুপ করেন। তখনি মোর্শেদ বললেন,’অহনি যাইতাছি। সব লইয়া হেরপর আইয়াম।’
‘এখন গিয়ে হবেটা কী বলো তো? হঠাৎ ওরা চলে আসবে।’
‘আমি যাইয়াম আর আইয়াম।’ বলতে বলতে মোর্শেদ নৌকা ভাসিয়ে দূরে চলে যান। হেমলতা ক্লান্তি ভরা দৃষ্টি নিয়ে স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পূর্ণার চিৎকার ভেসে আসে কানে। তিনি চমকে ঘুরে তাকান। পূর্ণা, আপা আপা বলে চেঁচাচ্ছে বাড়িতে। হেমলতা বিড়বিড় করেন, ‘এসে গেছে আমার পদ্ম।’

তিনি ব্যস্ত পায়ে হেঁটে বাড়ির উঠোনে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটা হামলে পড়ে বুকের উপর। আম্মা,আম্মা বলে জান ছেড়ে দেয়। হেমলতার এতো বেশি আনন্দ হচ্ছে যে, হাত দুটো তোলার শক্তি পাচ্ছেন না। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি দুই হাতে শক্ত করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরেন। শূন্য বুকটা চোখের পলকে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। পদ্মজা নিশ্চয় বুঝে যাবে, দুই রাত তার আম্মা ঘুমায়নি। চোখদ্বয় নিশ্চিন্তে আরাম করতে পারেনি। বুঝতেই হবে পদ্মজাকে। পদ্মজা ঘন ঘন লম্বা করে নিঃশ্বাস টানছে। স্পষ্ট একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ। পারলে যেন পুরো মাকেই এক নিঃশ্বাসে নিজের মধ্যে নিয়ে যেত সে।

হেমলতা পদ্মজার মাথায় আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, ‘আর কাঁদিস না। এই তো,আম্মা আছি তো।’
‘তোমাকে খুব মনে পড়েছে আম্মা।’
‘আমারও মনে পড়েছে।’ হেমলতার চোখের জল ঠোঁট গড়িয়ে গলা অবধি পৌঁছেছে। তিনি অশ্রুমিশ্রিত ঠোঁটে পদ্মজার কপালে চুমু দেন। আমির হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করতে নেয়। হেমলতা ধরে ফেলেন। আমিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘লাগবে না বাবা।’
আমির বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘ ভালো আছেন আম্মা?’
‘ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো? আমার মেয়েটা কান্নাকাটি করে জ্বালিয়েছে খুব?’
‘ভালো আছি আম্মা। একটু-আধটু তো জ্বালিয়েছেই।’ কথা শেষ করে আমির আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজা ফোঁপাচ্ছে। হেমলতা অনেকক্ষণ চেষ্টা করে পদ্মজাকে নিয়ন্ত্রণে আনেন। বাড়িতে মনজুরা,হানি সহ হানির শ্বশুরবাড়ির অনেকেই ছিল। তারা আগামীকাল ঢাকা ফিরবে। জামাই স্বাগতমের বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। পূর্ণা পদ্মজা, লাবণ্যকে টেনে নিয়ে যায় ঘরে। হানির স্বামী আমিরকে নিয়ে গল্পের আসর জমান।আমির আসার সময় গরু গাড়ি ভরে বাজার করে নিয়ে এসেছে। হেমলতা সেসব গুছাচ্ছেন। তিনি বার বার করে মজিদ মাতব্বরকে বলে দিয়েছিলেন, ফের যাত্রায় বাজার না পাঠাতে। তবুও পাঠিয়েছেন। ফেলে তো দেওয়া যায় না।

___________
রাতের খাবার শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। পূর্ণাকে আমির ছোট আপা ডাকে। শালির চোখে একদমই দেখছে না। তেমন রসিকতাও করছে না। আমিরের ব্যবহারে পূর্ণা ধীরে ধীরে আমিরকে বোন জামাই হিসেবে পছন্দ করছে। না হোক নায়কের মতো সুন্দর। মন তো ভালো। হানির বড় ছেলে,লাবণ্য,আমির আর পূর্ণা লুডু খেলছে। পদ্মজা কিছুক্ষণ খেলে উঠে চলে এসেছে। হেমলতা,মোর্শেদ বারান্দার বেঞ্চিতে বসে ছিলেন। পদ্মজা দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। মোর্শেদ দেখতে পেয়ে ডাকলেন, ‘ কী রে মা? আয়।’
পদ্মজাকে দুজনের মাঝখানে বসিয়ে দিলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘ হউরবাড়ির মানুষেরা ভালা তো?’
পদ্মজা নতজানু হয়ে জবাব দিল, ‘সবাই ভালো।’
‘একটু আধটু সমস্যা থাকবেই,মানিয়ে নিস। জয় করে নিস। সব কিছুই অর্জন করে নিতে হয়।’ বললেন হেমলতা। পদ্মজা হেমলতার দিকে তাকিতে মৃদু করে হাসলো। হেমলতা আবার বলেন, ‘তোর শ্বাশুড়ি একটু কঠিন তাই না? চিন্তা করিস না। যা বলে করবি। পছন্দ-অপছন্দ জানবি। সেই মতো কাজ করবি। দেখবি, ঠিক মাথায় তুলে রেখেছে।’
‘আচ্ছা, আম্মা।’ বলল পদ্মজা।
‘সব শ্বাশুড়ি ভালো হয় না লতা। আমার শ্বাশুড়িরে আজীবন তেল দিলাম। কোনো পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি।’ বললেন হানি। তিনি ঘর থেকে সব শুনছিলেন। কথা না বলে পারলেন না।

হেমলতা এক হাতে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর হানির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার পদ্মর কপাল এতো খারাপ নিশ্চয় হবে না।’
‘পদ্মর অবস্থা আমার মতো হয়েছে যদি শুনি,পদ্মকে তুলে নিয়ে যাব আমার কাছে। তুই মিলিয়ে নিস।’
‘আহ! থামো তো আপা। আমির, লাবণ্য শুনবে। কী ভাববে?’

হানি আর কিছু বললেন না। চারজন মানুষ নিশ্চুপ বসে রইল অনেকক্ষণ। একসময় হেমলতা রান্নাঘরের দিকে যান। রান্নাঘর গুছানো হয়নি। মোর্শেদ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। হানি পদ্মজার পাশে বসেন। বললেন, ‘শোন মা, শ্বাশুড়িরে বেশি তেল দিতে গিয়ে নিজের জীবন নষ্ট করবি না। তোর মায়ের অনেক জ্ঞান,অভিজ্ঞতা মানি। কিন্তু লতার শ্বাশুড়ি নিয়ে সংসার করতে হয়নি। তাই সে জানে না। আমি জানি শ্বাশুড়িরা কেমন কালসাপ হয়। এরা সেবা নিবে দিনরাত। বেলাশেষে ভুলে যাবে। নিজের কথা আগে ভাববি। শ্বাশুড়ি ভুল বললে জবাব দিবি সাথে সাথে। নিজের জায়গাটা বুঝে নিবি। পড়াশোনা থামাবি না। পড়বি আর আরামে থাকবি। আমরা বান্দি পাঠাইনি। সাক্ষাৎ পরী পাঠাইছি। শুনছি, আমিরের টাকাপয়সা, জমিজমা অনেক আছে। তাহলে তোর আর চিন্তা কীসের? জামাই হাতে রাখবি। তাহলে পুরো সংসার তোর হাতে। আমার কপালে এসব ঠেকেনি। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন রাখতে রাখতে কখন বুড়ি হয়ে গেছি বুঝিনি। বুঝছিস তো?’

পদ্মজা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, ‘ মেজো আপা আসে নাই কেন? বিয়ে কবে আপার?’
‘ওর তো পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনা শেষ করুক। এরপর বিয়ে দেব।’
‘বিয়ে না ঠিক হওয়ার কথা ছিল। হয়নি?’
‘কবে?’ বললেন হানি। পদ্মজা হানির প্রশ্নে খুব বেশি অবাক হলো। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘ আম্মা না কয়দিন আগে তোমাদের বাড়ি গেল। বড় আপার বিয়ে ঠিক করতে।’

হানি হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন পদ্মজার দিকে। তিনি কিছুই বুঝছেন না। তার মেয়ের বিয়ে আবার কবে ঠিক হওয়ার কথা ছিল? পদ্মজা বিয়ে করে কী আবোলতাবোল বকছে! তিনি বললেন, ‘কী বলিস?’

হানির সহজ সরল মুখখানার দিকে পদ্মজা একদৃষ্টে চেয়ে রইল। সে ভাবছে, ‘আম্মা রাজধানীতে তাহলে কেন গিয়েছিল? মিথ্যে কেন বলেছে? সেদিন রাজধানীতে গিয়েছিল বলেই, এতো বড় অঘটন ঘটেছিল। না! অঘটন ভাগ্যেই লেখা ছিল। কিন্তু মিথ্যে কেন বলল আম্মা?’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।