আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়৷ গত তিনদিন যাবৎ ভারী বর্ষণ হচ্ছে। বিকেলের দিকে এই ধারাপাত কমলেও, সন্ধ্যার পর ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেদিন রাতে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিল প্রণয়। কয়েক রাত ঠিকভাবে ঘুমাতেও পারেনি৷ কিন্তু গত ক’দিন ধরে শাহিনুরের শরীর ভীষণ খারাপ। তাই সেই ঘটনা নিয়ে চিন্তার সমাপ্তি টেনেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির প্রকোপও বাড়তে লাগল। প্রণয় তখন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। সন্ধ্যার পর থেকেই পেটে ব্যথা হচ্ছিল শাহিনুরের। ধীরে ধীরে সে ব্যথা বাড়তে শুরু করে। সহ্য ক্ষমতা অতিরিক্ত থাকার কারণে যে পর্যন্ত এই ব্যথা ভয়াবহ আকার ধারণ না করল, সে পর্যন্ত চুপ থাকলো সে। মাঝরাতে অসহনীয় ব্যথায় চোখ,মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। শরীর থেকে বিরতিহীন স্বেদজল নিঃসৃত হচ্ছে। প্রথমবার মা হচ্ছে বলে বুঝতেও পারছে না তার প্রসববেদনা হচ্ছে। হঠাৎ চোখমুখ কুঁচকে, একহাত শক্ত মুঠ করে বিছানায় মুষ্টির আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে শরীর কাঁপিয়ে চোখ খুলল প্রণয়। পাশফিরে হারিকেনের স্বল্প আলোয় যতটুকু দেখার দেখে ধপ করে ওঠে বসল। শাহিনুরের কপালে, মাথায়, পেটে হাত রেখে ধমকে ওঠল,
-‘ এই মেয়ে কখন থেকে ব্যথা হচ্ছে! আমাকে ডাকলে না কেন? ‘
শাহিনুরের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করল৷ প্রচণ্ড হাঁসফাঁস কণ্ঠে বলল,
-‘ ডাক্তারসাহেব কিছু একটা করুন। আমি মরে যাচ্ছি, আর সহ্য করতে পারছি না! আম্মাহ, আম্মা গো, আমি মরে যাচ্ছি!’
স্তব্ধ হয়ে গেল প্রণয়। ভয়ানকভাবে তার হৃদযন্ত্র কেঁপে ওঠল। যেনতেন ব্যথায় এমনটা বলার মেয়ে শাহিনুর না। ঠিক কতটা ব্যথায় অসহনীয় হয়ে এভাবে বলল ভাবতেই বুকের ভিতর মোচড় দিলো। একজন দাই ঠিক যে যে প্রক্রিয়ায় গর্ভবতী নারীদের বাচ্চা জন্ম দিতে সহায়তা করে, তার সকল পদ্ধতিই অবলম্বন করল সে। টুনটুনি দাদি এসে সহায়তা করল তাকে। দাদা পাশের ঘরে বসে আছে। যখন যা প্রয়োজন পড়ছে টুনটুনি দাদিকে এগিয়ে দিচ্ছে। বাইরে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে। আধাঘন্টার মতো চেষ্টা করল শাহিনুর। সময়ের গতিতে তার অবস্থা খারাপ হতে লাগল। দিশেহারা হয়ে গেল প্রণয়। বুঝল, শাহিনুর পারছে না, এভাবে বসে থাকলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। এক পর্যায় আর্তচিৎকার করে ওঠল শাহিনুর। তার সে চিৎকার সহ্য করতে না পেরে প্রণয় টুনটুনি দাদি’কে বলল,
-‘ দাদি আপনি ওর সঙ্গে থাকুন আমি জমিলের কাছে যাচ্ছি। আগেই ও’কে বলে রেখেছি, এমন একটা দিন আসতে পারে ধারণা করেই সব ঠিকঠাক করেছি শুধু খবর দিতে হবে। ‘
-‘ হাসপাতালে নিয়া যাবা? ‘
-‘ হ্যাঁ আমি জমিলের সিএনজি নিয়ে এখুনি আসছি। কাঁচা রাস্তা অবধি সিএনজি আসবে বাকিপথ কোলে করেই নিয়ে যাব। ‘
প্রণয় দাদিকে খেয়াল রাখতে বলল। যদি এর আগে বাচ্চা হয়ে যায় কীভাবে কি করতে হবে বুঝিয়েও দিলো। তীব্র ব্যথায় শাহিনুরের শরীর থরথর করে কাঁপছে। প্রণয় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেল বলল,
-‘ কিছু হবে না আমি আছি, তুমি মানসিকভাবে শক্ত থাকো প্লিজ। ‘
বিধ্বস্ত মুখশ্রীতে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল শাহিনুর।
প্রণয়ের একটি হাত চেপে ধরে বলল,
-‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমাকে রেখে যাবেন না। আমার খুব ভয় হচ্ছে।’
একদিন, যে মেয়েটা দু’টো প্রাণ অবলীলায় শেষ করে দিয়েছিল। দু’জন মানুষ’কে দুনিয়ার আলো থেকে চিরজীবনের মতো অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল৷ আজ সে একটি প্রাণ’কে দুনিয়ার আলো দেখাতে কত ভয়, কত কষ্টে জর্জরিত হয়ে আছে। এ-থেকেই প্রমাণিত – মানুষের প্রাণ নাশ যত সহজ, প্রাণ দান তত কঠিন। যত সহজে একটি মানুষ’কে ধ্বংস করা যায় তত সহজে একটি মানুষ’কে গড়ে তোলা যায় না। প্রণয়ের দু-চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠল। টুনটুনি দাদির সামনেই শাহিনুর’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল,
-‘একদম ভয় পাবে না। আমি আছি তো।’
বক্ষপট থেকে কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়ে শাহিনুরের মলিন মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রণয়। আদুরে কণ্ঠে বলল,
-‘আর সময় নেই, আমি এই যাব এই আসব। আমাদের সন্তান ছটফট করছে, একঘেয়েমি জীবন আর ভালো লাগছে না তার। এবার বাবার কাঁধে চেপে পৃথিবীর আলো, বাতাস উপভোগ করতে চায় সে।’
ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে ওঠল শাহিনুর৷ প্রণয় তার সারা মুখে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলল,
-‘আসছি আমি। তুমি শক্ত থাকো, আমি না আসা অবধি একটুও কাঁদবে না, একটুও দুর্বল হয়ে পড়বে না। মনে রেখো তুমি দুর্বল হয়ে পড়া মানে আমাদের সন্তানও দুর্বল হবে। দুর্বল মা’য়ের দুর্বল সন্তান পৃথিবীতে আসুক তা আমি চাই না। আমি চাই শক্তিশালী বাবা, মা’য়ের শক্তিশালী সন্তান হয়ে পৃথিবীর বুকে ওর আগমন হোক।’
কথাগুলো শেষ করে প্রণয় ওঠার জন্য উদ্যত হলো। তৎক্ষণাৎ শাহিনুর ওর হাত টেনে ধরল। কাতর স্বরে বলল,
-‘মা হওয়া খুব কঠিন ডাক্তারসাহেব।’
এতদিন সে প্রণয়ের আত্মত্যাগ দেখে বলত, বাবা হওয়া কঠিন৷ অসহ্য যন্ত্রণার স্বীকার হয়ে আজ বলছে, মা হওয়া কঠিন। সত্যি বলতে, বাবা, মা হওয়া সুখকর বিষয় হলেও সহজতর বিষয় নয়।স্মিত হেসে প্রণয় বলল,
-‘এইতো অল্পসময় তারপর এত কঠিন লাগবে না।’
-‘আপনিই আমার সাহস, বেশি দেরি করবেন না।’
-‘ভয় পেয়ো না এই যাব আর এই আসব।’
-‘ছাতা নিয়ে যাবেন কিন্তু।’
হ্যাঁ সূচকে মাথা দুলিয়ে টুনটুনি দাদিকে দায়িত্ব দিয়ে বের হলো। টুনটুনি দাদি বাতাস করতে লাগল শাহিনুর’কে। বলল,
-‘নাতবউ আবার চেষ্টা কর দেহি পারোস কিনা।’
__
বৃষ্টিভেজা পাহাড়ি পথে হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হয়। পাঁচমিনিটের পথ শেষ করতে দশমিনিট লেগে যায়। কাঁচা রাস্তার শেষ মাথায় পাকা রাস্তার শুরুতে জমিলদের বাড়ি। জমিল একজন সিএনজি চালক। মাঝেমধ্যে তার সিএনজি করে বাজারে যাওয়া,আসা করেছে প্রণয়৷ মোটামুটি ভালো একটি সম্পর্কও গড়ে ওঠেছে। সেই সুবাদেই বলে রেখেছিল, তার গর্ভবতী স্ত্রীর কথা। যাতে দুঃসময়ে পাশে পাওয়া যায়। জমিলও কথা দিয়েছে এমন সময় এলে সে অবশ্যই সাহায্য করবে। সেই বিশ্বাসেই তার বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে প্রণয়৷
“দুনিয়াতে বসবাস করা মনুষ্য জাতির পরিকল্পনা যেখানে ইতি টানে, মহাপরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সেখান থেকেই শুরু।”
প্রণয় পরিকল্পনা করেছিল, সে জমিলসহ জমিলের সিএনজি নিয়ে কাঁচা রাস্তার শেষ মাথায় যাবে। সেখানে সিএনজি আর জমিলকে দাঁড় করিয়ে সে ছুটে যাবে, শাহিনুরের কাছে। ভরসা দিয়ে, সাহস জুগিয়ে প্রিয়তমা’কে কোলে তুলে নেবে। সন্তর্পণে বক্ষে চেপে, পাহাড়ি কাদামাটিতে খুব সচেতনভাবে পা ফেলে দ্রুত সিএনজির কাছেও চলে আসবে। তারপর সোজা সরকারি হাসপাতালে গিয়ে সিজার করাবে। ভারী বর্ষণ কমে এখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে।ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে সহসা বজ্রপাত হওয়ার মতো করে মুহূর্তেই প্রণয়ের সমস্ত পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। এই মাঝরাতে, হঠাৎ এই ভয়াবহ অঘটনটি কোন হৃদয়হীন ঘটাল?
প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে হাঁটছিল প্রণয়। মাঝেমাঝে ছুটছিলও সে। কাঁচা রাস্তার অনেকটা পথ এগুনোর পর আচম্বিতে কয়েকজোড়া হাত জাবটে ধরল ওকে। একজন ছাতাটা টেনে সরিয়ে পেছন থেকে কাপড় দিয়ে মাথা সহ পুরো মুখ শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলল। সহসা নিজের সঙ্গে কী ঘটে গেল বা কী ঘটতে চলেছে বুঝে ওঠার আগে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছোটার চেষ্টা করল। কিন্তু চোখ,মুখ বাঁধা অবস্থায় এতগুলো মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠল না৷ কয়েক মিনিটের মধ্যেই আগন্তুক গুলো হাত, পা বেঁধে একটি গাড়িতে ওঠাল তাকে। মুখ দিয়ে শুধু মৃদু মৃদু শব্দ ব্যাতীত আর কোন শব্দই করতে পারলো না। শরীরে এত কঠিন, শক্ত বাঁধন দিয়েছে আর এতজন চেপে ধরে বসেছে যে বিন্দু পরিমাণ নড়তেও পারলো না। শুধু শুনতে পেলো কয়েকজোড়া মানবের কথোপকথন,
-‘ কি বলেছিলাম তো, সবুরে মেওয়া ফলে। ভাগ্যিস ধৈর্য্য ধরেছিলাম।’
-‘ শালা বহুত চতুর! সেই রাতের পর দিনের বেলায়ও বের হয় নাই।’
তৃতীয় এক ব্যক্তি অশ্লীল সুরে বলল,
-‘যে গর্তে ঢুকছে ঐ গর্ত থেকে কি বের হবার মন চায়।’
সস্বরে কয়েকটি মুখে অশ্লীল হাসি ফুটে ওঠল। ক্রোধে শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠল প্রণয়। একজন বলল,
-‘ দেখ দেখ তেজ কত। এই তেজ আর বেশি সময় থাকব না। তারপর যদি তোর গর্ত খুঁজে পাই…’
সকলেই হো হো করে হেসে ওঠল। পরিস্থিতির বীভৎসতা বুঝতে পেরে দু-চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াল প্রণয়ের। মনে মনে বলল,
-‘ হায় শাহিনুর আমি বোধহয় আমার কথা রাখতে পারলমান না। হে প্রভু তুমি আমার শাহিনুর’কে সাহায্য করো। তুমি আমার সন্তান’কে রক্ষা করো।’
[১০৭]
প্রণয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সময় গড়িয়ে গিয়েছিল অনেকটা। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল শাহিনুরের। তীব্র ব্যথায় শরীরের হাড়গোড় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছিল। চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে নিজেকে শক্ত করে নিয়ে শেষ চেষ্টা করতেই ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে মূর্ছা ধরে সে। কর্ণে বাচ্চার কান্নার শব্দ গেলেও চোখ তুলে তাকানোর শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলে ৷ শুধু দু’চোখের কার্ণিশ বেয়ে অবিরত অশ্রু নিঃসৃত হতে থাকে। অবচেতন মন প্রণয়ের আসার অপেক্ষা করে। টুনটুনি দাদিকে ঠিক যেভাবে বলে গিয়েছিল প্রণয় সেভাবেই সে সবটা সামলায়। তাকে সাহায্য করে বুড়ো দাদা। একটি পরিষ্কার নরম কাপড় দিয়ে সদ্য জন্মানো ফুটফুটে বাচ্চাটার শরীরে লেগে থাকা শোণিত মুছে দেয়৷ কপাল, চোখ কুঁচকে, ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে একনাগাড়ে চিৎকার করে কাঁদছে বাচ্চা’টা। টুনটুনি দাদি আরেকটি পরিষ্কার ছেঁড়া কাপড় দিয়ে ছোট্ট দেহটি মুড়িয়ে বুকে নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকে। উম পেয়ে চুপ করে অবুঝ শিশুটি। মিনিট কয়েক পর আবারও কান্না শুরু করলে টুনটুনি দাদি শাহিনুরের ডানপাশে ও’কে শুইয়ে দিয়ে দাদাকে বলে,
-‘আ’ কুদ্দুসের বাপ নাতিনডায় এহনো আইলো না। তুমি যাও দেহি, কোনো বিপদআপদ হইল না কী?’
-‘হাঁচাই তো কইছো। এহনো আইলো না। আমি যাই দেইখে আসি।’
দাদা তখনি বেরিয়ে পড়ল৷ টুনটুনি দাদি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। শাহিনুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বারকয়েক ডাকলো,
-‘ও নাতবউ চোখ দুইডা খুলো দেহি। মেয়ার মাওগোরে কি শুইয়া থাকলে চলব?’
দুর্বলচিত্তে চোখ খুলল শাহিনুর। টুনটুনি দাদি বাচ্চাটাকে উঁচিয়ে ধরে বলল,
-‘ খিদায় কিবা করতাছে দেহো। কান্দিতে কান্দিতে গলা শুকাই গেছে মনে হয়। একটু খিলাও দেহি। বেলাউজের বোতাম খুলো, আমি শিখাই দেই শরম পাইয়ো না।’
নিজের নাড়িছেঁড়া সন্তান’কে দেখে সমস্ত যন্ত্রণা যেন এক নিমিষে ভুলে গেল শাহিনুর। সমস্ত লজ্জা, ব্যথা, চিন্তা, বিষাদ ভুলে গিয়ে দু’হাতে বুকে টেনে নিলো নিজ বাচ্চা’কে, প্রণয়কন্যা’কে। তারপর টুনটুনি দাদি’কে বলল,
-‘উনি এখনো আসছে না কেন? মেয়ের যে নাম রাখতে হবে। দাদা’কে বলুন উনাকে খবর পাঠাতে, আর সিএনজি লাগবে না। হাসপাতালেও যেতে হবে না। আমি একদম সুস্থ।’