অন্যদিনের তুলনায় আজ দ্বারে করাঘাতের শব্দটি বেশিই কড়া ছিল। শাহিনুর ত্বরান্বিত হয়ে বদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করল। প্রিয়তম অর্ধাঙ্গের ক্লান্ত মুখমণ্ডল, চিন্তান্বিত দৃষ্টিজোড়া নজরে পড়তেই মিষ্টি করে হাসলো। তার সে মিষ্টি হাসি দেখে প্রণয়ের দেহ, মনে চলা দাবদাহের অনুভূতি’তে ভাটা পড়ল। প্রাণভরে কতক্ষণ শ্বাস ফেলল সে। কিন্তু শাহিনুরের মিষ্টি হাসিটুকু বেশিক্ষণ স্থির রইল না। প্রণয়’কে আপাদমস্তক দেখে তার সর্বাঙ্গ ভয়ে কেঁপে ওঠল। উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,
-‘ কী হয়েছে? আপনাকে এমন লাগছে কেন? গা’য়ের শার্ট, শার্ট কোথায়? কী হয়েছে আপনার? ‘
অবিরত প্রশ্নের পাশাপাশি কপালে, মুখে, শরীরে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে লাগলো। প্রণয় লম্বা করে শ্বাস টেনে শাহিনুরের হাত নিজের হাতের মুঠোবন্দি করে নিলো৷ শাহিনুর ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত চলছে। দু’হাত মৃদুভাবে কাঁপছে। মুঠোবন্দি করা হাতটি উল্টো করে হাতের পিঠে চুমু খেলো প্রণয়৷ বলল,
-‘ উত্তেজিত হচ্ছো কেন? আমার কথা শোনো আগে৷’
কিঞ্চিৎ পরিমাণে শান্ত হলো শাহিনুর। প্রণয়ের দিকে গভীর চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-‘ আপনি বসুন আমি পানি আনছি। ‘
নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে প্রণয় বাঁধা দিয়ে হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো। বলল,
-‘ আমি আনছি, তুমি বসো। ‘
তারপর শাহিনুরের আটমাসের উঁচু পেটটায় চট করে চুমু খেলো। হাতে থাকা জিনিসগুলো বিছানার একপাশে রেখে এক গ্লাস পানি খেলো, আরেক গ্লাস শাহিনুরের জন্য নিয়ে এলো। শাহিনুর পানিটা খেয়ে গ্লাস ফেরত দিতেই প্রণয় সেটা যথাস্থানে রেখে ওর পাশে এসে বসলো। একটি হাত ধরে ভরসার সঙ্গে বলল,
-‘ অল্পতে এত উত্তেজিত হলে চলে? এই অবস্থায় এমনটা ঠিক না। ‘
-‘ আপনার কী হয়েছে? আপনাকে খুব বিধ্বস্ত লাগছে। কী হয়েছে বলুন না। ‘
শাহিনুরের কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা, কাতরতা। প্রণয় একবার ভাবলো সবটা খুলে বলবে, আবার ভাবলো, এ মুহূর্তে এসব বলা ঠিক হবে না। শাহিনুরের শরীর’টা তেমন ভালো নেই। যত সময় এগুচ্ছে তত ছটফটে অনুভূতি বাড়ছে মেয়েটার। ইদানীং সেভাবে খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। তীব্র অস্বস্তি’তে ভোগে। চাপা স্বভাব, মানসিক ভাবে প্রচণ্ড শক্ত হওয়ার দরুন নিজের সমস্যা গুলোর কথা সেভাবে বলে না। কিন্তু প্রণয় বুঝতে পারে। তাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলল,
-‘ জানোই তো কি ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে আসতে হয়৷ আসার সময় অন্ধকারে ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম৷ একটি গাছের সঙ্গে শার্ট আঁটকে গিয়েছিল। মনে হয় গাছটা কাঁটাযুক্ত কোন গাছ হবে৷ এত টানাটানি করলাম কাজ হলো না। এদিকে দেরিতে ফিরলে তুমি চিন্তা করবে। তাই শার্ট’টা খুলেই চলে এসেছি। ‘
শাহিনুর বিশ্বাস করল কিনা বোঝা গেল না। শুধু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রণয় প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
-‘ দাদা,দাদি টিভি দেখতে গেছে? ‘
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল,
-‘ হ্যাঁ। আপনি হাতমুখ ধুয়ে আসুন খিদে পেয়েছে আমার।’
প্রণয় মাথা ঝুঁকিয়ে ওঠতে নিয়েও ওঠল না। শাহিনুর পেটে হাত দিয়ে ওঠতে গেলে তাকেও বাঁধা দিয়ে বসিয়ে দিলো। প্যাকেট থেকে কানের দুল, চুড়ি বের করে উৎফুল্ল চোখে তাকাল প্রণয়। শাহিনুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রশস্ত হেসে কানের দুলজোড়া, আর চুড়ি গুলো বের করে শাহিনুর’কে পরিয়ে দিলো। হারিক্যানের স্বল্প আলোতে এটুকু সাজসজ্জায় যে সৌন্দর্য টুকু সপ্তাদশী শাহিনুরের দেহে উপচে পড়ল, এতেই কপোকাত হয়ে গেল প্রণয়৷ চোখ বন্ধ করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,
-‘ তুমি আমার সেই মানুষ যাকে দেখলে আমার চোখ জুড়ায়, প্রাণ শীতল হয়।’
অবাক চোখে তাকিয়ে রইল শাহিনুর। একহাতে নিজের কানের দুলে স্পর্শ করল, হাতের চুড়িগুলোতে তাকিয়ে অপরহাতে প্রণয়ের বুকে স্পর্শ করল। বলল,
-‘ এই বুকে এত প্রেম কেন ডাক্তারসাহেব? ‘
-‘ সব তোমার জন্য। ‘
-‘ আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ। আমার শ্রেষ্ঠ স্বামী। ‘
-‘ তুমি নিজেই অতুলনীয় তাই এমন পুরুষ’কে স্বামীরূপে পেয়েছো। ‘
-‘ আমার নিজেকে খুব সুখী সুখী লাগে ডাক্তারসাহেব। বড়ো ভাগ্য করে আপনাকে পেয়েছি।’
তৃপ্তিময় হেসে প্রণয় বলল,
-‘ একজন স্বামীর কাছে এর চেয়ে বড়ো গর্বের বিষয় কি হতে পারে। ‘
অবুঝ চোখে তাকাল শাহিনুর। প্রণয় মুচকি হেসে বলল,
-‘ প্রতিটি স্বামীই তাদের স্ত্রীর কাছে এমন সার্টিফিকেট পেতে চায়। ‘
লজ্জা পেলো শাহিনুর। দৃষ্টি নত করে বলল,
-‘ আপনার মতো এভাবে কেউ ভালোবেসেছে কিনা জানি না। আমি শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে উপায় চাই কীভাবে কোন রূপে এই ভালোবাসার প্রতিদান দেবো। কীভাবে ভালোবাসলে এর প্রতিদান দেওয়া হবে? ‘
-‘ বার্ধক্যের সঙ্গী হয়ে দিও।’
কিঞ্চিৎ অভিমানের স্বরে বলল,
-‘ সব সময় এভাবে বলেন আপনি। এটা কি বার বার বলার মতো কথা? এটাতো জানা কথাই।’
বলেই প্রণয়ের চোখে দৃঢ়ভাবে তাকাল। মোহনীয় স্বরে বলল,
-‘ শুনুন যতদিন আপনার দেহে প্রাণ থাকবে, যতদিন আমার দেহে প্রাণ থাকবে ততদিন আমরা একসঙ্গে, একে অপরকে এভাবেই আঁকড়ে বাঁচব। ‘
-‘ উহুম ভুল হলো। এভাবে বলো, ইহজনমেও তুমি আমি একসঙ্গে বাঁচব পরজনমেও তুমি আমি একসঙ্গে কাটাব।’
কপট রাগ দেখিয়ে শাহিনুর বলল,
-‘ ভালোবাসাতে আপনি সব সময় এগিয়ে আমি সব সময় পিছিয়ে। কথাতেও পারি না এক ধাপ ঠিক এগিয়ে থাকেন।’
-‘ রাগ করছো কেন। তুমি খুঁজে পাও না কীভাবে প্রতিদান দেবে। আমি ভাবি বুড়ো বয়সে প্রতিদান দিতে দিতে কী কষ্টই না হবে তোমার! শেষ বয়সে তুমিই এগিয়ে থাকবে। কথাটা মিলিয়ে নিও।’
সহসা হেসে ফেলল শাহিনুর। দুষ্টুমির ছলে বলল,
-‘ আপনি বুড়ো হলে আমি আপনাকে বুড়ো বলে ডাকব। ‘
টিপ্পনী কেটে প্রণয় বলল,
-‘ আর আমি তোমাকে বুড়োর বউ বলে ডাকব। ‘
ওঠে দাঁড়ালো শাহিনুর। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
-‘ আমার বর’কে বুড়ো বলবেন না। আর একবার বুড়ো বললে আপনার আজ খাওয়া বন্ধ! ‘
ভ্রু উঁচিয়ে বড়ো বড়ো করে তাকাল প্রণয়। শাহিনুর ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ আমার বর’কে আমি ছাড়া পৃথিবীর কেউ বুড়ো বলতে পারবে না। কক্ষনো না, আমার এমন সুদর্শন স্বামী বুড়ো হতেই পারে না।’
অট্ট স্বরে হেসে ওঠল প্রণয়। শাহিনুর চমকে ওঠল। পরোক্ষণেই প্রণয়ের কাছাকাছি এসে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল। দু’হাত বাড়িয়ে সন্তর্পণে তার দু’গাল ধরল। মুগ্ধ করা কণ্ঠে বলল,
-‘ আপনার হাসিটা খুব সুন্দর। আপনি সব সময় এভাবে হাসবেন। এই হাসিটাকে আমি বড্ড ভালোবাসি।’
প্রণয়ের দৃষ্টিজোড়া মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে, ক্ষণকাল সে দৃষ্টিতে প্রগাঢ়তার সঙ্গে তাকিয়ে পুনরায় বলল,
-‘ আস্ত একটা ভালোবাসার মানুষ আপনি। ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা কিনে নেওয়া তুখোড় পুরুষ আপনি। আমার এই আস্ত ভালোবাসায় কারো নজর না লাগুক। আমার এই ভয়ানক প্রেমিক’টা আমৃত্যু আমারই থাকুক।’