পরিহাস্যের সুরে বলা প্রণয়ের বক্তব্য’টি কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই চোখ তুলে তাকালো শাহিনুর৷ প্রণয়ের দৃষ্টি গাঢ়,নির্নিমেষ, দুর্বোধ্য। আর শাহিনুরের দৃষ্টিদ্বয় আসক্তিহীন। একজোড়া প্রগাঢ় দৃষ্টি’তে কতো সুনিপুণ ভাবে মিলিত হলো একজোড়া নির্লিপ্ত দৃষ্টিদ্বয়ের। ছাব্বিশ বছর বয়সী একজন কাঠিন্য,রাশভারী যুবকের পানে কতো অবলীলায়, অবহেলায় মাত্র পনেরো বছর বয়সী কিশোরী’টি দৃষ্টিপাত করলো। সে দৃষ্টিজোড়ায় না আছে লজ্জা, না আছে জড়তা। প্রণয়নের অন্তঃকোণে জেগে ওঠলো সেই রাতের অনুভূতি। যে রাতে প্রথম দেখেছিলো শাহিনুর’কে। সে’রাতে এই দৃষ্টিতে ভয় ছিলো,জড়তা ছিলো, কতশত সংকোচে আচ্ছন্ন ছিলো এ’দৃষ্টিজোড়া, হয়তো হিসেবনিকেশ করে বের করা যাবে না। অথচ আজ কতো পরিবর্তন! সময়ের ব্যবধান’টা একজন পরিবর্তনশীল মানুষ’কে দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিবর্তন না ঘটলে,মানুষের জীবন না বদলালে হয়তো সময় কতো সুন্দর, কতো নির্মম তা বোঝা কঠিন হয়ে যেতো। গত সময়,আজকের সময় এবং পরবর্তী সময় যাইহোক না কেন আপন অনুভূতিটুকু যে একই রয়েছে তা সুক্ষ্ম ভাবেই টের পেলো প্রণয়৷ সেদিনের দৃষ্টিজোড়া তার হৃদয়ে যে অনুভূতি দান করেছিলো আজকের এ মূহুর্তের এই দৃষ্টিও একই অনুভূতির সঞ্চার করছে। তবে পার্থক্য তো আছেই। তা হলো সেদিনের থেকেও আজকের অনুভূতি অনেক বেশীই দৃঢ়, অনেক বেশীই গাঢ়। এ পৃথিবীতে বহু পুরুষ বিভিন্ন কারণে বহু নারী’র প্রেমে পড়েছে। কত-শত নারী কত-শত পুরুষের বুকে প্রেমের জোয়ার এনেছে হিসেবের বাইরে। এক্ষেত্রে পুরুষ’রাও থেমে নেই। তারাও নারীদের বুকে প্রেমের জোয়ার আনে। কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তা সুপ্ত রয়ে যায়। প্রণয়ের হৃদ সিন্ধু পারে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ খেলা তো সেই কবেই শুরু হয়েছে। এই যে তার সম্মুখে সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া ফুলের ন্যায় নিষ্পাপ, শুভ্র মুখশ্রী, একজোড়া স্বচ্ছ,হরিণাক্ষী দৃষ্টি, প্রেমে পড়ার জন্য এই এটুকুই যথেষ্ট। আজ প্রণয় তীব্রভাবে অনুভব করছে দায়িত্ব আর ভালোবাসার ফারাক কতোটা হয়৷ দায়িত্ব’তে শুধু দায়িত্ব পালনই গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে ভালোবাসা নাও থাকতে পারে। কিন্তু ভালোবাসলে ভালোবাসার পাশাপাশি দায়িত্ব পালনও গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বে ভালোবাসা নাও জন্মাতে পারে,কিন্তু ভালোবাসায় দায়িত্ব আপনাআপনিই জন্মায়। প্রণয় খেয়াল করলো শাহিনুরের চোখমুখ ভীষণ রুক্ষ হয়ে আছে। অজস্র ক্লান্তি এসে ভর করেছে দৃষ্টিদ্বয়ে। ঈষৎ লাল বর্ণীয় নীরস ঠোঁটজোড়ায় দৃষ্টি পড়তেই বুকের ভিতর মুচড়ে ওঠলো। মনের ভিতর চনমনে হয়ে কেউ যেনো বলে ওঠলো,
-‘ মেয়েটা ভীষণ ক্ষুধার্ত, মেয়েটা ভীষণ তৃষ্ণার্ত। ওর খাবার প্রয়োজন, পানি প্রয়োজন, ঘুম প্রয়োজন, ভালোবাসা, আদর, স্নেহ সবটা প্রয়োজন। এসবের অভাবে মেয়েটা নুয়ে পড়ছে, ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার দেহ,মন সবটা, সবটা! ‘
হৃৎস্পন্দন থমকে গেলো প্রণয়ের। রুদ্ধশ্বাসে একহাত বাড়িয়ে শাহিনুরের গালে স্পর্শ করলো। কঠিন,গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বের পুরুষ’টি আচমকাই নম্র হয়ে ওঠলো। কিঞ্চিৎ আদুরে কন্ঠে বললো,
-‘ এই মেয়ে, তোমার মুখটা শুঁকিয়ে গেছে, কখন থেকে না খেয়ে আছো তুমি? খেতে হবে তো, ঘুমহীন চোখে ঘুম প্রয়োজন তো, এভাবে চেয়ে থেকো না নুর, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? ‘
উদ্বিগ্ন হয়ে গেলো প্রণয়। গালে ছুঁয়ে থাকা হাতটি আলতো চেপে আবারো বললো,
-‘ আই নো নুর তুমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছো, আমি তোমার এই কষ্ট দূর করতে চাই, তোমার পাশে থাকতে চাই। ‘
আর কিছু বলতে পারলো না প্রণয় তার পূর্বেই শাহিনুরের ছোট্ট, কোমল হাতটি তার পুরুষালী হাতের ওপর রাখলো। সে হাত কিঞ্চিৎ দৃঢ়তার সঙ্গে চেপে ধরে ঠাশ করে নামিয়ে দিলো। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,
-‘ আমি গোসলে যাব। আপনার শার্ট’টাও ফেরত দেবো। ‘
বিস্মিত হলো প্রণয় এতো সহজেই যে শাহিনুর মেনে যাবে ভাবতেও পারেনি৷ শার্ট ফেরত দেবে ভাবতেই হাসি পেলো, কিন্তু কথা মেনেছে তা ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ব্রিফকেস এগিয়ে দিলো। শাহিনুর তখনো প্রণয়ের দিকে চেয়ে আছে। আর ভাবছে তার আম্মা শারমিনের কথা। সে বলেছিলো একজন মানুষ’কে চিনতে হলে, জানতে হলে সর্বপ্রথম তার চোখের ভাষা’কে বুঝতে, তারপর মানুষটা’কে পড়ার চেষ্টা করতে। তাই সে দেখছে প্রণয়’কে অতি সুক্ষ্ম নজরে৷ প্রণয় ব্রিফকেস খুলে দিয়ে পুনরায় তাকালো শাহিনুরের দিকে। আবারো দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলন ঘটলো। কিন্তু শাহিনুর প্রণয়’কে কিছু ভাবার সুযোগ দিলো না, সহজ গলায়, নরম সুরে বলে ওঠলো,
-‘ গোসল থেকে এসে খাবার পাবোতো? আমার খুব খিদে পেয়েছে! ‘
বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠলো প্রণয়ের। কি নিষ্পাপ, কি সরল স্বীকারোক্তি। একটুও সময় নিলোনা প্রণয় ত্বরিতগতিতে মাথা উপর নিচ করলো। শাহিনুরও আর বসে থাকলো না। নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়ালো। খাওয়া,ঘুম কোনটাই ঠিকমতো না হওয়াতে শরীরটা প্রচুর দুর্বল অনুভব করলো। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠলো। সহসা দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ক্ষণকাল চুপ রইলো সে। তা দেখে প্রণয় সটান হয়ে দাঁড়িয়ে শাহিনুরের কাঁধ স্পর্শ করলো,উদবিগ্ন কন্ঠে বললো,
-‘ শরীর খারাপ লাগছে? ‘
শরীরে থাকা শেষ শক্তিটুকু দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো শাহিনুর। কাঁধে থাকা প্রণয়ের হাতটি সরিয়ে দিয়ে ছোট্ট হাতের পাঁচ আঙুলের তালু উঁচিয়ে বললো,
-‘ কথার ছলে বার বার ছুঁয়ে দিচ্ছেন কেন? আমি কি আমাকে ছুঁতে অনুমতি দিয়েছি? ‘
রাগ এবং বিরক্তি মিশিয়ে কথাটা বলে ব্রিফকেস থেকে দ্রুত একটা শাড়ি, মখমলের কাপড়ের ব্লাউজ,আর পেটিকোট নিয়ে বাথরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো শাহিনুর।
রুদ্ধ শ্বাস ছাড়লো প্রণয়। শাহিনুরের যাওয়ার পানে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। কেন জানি রাগ হলো না, খারাপ লাগলো না। হৃদয়ে বাস করা নারী’র করা ভুলে রাগতে নেই, শুধরে দিতে হয়৷ সব পুরুষ শুধরে দেয় কিনা সে জানেনা। কিন্তু সে দেবে। পুরো কক্ষ জুড়ে পায়চারি করতে করতে আরেকটি দৃশ্য মনে পড়ে গেলো তার রঙ্গনের হাতে রাখা শাহিনুরের হাতের সেই দৃশ্যটি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাই বিরবির করে বললো,
-‘ অপাত্রে ঘি ঢালতে আপনি বড়ো ওস্তাদ মনোহারিণী। ‘
চলবে….
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ)
[ রিচেক করিনি। কেউ একজন রোমানাকে বলা প্রণয়ের একটি বাক্য কমেন্টে দিয়েছে। তার মন্তব্য পুরোটাই পড়েছি। তাই একটু বলে দেই দায়িত্ব আর ভালোবাসা এক নয়। রোমানা যে প্রণয়ের দায়িত্ব ছিলো এটা প্রমাণিতই। রোমানার প্রতি সব অনুভূতি ছিলো প্রণয়ের শুধু ভালোবাসা ছাড়া৷ উপন্যাস পড়তে পড়তে আরো অনেক প্রশ্নের উত্তরও মিলবে ইনশাআল্লাহ ]
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২৯ (শেষাংশ)
[৪২]
পাঁচফোড়ন গৃহের পরিবেশ বেশ থমথমে। আনাচে কানাচে ভৃত্যদের ছাড়া কাউকেই তেমন নজরে পড়ছে না। কারো মুখে একটুখানি রা নেই, চারিদিকে কেমন ভয়াবহ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। প্রতিটি ভৃত্যের চোখ,মুখে স্পষ্ট ভয় দেখা যাচ্ছে। সকলেই বেশ আতঙ্কিত। একটি পরিবার’কে মুরুব্বি’রা যে ছায়া দিয়ে আগলে রাখে, অলিওরের মৃত্যুর পর পাচঁফোড়ন গৃহে সেই ছায়া বিলীন হয়ে গেছে। মুরুব্বি’রা ভালো হোক বা মন্দ হোক যতোদিন তারা বেঁচে থাকেন ততোদিন তাদের ঘর,সংসারে সমস্ত বিপদ মাথার উপর দিয়েই চলে যায়। মানুষের শরীরে মাথার ভূমিকা যতোটা পরিবারে বাবার ভূমিকাও ঠিক ততোটাই। আজ অলিওর বেঁচে থাকলে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে পরাজিত হতে বাধ্য থাকতো তার ছেলেরা। সকল ঝড় ঝাপটা গৃহের বাইরেই সারতো সে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর যে ঝড় গৃহে প্রবেশ করেছে সেই ঝড় সব কিছু তছনছ না করে ছাড়বে না। এটা পরিবারের সকলের আত্মায়ই জানান দিয়েছে। ভোজন কক্ষে উপস্থিত হয়েছে পল্লব, পলাশ এবং প্রণয় চৌধুরী। তিন ভাই অপেক্ষা করছিলো মা প্রেরণার জন্য। অরুণা তিনজনের পাতেই ধীরে ধীরে খাবার বাড়তে লাগলো। আজ তিন ভাইয়ের মুখই বেশ গম্ভীর। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। রান্নাঘরে শবনম শাহিনুরের জন্য খাবার বেড়ে এক ভৃত্য’কে দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। প্রণয় তা খেয়াল করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বড়ো আম্মা অরুণা’কে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ আম্মা কোথায়? ‘
অরুণা চেয়ার টেনে তিন পুত্রের সম্মুখে বসলো৷ বললো,
-‘ চুপচাপ খেয়ে নাও তোমরা, ছোটো বউ এখানে আসবে না। কেন আসবে না তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো? ‘
অরুণার কথা শুনে পলাশ কঠিন মুখে এক পলক প্রণয়ের দিকে তাকালো তো আরেকবার পল্লবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। পল্লব চোখের ইশারায় তাকে সংযত থাকতে বলে হালকা কেশে ওঠে প্রণয়’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘ তুই কী ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস? এটা কিন্তু আমাদের সম্মানের ব্যাপার। জমিদারের বংশধর আমরা, আমাদের জন্য তাদের সম্মানে আঘাত লাগবে এমন কাজ করা অনুচিত। ‘
অরুণা প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে তার কঠোর মুখোভঙ্গি দেখে পল্লব’কে বললো,
-‘ খাবার বসে এসব আলোচনা কেন? ‘
প্রণয় অরুণা’কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ থাক বড়ো মা কথা যখন ওঠেছে উত্তর আমি দেবো৷ ‘
পলাশ থম মেরে বসে আছে, পল্লব উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে প্রণয়ের থেকে কিছু শোনার জন্য, অরুণাও চুপ মেরে গেলো। কথা বলার পরিস্থিতি তৈরি করে নিয়ে প্রণয় পল্লবের দিকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, ঈষৎ তাচ্ছিল্য সহকারে হেসে বললো,
-‘ বেয়াদবি নেবেন না ভাইয়া, ঘরে দু’টো বউ রেখে বাইজি গৃহের বাইজিদের সঙ্গে মেলামেশা করে আপনি এবং আপনারা জমিদার’দের কোন সম্মান রক্ষা করছেন? ‘
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠলো পল্লবের। প্রণয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘ বাইজি গৃহ আজকের নয় প্রণয়, এটা আমাদের পূর্ববংশীয়দের বাইজি গৃহ। আমরা তাদের ধারাগুলোই মেনে চলছি। কিন্তু কোন বাইজি’কে আমাদের এই পবিত্র গৃহে স্থান দেইনি, দেওয়ার কথা ভাবিওনি৷ ‘
-‘ আমিও কোন বাইজি’কে তুলে নিয়ে আসিনি। ‘
চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় সুরে বলে ওঠলো প্রণয়৷ একটু থেমে আবারও বললো,
-‘ আপনি জমিদার’দের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এতে আমি বাঁধা দেইনি, ঠিক তেমনি আপনিও আমার সিদ্ধান্তে বাঁধা দেবেন না। যদি কিছু ভুল মনে হয় বলতে পারেন।’
-‘ ভুল তো অবশ্যই একটা বাইজির মেয়ে এ বাড়ির বউ হয় কি করে! ‘
-‘ একটা বাইজির মেয়ের জন্য জমিদারের চার ছেলেদের কামপ্রবৃত্তি জাগা যদি স্বাভাবিক হয় একজন পুত্রের ভালোবাসা জেগে ওঠা অস্বাভাবিক কেন হবে ? ‘
থতমত খেয়ে পল্লব বললো,
-‘ এটা আমাদের নীতিবিরুদ্ধ। ‘
-‘ বাহ বড়ো ভাই বাহ আপনারা সৃষ্টিকর্তার দেওয়া নিয়ম ভঙ্গ করতে পারেন, আর আমি সামান্য আপনাদের নিয়ম ভাঙতে পারবো না? ‘
কথোপকথনের এ পর্যায়ে পলাশ কূটবুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা করে বললো,
-‘ তুই কি জানিস ঐ মেয়ে রঙ্গনের সঙ্গে খুব বাজেভাবে মেলামেশা করেছে? ‘
চোখজোড়া ঈষৎ রক্তিম হয়ে ওঠলো প্রণয়ের৷ সামনে বড়ো ভাই,বড়ো মা রয়েছে। শাহিনুর’কে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে আরেক বড়ো ভাই। নিজের ক্রোধটুকু কোনক্রমে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো সে। পলাশের দিকে নিবিড়ভাবে তাকালো, অধরে কিঞ্চিৎ পরিমাণ তাচ্ছিল্য নিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
-‘ সে যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কলঙ্কিত নারীও হয় তবুও তাকে আমার বউ করবো। ‘
বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো তিনজনই। আশপাশে যেসব ভৃত্যরা প্রণয়ের বলা বাক্যটি শুনতে পেলো সকলেই ক্ষণকাল থমকে দাঁড়ালো। অবিশ্বাস্য কতোগুলো দৃষ্টি তাকিয়ে রইলো তার পানে। প্রণয় এবার বেশ উচ্চবাচ্যে বললো,
-‘ এবার যদি বলো তুমি তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য তোমার প্রবৃত্তি মেটানোর জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছো। তাহলে বলবো, নিজের ভালোবাসা’কে নিজের না করে নিজ আত্মার সঙ্গে স্বার্থপরতা বা বেইমানি কোনটাই আমি করতে পারবো না৷ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো বেইমান সে যে নিজের সঙ্গে বেইমানি করে! আমি তোমাদের প্রকৃতির নয় বলে আমি খুব বেশী উদার হবো এটা ভাবা বোকামি। জমিদারের পুত্র এক বাইজি কন্যা’কে ভালোবাসে,বিয়ে করতে চায়, এটা যদি পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম কাজও হয় তাহলে সেই জঘন্যতম কাজটি আমি অনায়াসেই করে ফেলবো।
” বাইজি কন্যা’কে ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, সে অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে মৃত্যুদন্ড গ্রহণ করতেও আমি প্রস্তুত। বাইজি কন্যা’কে নিজের বউ করা যদি অন্যায় হয় তাহলে এ পৃথিবীর সব ন্যায় ভুলে গিয়ে হলেও এই অন্যায়টুকু সুকৌশলে করে নেবো আমি ” ‘
সকলেই স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ। অরুণা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ভৃত্যরাও। পল্লব হতবাক হয়ে বসে আছে। পলাশ ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। সে দৃষ্টি’কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো প্রণয়৷ আর একটি বাক্যও সে খরচ করলো না৷ নিজের মতো খাবার খেয়ে চলে গেলো নিজের কক্ষে। সে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনে থাকা খাবারের প্লেট ছুঁড়ে ফেললো পলাশ। হতভম্ব হয়ে অরুণা চেয়ে রইলো৷ পলাশ তাকে উদ্দেশ্য করে হুংকার ছাড়লো,
-‘আম্মা’কে কিছু করতে বলুন নয়তো ধ্বংসলীলা শুরু করবো আমি! ‘
[৪৩]
গোসল শেষ করে ভেজা চুলগুলো পিঠজুড়ে ছড়িয়ে,ছিটিয়ে দিয়ে কক্ষে এলো শাহিনুর। দেখতে পেলো গোলাকার বেতের টেবিলে তার জন্য খাবার রেখে দিয়েছে। আশপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে অপেক্ষা না করে একে একে খাবারগুলো মেঝেতে রাখলো। তারপর হাঁটু মুড়িয়ে বসে পড়লো। সদ্য ভেজা কোঁকড়ানো চুলগুলো মেঝেতে ছুঁয়ে রইলো। টপ টপ করে পানি ঝড়তেও লাগলো। শাহিনুর সম্মুখের খাবারের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বড়োসড়ো একটি প্লেটে সাদা ভাত দেওয়া হয়েছে তাকে, ভাতের মাঝবরাবর একটা ডিম সিদ্ধ, ছোট ছোট বাটিতে কয়েক রকমের ভাজি,তরকারি দেওয়া হয়েছে। এতো খাবার দেখে বিচলিত হয়ে গেলো মেয়েটা৷ তার ছোট্ট পেটে এতো খাবারের জায়গা হবে না। জীবনে কখনো এতো খাবার একসাথে খাওয়া হয়নি তার। তাছাড়া তার মা সবসময় খাবার নিয়ে একটি কথা বলতো, খা, না। খাওয়াটা যেমন প্রয়োজন তেমন অতিরিক্তও খাওয়াও অনুচিত। ভেবেচিন্তে সব খাবার দূরে ঠেলে শুধু মাত্র ডিম সিদ্ধ আর সবজি দিয়ে অল্প ভাত খেলো সে। মাংস তার প্রিয় হলেও আজ খেলো না। আর মাছ তো মা’কে ছাড়া সে কখনো খেতেই পারেনা। গলায় কাঁটা ফুটে যায়। কক্ষে প্রবেশ করলো প্রণয়৷ ভিতর কক্ষে দেখতে পেলো শাহিনুর খাবারগুলো গুছিয়ে রাখছে। দোনোমোনো করে শাহিনুরের কাছে গেলো সে। প্রণয়’কে দেখে শাহিনুর পরিহিত শাড়ির আঁচলটি ডান কাঁধে টেনে নিলো৷ সদ্য গোসল করে আশা শাহিনুর’কে দেখে বুকের ভিতরটা ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো প্রণয়ের৷ ঢেউ খেলানো ভেজা চুলগুলো বেয়ে পানি পড়ায় শাহিনুরের পিঠ, কোমড় সহ মেঝেও ভিজে চুপেচুপে হয়ে যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে কয়েক পল তাকিয়ে রইলো প্রণয়৷ শাহিনুর জড়োসড়ো হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে তার। অস্বস্তি টুকু বুকে ভীষণ পীড়া দিতে শুরু করায় সে প্রণয়ের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো,
-‘ আপনি কি সবসময় এ’ঘরে আসবেন? ‘
কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় দ্বিগুণ কুঁচকে গেলো প্রণয়ের। কিছুক্ষণ পূর্বে ভোজন কক্ষে বলা নিজের বলা একটি বাক্য স্বরণ হলো তার,
-‘ সে যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কলঙ্কিত নারীও হয় তবুও তাকে আমার বউ করবো। ‘
বক্ষঃস্থলে অদ্ভুত একটা অনুভূতি জেগে ওঠলো। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে শাহিনুরের স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, কতো সহজেই আজ বলে দিলো কথাটি। অথচ সেদিন রোমানার বেলায় এই কথাটি তার মাথায়ও আসেনি। সত্যি ভালোবাসা কি না পারে…। প্রণয়ের প্রগাঢ় চাহনি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো শাহিনুর। নিজের দৃষ্টি থেকে শাহিনুরের দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন হতেই প্রণয় সম্বিৎ ফিরে পেলো। বললো,
-‘ এ প্রশ্ন কেন? ‘
নিরুত্তর রইলো শাহিনুর। উত্তর না পেয়ে প্রণয় বললো,
-‘ ব্রিফকেসে তয়ালে আছে মাথা মুছে নাও। ‘
শাহিনুর কথা শুনলো না। চুপচাপ গিয়ে পালঙ্কে বসলো। প্রণয় আবারো বললো,
-‘ চুলগুলো থেকে পানি ঝড়ছে আমার ঘর নষ্ট হচ্ছে। অন্যের ক্ষতি করা অনুচিত। ‘
শাহিনুর নীরস দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়ের পানে। প্রশ্ন করলো,
-‘ আমার এতোবড়ো ক্ষতিটা কে করলো? ‘
-‘ মানে? ‘
-‘ আমার আম্মা’কে কে মারলো? ‘
-‘ সবটা জেনেও বোকার মতো প্রশ্ন করছো কেন? ‘
-‘ সবটা জানি বলেই তো বিশ্বাস করতে পারছিনা। ‘
-‘ কী জানো তুমি? ‘
-‘ কিছু না। ‘
অকপটে এ কয়েকটি জবাব দিয়ে আর কিছু বললো না শাহিনুর, চুপচাপ পিঠ ঘুরে শুয়ে পড়লো। শুধু অলিওর তার মায়ের হত্যাকারী এটা কেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার? এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত নিদ্রাহীন থাকার ফলে খুব দ্রুতই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলো সে। প্রণয় চিন্তামগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর খেয়াল করলো শাহিনুরের ভেজা চুলে বিছানা ভিজে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তয়ালে বের করে ধীরেপায়ে এগিয়ে শাহিনুরের পাশে বসলো। চুলগুলো উঁচিয়ে নিচ দিয়ে তয়ালে দিয়ে কৌশলে পেঁচিয়ে ফেললো। শাহিনুরের ধবধবে ফর্সা কোমল ত্বকে দৃষ্টি পড়তেই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। একহাত তার ভেজা মাথায় রাখলো নম্র কন্ঠে বললো,
-‘ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন সব স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। ‘
লেখকের কথা: জরুরি প্রয়োজনে এ উপন্যাসটি দু’টো খন্ডে ভাগ করা হবে। ১ম খন্ডের সমাপ্তি দিব খুব শিঘ্রই। পাঠকদের কাছে অনুরোধ সকলেই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আপনাদের মন্তব্য আমার লেখায় বিরাট ভূমিকা পালন করবে ]