অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ২২

আরহামের বলা একটা কথা কানে বাজতে থাকে ‘আপনি আমার মাসনা হওয়ার যোগ্য না’।নাক টেনে হেঁচকি উঠতেই হাফসা সরে গেল।উনার সামনে কান্নার কোনো মানে হয় না।উল্টো ঘুরে হাতের পিঠ দিয়ে সদ্য গালে বেয়ে পড়া পানি মুছতে নিলেই কেউ সামনে আসলেন।কোনোকিছুর বোঝার আগেই শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন।

‘আপনার টলমলে চোখ আমার বুকে কত যন্ত্রণা ধরায় বুঝাতে পারব না।সব রাগ অভিমান মিটিয়ে নিন আমার ওপর।তবুও কাঁদবেন না।’

পার হলো বেশ কিছুক্ষণ।

হাফসা কাঁদছে।উনার বুকে মাথা লাগিয়ে কাঁদছে।প্রায় দশদিন পর উনার আলিঙ্গন।দশদিনে এভাবে স্পর্শ করেন নি তাই হুট করে উনার উষ্ণ আলিঙ্গনে বর্ষণ ছুটছে চোখে।

উনি বুঝতে পারলেন উমায়ের কাঁদছে।তাই আরো গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে কপালে গাঢ় চুমু দিয়ে বললেন, ‘ডোন্ট ক্রাই প্লিজ!ইট হার্টস মি হুয়েন ইউ ক্রাই।’

‘ধরে নিন এটা আপনার শেষবারের মতো দূঃখ পাওয়া।আর একটুও দূঃখ দেব না।এই খারাপ বরটাকে ক্ষমা করে দিন শেষবারের মতো।’

হাফসা উনাকে ছোট্ট দূহাতে জড়িয়ে ধরে ছিলো।কিছুক্ষণ পর হুষ ফিরতেই চট করে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যায়।উনি ওর অবস্থা বুঝতে পেরে হালকা হেসে একহাতে আগলে একটানে আবার কাছে আনলেন।নিজহাতে চোখ মুছে চোখের পাপড়ি তে চুমু খেলেন।

আরো কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর হাফসা চোখ তুলে ছলছল নয়নে ভারি কন্ঠে বলল, ‘আপুর দোষ নেই।আপনার দোষ।আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।বিশ্বাস করেননি একটুও।’

আরহাম কানে ধরে অপরাধী সুরে বললেন, ‘আফওয়ান
আর এমন ভুল করব না। পানিশমেন্ট দিবেন?দিন।আমি রাজি।’

হাফসা এখনো হেঁচকি তুলে কাঁদছে।উনিও গালে ঠোঁট লাগিয়ে রয়েছেন।

‘ছাড়ুন আমায়।’

‘ছাড়বো না।চুমু দিয়ে ভাসিয়ে দিব যদি কান্না না থামান।’

চুমুর শ্রোতে ভাসিয়ে যাওয়া থেকে মুক্তি পেতে হাফসা কান্না থামিয়ে গাল মুছে নিলো।

আরহাম ওর গাল টেনে বললেন, ‘রাগ আছে এখনো?’

‘একটু একটু।’

‘উঠবস করা লাগবে?’

হাফসা হেসে দিলো।উনি বেশ কিছুক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে থাকলেন।

হাফসার অস্বস্তি হচ্ছিলো।’কি দেখছেন?’

‘এই হাসিটাই মিস করছিলাম এতদিন থেকে।’

‘আপনাকে ভালোবাসি আমি।ভীষণ রকম।আপনার অনুপস্থিতিতে সেটা ভালোভাবেই টের পেয়েছি। একবারের জন্য ও ভুলতে পারিনি।’

‘এ্ এ একটা কথা রাখবেন?’

‘রাখার মতো হলে রাখবো ইনশাআল্লাহ।’

‘তাহলে না বলি?’

‘বলুন না!চেষ্টা করব রাখার।’

‘জ্বি না রাখতে হবে।’

‘বলুন কি কথা?’

‘আপুকে ক্ষমা করে দিন।’

হাফসার দিকে কঠিন চাহনি দিলেন আরহাম।হাফসা সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।

_________
অযু সেরে বিছানায় শুতেই আরহাম ওকে জাপটে ধরলেন।ইসস এত জোরে কেউ ধরে।শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

‘এত জোরে কেন ধরেছেন।ছাড়ুন।’

‘এত দিনে কাছে পেয়েছি।আর ছাড়ছি না।’

‘আমার কষ্ট হচ্ছে তো।’

বাঁধন হালকা করে উমায়ের কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলেন।ওর খোলা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘পুরো দশদিন আপনি আমার থেকে দূরে থেকেছেন।দশদিন!আপনার সাথে দূরত্ব আমি সহ্য করতে পারি না।আর যদি ঝগড়া হয়, মন খারাপ হয়, নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিবো,তবুও দূরত্ব বাড়িয়েন না প্লিজ।’

‘উমমমম।’

কিছুক্ষণ পর __

‘আমার তৃষ্ণা পেয়েছে’ –আরহাম ঘোরলাগা কন্ঠে কথাটি বললেন।

‘উ্ উঠে পানি দিই?’

আরহাম ওর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘পানির তৃষ্ণা না।আপনার তৃষ্ণা পেয়েছে।’

উনার মুখে এমন আনএক্সপেক্টেড কথা শুনে হাফসা লজ্জায় উনার বুকে মুখ লুকালো।ওর কান্ডে আরহাম বেশ শব্দ করেই হেসে উঠলেন।…..

৬৪

রাত গভীর।নিস্তব্ধ রজনী।রাতের শেষ প্রহর চলছে।মাথার ওপর গোলাকার চাঁদ।তার পরিপূর্ণ আলোতে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।ছাদের ডিভানে পাশাপাশি বসে আছেন আরহাম হাফসা।চাঁদ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে দেখলেন হাফসা একধ্যানে চেয়ে আছে চাঁদের দিকে।একটান দিয়ে হাফসাকে কাছে এনে ঘাড়ে হাত রাখলেন।মোলায়েম কন্ঠে বললেন, ‘এতদিন আপনি দূরে ছিলেন তো অমাবস্যা ছিলো।প্রতি রাতে আমি ছাদে এসেছি।তো আজকে এত সুন্দর চাঁদ কেনো?’

হাফসা একটু মোটাসোটা ভাব নিয়ে অভিজ্ঞ গলায় বলল, ‘হুমমম।আমি এসছি,তাই পূর্ণচাঁদ হয়েছে।আমার জন্যই।’

‘ওরে আমার চাঁদ রে!’

হাফসা খিলখিল করে হেসে উঠলো।পূর্ণিমা রাতে ব্যাক্তিগত চাঁদের হাসিতে আরেকদফা মুগ্ধ হলেন আরহাম।

‘এখন নিচে যাই চলুন।সাহরির টাইম হয়ে গেছে।’

‘আরেকটু থাকি?’

‘পরে লেট হয়ে যাবে।’

‘আপনি কোনো কাজ করবেন না। ওকে?’

‘কেন কেন?’

আরহাম একটা লম্বা শ্বাস ফেলে উঠে বললেন, ‘চলুন যাই।’

_________
আম্মু আর হাফসা এসেছেন বাগানে।এই প্রথম বাগানে আসা হাফসার।
বাগানে সবজির আইটেম গুনতেই চমৎকৃত হলো হাফসা।তেরো রকমের সবজিই শুধু।কিছু বিদেশী সবজিও আছে।এখান থেকেই সবজি নিয়ে বাসায় রান্না করা হয়। বাইরে থেকে কখনো কাঁচাসবজি আনতে দেখেনি হাফসা।

‘ব্রোকলী খাবে?’

‘নিন।’

‘সব রকম সবজি নিয়ে নেই।ভাজি করবো।’

‘জি আচ্ছা।’

‘ঢেড়শ নেই আম্মু?’

‘আছে তো পেছন দিকে।তুমার পছন্দ?’

‘হুমমম।’

‘তাহলে নিই চলো।’

সামনের দিক দিয়ে বেরিয়ে পেছন দিকে যাওয়ার জন্য বেরোতেই হাফসা দেখলো আরহাম উঠানে বসে আছেন। হাতে খুব কিউট একটা বিড়াল।আরহামে বুকের শার্ট খামচে উঠার চেষ্টা করছে।হাফসা পাশ কাটিয়ে যেতেই চোখাচোখি হলো দূজনের।আরহাম ওকে চোখ মারলেন।হাফসা চমকালো।লোকটা খুব পাজি।আমাকে লজ্জায় ফেলে এখন বিড়াল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছেন।

পেছনের সবজির দিকটায় যেতেই দেখলো আরহামও এদিকেই আসছেন।সবুজ আর ডার্ক ব্লু এর চেগ এর একটা শার্ট পড়েছেন।কালো ট্রাউজার।মাথার চুলগুলো বেশ বড় হয়েছে।এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালে। দেখতে মারাত্মক কিউট লাগছে।ইসসস এত সুন্দর মানুষ কি করে হয়!

_______
সবজি তোলা শেষ হলো।ঝুড়িতে ফল-সবজি নিয়ে বাড়ির দিকে আসছেন আম্মু আর হাফসা।আরহাম আগেই চলে আসছেন।আড়চোখে আরহামের দিকে তাকাতেই দেখলো উনি এক ধ্যানে নির্নিমেষ হয়ে তাকিয়ে আছেন হাফসার দিকে।আশ্চর্য!এভাবেও কেউ তাকায়?আম্মুকে কি দেখছেন না?লজ্জা-শরমের ছিঁটোফোঁটাও গিলে ফেলেছেন দেখছি!

পাশ কাটিয়ে কিছুদূর চলে আসতেই উনার “আউউউউচ”
শব্দে তৎক্ষনাৎ পেছন ঘুরে হাফসা।বেশ হয়েছে।বিড়াল আঁচড় কেটেছে!

_________
উনি রেডি হচ্ছেন রুমে।হাফসাকে ডেকে এনেছেন সেই কখন।কিন্তু কিছুই বলছেন না।নিজের কাজে নিজে ব্যস্ত।উনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে হাফসাকে উনি নিয়ে এসছেন উনি কীভাবে রেডি হন সেটা দেখাতে।বিরক্তি উঠলো হাফসার।মায়ের সাথে সবজি পরিষ্কার করছিলো।কাজের মাঝে ডেকে নিয়ে আসছেন। তাও এমন ভাবে জরুরি অজুহাত দেখিয়ে নিয়ে এসছেন যেনো উনার কোনো দূর্ঘটনা হয়েছে, এসে হা-হুতাশ করতে।

‘কি জন্য ডাকলেন আমাকে?বলুন।আমি যাব তো।’

‘এমনিইই।’

‘এমনি মানে?বললেন না জরুরি কাজ?’

‘হুমম।আমার সাথে থাকা কী জরুরি কাজ নয়?’

‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন না কি যে আমি আপনার সাথে থাকবো?’বলতেই আরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তারপর ফিক করে হেসে দিলেন।কি সুন্দর হাসি!

‘ফাইজলামি ভালো পারেন।’

হাফসা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘মোটেই ফাইজলামি করছি না।আমি আম্মুর সাথে কাজে ছিলাম।শুধু শুধু ডেকে আনলেন।’

‘এখন তো চলেই যাবো।সারাদিনের জন্য।একটু থাকুন না!’

আরহামের এমন আবদারে হাফসা চুপ হয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ যেতেই নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা আপনি এত লেট করে কেনো আসেন প্রতিদিন?মাদ্রাসা কি সন্ধ্যায় ছুটি হয়?’

‘উহু,চারটায়।’

কোনো এক অজানা সাহসের কারণে হাফসা পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলো না ‘তাহলে কেন লেট হয়?’

34★

৬৪
কোনো এক অজানা সাহসের কারণে হাফসা পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলো না ‘তাহলে কেন লেট হয়?’

ওর নিরবতা দেখে আরহাম নিজেই বললেন, ‘মাদ্রাসা শেষে বাকি সময় টুকু আমি এতিমখানায় কাটাই।’

হাফসা হালকা হাসলো।আরহামের এমন উত্তর ওর ভালো লেগেছে।

উনি হুট করে বলতে শুরু করলেন, ‘রান্নার জন্য, কিচেনে কাজ করার জন্য চারজন ম্যাড আছে।তবুও কেন আপনি যান হ্যাঁ?আমার ভালো লাগে না এসব।কিচেনে কাজ করবেন না আপনি।’

‘আম্মু একা…

‘আসি আমি।আল্লাহ হাফিজ।’

হালকা আলিঙ্গন সেরে হাফসার কপালে চুমু দিয়ে সালাম দিয়ে বের হতে গেলে হাফসা কিছুটা সাহস জুগিয়ে পিছু ডাকে।

‘শুনুন।’

আরহাম পিছ ঘুরে জিজ্ঞাসাদৃষ্টি ফেললেন।

হাফসা চেয়েও বলতে পারছে না।হাত মোচড়ামুচড়ি করছে।

__
গত পাঁচ মিনিট থেকেই বলবে বলবে করে একটা শব্দ ও উচ্চারন করতে পারে নি।
ওর অবস্থা দেখে আরহাম বরাবরই হেসে মজা নিচ্ছেন।

‘কি হলো বলুন?আমাকে বলতে এত কি দ্বিধা?’

‘আপুর রুমে একবার ডুকে যাবেন।আপু অনুতপ্ত। উনাকে ক্ষমা…

কথা শেষ করবার আগেই আরহাম চলে গেলেন।হাফসা হতাশার শ্বাস ফেললো।বলা বাহুল্য,’উনার রাগ!এত ভয়ংকর!’

৬৫

কেটে গেছে গোটা এক সপ্তাহ।রহমতের দিন শেষ প্রান্তে।হাফসার দিনে রাতে বুঝানোর পর আরহাম কিছুটা নরম হয়েছেন মাইমুনার প্রতি। সাহরির আগে হাফসার মাইমুনার তিলাওয়াত শুনেন নিয়ম করে।আজ সবার ইফতারির দাওয়াত ফুপির বাসায়।আরহামের আসার কথা ছিলো আসরের পর।কিন্তু ফোন করে জানালেন, জরুরি কাজে আসতে পারছেন না।তবে সন্ধ্যের আগে এটেন্ড থাকবেন।

প্রথম ফুপির বাড়ি যাওয়া উপলক্ষে এবং নতুন বউ হিসেবে মায়ের আদেশে শাড়ি পরতে হলো হাফসার।কালো পাথরের কাজ করা শাড়ী,শুধু পাড় টা গলডেন।কালো শাড়ির সাথে কালো পাথরের কাজ।শাড়ি পরতে সাহায্য করলেন আম্মু। পড়ানো শেষ হতেই হাফসার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে কয়েকপলক তাকিয়ে গালে হাত রেখে বললেন, ‘তোমার ত্বকে কোনো প্রসাধনীই মানে তোমার রুপকে কদর্য করা।আল্লাহ তো আমার ঘরে স্বয়ং চাঁদ পাঠিয়ে দিয়েছেন।’

হাফসা লাজুক হাসলো।আম্মু চলে গেলেন।কেমন যেনো একটা অনুভূতি হচ্ছে।সত্যি মানুষগুলো অমায়িক।এমন মানুষ ও হয়!আরহামের কথা তো বাদ-ই।শাড়ি পরে লজ্জায় তো তাকাতেই পারতো না হাফসা।লোকটা থাকলে চুমু দিয়ে ভাসিয়ে দিতেন!

পেছনে বসছেন আম্মু,মাইমুনা, আর হাফসা।তিনজন কালো বোরকার সাথে লম্বা নিকাবে আবৃত।সামনে আব্বু।গাড়ি চলছে আপন গতিতে।হাফসা একধ্যানে জানালার পানে চেয়ে আছে।বাইরের প্রকৃতি ওর ভালো লাগে।তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বাইরের জগতের সাথে ওর তেমন সখ্যতাই নেই।

________
বাসায় ডুকতেই ফুপি সবার আদর যত্ন নিয়ে হামলে পড়লেন।গরম পড়েছে মোটামুটি।তিনজনকে অন্দরমহলে নিয়ে বোরকা খুলে বিশ্রাম নিতে বললেন।একটু পরই আসর আযান পড়বে।

‘ইসসস তুমি বেশী কিউট ছোট ভাবি,নাহ তুমিও কিউট বড়ভাবী।ইসসস বলো আমাকে কে বেশী কিউট!তাল-গোল পাকিয়ে দিচ্ছি একদম।ভাইয়ার পছন্দ দেখলে!বেছে বেছে সুন্দরী বউ আনলেন।’

ছোট্ট ইনায়াত এর কথায় মাইমুনা হাফসা দু’জনেই হেসে উঠলো।ফুপির তিন মেয়ে।বড় মেয়ে সুইডেনে স্টাডি করছেন,বিবাহিত।দ্বিতীয় জন মেডিকেল পড়ছেন চট্রগ্রামে।তৃতীয় জন ক্লাস সেভেনে, ইনায়াত।আসার পর থেকেই বাক বাকুম করে যাচ্ছে কার থেকে কে বেশী সুন্দর।

________
সন্ধ্যার আগমুহূর্ত।ইফতারের আনা-নেওয়ার তোড়জোড় চলছে।মহিলাদের জন্য অন্দরমহলে, আর পুরুষদের জন্য লিভিংরুমে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।একটু আগেই হাফসা দোতলার জানালা দিয়ে দেখেছে আরহাম এসছেন।উনি আর ভেতরে আসেননি।

ইফতারে থাকলো বিরাট আয়োজন।ইফতারের তালিকায় বাহারি ফলমূল, মিষ্টান্ন জাতীয় রেসিপি সহ, বিরিয়ানির ভোজ আয়োজন।

ইফতারি শেষে নামাজ আদায় করে দোতলায় আসলেন আরহাম।আম্মু কে অনুসরণ করে রুমের দিকে তাকাতে হাফসার সাথে চোখাচোখি হলেন।পাশে মাইমুনা বসা।আরহাম থামলেন না।প্রথম রুম পেরিয়ে উনার জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার রওয়ানা দিতে হবে তারাবীহের উদ্দেশ্যে।এখান থেকে বেশ দূরের পথ!

_______
তারাবীহের জন্য রেডি হচ্ছেন আরহাম।হাফসাকে বলেছিলেন উনার একটা টার্বানের কাপর আনতে।তা খুঁজতেই ওদের রুমের দিকে এগোলেন আরহাম।

‘আসবো?’

অন্যমনষ্ক মাইমুনার হঠাৎ ধ্যান ভাঙ্গে আরহামের কন্ঠে।পা ভাঁজ করে বসে ছিলেন বিছানায়।আরহাম কে দেখে তড়িৎ বেগে পা নামিয়ে স্বাভাবিক হলেন।দ্রুততার সাথেই বললেন, ‘জ্বী।’

এই ছোট্ট শব্দ টা উচ্চারণ করতে বেশ বেগ পেতে হলো।লজ্জায়, অস্বস্তিতে জড়তা এসে ভর করলো অস্তিত্বজুড়ে।

আরহাম কিছুক্ষণ কি যেন খুঁজলেন।কাঙ্খিত জিনিস না পেয়ে মাইমুনার দিকে ফিরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘টার্বান কোথায়?’

‘হু?’ মাইমুনা বুঝতে না পেরে বললেন।

‘উমায়ের কোথায়?’

মাইমুনা নত মস্তকেই জড়তার মধ্য দিয়ে উত্তর দিলেন, ‘ন্ নিচে ফুপির সা..

এতটুকু বলতে মাইমুনা অনুভব করলেন উনার কন্ঠস্বর কাঁপছে।বিগত দিন আরহাম উনাকে এড়িয়ে চলার কারন প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পেরেছেন ঠিকই।তবে বুঝতে দেরি হয়ে গেলো। নিজের কাজে অনুতপ্ত তিনি,লজ্জিত!উনার সব একদিকে, আর আরহাম একদিকে!প্রিয়জনের অবহেলা যে এত কষ্টকর, এত যন্ত্রনাদায়ক হয় জানলে কখনো এমনটা করতেন না মাইমুনা!

নিজের ওপর রাগে,আফসোসে চোখ থেকে দূ ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কোলে রাখা হাতের পিঠে।তৎক্ষণাৎ দরজা লক করার শব্দে তড়িৎ চোখ ঘুরিয়ে আরহামকে সামনে এগিয়ে আসতে দেখে বুক কাঁপলো মাইমুনার।

নতমুখী রমণীর সামনের কাউচে বসলেন আরহাম।

মাইমুনা ইতস্তত বোধ করলো।বেশ কিছুক্ষণ হলো আরহাম নীরবতা পালন করলেন।

‘আমার একেবারেই আশাতীত কাজ করলেন আপনি।আমি আপনার থেকে এসব আশা করিনি মাইমুনা।’

শান্ত অথচ অসন্তোষ স্বরে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন আরহাম।অতপর নরম কন্ঠে বেশ কাতর স্বরে ধীরগলায় বললেন, ‘আমি আমার আগের হানিকে ভীষণ মিস করি।ভীষণ!’

উনার কন্ঠের দূর্বলতা মাইমুনা কে আঘাত করলো ভীষণ। খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আমি আর কোনো অন্যায় করবো না।আপনি আমাকে আগের মতো ভালোবাসেন শাহ।’

বাইরে হাফসার কাশির শব্দ শুনে দরজা খুললেন আরহাম।হাফসাকে দেখতেই তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘টার্বান টা কোথায়?তাড়াতাড়ি দিন।লেট হয়ে যাচ্ছে।’

উনার মলিন চেহারা দৃষ্টি এড়ালো না হাফসার।
হাফসা টার্বান দিতেই আরহাম আর এক মুহুর্ত ও দাঁড়ালেন না, চলে গেলেন।হাফসা আরহামের যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাইমুনা কে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার কিছু লাগবে আপু?’

‘না।’

‘নিচে যাবেন?নিচে যেতে সাহায্য করবো?’

‘পরে যাবো।’

খানিক পর একসাথে ফুপি,ইনায়াত,আম্মু,মাইমুনা,হাফসা সবাই নামাজের জন্য বরাদ্দকৃত আলাদা রুমে তারাবীহ আদায় করলো।

_________
ঘড়ির কাটা সাড়ে দশটার ঘর পেরিয়েছে।পুরুষরা আসছেন বাইরে থেকে।না চাইতেও হালকা খাবারের আয়োজন শেষে ক্লান্ত দেহে একেবারে রুমেই আসলেন আরহাম।এসি ছেড়ে সোফায় মাথা এলিয়ে দিলেন।মাথাটা ধরেছে ভীষণ!

চোখে তন্দ্রা ভাবটা লেগে আসবে ঠিক তখনই দরজায় আওয়াজ হয়।আম্মু আসলেন পারমিশন নিয়ে।হাতে নিয়ে আসলেন ফুড ডেজার্ট।

‘আর কত কী খাবো আম্মু? আমার আর সাহরি খাওয়া লাগবে না।’

‘খেয়ে নাও।ভালো ফিল করবে,আপা বানিয়েছেন কষ্ট করে।’

অপারগ ছেলেকে মা-ই খাইয়ে দিলেন।খাওয়ার ফাঁকে আরহাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘দূজনে কী শাড়ি পরে আসছেন?’

‘হুমম।’

আরহাম রাগত স্বরে বললেন, ‘কেনো?বললাম না বোরকা ছাড়া বের না হতে?গাড়িতে নিশ্চয়ই ড্রাইভার ছিলো নন-মাহরাম।বাইরের মানুষ আছে সাথে এ বাসায় ফুপা।এগুলো কি বুঝেন না উনারা?এটা কি ঠিক হলো?উনাদের কেন মানুষ দেখবে?’

ছেলের রাগে আফসানা মৃদু হাসলেন।এই হাসিটা আরহাম মানলেন না।মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

‘শুধু শুধু রাগ করছো তুমি?’

‘শুধু শুধু রাগ?উনারা কোন সাহসে….

‘বোরকা পড়েই আসছে দূজন।চোখটাও ঢাকা ছিলো।অন্দরমহলে এসে বোরকা খুলেছে।’

আরহামের সব রাগ যেন নিমিষেই গলে পড়ে গেলো।ধীরস্বরে বললেন, ‘ওহ।’

ফুপির ডাকে চলে গেলেন আম্মু।

_______
শেষ কর্ণারের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন আরহাম।রুমের সামনেই বারান্দা। বেশ গরম লাগছে।কাপর চেন্জ করলে ভালো হতো কিন্তু উনাদের রুমে ইনায়াত।

হঠাৎ-ই মায়ের ডাকে পিছ ঘুরলেন আরহাম।

‘ঘুমাবে না?’

‘হুমম।’

‘হাফসা আসছে।রুমে…

‘কেন?উনি কি আমার সাথে থাকবেন?’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।