অভির কলেজ ওর বাড়ি থেকে বেশি দুরে নয়। কলেজে সবার একটা ডাক নাম থাকে, অভির ডাক নাম “বিহারী”, তার কারন অভি ওর পরাশুনার বেশির ভাগ সময় বিহারে কাটায়। দেওঘরে হস্টেলে থেকে অভি স্কুল আর হাইস্কুল পড়েছে।
অভির কলেজ পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়, প্রথম পিরিওড, অপ্টিক্সের, করতে পারেনা অভি। লাঞ্চ ব্রেকের পরে প্রাক্টিকাল ক্লাস। প্রাক্টিকাল ক্লাসে ঢুকে পরে অভি, বই খুলে একমনে পড়তে শুরু করে। এখনো কেউ আসেনি ক্লাসে। খোলা বইয়ের পাতায় পরীর চোখ আর হাসি দেখতে থাকে অভি। অভির গতকাল রাতের কথা মনে পরে যায়, কেমন জলপরীর মতন পরী ওর বাহুপাসে কাঁপছিল, আর অভি ওর কোমল শরীর টাকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে ছিল। বারেবারে নিজের গাল ঘষে অভি, যেখানে পরী গাল ঘষে দিয়েছিল।
এমন সময়ে ওর বাঁ বাহুতে টান পরে, “কিরে ওর নাম কি?”
অভির মুখ থেকে আপনা হতেই পরীর নাম বেড়িয়ে যায়, “পরী।”
নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে অভির ঘোর কাটে, মাথা ঘুরিয়ে দেখে ওর দিকে মিটিমিটি করে হাসছে ওর সব থেকে ভাল বান্ধবী, অরুন্ধতি, ওর প্রাক্টিকাল পারটনার আর ক্লাসের সব থেকে ভাল মেয়ে।
অরুন্ধতি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “শেষমেশ বিহারী প্রেমে পড়ল। হুম গাধা ছেলে!”
মৃদু ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “পরীর সাথে কত দিন থেকে প্রেম চলছে? আর আমাকে একবারও জানাস নি তুই?”
অরুন্ধতি ব্যানারজি, অভি ওকে মিষ্টি করে ডাকে অরুনা। অরুনা ওর হতবাক বোকা বোকা মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। অভি অনেক সযত্নে পরীর নাম বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু আজ ধরা পরে গেল ওর প্রিয় বান্ধবীর হাতে!
অভি মাথা নাড়ায়, “না না না, কে পরী, আমি কোন পরীকে চিনি না।”
মাথার পেছনে আলতো করে একটা থাপ্পর মারে আরুনা, “আমার কাছে মিথ্যে কথা বলছিস? তোর চোখ বলছে যে তুই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস আর তুই কিনা চিনিস না পরীকে?”
ধরা পড়ার পরেও অভি মানতে নারাজ, “না রে সত্যি বলছি আমি কোন পরীকে চিনি না।”
অরুনা, “মানতেই পারলাম না যে অভি প্রাক্টিকাল ক্লাসে এই রকম ভাবুক হয়ে বসে থাকতে পারে।”
শেষমেশ অভিকে স্বীকার করতে হয়, “আচ্ছা বাবা আমি তোকে প্রাক্টিকাল ক্লাসের পরে সব বলব।”
অরুনা মৃদু চিৎকার করে ওঠে, “না, আমি এখুনি সব শুনতে চাই।”
জামা ধরে টানতে শুরু করে অরুনা, “চল না ক্লাস বাঙ্ক করি।”
অভি, “মানে? আমি তোর জন্য শুধু প্রাক্টিকাল ক্লাস করতে এসেছি আর তুই কিনা ক্লাস বাঙ্ক করার কথা বলছিস।”
অরুনা ওর জামা টেনে তুলে দেয়, “অহ, তুই আমার জন্যে যখন প্রাক্টিকাল ক্লাস করতে এসেছিস তাহলে আমি তোকে যেখানে নিয়ে যাব সেখানে চল। আর সত্যি যদি তুই না যাস তাহলে কিন্তু আমি সত্যি রাগ করব।”
অগত্যা অভি দাঁড়িয়ে পরে, কিন্তু তাও অরুনা কে জিজ্ঞেস করে, “প্রাক্টিকালের কি হবে?”
অরুনা, “ধুর বাবা প্রাক্টিকাল নিয়ে চিন্তা করিস নাত। আমার বাড়িতে ব্রেড বোর্ড আর মাল্টিমিটার সব আছে। আমরা পরে করে নেব। তুই চল আমার সাথে, আমি আর তর সইছেনা।”
অরুনা অভির জামা টানতে টানতে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেল। ওদের দিকে বাকিরা তাকিয়ে, বিশেষ করে সুকোমল আর অনুসুয়া।
পুবালি দৌড়ে অরুনার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “এই তোরা কোথায় যাচ্ছিস রে? প্রাক্টিকাল ক্লাস করবিনা তোরা?”
অরুনা একবার অভির দিকে তাকিয়ে পুবালিকে উত্তর দিল, “না রে আমরা একটু বের হচ্ছি। আমি তোকে সবকিছু বাড়িতে গিয়ে বলব আর তুই ঠিক করে প্রাক্টিকাল ক্লাস টা করিস।”
কলেজ থেকে বেড়িয়ে অরুনা ওকে জিজ্ঞেস করল, “কি রে কোথায় যেতে চাস?”
অভি, “আর কোথায় যাব বল, চল কফি হাউসে গিয়ে বসি আর কি।” দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল।
অরুন্ধতি ওর বাবা মার দ্বিতীয় সন্তান, দমদম এয়ারপোর্টের কাছে ওদের বাড়ি। অরুনার বাবা আর অভির বাবা দু’জনেই এয়ারপরট অথরিটি তে চাকরি করেন। অরুনাদের একান্নবর্তি পরিবার বাবা কাকা সবাই মিলে এক বিশাল বাড়িতে থাকে। পুবালি অরুনার খুরতুত বোন, একি বয়স। অরুনা বেশ মিষ্টি দেখতে, চোখে চশমা আর চোখ দুটো যেন সবসময়ে কথা বলে। খুব চঞ্চল আর হসিখুসি প্রকৃতির মেয়ে অরুনা কোন সময়ে বুকের ভেতরে কন কথা লুকিয়ে রাখে না, যা মনে আসে তাই লোককে বলে দেয়।
এই জন্যে যেমন ওর বন্ধুর সংখ্যা বেশি তেমনি শত্রুর সংখ্যাও বেশি। পুবালি ঠিক উল্টো প্রকৃতির মেয়ে, খুব চুপচাপ আর সংযত একটু লাজুক। কারুর সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। সারাদিনে হয়ত দুটো কি তিনটে কথা বলে অন্যদের সাথে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা শিয়ালদা পৌঁছে গেল। অরুনা অর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, “কিরে গাধা, চুপ করে কেন আমি তোর পরীর কথা সব শুনতে চাই, যদি তুই চুপ করে থাকিস তাহলে কিন্তু আমি চিৎকার করে লোক জড় করে বলব যে এই ছেলেটা আমার সাথে অপব্যাবহার করছে।”
অভি ওর দিকে মিনতির সুরে বলল, “প্লিস ওই রকম করিস না, আমি তোকে সব বলছি।”
অভি ওর গল্প শুরু করল, কি করে পরীর সাথে সুব্রতর বিয়েতে দেখা হয়েছিল, কপালে প্রথম চুম্বনের কথা, পরী আর ওর সম্পর্কের কথা। মায়ের সাথে পরীর সম্পর্কের কথা। ওকে জানাল যে পরী কিছুদিন পরে ওদের বাড়িতে থাকতে আসছে।
সব শুনে অরুনা আঁতকে ওঠে, “বলিস কি রে? তিন মাস ধরে তোদের প্রেম চলছে আর আমি কিছু জানি না। শয়তান ছেলে কেন তুই এত কথা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে ছিলিস বলত। কুত্তা, শূয়র…”
মাঝ রাস্তায় অরুনা অভিকে মারতে শুরু করে।
রাজাবাজার থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ওরা শিয়ালদা স্টেসানের দিকে হাঁটতে শুরু করে। সামনে ফুচকা ওয়ালা দাঁড়িয়ে, টাকে দেখে অরুনা ওকে জিজ্ঞেস করে যে ফুচকা খাবে কিনা। অভি মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ”
অরুনা, “ঠিক আছে বাকি গল্প কফি হাউসে গিয়ে সুনব।”
অরুনার সারা মুখে একটা দুষ্টু মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে থাকে। অভিকে একটু আনমনা দেখে জিজ্ঞেস করে, “আজ কি প্রব্লেম তোর যে তুই এত আনমনা?”
অভি, “কাল পরী আমার বাড়িতে এসেছে।”
অরুনা, “তুই একটা বড় কুত্তা। পরীকে ছেড়ে তুই প্রাক্টিকাল ক্লাস করতে এসেছিস? যাই হক তুই না এলে আমি ত জানতেও পারতাম না তাই না।”
তারপরে ওর দিকে প্রশ্নের জাল ছুঁড়ে দেয় অরুনা, “আচ্ছা, পরীকে দেখতে সুন্দরী? কি পড়াশুনা করেছে? তুই কবে ওর সাথে আমার দেখা করাবি?”
অভি ওর মাথায় চাঁটি মেরে উত্তর দেয়, “আরে বাবা দাঁড়া দাঁড়া। বাসন্তি পুজোর পরে পরী যখন আমার বাড়িতে থাকতে আসবে তখন তোর সাথে দেখা করাব, চিন্তা নেই তোর।”
তর্জনী উচিয়ে বলে অরুনা, “কথা দিচ্ছিস?”
অভি, “হ্যাঁ বাবা কথা দিচ্ছি, তোকে না দেখিয়ে আমি কোথায় যাব রে।”
ওরা ফুচকা খাওয়ার পরে আবার হাঁটতে শুরু করে, ফ্লাইঅভার পার করে কলেজ স্ট্রিটের দিকে চলতে থাকে।
অরুনা, “তাহলে বিহারী শেষ পর্যন্ত প্রেমে পড়ল।” খিলখিল করে হেসে বলে, “আমি এক সময়ে ভাবতাম তোর কপালে কোন মেয়ে জুটবে না। তোর যা তিরখি মেজাজ আর যা মুখ।”
“তিরিক্ষি মেজাজ, হ্যাঁ তা বটে” ম্লান হাসি হেসে অরুনা কে বলল, “এই মেজাজ আমাকে আমার চার পাশের পৃথিবী দিয়েছে রে।”
অরুনা দেখল অভি আবার ভাবুক হয়ে উঠেছে, “এই ছেলে, অসব কথা ছাড়। তোর চোখে জল দেখলে আমার খুব কান্না পায়। তোর মুখে হাসি দেখে আমি সত্যি খুব খুশি। আমি সত্যি পরীর সাথে দেখা করে ওকে অনেক বড় ধন্যবাদ জানাব যে তোর মুখে আবার হাসি ফুটিয়ে তুলেছে।”
অভি, “এই সমুদ্রনীল কে ডেকে নেব কফি হাওসে?”
সমুদ্রনীল, অরুনার বন্ধু, অরুনার প্রেম। কোলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স করছে। গত বছর অক্টবরে ওদের দেখা হয় কোন কলেজ অনুষ্ঠানে আর তারপর থেকে প্রেম। সমুদ্রনীল বেশ ভাল ছেলে। যেদিন সমুদ্রনীল অরুনাকে প্রোপস করে, সেদিন অভি সমুদ্রনীল কে বলেছিল যে যদি কোন দিন অরুনার চোখে জল দেখে তাহলে ও সমুদ্র কে আস্ত রাখবে না, কেটে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবে ওকে।
ওরা দু’জনে কফি হাউসের দিকে হাঁটতে থাকে। অভির মনে পুরান স্মৃতি জেগে ওঠে, অরুন্ধতির স্মৃতি আর ওর নিজের জীবনের কথা। কলেজে দেরিতে ঢোকে অভিমন্যু তাই বাকিদের চেয়ে ও বছর দুই বড়। ছোটো বেলায় হস্টেলে মানুষ, স্কুলের পড়াশুনা ও দেওঘরের এক স্কুল থেকে পড়ছে। ক্লাস ইলেভেনে একবার ফেল করে আর এক বছর নষ্ট হয় জয়েন্ট আই.আই.টি পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নেবার সময়ে। বাবা মায়ের খুব চাপ ছিল যে ছেলে কে ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। সবসময়ে অভিকে কথা শুনাত যে যেহেতু ওর পরাশুনার পেছনে বাবা মা অনেক টাকা খরচ করছে তাই ওকে জয়েন্ট পেতেই হবে, ভালো রেসাল্ট করতেই হবে। ছোটো বেলা থেকে অভিমন্যুর খুব শখ ছিল যে বড় হয়ে ও একজন নামী চিত্রকার হবে।
ক্লাস টেন পাশ করার পরে ও শান্তিনিকেতনে পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু বাবা মা বাধ সেধে ছিলেন। বলেছিলেন যে এত পয়সা ওরা অভির পেছনে খরচ করেছে শুধু ওকে চিত্রকর বানানোর জন্য নয়, ওকে জয়েন্ট পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য। বহু রাত কেটে গেছে, বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া করে অভি রাতে ঘুমায়নি। ক্লাস ইলেভেনে ওকে একরকম জোর করে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হয়েছে, যেটা ওর বিশেষ ইচ্ছে ছিল না। টুয়েলভ পাশ করার পরে অভি আই.আই.টি আর আই.এস.এম এ পায় কিন্তু অভির মাথায় রোখ চেপে যায় যে ও ইনঞ্জিনিয়ার হবে না। অনেক লড়াই যুদ্ধ করার পরে ও শেষমেশ ফিসিক্স নিয়ে কলকাতার এক কলেজে ভর্তি হয়।
আড়াই বছর আগে অভি যখন কলেজে পড়তে আসে, তখন কোলকাতা শহর ওর কাছে এক নতুন জায়গা। হ্যাঁ কোলকাতায় জন্ম ওর হয়েছিল কিন্তু পড়াশুনার জন্য ওকে বাইরে থাকতে হয়েছিল। প্রথম প্রথম ওর কলকাতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে একটু অসুবিধে হয়েছিল। কথাবার্তা বলার ঢঙ্গে বেশি হিন্দি আর ইংরাজি শব্দ বের হত, যার জন্য ওর ক্লাসের বাকিরা ওকে বাইরের মানুষ বলে গন্য করত। বন্ধু বলতে কম ছিল, বিশেষ কোন দরকার না থাকলে কেউ ওর সাথে কথা বলত না বা অভিও কারুর সাথে বিশেষ কথা বলত না।
কলেজে দেখা হয় অনুশুয়া চ্যাটার্জি, এক সুন্দরী মেয়ে খুব ভাল নাচত অনুশুয়া। নাচ সেখার জন্য অনুশুয়ার শরীরের গঠন বেশ পাতলা আর দেখতে ভারী মিষ্টি লাগত। অভি অনুশুয়ার রুপ দেখে ওর প্রেমে পড়ে যায়। ওদের দুজনার মধ্যে বন্ধুত গড়ে ওঠে। অভি অনুশুয়াকে ওর জীবনের অনেক কথা বলে, ওর হেরে যাওয়ার কথা, মনের ব্যাথা, সব কিছু বলে আর সেটাই সে জীবনের সব থেকে বড় ভুল করে ফেলে একজন কে বিশ্বাস করে মনের কথা বলার। সুন্দরী অনুশুয়াকে ওর পাশে দেখে অনেকে বন্ধুতের হাত বাড়িয়ে দেয় অভির দিকে।
কলেজের প্রথম বছরের ডিসেম্বরে অভি অনুশুয়াকে প্রোপোস করে, কিন্তু অনুশুয়া ওকে প্রত্যাখান করে দেয়, কারন বলে যে ও হেরে যাওয়া মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না, ও ভীতু তাই আই.এস.এম পেয়েও ছেড়ে দিয়েছে। আরও জানায় যে ওর কথাবার্তা বাঙ্গালীর মতন নয় তাই ওদের সম্পর্ক বন্ধুতের বেশি কিছু হতে পারে না। ভেঙ্গে পরে অভি, আবার একা এই চেনা মুখের ভিড়ে, নিজেকে আর খুঁজতে চেষ্টা করে না। পেছনের বেঞ্চে বসে থাকত অভি আর ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে তাকিয়ে থাকত অনুশুয়ার দিকে।
অরুন্ধতি আর পুবালি খুব অধ্যয়নশীল আর বুদ্ধিমতী, তাদের অনেক বন্ধু বান্ধবী ছিল। আর অরুন্ধতি যেহেতু খুব হাসিখুশি মেয়ে তাই ওর চারপাশে অনেক লোকেরা জড় হয়ে থাকত। অনুশুয়া অভির কথা ক্লাসে বলে বেড়ায়, অভিকে সবার সামনে নিচে নামিয়ে দেয়। অভিমন্যু খুব অসহায় বোধ করে, পাশে কোন বন্ধু না থাকার জন্য।অভি অনুশুয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে ওর জন্ম কোলকাতায় কিন্তু পড়াশুনার জন্য বাইরে থাকতে থাকতে ওর কথাবার্তার শুর বদলে গেছে। অনুশুয়া মানল না আর, বলল যে হেরে যাওয়া মানুষের সাথে ও কোনরকমের সম্পর্ক রাক্তে চায় না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয় অভি।
কিছুদিন পরে ওই অনুশুয়া ওর ক্লাসের এক বন্ধু সুকোমলের সাথে ঘুরে বেড়ায় হতে পারে অভিকে ঈর্ষার বাণে জর্জরিত করার জন্য। অভি প্রথম প্রথম ঈর্ষান্বিত হয়, কিন্তু পরে মন কে প্রবোধ দেয় যে অনুশুয়ার মতন সুবিধাবাদী মেয়ে ওর জন্য নয়। ধিরে ধিরে স্বাভাবিক হয়ে যায় সবকিছু কিন্তু অনুশুয়ার সাথে ওর সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয় না।
কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ, সেপ্টেম্বরের একদিন। লাঞ্চের সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, ক্লাসে অরুন্ধতি আর পুবালি বসে আছে। অভি ওদের অনেক পেছনে বসে একটা বাংলা উপন্যাস পড়ছে। হটাত করে সবাই চুপ, একটা কান্নার মতন গোঙানি আওয়াজ গেল অভির কানে। অভি বই থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে যে অরুন্ধতি পুবালির পিঠে হাত বোলাচ্ছে আর পুবালি মাথা নিচু করে কাঁদছে। পুবালির নাক থেকে অসম্ভব রকমের রক্ত বের হচ্ছে। পুবালি যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠছে বারে বারে আসে পাশের ছেলেরা শুধু দেখা ছাড়া আর নির্দেশ দেওয়া ছাড়া কিছু করছে না। সত্যি বাঙ্গালীর রক্ত, মাথা গরম হয়ে গেল অভির। অভি দৌড়ে যায় অরুন্ধুতির কাছে, গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে পুবালির কি হয়েছে।
অরুন্ধুতি ওর দিকে চোখে জল নিয়ে তাকায়। পুবালির মাথা উঁচু করে ধরে অভি, গায়ের জামা খুলে চেপে ধরে পুবালির নাক। বাকিদের চিৎকার করে একটা এম্বুলেন্স ডাকতে বলে। পুবালি কে পাজা কোলা করে হাতের মধ্যে তুলে নেয় অভি, জামা আর গেঞ্জি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পুবালি ওর কোলে অজ্ঞান হয়ে যায়। অরুন্ধতির চোখে জল, পুবালির মাথাটা কোনরকমে ধরে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এম্বুলেন্স এসে পৌছয়, অভি ওদের কে নিয়ে এম্বুলেন্সে উঠে হস্পিটাল নিয়ে যায়। সবার মুখে এক কথা যে কি হয়েছে পুবালির, ওদের দিকে তাকিয়ে অভি বলে যে পুবালির বাড়িতে খবর দিতে।
হস্পিটালে গিয়ে জানা যায় যে পুবালির নাকের আর কপালের মাঝে একটা ছোট্ট টিউমার আছে আর সেটা ফেটে গিয়ে রক্ত বেড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পুবালিকে অপারেসান থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। অরুন্ধতি আর অভি উৎকণ্ঠায় অপারেসান থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। অরুন্ধুতি সমানে কাঁদতে থাকে, অভির কাছে ওকে সান্তনা দেবার মতন কোন ভাষা থাকে না। মনে মনে অভি কলেজের বন্ধুদের মুন্ডপাত করে যাচ্ছিল, কেউ একবারের জন্য এগিয়ে এসে পুবালিকে হস্পিটাল নিয়ে যাবার কথা ভাবেনি, তাঁর চেয়ে কিনা জ্ঞান দিতে ব্যাস্ত ছিল সবাই। অরুন্ধতিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে অভি, ওর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শান্তনা দেবার চেষ্টা করে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের কলেজের বন্ধুরা হসপিটাল পৌঁছে যায়, সাথে সাথে পুবালির বাবা মা ও হস্পিটাল পৌঁছে যায়। কলেজের সবাই ওদের কে জিজ্ঞেস করে যে পুবালির কি হয়েছিল, অরুন্ধতি সবার দিকে একটু রেগে তাকিয়ে থাকে তারপরে কাকু কাকিমা কে সব কথা বলে। অভি খালি গেঞ্জি পরে বসে, গেঞ্জির বেশির ভাগ রক্তে ভিজে গেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে অভির, ছেলেরা ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে যে পুবালির কি হয়েছে। অভি উত্তরে জানায় সব ঘটনা।
অপারেসান থিয়েটারের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে, কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার এসে জানায় যে, পুবালি বর্তমানে বিপদমুক্ত, কিছু দেরি হলে হয়ত টিউমারের রক্ত ওর মাথার ভেতরে চলে যেত আর মাথার শিরা উপশিরা গুলোকে খতিগ্রস্থ করে দিত। পুবালির বাবা মা আর অরুন্ধতির বাবা মা অভির দিকে কৃতজ্ঞ ভরা চোখে তাকায়। অরুন্ধতি দৌড়ে এসে অভিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। সেই কান্না বেদনার কান্না ছিল না, সেই কান্না কৃতজ্ঞতার কান্না ছিল, যেহেতু অভি ওর প্রানের বোন পুবালিকে আবার ওর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে তাই। অভির মনে হল বিগত চোদ্দ বছরে কেউ ওকে ভালবাসায় বা কৃতজ্ঞতায় ওই রকম ভাবে জড়িয়ে ধরেনি।
সারা জীবন ধরে বাবা মার কাছে ধিক্কার শুনে গেছে যে ও জীবনে কিছু করতে পারল না। অভির চোখে জল এসে যায়। অরুন্ধতির বাবা ওকে বাড়িতে আসতে বলে কিন্তু অভি ওদের জানায় যে অন্য কোনদিন ওদের বাড়িতে আসবে সেদিন আর যায় না। খুব ক্লান্ত লাগছিল অভির। অরুন্ধতির বাবা ওকে একটা টিশার্ট কিনে দেয়, কেননা তখন পর্যন্ত অভির গায়ে রক্ত মাখা গেঞ্জি ছিল।
হসপিটাল থেকে অভি মাথা উঁচু করে বেড়িয়ে এল, মনে হল যেন জীবনে খুব বড় কাজ করেছে, ও আর সেই ভীতু হেরে যাওয়া অভি নয়। সেই প্রথম বার অভির মনে হল যে ওর চারপাশের পৃথিবী টা কত অন্ধকার ময় আর কত সুবিধাবাদী মানুষে ভরা। বাকি কলেজের বন্ধুরাও ওর পেছন পেছন হস্পিটাল থেকে বেড়িয়ে আসে। অভিকে ডাকে কফি হাউসে যাবার জন্য। অভি ওদের মানা করে দেয়। অভি হটাত করে দেখে যে অনুশুয়া ওর দিকে দৌড়ে আসছে আর হাতের ইশারায় ওকে দাঁড়াতে বলছে। অভি ওর দিকে তাকায় মাথা
নাড়িয়ে ওকে ক্ষমা করে দেবার ইশারা করে, সামনে যে বাস আসে তাতে অভি উঠে পরে। একসময়ে অভির চোখে যে হেরে যাওয়ার চাহনি ছিল সেটা ও অনুশুয়ার চোখে দেখতে পায়। ভগবানকে মাথা তুলে ধন্যবাদ জানায় অভি, তিনি যা করেন সবার ভালোর জন্য করেন।
তারপরে বেশ কিছুদিন অরুন্ধতি আর পুবালি কলেজে আসেনা, অভির ও আর ওদের বাড়ি যাওয়া হয় না কেননা ও চেনেনা ওদের বাড়ি বা ওর কাছে অরুন্ধুতির ফোন নাম্বার ও নেই যে ফোন করে পুবালির খবর জেনে নেবে। এমন একদিনে, অভি চুপ করে ক্লাসে বসে। অরুন্ধতি ক্লাসে ঢোকে, সবার চোখ অরুন্ধতির দিকে চলে যায়, সবার মুখে এক প্রশ্ন পুবালি কেমন আছে। অরুন্ধতি বিরক্তি ভরা চোখে সবার দিকে তাকায়, যেন বলতে চায় যে তোদের জানা কোন অধিকার নেই।
অভির দিকে হেঁটে এসে কাঁধ নাড়িয়ে বলে, “এই বিহারী, আমার সাথে চল।”
অভি ওকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায়।”
অরুন্ধুতি, “বাবা তোকে বাড়িতে ডেকেছে।”
এই বলে ওর জামা ধরে টানতে টানতে ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে আসে।
অরুন্ধতির বাড়ি যাবার পথে অভি পুবালির কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে পুবালি এখন ভালো আছে আর গতকাল বিকেলেই হস্পিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে এসেছে। তাই ও অভিকে বাড়ি নিয়ে যেতে কলেজে এসেছে। অভি ওকে জিজ্ঞেস করে যে ও ওকে ফোন কেন করেনি।
অরুন্ধতি জবাবে বলে, “আমার কাছে ত তোর ফোন নাম্বার নেই।”
অভি, “তুই কোনদিন চাসনি।”
অরুন্ধতি, “জীবনের এই প্রথম আমি সব থেকে বড় ভুল করেছি।”
অভি, “কি ভুল?”
অরুন্ধুতি, “মানুষ চিনতে ভুল করেছি, বন্ধু চিনতে ভুল করেছি।”
অভি, “ধুর বোকা, সবাই কিছু না কিছু ভুল করে ফেলে, ছাড় অসব কথা।”
অরুন্ধুতি কিছু পরে ওকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে তোর বাবার নাম কি অর্জুন তালুকদার?”
অভি চমকে যায়, “হ্যাঁ কিন্তু তুই কি করে জানলি?”
অরুন্ধুতি, “আমি এইটুকু জানতাম যে কাকু এয়ারপোর্ট অথরিটি তে চাকরি করেন আর আমার বাবাও করেন। আমার বাবা যখন তোর নামধাম আমাকে জিজ্ঞেস করল তখন আমি বললাম যে আমি তো কাকুর নাম জানিনা। বাবা আমকে তোর কাছে কাকুর নাম জিজ্ঞেস করতে বলেছে।”
অভি, “হুম… আচ্ছা তোর বাবা মানে ব্যানারজি কাকু। ওকে এবারে বুঝেছি।”
দিন যায় ওদের বন্ধুত প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। ক্লাস ফাকি দিয়ে কলেজ স্ট্রিটে ঘোরা, গ্লোবে সিনেমা দেখা, এস্প্লানেড বা পার্ক স্ট্রিটে কোন রেস্টুরেন্টে খাওয়া বা নন্দনে আড্ডা মারা। পুবালি খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে তাই বেশির ভাগ দিন ওরা দু’জনে ঘুরে বেড়াত এদিক সেদিক। কোলকাতায় অভি নতুন, অরুন্ধতি ওর গাইডের কাজ করত যেন। কলেজের বাকিরা ওদের এই বন্ধুত্ত টাকে অন্য চোখে দেখে, সবার মুখে এক কথা, অরুন্ধতি অভির প্রেমে পড়েছে আর সেই কথা ওদের কানে আসে, ওরা দু’জনে খুব উপভোগ করে বাকিদের সংশয়।
কেউ ভাবতে পারে না যে একটা ছেলের আর একটা মেয়ের মধ্যে প্রেম প্রীতির থেকেও ভালবাসা এক অন্য ধরনের হতে পারে, বন্ধুত্তের ভালবাসা থাকতে পারে।
অভির বাবা যেহেতু অরুন্ধতির বাবার অফিস কলিগ তাই ওদের বাড়িতে অভির যেতে কোন বাধা থাকেনা। অভির বাবা মা আর অরুন্ধতির বাবা মায়ের মধ্যেও সেই একি ধারনা জাগে যে অভি অরুন্ধতিকে ভালবাসে আর ওর মায়ের কোন বাধা থাকে না অরুন্ধতিকে বউমা করে ঘরে আনতে। অভি আর অরুন্ধতি দু’জনে ওদের চারদিকের ভুল ধারনা টাকে খুব উপভোগ করে আর হাসে।
পুবালি আর অরুন্ধুতি সবসময়ে অভিকে অনুশুয়ার কাছ থেকে আগলে রাখত, কিছুতেই অনুশুয়াকে অভির কাছে আসতে দিত না। একদিন ওরা তিনজনে মিলে পার্ক স্ত্রিটের ফ্লুরিসে বসে খাচ্ছিল তখন পুবালি অরুন্ধতিকে বলে, “জানিস, কাল অনুশুয়া তোর কথা আর অভিমন্যুর মাঝের সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করছিল।”
ওরা দু’জনে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করে যে পুবালি কি উত্তর দিয়েছে।
পুবালি, “আমি বলেছি যে তোরা খুব ভাল বন্ধু ব্যাস আর কিছু না।”
অরুন্ধতি পুবালিকে আলতো করে চাঁটি মেরে বলে, “বোকা মেয়ে ওকে বলবি ত যে আমরা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ধুত বোকা, এখন আবার অনুশুয়া ওর পেছন পেছন আসতে চাইবে।”
অরুন্ধতি অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “মাগি টার পেছনে আর গেছিস ত আমি তোর ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব।”
হেসে ওঠে অভি, মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে ন্যাড়া বেলতলায় একবার যায়।
ঠিক দুর্গাপুজার আগে, অরুনা আর অভি আউট্ট্রাম ঘাটের, স্কুপে বসে গল্প করতে থাকে। দুজনে আইস ক্রিম খেতে খেতে সামনের কাঁচের জানালা দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আলোকিত লাল নদীর জল দেখতে দেখতে হারিয়ে যায়। অভি একমনে অরুনার দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই প্রথম বার অভির মনে হয় যে অরুনা ওর কত কাছের মানুষ। অরুনার চোখ দুটি খুশিতে চকচক করছে যেন। খুব বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে অভি অরুনার কাঁধে হাত রাখে।
অরুনা অভির হাতের স্পর্শে আইসক্রিম খাওয়া থামিয়ে অভির মুখের দিকে তাকায়, চোখের চাহনি দেখে অভির মনের ভাব বুঝতে পারে অরুনা, কিন্তু তাও জিজ্ঞেস করে, “কিরে আমার দিকে ওই রকম ভাবে দেখছিস কেন রে?”
হাত সরিয়ে নেয় অভি, হেসে ফেলে, “কিছু না এমনি।”
গভীর ভাবে অভির দুচোখের দিকে তাকায় অরুনা, “আমার কাছে থেকে কিছু লুকাতে পারবি না রে। তুই চুপ থাকলে কি হবে তোর চোখ দুটো যে অনেক কথা বলে।”
অভি ওকে হেসে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তাহলে তুই বল আমার চোখ কি বলছে?”
অরুনা ওর গাল টিপে বলে, “তুই যা ভাবছিস আমিও সেটাই ভাবছি।”
অভি ওর দু’হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। অরুনা বলতে থাকে, “আমি চাই না আমাদের সম্পর্ক একটা বাঁধনের জোরে নষ্ট হক। বহু দিন পরে আমাদের মনে হবে যে আমাদের কোন বন্ধু হত যাকে আমরা আমাদের মনের কথা বলতে পারি, যেগুলো হয়ত আমরা আমাদের সাথি কে বলতে পারব না সেগুল আমরা এঁকে অপরকে বলব। আমি আমার সব থেকে ভাল বন্ধুকে হারাতে চাই না অভিমন্যু।”
এইসব ভাবতে ভাবতে ওরা কফি হাউসে পৌঁছে যায়। অরুনা ওর বাজুতে চাঁটি মেরে বলে, “কিরে সারা রাস্তা এত চুপ মেরে গেলি কেন? তুই কি পরীর খেয়ালে আবার হারিয়ে গেলি নাকি?”
অভি মাথা চুলকে বলে, “নারে, আমি ত তওর কথা আর আমাদের বন্ধুত্তের কথা ভাবছিলাম।”
অরুনা ওকে আলতো করে থাপ্পর মেরে বলে, “আহা, ছেলের ভাব দেখ, ভেতরে যেন টালা ট্যাঙ্ক ভরে উঠেছে। হ্যাঁ রে তোর পরীর কথা আমাকে বলতে হবে সেটা মনে থাকে যেন নাহলে কিন্তু আমি তোকে ছিঁড়ে খাবো। যাই হক পরীর ভাল নাম কি?”
অভি, “শুচিস্মিতা মন্ডল।”
অরুনা, “শুচিস্মিতা, মানে যার হাসি শুদ্ধ, বাহ রে নিশ্চয় পরীর হাসি খুব সুন্দর হবে।”
লাজুক হেসে অভি উত্তর দেয়, “হ্যাঁ রে পরীর হাসি খুব মিষ্টি। ও যখন হাসে তখন দু’গালে টোল পরে আর হাসিটা যেন আরও বেশি মিষ্টি হয়ে যায়।” অভি যেন ওর চোখের সামনে পরীর হাসি মাখা মুখ দেখতে পায়।
কফিহাউসে বসে অভি পরীর গল্প শুরু করে, কি করে অভি ওকে নিয়ে হিমাচলে ঘুরে এসেছে। সব শুনে অরুনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অভির দিকে, বাবা ছেলের কি সাহস।
অরুনা কফির কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ত অসুবিধে টা কোথায়?”
অভি মাথা নাড়ে, “আমাদের মধ্যে ত কোন অসুবিধে নেই।”
অরুনা, “ধুর বোকা ছেলে, আমি জানি যে তোদের মধ্যে কোন অসুবিধে নেই, কিন্তু তোর মনের ভেতরে একটা গভীর সংশয় বা ভয় দানা বাধছে তাই না।”
অভি অবাক হয়ে অরুনার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই জানলি কি করে।”
অরুনা ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, “আমি তোকে তোর চেয়ে বেশি জানি বুঝলি রে। তুই ভাবছিস যে কাকু কাকিমা তোদের সম্পর্ক মেনে নেবে না, কেননা পরী তোর চেয়ে দু’বছরের বড় আর কাকিমার সাথে পরীর সম্পর্ক। কাকিমা কে বুঝাতে অনেক কষ্ট হবে কেননা কাকিমা খুব কড়া প্রকৃতির মহিলা।”
অসহায় ভাবে অভি ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, “আমি জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাকে অনেক কঠিন করে দিয়েছে। পরীকে পাওয়ার জন্য আমি আকাশ পাতাল এক করে দেব।”
অরুনা, “অত শত ভাবিস না। আমি কাকু কাকিমা কে বুঝাতে আপ্রান চেষ্টা করব। তুই শুধু বসে কফি খা কুত্তা।”
অভি অরুনার হাসি মুখ দেখতে থাকে, অরুন্ধুতি ওর কাছে যেন দেবী প্রতিমা, ওর সব থেকে ভাল বন্ধু। জীবনের কিছুর বিনিময়ে ও অরুনার হসি মুখ হারাতে চায় না।
মাতৃময়ী মূর্তি
কফি হাউস থেকে বাড়ি ফিরতে অভির দেরি হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে দেখে যে সবাই বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছে। বাবা নিজের ঘরে বসে অফিসের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। মা পরীর মাথা কোলে করে নিয়ে ডিভানের ওপরে বসে আছে আর পরীর চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। পরী ছোট্ট বিড়ালের মতন মায়ের আদর খাচ্ছে। লম্বা সোফায় মৈথিলী আর সুব্রত বসে। অভি ঘরে ঢুকে ছোটো সোফার ওপরে গিয়ে বসে পরে। মা ওকে জিগ্যেস করলেন যে দেরি কেন। উত্তর অভি জানাল যে প্রাক্টিকাল ক্লাসের জন্য দেরি হয়ে গেছে।
মা ওকে বললেন যে আগামি কাল সুব্রত আর মৈথিলী ঢাকুরিয়া যাবে মৈথিলীর কাকার বাড়িতে, অভি কেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। মায়ের কথা শুনে অভি পরীর দিকে তাকায়, পরীর চোখ ইশারায় বলে ওঠে “প্লিস যেও না” অভি মাকে জিজ্ঞেস করে যে কালকে মা আর পরী কোথায় যাবে। মা জানালেন যে পরীকে নিয়ে মা একটু কেনাকাটা করতে শ্যাম বাজার হাতিবাগান যাবে তারপরে পরীর জন্য গয়না কিনতে বউ বাজারে যাবে।
মৈথিলী অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আজকে আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে গেলে না, কাল কিন্তু না করতে পারবে না।”
অভি দেখল মা ও চাইছে অভি ওদের সাথে ঢাকুরিয়া যাক, কিন্তু বাধ সাধছে প্রেয়সী পরীর চোখ।
সুব্রত ওকে বলল, “মামা আমি কোন কথা শুনব না, কাল তোমাকে আমাদের সাথে যেতেই হবে।”
অভি দেখল যে বড় ফাঁপড়ে পরে গেছে, কিছু একটা বলে ওদের কে ক্ষান্ত না করলে অভির যে স্বস্তি নেই।
অভি পরীর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে একটু কথা বলে বাকিদের জানাল, “ঠিক আছে, শনিবার আসুক আমি জানাব আমি কি করব।” পরী ওর কথা শুনে মৃদু হেসে জানিয়ে দিল যে ও খুব খুশি।
মা পরী আর মৈথিলীকে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে যায়। অভি নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সুব্রত জিজ্ঞেস করে যে ও সাথে যেতে পারে কিনা। মাথা নাড়ায় অভি, জানিয়ে দেয় যে সুব্রতর জন্য ওর দরজা সবসময়ে খোলা।
সুব্রত ওর ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার বলত মামা, তুমি কি অরুনিমার প্রতি ইন্টারেস্টেড নও?”
মাথা চুলকালো অভি, কিছু একটা উত্তর দিতে হবে যাতে সাপ মরে কিন্তু লাঠি ভাংবে না। অভি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে উত্তর দেয়, “মামা আসল কথা হচ্ছে যে আমি একজনার প্রতি একটু ঝুঁকে আছি।”
সুব্রত চমকে গিয়ে বলে, “কি বলছ মামা, এ কথা ত আমাকে জানাও নি। কে সে? তুমি নাকি অরুনিমাকেও বলেছিলে যে তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই তাহলে?”
অভি, “মামা প্রেম কি আর বলে কয়ে আসে, এত হয়ে যায় হটাত করে। কার সাথে কি ভাবে হবে কেউ জানেনা। মামা প্রেম ত আর অঙ্ক নয় যে দুয়ে দুয়ে চার হবে। তুমিও ত প্রেম করে বিয়ে করেছ, তুমি ত বুঝবে মনের কথা।”
সুব্রত, “কিন্তু মামা, একতরফা প্রেম হলে যে মুশকিল। তা তুমি কি প্রোপস করেছ?”
অভি দেখল সত্যি কথা বলা বিপদ, অগত্যা অভি কে অরুন্ধতি কে টেনে নিয়ে আসতে হল। অভি বলল, “না মামা আমি এখনো প্রোপস করিনি তবে আমি জানি যে মেয়েটা আমাকে ভালবাসে।”
সুব্রত, “কে সে?”
অভি, “আমার কলেজের এক বান্ধবী।”
সুব্রত, “কবে প্রোপোজ করবে?”
অভি, “দেখি, ওর জন্মদিনে ভাবছি প্রোপস করব।”
সুব্রত মনে হল যেন একটু মনক্ষুণ্ণ হয়ে গেল অভির কথা শুনে, “অরুনিমা একটু আঘাত পাবে এই কথা শুনে। বিগত দু’মাস ধরে ও তোমার ফোনের আশায় বসে আছে। যাই হক একবার ফোন করে দেখ, তুমি ত তোমার বান্ধবিকে এখন মনের কথা বলোনি তাই ত। হয়ত অরুনিমার সাথে দেখা করলে তোমার মনের ভাব বদলে যেতেও পারে।”
অভি ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, “ঠিক আছে আমি কথা দিচ্ছি যে আমি অরুনিমার সাথে দেখা করব, কিন্তু কাল হবে না। একটা কথা বল মামা, তুমি আর চুরনি কেন আমার পেছনে অরুনিমার জন্য পরে আছো?”
সুব্রত ওর দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানি হাসি হেসে বলল, “ধিরে ধিরে সব জানতে পারবে মামা।”
অভি ঠিক বুঝতে পারল না যে সুব্রত হটাত করে এই রকম কথা কেন বলল, কি জানতে পারবে অভি, কি মতলব চলছে সুব্রতর মাথার মধ্যে? সুব্রতর হাসির মধ্যে যেন একটু শয়তানি বদ মতলবের ছোঁয়া রয়েছে।
ঠিক সেই সময়ে মৈথিলী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে জানাল যে খাবার তৈরি আর মা ওদের কে খেতে ডাকছে। সুব্রত মৈথিলীকে দেখে বলল যে ও অভিকে অরুনিমার সাথে দেখা করার কথা বলেছে আর অভি রাজি হয়েছে যে অরুনিমার সাথে দেখা করবে, কিন্তু কাল দেখা করতে পারবে না, পরে দেখা করবে। সুব্রত আরো জানাল যে অভির কলেজে একটি বান্ধবী আছে যাকে অভি ভালবাসে আর ভবিষ্যতে প্রেম নিবেদন করতে চায়।
মৈথিলী লাজুক নয়নে অভির দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে একটা হাসি দিল, বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুল দিয়ে দাঁতের মাঝে চেপে ধরল। অভি ওর মন মাতান হসি দেখে চঞ্চল হয়ে উঠল, বুকের মধ্যে যেন ওই মত্ত হাসিটা একটা গভীর রেখা পাত করে গেল।
অভি মৈথিলীকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমার দিকে ওই ভাবে তাকিয়ে হাসছ কেনও?”
“কিছু না, এমনি হাসছি।” অভিকে আপাদ মস্তক চোখ বুলিয়ে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি বলেছ ওকে?”
সুব্রত ওর দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানি হাসি হেসে বলল, “আরে না না ডার্লিং, চিন্তা কোরো না। ও বলেছে ত যে অরুনিমার সাথে দেখা করবে, ব্যাস তারপর যা হবার সেটা সময়ের ওপরে ছেড়ে দাও।”
“খাবার তৈরি, নিচে এস”
এই বলে মৈথিলী ওর সুডৌল নিতম্ব মাছের মতন দুলিয়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেল। অভির চোখ মৈথিলীর মত্ত চলনের ওপরে নিবদ্ধ হয়ে থাকল, চোখের সামনে মৈথিলীর সুডৌল নিতম্বের লয় যেন বুকের ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে চলে গেল। ইচ্ছাকৃত ভাবে কি মৈথিলী ওই রকম ভাবে কোমর দুলিয়েছে? কি জানি। দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাবার ঠিক আগে, মৈথিলী ওদের দিকে ঘুরে তাকাল, চোখে যেন কামনার আগুন জ্বলছে, কিছু একটা বলতে চাইছে দু’চোখ ঠিক বুঝতে পারছে না অভি।
অভির চোখ ওর মত্ত ছন্দময় নিতম্বের ওপরে, একটু যেন কেঁপে উঠল মৈথিলী, অভির চোখ যেন ওর পিঠ কোমর আর নিতম্ব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। সুব্রতর দিকে চোখ টিপলও মৈথিলী। অভি একি করছে, বরের সামনে তার নতুন বিয়ে করা বউয়ের মত্ত চলন লম্পটের মতন দেখছে।
অভি যেন ধরা পরে গেল সুব্রতর কাছে, ওর কান গরম হয়ে ওঠে, কি করছে ও? মৈথিলী কেন ওই রকম ভাবে কোমর দুলিয়ে গেল? সুব্রতর কি মতলব? কি জানে কি আছে ভবিষ্যতে।
খাবার সময়ে পরীর সাথে বিশেষ কথাবার্তা হল না, সবার সামনে একটু দুরত্ত রেখে কথা বলতে হয়েছে দুজনকে। পরীর মন খুব আনচান করতে থাকে, সামনে অভি বসে কিন্তু কিছুতেই ছুঁতে পারছে না, একি বিড়ম্বনা বিধাতার। সামনে সুধার ভাণ্ডার তাও ভালবাসার পাত্র খালি, বারে বারে আর চোখে পরীর দিকে তাকায় অভি। মা জানালেন যে ওরা কাল দুপুরে শপিং করতে বের হবে। অভি ওদের কে বলল যে ও ঢাকুরিয়া যাবে না। অভির কথা শুনে পরীর মনে যেন খুশি আর ধরে না, চোখ জলজল করে ওঠে পরীর, বুকের মধ্যে খুশির জোয়ার আসে।
পরী শয়তানি করে মাকে বলে, “আচ্ছা ছোটো মা, আমাদের তো একটা গাধা লাগবে ব্যাগ ধরার জন্য, তাই না।”
অভি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখ তোমার পরী আমাকে কি সব বলছে।”
পরী, “দেখ দেখ একটা গাধা কিনা মাংস খাচ্ছে।”
অভির খুব ইচ্ছে করছিল ওই গোলাপি গালে চিমটি কাটার জন্য। নিজেকে কোন মতে সামলে নিয়ে, “কুকুর, ভেড়া, ঢেঁড়স, কাক, হাড়গিলে…”
ওদের ঝগড়া দেখে সবাই হেসে ফেলল, মা ওদের দু’জনকে মৃদু বকুনি দিল, “তুই খেয়ে শুতে যা” পরীর দিকে তাকিয়ে বলল “আর তুই তাড়াতাড়ি কর, কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।”
অভি খাওয়া শেষ করে মাকে বলল, “আমার শুতে দেরি হবে প্রাক্টিকালের কিছু কাজ বাকি আছে আমার।”
পরীর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ইশারায় বলে, “আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব কিন্তু।”
প্রাক্টিকাল খাতা লিখতে লিখেত অনেক রাত হয়ে গেল, ঘড়ি দেখল অভি, রাত একটা বাজে। চোখ দুটো জ্বালা জ্বালা করছে, মাথাও একটু ব্যাথা ব্যাথা করছে। আঙ্গুল দিয়ে মাথায় আঁচর কাটে অভি, মনে পরে কতকাল পরীর ছোঁয়া পায়নি মাথার ওপরে, কি সুন্দর চুলে বিলি কাটে পরী আর অভি ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ত। পরী আর এলনা তাহলে, এই ভেবে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে থাকল। কিছুতেই প্রেয়সি কে কাছে পাওয়া যাচ্ছে না, তবে এটা ভেবে মন খুশিতে ভরে গেল যে কাল মা আর পরীর সাথে কেনাকাটা করতে বের হবে।
হ্যাঁ, পাশে হয়ত হাঁটতে পারবে না বাঁ জড়িয়ে ধরতে পারবে না, কিন্তু চোখের সামনে ত থাকবে পরী। পরীর গায়ের ঘ্রান কতদিন বুকের মধ্যে নিতে পারেনি, টেবলের ড্রয়ার থেকে রুমাল বের করে মুখের ওপরে মেলে ধরে অভি, গায়ের গন্ধ কিছু যেন এখন লেগে আছে রুমালে। এত কাছে পরী তবুও এত দুরে পরী, হাতের নাগালের বাইরে।
এমন সময়ে অভির অরুন্ধুতির কথা মনে পরে যায়, পরীকে জানান হয় নি অরুন্ধুতির ব্যাপারে। মনে ভেতরে একটা সংশয় জেগে ওঠে, অরুনার কথা শুনলে পরী কি ভাবে গ্রহন করবে অরুনাকে। অরুনা এই পৃথিবীতে ওর একমাত্র বন্ধু। পরীর কাছে থেকে অরুনাকে লুকিয়ে রাখা মস্ত বড় ভুল হবে, পরীকে জানাতে হবে অরুনার কথা কিন্তু সাবধানে।
দরজায় খুব মৃদু আওয়াজ হয়, হাওয়ায় মনে হয়, বাইরে বেশ মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ঠিক তারপরে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকাল অভি। ওর চোখের সামনে পরীর হাসি মুখ, কখন যে চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি। দু’কাঁধের ওপর দিয়ে হাত গলিয়ে বুকের ওপরে হাত রাখল পরী। মাথা পেছনে হেলিয়ে দিল অভি, পরী ওর কপালে চিবুক রেখে আবার একটা ছোট্ট চুমু খেল কপালে। পেছনে হাত বাড়িয়ে পরীর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেয়, ঘাড়ের ওপরে পরীর বুকের উষ্ণতা অনুভব করে।
পরী মৃদুকনে বলে, “আমার ছোট্ট রাজকুমার কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে?”
অভি, “হ্যাঁ সোনা, তা তোমার এত দেরি কেন হোলো?”
পরী, “তুমি তো বললে…”
অভি, “তোমার ছোটো মা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
পরী, “হ্যাঁ বাবা অনেক আগে ঘুমিয়ে পড়েছে।”
অভি, “তাহলে এত দেরি কেন?”
পরী, “সুব্রত আর মৈথিলী জেগে ছিল তাই।”
অভি, “ওরা দুজনে কেন জেগেছিল সেটা তো বেশ জানো আর তুমি কি করছিলে তাহলে?”
পরীর গাল লাল হয়ে ওঠে, “ধ্যাত বাবা, ওরা কেন জেগেছিল সেটা যেন তুমি জানো না।”
পরী বুকের ওপরে আলতো করে চাঁটি মেরে বলে।
অভি পরীর কোমল নিতম্বের ওপরে হাত চেপে ধরে আর মৃদু মৃদু চাপ দেয়, কোমল নারী মাংসে। মাঝে মাঝে হাতের চাপ বেশ শক্ত হয়ে ওঠে, নখের আঁচর কাটে কোমল গোলকে। পরী ওর কোমল শরীরে অভির নখের আঁচরের স্পর্শ পেয়ে অভির বুকে হাত চেপে ধরে।
অভি পরীকে উত্যক্ত করার জন্য বলে, “ওদের কথা মনে মনে ভেবে তুমি কি করছিলে শুনি? তোমার গাল লাল হয়ে যায়নি ওদের আওয়াজ শুনে, দুষ্টু মেয়ে।”
পরী, “না বাবা ওরা যা আওয়াজ করছিল, আমি শেষ পর্যন্ত টি.ভি র আওয়াজ জোরে করে দেই।”
অভি, “মিথ্যে বোলোনা সোনা, তুমিও ওই আওয়াজ গুলো বেশ উপভোগ করছিলে তাই না।”
পরী লজ্জায় লাল হয়ে যায়, লজ্জা ঢাকার জন্য নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। পরীর নরম পেছনে অভির হাত যেন থেমে থাকতে পারে না বারে বারে মুঠি মুঠি শরীরের অংশ নিয়ে হাত দিয়ে চাপে। হাতের তালুর নিচে অভি অনুভব করল যে পরীর গায়ের কাপড়ের নিচে কিছু নেই, সেটা ভেবেই মাথার মধ্যে কামনার আগুন চাগিয়ে উঠল অভির।
অভি মৃদু কন্ঠে পরীকে বলে, “ভেরি সরি সোনা আজ আমি তোমার সাথে সিনেমা দেখতে যেতে পারিনি।”
পরী, “সেটা ঠিক আছে, তার জন্য ত আমি রাগ করিনি। তোমার পরীক্ষা কাছে আসছে তোমার ভাল করে পড়াশুনা করা উচিত। দেখ আড়াইটে বেজে গেছে এবারে শুয়ে পরো।”
অভি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ওকে বাহুপাশে বেঁধে ফেলে। পরী ওদের দুজনের শরীরের মাঝে হাত এনে অভির বুকের ওপরে হাত রাখে, মুখ উঁচু করে অভির মুখের দিকে তাকায়। মাথা নিচু করে অভি আলতো করে পরীর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
কানে কানে বলে, “রাতে আমার সাথে এখানে শুয়ে পর।”
পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে ওর কপাল ছুঁতে যায় পরী। কল্পালে ঠোঁট দিয়ে চুমু খাবার পরে অভির ঠোঁটের ওপরে গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে, “না সোনা, তুমি আমার কোলে মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে পরো, আমি তোমার চুলে বিলি কেটে দেই, দেখবে খুব আরাম লাগবে।”
পরী হাঁটু গেড়ে বিছানার ওপরে বসে পরে, অভি ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। পরী খুব আদরে অভির চুলে বিলি কেটে দেয়। অভি ওর কোমর জড়িয়ে ধরে থাকে। দু’জনের বুকের ভেতর এক অনাবিল প্রেমের আলো বিছুরিত হয়, সেই প্রেমে কোন কামনার লেশ নেই, বাসনার লেশ নেই, এ যেন এক সুন্দর ধবধবে সাদা প্রেমের বন্ধন।
অভি, “পরী…”
পরী, “হুম বল।”
অভি, “সুব্রত আর মৈথিলী আমার সাথে অরুনিমার সম্পর্ক তৈরি করার জন্য উঠে পরে লেগেছে।”
পরী, “আমি জানি অভি, আর এও জানি সেই জন্য তুমি আজ ওদের বাড়ি যাচ্ছ না। তোমার ওপরে যে আমার অগাধ বিশ্বাস আছে অভি।”
অভি আজ বিকেলের কথা সব পরীকে জানাল, সুব্রত ওকে কি বলেছে, মৈথিলী ওর দিকে কেমন করে তাকিয়েছিল আর যা যা কিছু ঘটেছে সব কিছু পরীকে বলে দিল। পরী ওর কথা শুনে মিষ্টি হেসে জানিয়ে দিল যে ওর নিজের হৃদয়ের ওপরে মানে অভির ওপরে অগাধ বিশ্বাস যে অভি ওকে ছেড়ে কোনদিন যাবে না। কিন্তু সুব্রতর কথা শুনে মনে একটু সংশয় জেগে উঠলো পরীর, “আমি ত ঘুণাক্ষরে ও ওদের মতলব বুঝতে পারছিনা অভি, যাই হক দেখা যাক কি করতে চায় ওরা।”
পরী ওর দিকে একটু ঝুঁকে এল, অভি নাকের ওপরে নাক ঘষে বলল, “তুমি সত্যি অনেক সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী, পরী।”
পরী, “আমি না তোমার চেয়ে দু বছরের বড়, তাই ত তোমার চেয়ে আমার মাথায় কিছুটা বেশি বুদ্ধি আছে।”
অভি ভাবল এবারে ওকে অরুনার কথা জানানো যেতে পারে, “পরী, আমি তোমাকে একটা সত্যি কথা বলতে চাই। আমি আজ প্রাক্টিকাল ক্লাস করিনি।”
আঁতকে ওঠে পরী, “মানে? কি করেছ তাহলে?”
অভি একটু চিন্তায় পরে যায়, তারপরে বলে, “আজ আমি আমার সব থেকে ভাল বান্ধবীর সাথে ছিলাম, তার নাম অরুন্ধতি ব্যানারজি।”
পরীর হাত থেমে যায়, চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে ফেলে পরী। বুকের মধ্যে হটাত করে কেউ যেন বাড়ি মেরে দিয়েছে। অভির কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য বুক দুরুদুরু করে কেঁপে ওঠে, কি বলতে চাইছে অভি? হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে অভির মুখের দিকে। অভি ওর চোখের চাহনি দেখে পরীর মনে ভাব বুঝতে পারে। পরীর মনের ভেতরে এক উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পরে যেন, “কি করে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ভাল বন্ধু হতে পারে? না সেটা ঠিক নয়, অভি কেন বলেনি আগে, কেন আমাকে এত বড় একটা ভ্রান্তিতে ডুবিয়ে রেখেছে?”
মাথা নাড়াল অভি, “কি দেখছ ওই রকম ভাবে আমার দিকে?”
পরী কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “তুমি ত কোনদিন আমাকে জানাও নি যে তোমার কোন ভালো বান্ধবী আছে মানে গার্লফ্রেন্ড।”
অভি, “না পরী না, তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ।” মাথা নাড়ে অভি, “অনেক বড় গল্প পরী, কিন্তু আজ তোমাকে আমি সেই গল্প বলব।”
অভি ওর জীবন কাহিনী পরীর সামনে মেলে ধরে। মায়ের কথা, বাবার কথা, সবসময়ে ওর ওপরে বাবা মায়ের চাপ, যেন পয়সাই সব। ভালবাসা কি ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারেনি অভি। ছোটো বেলায় চাকরদের কাছে আর তারপরে হস্টেলে জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হয়েছে। পরাশুনায় ভাল ছিল অভি, তাঁর সাথে সাথে ভাল আঁকত। মনে খুব ইচ্ছে ছিল যে বড় হয়ে খুব বড় এক চিত্রকর হয়। বাবা মাকে জানিয়েছিল মনের অভিপ্রায়, কিন্তু না তাদের কথা, যে ওদের পরিবারের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, এমত অবস্থায় অভি যদি সামান্য এক চিত্রকর হয় তাহলে কি করে সবাই কে মুখ দেখাবে বাবা মা।
মা স্কুলের শিক্ষিকা, বাবা এয়ারপোর্ট অথরিটির বড় ম্যানেজার, এই অবস্থায় অভি কিছুতেই চিত্রকর হতে পারে না। এত পয়সা খরচ করে ওর বাবা মা ওকে সব থেকে ভাল স্কুলে পড়িয়েছে আর অভি যখন ভাল ফল আনতে পেরেছে তাহলে ওকে বিজ্ঞান নিয়েই পড়তে হবে। উচ্চমাধ্যমিকেও ওকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হল শেষ পর্যন্ত। পরী চুপ করে অভির কথা শোনে, কাহিনী বলতে বলতে অভির চোখের কোল যেন একটু চিকচিক করে আসে। ভেতরটা যেন ককিয়ে ওঠে বেদনায়। পরী আলতো করে অভির কপালে হাত বুলিয়ে দেয়, ওর কথা শুনে পরীর চোখের কোলেও জল চলে আসে।
কম্পিত স্বরে বলে, “আমি এ সব জানি, ছোটো মা আজ আমাকে তোমার কথা বলছিল।”
অভি চমকে ওঠে, “কি? মা তোমাকে এই সব কথা বলেছে?”
পরী, “হ্যাঁ সোনা। ছোটো মা তোমাকে বড় করার জন্য যা করেছে সেই সব বলেছে আর তুমি ছোটো মায়ের কথা একদম শোনো না তাই বলেছে। নদীর সবসময়ে দু’ধার দেখা উচিত না হলে নদীর কথা বোঝা দায় হয়ে ওঠে, তাই না। এখন বুঝেছি আমি তোমার কষ্ট, আমি ছোটো মা কে বুঝিয়ে বলব খানে। দেখ সোনা, মনের ঘা এমন ঘা যে ঠিক ত হয়ে যায় সময়ের সাথে কিন্তু একটা কাটা দাগ চিরদিনের জন্য রেখাপাত করে রেখে যায়। আমি আপ্রান চেষ্টা করব তোমার সেই দাগ মুছে দেবার জন্য।”
চোখের কোল মুছে অভি কে জিজ্ঞেস করে, “এবারে বল ত যা আমি জানি না। কে এই অরুন্ধতি ব্যানারজি?”
অভি ওর কলেজের গল্প বলতে শুরু করে, অনুশুয়ার কথা তারপরে পুবালির কথা। সবশেষে অরুনার কথা। সব কিছু শুনে পরী একটু ঝুঁকে অভির কপালে মিষ্টি করে একটি চুমু খেয়ে বলে, “তোমার দেবী, অরুনার সাথে কবে দেখা করাচ্ছ?”
অভি মৃদু হেসে বলে, “অরুনাও তোমার সাথে দেখা করতে চায়।”
ওর হাতদুটি বুকের ওপরে চেপে ধরে অভি।
পরী ঘড়ির দিকে দেখে চমকে ওঠে, “আরে সাড়ে চারটে বাজে যে।”
অভি ওর হাত টেনে বলে, “পরী, এই তোমার অভিমন্যু, তোমার সামনে খোলা বইয়ের মতন রাখা।”
পরী অভির মাথার নিচে একটা বালিস টেনে দিয়ে ওর পাশে বসে। নরম হাতে অভির গালের ওপরের জলের দাগ মুছে দেয়। আস্তে করে চোখ থেকে চশমা খুলে ভাঁজ করে মাথার পেছনে রাখে।
আলতো করে গালে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “অতীত কখন ভুলতে নেই অভি, অতীত আমাদের ভবিষ্যতের সিঁড়ি, অতীত আমাদের অনেক কিছু শেখায়। জীবন একটি চক্রের মতন অভি, কোন একসময়ে হয়ত আমাদের অতীত আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারে, তখন আমরা দু’জনে মিলে এক সাথে তার সামনা করব। এখন একটু বিশ্রাম করও ছোট্ট সোনা, আজকে আবার শপিঙয়ে বের হতে হবে তাই না।”
অভির মাথা বুক একদম খালি হয়ে আসে, কে এই নারী? কে এই পরী, “তুমি কে?”
গলা ধরে আসে অভির।
পরী ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে পরে, কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে উত্তর দেয়, “আমি তোমার পরী, বুদ্ধিতে তোমার মন্ত্রি, সুন্দরী আর ধনে আমি লক্ষ্মী, আমি ধরিত্রি তোমাকে বোঝার জন্য আর আমি তোমার মা তোমাকে ভালবাসা আর স্নেহে ভরিয়ে তোলার জন্য, শয়নে আমি রম্ভা আর মেনকা, আমি তোমার পরী।”
পরী ওর খোলা চোখের ওপরে আঙ্গুল রেখে চোখের পাতা বন্ধ করে দেয়। মিষ্টি গলায় বলে, “শুয়ে পরো ছোট্ট রাজকুমার আমার।”