কবির চেয়ার টেনে বসে আক্কাস কে বলল,
— ওর কাছে জিজ্ঞেস কর, সাফওয়ান কে? সাফওয়ান কে ও কিভাবে চেনে, আর ওর সাথে তার কি সম্পর্ক?
আক্কাস কবিরের কথা টা ট্রান্সলেট করে অবু কে বলল। অবু উত্তরে কিছুই বলল না, দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে পড়ে রইলো। কবির কিছুক্ষণ চুপ করে অবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের আশায়। তারপর আবার আক্কাস কে দিয়ে তাগিদ দিলো অবু কে কথা বলার জন্য।
অবু ওইভাবে বসে বসে চোখ বুজে রেখে নিজের সাথেই বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকলো,
— আজ এতকাল এত জায়গাতে গেলাম, কেউ আমার টিকি টাও খুজে পেলো না। আর ওই বিষধর টা বাংলাদেশে আসতে না আসতেই আমাকে ধরে ফেললো! শয়তান টা তো আমাজনেই ছিলো! দেশে কবে এলো! এলো তো এলোই! আমাকেও ডুবিয়ে দিয়ে গেলো!
আক্কাস অবুর কথা গুলো খেয়াল করে শুনে সেগুলো কবির কে ট্রান্সলেট করে বলল। কবির কোনো কথা বলল না। ওদের কে ওভাবে রেখেই পুলিশ সুপারের কাছে চলে গেলো ও৷
পুলিশ সুপার নিজের কেবিনে কাজ করছিলেন, আর তখনই সেখানে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো কবির, তারপর পুলিশ সুপার কে কোনো কথা বলতে না দিয়েই সে বলে উঠলো,
— স্যার, জংলি টা সাফওয়ান আহমেদের ব্যাপারে কিছু একটা বলছে, আপনি একটু আসুন, এসে একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমার মনে হয় সাফওয়ান আহমেদের সাথে এই কেসের কোথাও না কোথাও ওকটা কানেকশন আছে। ইশতিয়াক আহমেদ দের ওই কেস গুলো তো আপনিই হ্যান্ডেল করেছিলেন, তাই আপনিই ভালো বুঝবেন ব্যাপার টা কি!
পুলিশ সুপার সাফওয়ান আহমেদ নাম টা শোনা মাত্রই চমকালো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,
— কি বলেছে ওই বুড়োটা সাফওয়ানের ব্যাপারে?
কবির অবুর বলা কথা টা হুবহু বলল পুলিশ সুপার কে। পুলিশ সুপার কথা টা শুনেই দাঁড়িয়ে পড়লো। সাফওয়ান আহমেদ বেচে থাকতে পারে, আবার বাংলাদেশেও আসতে পারে এ খবর টা শোনা মাত্রই তার চোখ মুখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সে প্রস্তুতি নিলো কবিরের সাথে সেলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তখনি থানার বাইরে হইচই শুনলো সে।
কি হচ্ছে দেখার জন্য পুলিশ সুপার আর কবির দুজনেই কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো। তখনই একজন কনস্টেবল এসে পুলিশ সুপারের সামিনে দাঁড়িয়ে বলল,
— স্যার, সাংবাদিক রা এসে ভিড় জমিয়েছে থানার সামনে। কেউ এই জংলি গুলোকে ধরার খবর ফাঁস করে দিয়েছে ওদের কাছে। সাংবাদিক গুলো এই খবর শুনেই চলে এসেছে।
পুলিশ সুপার রাগের চোটে হাত মুষ্ঠি করে ধরলেন। কবির অবাক গলায় বলে উঠলো,
— কিন্তু এ খবর কে বাইরে বলবে স্যার! আমরা তো হাতে গোনা কয়েকজন জানি ওদের সম্পর্কে, আর যারা যারা জানি তারা সবাই আমাদের বিশ্বস্ত! তাহলে এ খবর বাইরে লিক করলো কে!
পুলিশ সুপার কিছুক্ষণ নিরব থেকে কবিরের দিকে ফিরে উত্তর দিলেন,
— আমাদের সাথে একজন ট্রেইটর আছে কবির, যে আমাদের সব গোপন তথ্য বাইরে পাঁচার করে দেয় অর্থের লোভে। এর আগেও বহুবার সে এই কাজ করেছে, এমনকি সাফওয়ান আহমেদ কে হারিয়ে ফেলার পেছনেও সে-ই দ্বায়ী। এই ট্রেইটর টা আসলে কে সেটা আমাদের খুজে বের করতে হবে খুব দ্রুতই। তারপর তার উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, তবেই আমি শান্তি পাবো।
কথা গুলো বলেই পুলিশ সুপার সাংবাদিক দের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বাইরে চলে গেলো। কবির ও গেলো তার পেছন পেছন।
পুলিশ সুপার বাইরে বের হতেই সাংবাদিক রা জেকে ধরলো তাকে, কনস্টেবল গুলো কড়া গার্ড দিয়ে সাংবাদিক দের কে আটকে রইলো। ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন সাংবাদিক পুলিশ সুপার কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুড়ল
— স্যার, আপনারা অপরাধী দের কে ধরেছেন, কিন্তু কাউকে কিছু জাননি কেন?
অন্য একজন প্রশ্ন করলো,
— স্যার, আমরা জেনেছি অপরাধী রা সংখ্যায় অনেক, আপনারা কি সবাইকে ধরতে পেরেছেন? আপনাদের ভেতরে কি গোলাগুলি হয়েছে?
তার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই অন্য আর একজন প্রশ্ন ছুড়লেন,
— আমরা শুনেছি অপরাধীরা নাকি নরখাদক! বিষয় টা কতটুকু সত্যি? আর যদি সেটা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তো অপরাধী দের একজনকেও বাইরে রাখা জনগনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
সাংবাদিক দের প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে উঠলো পুলিশ সুপার। এত গুলো প্রশ্ন একসাথে শুনে তিনি কি করবেন বুঝতে পারলেন না। ওনার মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা গেলো। এদিক ওদিক অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কার প্রশ্নের উত্তর আগে দিবেন সেটা হিসেব করতে লাগলেন মনে মনে। কিন্তু কবির এসে তাকে এই সিচুয়েশন থেকে উদ্ধার করলো। পুলিশ সুপারের পেছন থেকে হেটে সামনে এগিয়ে এলো সে৷ এসেই সাংবাদিক দেরকে নিরব হতে বলে সে বলল,
— আমরা এখনো এই কেসের বিষয়ে পুরোটা উদঘাটন করতে পারিনি। অপরাধিরা সবাই আমাদের আন্ডারেই আছে, জীবিত বা মৃত। পুরোপুরি ইনভেস্টিগেট করে, তাদের থেকে অজানা তথ্য গুলো জেনে আমরা আপনাদের কে জানাবো, আর সেটা রাতের ভেতরেই ইন শা আল্লাহ। ততক্ষণ আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন, আর রঙ চং মাখিয়ে ভুয়া নিউজ ছড়াতে বিরত থাকুন। ধন্যবাদ৷
বলেই পুলিশ সুপার কে নিয়ে কবির আবার ভেতরে চলে গেলো। সাংবাদিক গুলো মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে রইলো, আর নিজেদের ভেতর ফাসুর ফুসুর করতে থাকলো। ওদের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে একজন কনস্টেবল তাদের কে বলল,
— শুনতে পাননি রাতের ভেতরে আপনাদের কে জানানো হবে? তাহলে এখনো খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? নিজেদের কাজে যান৷
সাংবাদিক গুলো কনস্টেবল টাকে কিছুক্ষণ চোখ গরম দিয়ে চলে গেলো এদিক সেদিক।
কবির পুলিশ সুপার কে নিয়ে সোজা গেল অবু আর আক্কাস কে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে৷ সেলে ঢোকার আগে কবির নিজের ফোন বের করলো, তারপর পুলিশ সুপারের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
— স্যার আপনাকে না জানিয়েই আমি একটা কাজ করে ফেলেছি। আফতাবের দেখার সুবিধার্থে আমি আমার এক ফ্রেন্ড কে দিয়ে সাদ্দাত হুসেইন সহ ইশতিয়াক আহমেদের পরিবারের বেশ কয়েক জনের ফটোশ্যুট করিয়ে এনেছি। ফটো আমার কাছে চলে এসেছে। এখন আপনি অনুমতি দিলে আফতাব কে একবার দেখাবো।
পুলিশ সুপার পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসতে বসতে নিজেও ছবি গুলো দেখতে চাইলেন। কবির ফোন টা তার হাতে ধরিয়ে দিলে খুব মনোযোগের সহিত সাদ্দাত হুসেইন নামের লোকটিকে দেখলেন তিনি। তারপর স্বগোতক্তি করলেন,
— ছেলেটা সত্যিই সুদর্শন!
এরপর আবার কবির কে বললেন,
— হ্যা ওকে দেখাও, এখানেই ডাকো, আমিও শুনতে চাই ও কি বলে।
কবির একজন কনস্টেবল কে দিয়ে আফতাব হোসেন কে ডেকে পাঠালো। আফতাব হোসেন এসে পৌছালে কবির তাকে নিজের ফোনে থাকা ছবি গুলো দেখিয়ে বলল,
— আফতাব সাহেব, দেখুন তো সেদিন রাতে যে লোকটা আপনাদের কে নরখাদক গুলোর হাত থেকে রক্ষা করেছিলো ইনি সেই ব্যাক্তি কিনা!
আফতাব হোসেন ভালো করে খেয়াল করলো ছবিটা। তারপর বলল,
— জ্বি স্যার, সেরকমই তো লাগছে। ওই লোকটার চুল ও এই লোকটার মতো এমন ওপরের দিকে দেওয়া ছিলো আর কয়েক টা চুল কপালের ওপর এসে পড়েছিলো। মুখ টাও কিছুটা এমনই ছিলো হয়তো। আমার সঠিক মনে নেই। তবে এরকমই কিছুটা। ইনি তিনি হতেও পারেন।
আফতাব হোসেনের খাপছাড়া উত্তর মনোঃপুত হলো না কবিরের। সে আফতাব হোসেন কে যেতে বলল। তারপর পুলিশ সুপার কে বলল,
— আফতাব হোসেন কে দিয়ে কিছু হবে না। সে চোখের মাথা খেয়ে বসে আছে। আপনি চলুন, ওই অবু না গোবু তার থেকে কোনো তথ্য বের করতে পারি কিনা। সে কি কি জানে সব শুনতে হবে, আর আমার আপনার মনে যে সন্দেহ টা বর্তমানে প্রকট হয়ে আছে সেটাই সত্যি কিনা সেটা নিশ্চিত হতে হবে।
১০৩. বিকেল বেলা ড্রইংরুমে সোফায় বসে সবাই টিভি দেখছিলো। সাদমান আর শাহমীর, রাদিফ আর রুহানির সাথে এক জোট হয়ে বসে আছে কার্টুন দেখবে তাই৷ কিন্তু শামসুল এখন নিউজ দেখবেন বলে রিমোট দিচ্ছেন না বাচ্চা দের কাছে। কোনো রকমে ওদের কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বসিয়ে রাখছেন যেন নিউজ টা অন্তত দেখতে পারেন।
অগত্যা সাদমান আর শাহমীর নানুর কথা মেনে নিয়ে চুপ হয়ে বসলো সোফাতে৷ ওদের চুপ হয়ে বসে যেতে দেখে রাদিফ আর রুহানিও দমে গেলো। ওরা দুজনও গিয়ে বসলো ওদের পাশে। শামসুল নিউজ অন করলেন। কিছুক্ষণ খবর পাঠ করার পর এবার সংবাদ পাঠক বললেন,
— অবশেষে ধরা পড়লো মানুষ গুম করা র্যাকেট টি। গত পরশু রাতে খুলনা বিভাগের মেহেরপুর জেলার একটি জঙ্গল থেকে গ্রুপ টিকে বেশ কিছু ভিকটিম সহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শোনা গেছে ওই র্যাকেট টি নরখাদক দের একটা গ্রুপ ছিলো, এবং আজ পর্যন্ত গুম হওয়া সকল মানুষ কে দিয়ে তারা নিজেদের উদরপূর্তি করেছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছুই জানায়নি যশোর পুলিশ বিভাগ। তবে খুব শিগ্রই বিস্তারিত জানিয়ে ব্রিফিং দিবেন বলে জানিয়েছেন যশোর থানার পুলিশ সুপার।
খবর টা শুনে চক্ষু ছানা বড়া হয়ে গেলো সবার। শামসুল আতকে উঠলেন, বললেন,
— কি সর্বনাশের কথা! নরখাদক! সেটাও আবার আমাদের আশেপাশেই! আর আমরা কিছুই জানতাম না! বাচ্চা আছে বাড়িতে দুইটা, যদি তাদের কিছু হতো! আল্লাহ বড় বিপদ থেকে বাচিয়েছেন।
তার কথায় সায় জানালো সবাই। রাফসান বলল,
— দিন কাল এখন ভালো না বাবা! কখন কার কি হবে কিছুই বলা যায় না। এখন সবকিছুর ওপর কড়া নজর রাখতে হবে, বিশেষ করে বাচ্চাদের ওপর। এতদিন আমরা শুধু সতর্ক হয়ে ছিলাম গুম হওয়ার খবর শুনে, কিন্তু যারা গুম হয়েছে তারা আর কখনো ফিরে আসবে না, এমনকি তাদের লাশ ও পাওয়া যাবে না! এর থেকে মর্মান্তিক আর কিছু হয়!
ছেলের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শামসুল। সাফওয়ান আর রুমাইশা একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা বলে নিলো। ভাগ্যিস সেদিন ওরা টের পেয়েছিলো, নইলে আরও কত নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ যেতো ওদের হাতে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সবার এমন নিরবতা দেখে শাফিন বলে উঠলো,
— মানুষের মনে এখন আর কোনো দয়া মায়া নেই। মানুষ হয়ে কিভাবে পারে অন্য একটা মানুষ কে কেটে কেটে রান্না করে খেতে! ওদের কি একটুও দয়া মায়া লাগে না! আর এই খবর শোনার পর তো কেউ আর বেরই হতে চাইবে না ভয়ে। কে শিউরিটি দিবে যে আর কোনো নরখাদক আমাদের আশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে না! কার ভরসায় মানুষ রাস্তায় নামবে! আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।
শাফিনের কথায় সম্মতি জানিয়ে আমিন বলে উঠলো সবাই। তারপর আবার নিরব হয়ে গেলো প্রত্যেকে। বাচ্চা গুলোও এই খবর শুমে কেমন যেন মিইয়ে গেলো। কয়েক মিনিট আগের সেই দুরন্তপনা উবে গেলো ওদের। বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো সাদমান আর শাহমীর। সাফওয়ান ওদের কে দু হাতে নিজের কোলে তুলে নিয়ে পায়ের ওপর বসিয়ে দিলো। রাশা আয়েশার কোলে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বসে বসে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে সবাইকে।
নিরবতা ভেঙে সাফওয়ান শাফিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
— আমাদের এখন বেরোতে হবে শাফিন, বিকাল পড়ে গিয়েছে। আরও দেরি করলে তখন সন্ধ্যা নেমে যাবে। এই পরিস্থিতি তে বাইরে থাকা কারোরই ঠিক হবে না।
শাফিন ভাইয়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে সানিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
— তুমি আর আপু গিয়ে গুছিয়ে নাও সানি, আমরা সকাল সকাল বের হই।
আয়েশা ওদের কথায় সহমত পোষণ করে বললেন,
— হ্যা, সেই ভালো হবে। যা অবস্থা দেখছি তাতে এখন তো দিনের বেলাতে বের হতেও ভয় লাগবে। বাচ্চা দের কে নিয়েই সব থেকে বেশি চিন্তা! বাচ্চা দুটো স্কুলে যায় রোজ, আফসানা গিয়ে দিয়ে আসে আবার নিয়ে আসে যদিও, কিন্তু ওইরকম যদি কখনো হয় তখন কি হবে ভাবতে পারছো! আল্লাহ আমাদের ওপর রহম করুন।
আয়েশার কথাতে সাফওয়ান বলে উঠলো,
— এখন থেকে সাবধানে থাকবেন মামি, চোখ কান খোলা রাখবেন সর্বদা। মামার বয়স হয়েছে, তার এখন আর আগের মতো শক্তি নেই। রাফসান ছেলে মানুষ, তার সবসময় বাইরে বাইরে থাকা লাগে, বাড়িতে আপনারা দুজন মেয়ে, আর বাচ্চা। বাড়ির গেট গুলো সবসময় দিয়ে রাখবেন। আর রাতের বেলা পুরোপুরি গেইট লক করার আগে ভালোভাবে চারপাশ টা দেখে নিবেন। পিশাচ গুলো ধরা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু সাবধানের মার নেই।
আয়েশা সাফওয়ানের কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আর এরপর সাফওয়ান শাফিন দুজনেই চলে গেলো রেডি হতে। এখন বের না হলে রাত নেমে যাবে।
বিকেল পাঁচ টা নাগাত ওরা বেরিয়ে পড়লো সবাই। সাদমান আর শাহমীর কে এবার সাফওয়ান নিজের সাথেই নিলো। আর শাফিন আর সানিয়া কে নিজেদের মতো ছেড়ে দিলো।
১০৪. নিজের কেবিনে থমথমে মুখে বসে আছে পুলিশ সুপার। তার সামনের টেবিলের বিপরীত পার্শ্বে বসে আছে কবির। দুজনেই চিন্তিত, দুজনেই নিরব। ওরা খানিক্ষন পূর্বে যেটা জেনেছে সেটা আসলে ভালো সংবাদ নাকি খারাপ সংবাদ সেটা ঠাহর করতে পারছে না দুজনের কেউই।
নিরবতা ভেঙে পুলিশ সুপার মুখ খুললেন, বললেন,
— কবির, সাফওয়ানের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই যে ও একজন মার্ডারার। কোনো প্রমান নেই, নট ইভেন অ্যা সিঙ্গেল ওয়ান! শুধুমাত্র ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের লোক গুলোই জানে এর সত্যতা। আজ পর্যন্ত সাফওয়ানের বিরুদ্ধে কোনো পুলিশ কেস হয়নি। একটাও না। কেউ সন্দেহবসতও তার সম্পর্কে কিছুই বলেনি। কিন্তু আমাদের ভেতরকার কোনো এক ডগের বাচ্চার জন্য বেচারা নিজের দেশ, পরিবার, আত্মীয় স্বজন সবই হারালো!
কবির কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুলিশ সুপার কে বলল,
— তাহলে এখন কি করবেন? সাফওয়ান কে সামনে আনবেন? এই পুরো মিশনটার কৃতিত্ব একমাত্র তার। দেশবাসীর জানা উচিত যে যাকে তারা একদিন মিথ্যা অপবাদের জের ধরে দেশছাড়া করেছিলো, আজ সেই-ই তাদের কে এই বিশাল নরখাদক গোষ্ঠীর হাত থেকে বাচিয়েছে! সে লোকটা আমাজনের ওই স্যাতস্যাতে পরিবেশে কতগুলো বছরই না কাটিয়ে দিলো, বউ বাচ্চা নিয়ে! নিজের নাম, পরিচয় সবকিছুই পরিবর্তন করলো বেচে থাকার তাগিতে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন! এতকিছুর পর ও সে হাল ছাড়েনি। সবকিছুকে পেছনে ফেলে সে ঠিকই ওপরে উঠে গেছে, নিজের বিজনেস দাড় করিয়েছে, নিজস্ব কোম্পানি খুলেছে। আমার ফোনে ওদের গাড়ির ছবিটা দেখেছেন নিশ্চয়! ল্যামবরগিনি! কেউই তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, সে তার লক্ষ্যে ঠিকই পৌছে গেল, বাই হুক অর বাই ক্রুক! সে কি করেছে সেটা কেউ এখন আর দেখতে যাবে না৷ সে যে একজন সফল ব্যাক্তি সেটাই এখন মুখ্য বিষয়।
পুলিশ সুপার কবিরের কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালেন। তারপর বললেন,
— আমাদের প্রেসে খবর দেওয়া দরকার। নরখাদকদের বিষয়টা আর সাফওয়ান আহমেদ ওরফে সাদ্দাত হুসেইনের পরিচিয় টাও সবার সামনে খোলাসা করা উচিত। লোকটাকে নিজের পরিচয়ে বেচে থাকার অধিকার দেওয়া উচিত। যে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এত গুলো মানুষের প্রাণ বাচিয়ে দিলো তার জন্য এইটুকু না করতে পারলে এই পোশাকের কোনো মূল্য নেই কবির। তবে প্রেস ডাকার আগে আমাদের কে স্বয়ং সাফওয়ান আহমেদের সাথেই আগে কথা বলে নিতে হবে। তুমি কি বলো?
কবিরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন পুলিশ সুপার। কবির তার কথায় সম্মতি জানিতে উত্তির দিলো,
— আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। তার সাথে আমাদের কথা বলা উচিত, এবং এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা উচিত। সে যদি বলে তার পরিচয় রিভিল করে দিয়ে তাকে স্বাভাবিক ভাবে পরিবার পরিজন দের সাথে একসাথে বেচে থাকার সুযোগ করে দিতে, তবে আমরা সেটাই করবো, আর যদি সে না চায়, তবে আমরা তার ব্যাপার টা সম্পুর্ন চেপে গিয়ে নিজেদের মতো করে নরখাদক গোষ্ঠী টার ব্রিফিং দেবো।
কবিরের কথা শুনে পুলিশ সুপার বলে উঠলেন,
— তাহকে চলো যাওয়া যাক। সাফওয়ান আহমেদের সাথে আমাদের মিটিং টা আমরা সেরে আসি।
বলেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন পুলিশ সুপার। আর সে উঠে দাড়াতেই কবির হোসেন ও উঠে দাড়ালো।
.
রাতের খাবারের পর হলরুমে সোফায় বসে গল্প করছিলো সবাই। বাড়িতে এখন শুধু ওরা পরিবারের লোকজন গুলো ছাড়া আর কেউই নেই। হেল্পিং হ্যান্ড ও নিজের কাজ শেষ করে বাড়িতে চলে গেছে। রাশা রুনিয়ার কোলে ঘুমাচ্ছে, সাদমান আর শাহমীর সানিয়ার সাথে খুনশুটি করছে। ইশতিয়াক আহমেদ নিজের রুমেই আছেন। ঘুম আসছে তার, তাই সকাল সকাল ঘুমাতে গেছেন তিনি।
শাফিন রুমাইশা আর সাফওয়ান, তিন জন মিলে গল্প করছে। আগের সেই দিন গুলোর মতোই হাসি তামাশায় মেতে উঠেছে ওরা। রুমাইশা আর সাফওয়ানের বিয়ের পূর্ববর্তী দিন গুলো নিয়ে এখন আলোচনা চলছে, সাফওয়ান কবে কি করেছে, রুমাইশা কে নিয়ে কোথায় কোথায় গিয়েছে, রুমাইশা দের বাড়িতে কবে কবে গিয়েছে আর কি কি করেছে এসব নিয়েই ডিসকাশন চলছে। স্মৃতিচারণ করতে করতে নিজেদের ছোটবেলায় ফিরে গেছে ওরা। সেই দিন গুলোকে আবারও একবার ছুয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মেতে আছে ওরা তিনজন৷
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো বাইরের। চমকে তাকালো সবাই সেদিকে। এত রাতে তো কারোরই আসার কথা না। তাহলে কে এলো এই অসময়ে! সানিয়া উঠে দেখতে যাচ্ছিলো, কিন্তু শাফিন থামিয়ে দিলো ওকে। তারপর নিযে গিয়েই দরজা খুলল ও, আর খুলেই দেখতে পেলো দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। দুজনের ভেতর একজন প্রৌঢ়, অন্যজন তরুন।
শাফিন এদের কে আগে কখনো দেখেছে বলে ওর মনে পড়ে না। সন্দেহ পূর্ণ দৃষ্টিতে লোক গুলোর দিকে তাকিয়ে ও জিজ্ঞেস করলো,
— জ্বি, আপনারা কারা? আর কাকে চান?
লোক দুটির ভেতরের প্রৌঢ় জন উত্তর দিলো,
— সাদ্দাত হুসেইনের সাথে দেখা করতে এসেছি আমরা। ব্যাপার টা খুব জরুরি।
শাফিন ভ্রু কুচকে তাকালো ওদের দিকে, তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো,
— পরিচয় দিন আপনাদের, আপনারা কারা? কোথা থেকে এসেছেন? আর আপনাদের পেশা কি?
শফিন কে দরজায় দাড়িয়ে কথা বলতে দেখে সাফওয়ান এগিয়ে গেলো সেখানে। সাফওয়ান কে দেখে লোক দুজন যেন খুশি হলো অনেক। তারপর সাফওয়ান কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— সাদ্দাত হুসেইন, আপনার সাথে আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, আপনি অনুমতি দিলে আমরা ভেততে আসতে চাই, কারণ কথা গুলো বাইরে দাঁড়িয়ে বলার মতো কথা নয়।
সাফওয়ান তীক্ষ্ণ চোখে দুজন কে কিছুক্ষণ পরখ করলো, তারপর দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে দিলো ওদের। ওরা ভেতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলো সাফওয়ান৷ আর এর পরেই লোকদুটো নিজেদের পকেট থেকে নিজেদের আইডি কার্ড বের করে সাফওয়ানের সামিনে ধরলো। তারপর বলল,
— মিস্টার সাদ্দাত হুসেইন, আমরা আপনার উপকার করতে এসেছি। আপনার ইচ্ছা হলে উপকার গ্রহণ করবেন, নইলে ফেরত দিয়ে দিবেন। ইটস আপ টু ইয়্যূ, টোটালি!