অফিডিয়ান | পর্ব – ৪২

হতবিহ্বল হয়ে রুমাইশা দেয়ালে হাতড়াতে লাগলো। কিন্তু ওরা যে দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলো সেটা ওদের ঢোকার পর পর ই আবার আগের মতো করেই বন্ধ হয়ে গেছিলো। সেই দরজা টা যে আসলেই কোথায় সেটাও বোঝার উপায় নেই এখন আর৷ অসহায় দৃষ্টিতে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রাণপণে সেই দরজা টা খুজতে লাগলো সমস্ত দেয়াল হাতড়ে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না।

সাফওয়ান অদ্ভুত কিন্তু ভয়ঙ্কর হাসি হেসে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকলো রুমাইশার দিকে৷ ওর ওই চোখ দুটোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। প্রচন্ডরকম হিংস্রতায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে সেগুলো। ভয়ঙ্কর ওই চেহারার দিকে তাকালেই রুমাইশার গলা শুকিয়ে আসছে!

বের হওয়ার দরজা খুজে না পেয়ে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে সাফওয়ানের দিকে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুমাইশা৷ ওর আর কিছুই করার নেই। সাফওয়ান যদি এখন ওকে মেরেও ফেলে তবুও কিছুই করার থাকবে না। মনে মনে কালিমায়ে শাহাদাত পড়তে লাগলো ও, আর সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে প্রাণে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকলো!

সাফওয়ান ওর দিকে প্রতিটা কদম এগিয়ে আসার সাথে সাথে ওর হৃৎস্পন্দন বেড়ে চলল, চোখ বুজে নিলো ও প্রাণপ্রিয় স্বামীর হাতে এই মুহুর্তে মৃত্যুবরণ করার জন্য। মৃত্যু কে গ্রহণ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো ও। আর তার কিছুক্ষন পরই নিজের খুব কাছে সাফওয়ানের উপস্তিতি অনুভব করলো রুমাইশা। সাফওয়ানের ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে ওর মুখের ওপর আর সেই সাথে ও অনুভব করলো সাফওয়ানের শরীরে কিলবিল করতে থাকা অজস্র সাপ।

সাফওয়ান ওইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো রুমাইশার সামনে৷ ওই তীর্যক চোখে রুমাইশাকে দেখতে থাকলো ও!

হঠাৎ করেই রুমাইশার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হারিয়ে যাওয়া সাহস ফিরে ফেলো ও হঠাৎ করে। ওর মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এটা জেনে যে সাফওয়ান ওর কোনো ক্ষতি করবে না।
সাফওয়ান তো ওকে ভালোবাসে, ও তো সাফওয়ানের স্ত্রী! সাফওয়ান ওকে কেন আঘাত করবে! মোটেই সাফওয়ান আঘাত করবে না ওকে।

এতক্ষন ওর সাফওয়ান স্বাভাবিকই ছিলো, এই সরিসৃপ গুলোর ছোয়া পেয়েই সাফওয়ান এমন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে! এদের মাঝেই কোনো ঝামেলা লুকিয়ে আছে, যা ও বুঝতে পারছে না! ওর চোখ মেলা প্রয়োজন এখনি! এইভাবে ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ রেখে কিছুই হবে না!

কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে অকস্মাৎ চোখ মেললো রুমাইশা৷ আর চোখ মেলেই সাফওয়ানের শরীরে জড়ানো একটা কুচকুচে কালো সাপ কে মুখ তুলে একেবারে ওর ঠোঁটের কাছে এগিয়ে থাকতে দেখলো। সেটার লকললে কালো জিহবা থেকে থেকে বের হচ্ছে, চোখে তার অদ্ভুত দৃষ্টি রুমাইশার দিকে নিবদ্ধিত, যেন জিহবা দ্বারা এখনি রুমাইশার ঠোঁট ছুয়ে দিবে সাপটা।

হঠাৎ করে সামনের পরে সাপের চেহারা পেয়ে রুমাইশা নিজের অজান্তেই চমকে উঠে আকস্মিক ভাবে ক্ষিপ্র গতিতে সাপটার গলা ধরে টেনে ছুড়ে ফেলে দিলো এক পাশে।
কিন্তু সাপ টাকে ছোয়ার সাথে সাথেই সাপটার গলা টা যেন পুড়ে গেলো। সাপটার গলা থেকে ধোয়া উড়তে লাগলো, পোড়া মাংসের গন্ধে বাগান টা ভরে উঠলো যেন৷

সাপ টা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই কিছুক্ষণ ছটফট করে ছুটে পালালো ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে। রুমাইশা অবাক দৃষ্টিতে একবার সেই সাপটার দিকে দেখলো, তারপর দেখলো নিজের হাত খানা৷

এদিকে সাপ টা সাফওয়ানের দেহ থেকে হঠাৎ করে ছুটে যাওয়ায় সাফওয়ান যেন টালমাটাল হয়ে গেলো। ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো ওর!
রুমাইশা তখনি বুঝে গেলো ওর কি করতে হবে। সাথে সাথেই সাফওয়ানের একেবারে কাছে এসে সাফওয়ানকে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরলো সমস্ত কিলবিল করা সাপ শুদ্ধ।
আর সাথে সাথেই ওর স্পর্শ পাওয়া সমস্ত সাপ যেন নিজেদের শরীরে অদ্ভুত ধরনের যন্ত্রনা অনুভব করলো। একে বেকে ছটফট করতে করতে যেরকম ভাবে ছুটে ওরা এসেছিলো ঠিক সেভাবেই পুড়ে যাওয়া, প্রায় অর্ধ গলিত শরীর নিয়ে যে যেদিকে পারলো ছুটে পালালো, যে সাপ গুলোর শরীরে রুমাইশার স্পর্শ লাগলো না সেগুলো ও অন্য গুলোর তাপে, আর চাপে সাফওয়ানের শরীর টা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেলো।

রুমাইশা খেয়াল করলো সাপ গুলো এতক্ষণ সাফওয়ান কে কামড়ে ধরে ছিলো। যেখানে যেখান ওরা কামড়েছে সবখানেই দুইটা দাঁতের দাগ বসে গিয়ে নীল হয়ে আছে৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সে দাগ গুলো মুহুর্তেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।
রুমাইশা বুঝলো সাফওয়ানের এত ভয়ঙ্কর রূপের কারণ৷
কয়েক দিন পর পর সাফওয়ান ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আসলেই এদিকে কেন আসতো এতদিনে বুঝে গেলো ও! কিন্তু কেন আসবে ও নিজের ক্ষতি করার জন্য! সাপ গুলো তো ওর শরীরে বিষের পরিমান আর ও বাড়িয়ে দিচ্ছে! তারপরও ও কেন আসে এখানে! নাকি ওর অভ্যাস হয়ে গেছে সাপেদের বিষ টা! ওর ওই হঠাৎ অসুস্থতা কি এই বিষের অভাবের কারণেই?

কিন্তু এদিকে সাফওয়ানের শরীর থেকে সব গুলো সাপ এক ঝটকায় ছুটে যাওয়ায়, সাফওয়ান নিয়ন্ত্রণ হারালো নিজের ওপর থেকে। টালমাটাল হয়ে পড়ে যেতে নিলো ও, আর তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে প্রচন্ড ক্রোধে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো ও৷ দাঁতে দাঁত চেপে মুখ দিকে অদ্ভুত চাপা গরগর শব্দ করতে করতে ও এগিয়ে এলো রুমাইশার দিকে। রুমাইশা ভয় পেলো না, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। সাফওয়ান ওর কোনো ক্ষতি করবে না সে বিশ্বাসে জীবজের ঝুকিয়ে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো ও! এক পা ও নড়লো না!

সাফওয়ান ক্ষিপ্ত হয়ে এগিয়ে এলো রুমাইশার দিকে। এই মুহুর্তে ওর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী, ওর রিমু কে ও চিনতে পারলো না! ক্ষিপ্র গতিতে রুমাইশা কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো নিজের সামনে থেকে, ধাক্কা খেয়ে রুমাইশা ছিটকে গিয়ে বাড়ি খেলো পেছনের দেয়ালে।

আর তারপর ই সাফওয়ানবিদ্যুৎ গতিতে রুমাইশার কাছে এসে রুমাইশার গলা ঘরে উচু করে এক ঝটকায় উপরে উঠিয়ে নিজের উচ্চতার সোজাসুজি করে নিলো, রুমাইশার পা শূন্য থেকে উপরে উঠে গুলো প্রায় এক ফুট৷ সাফওয়ানের ইস্পাত কঠিন হাতের চাপে দম বন্ধ হয়ে আসলো ওর।

আর তারপরই সাফওয়ান ওর গলা চেপে ধরেই ক্ষিপ্র গতিতে ওকে টেনে নিজের মুখের কাছে নিয়ে এসে ওর গলা আর বিউটিবোনের মাঝখানে বসিয়ে দিলো ওর বিষদাঁত, আর ছুড়ে দিলো ওর মারাত্মক বিষাক্ত ভেনমের খানিক টা রুমাইশার গলাতে। আর সেই ভয়ঙ্কর কামড় টা দিয়েই আবার রুমাইশা কে ছুড়ে দিলো পেছনে থাকা দেয়ালের দিকে।

ছিটকে পড়ে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়লো রুমাইশা। অসহ্য যন্ত্রনা দিয়ে ভেনম টা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো ওর। মুখ টা ওর এখনো সাফওয়ানের দিকে ফেরানো।
সাফওয়ান নিজের হুসে নেই৷ উন্মাদের মতো মাটিতে হাটু গেড়ে বসে অর্থহীন আর্তনাদ করতে থাকলো ও৷

মাটিতে আছড়ে পড়া রুমাইশার চোখ দুইটা বিষের প্রকোপে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো, তবুও শেষ বারের মতো বড় বড় করে চোখ মেলে একবার সাফওয়ানের চেহারা টা দেখে নিলো ও, হাটু গেড়ে বসা সাফওয়ানের বিশাল শরীর টা ধীরে ধীরে মাটিতে শুয়ে পড়লো, কণ্ঠস্বর স্তিমিত হয়ে এলো, আর তারপর জ্ঞান হারালো সাফওয়ান৷
অসহায় চোখে সাফওয়ানের এই মাটিতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করে রুমাইশার চোখ দুইটা বন্ধ হলে গেল একেবারে!

৪৩. রাত নেমে এসেছে ধরনীতে। পাতালের ল্যাবে মাটিতে পড়ে আছে দুইজন মানব মানবী। কত টা সময় পার হয়ে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। রুমে থাকা সাফওয়ান আর রুমাইশার ফোনে শত শত মিসডকল। কিন্তু সেটা দেখার কেউ নেই।

মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা সাফওয়ান একসময় ধীরে ধীরে চোখ খুলল। আশে পাশের সাপ গুলো ওর থেকে দুরত্ব বজায় রেখে মাথা উচু করে দেখছে ওকে, কিন্তু কেউ কাছে আসছে না। সাফওয়ান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। কিছুই মনে পড়ছে না ওর হঠাৎ করে৷ সাপগুলোর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ঘার ঘুড়িয়ে ডান দিকে চোখ ফেরালো। ও। আর চোখ ফেরাতেই দেখতে পেলো রুমাইশার নিথর দেহ!

হতচকিত হয়ে দ্রুত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে সেদিকে গেলো সাফওয়ান। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে রুমাইশা। সাফওয়ান গিয়ে হাটু গেড়ে বসে রুমাইশা কে তড়িৎ গতিতে সোজা করে নিজের দিকে ফেরালো আর ফিরিয়েই ঝটকা খেলো ও। রুমাইশার গলার ওপর ওর ই ছোবলের দাগ। সে জায়গা টা নীল হয়ে আছে, রক্ত পড়ে শুকিয়ে উঠেছে। কামড়ের জায়গার আশপাশের শিরা উপশিরা গুলো নীলবর্ণ ধারণ করেছে।

সমস্ত কিছু মনে পড়ে গেলো ওর! নিজের করা এতবড় ভুলের কারণে সাফওয়ান যেন অথৈ সাগরে পড়লো। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো ও রুমাইশার নিথর দেহের মুখ পানে৷ বিড়বিড় করতে লাগলো ও ‘
— রিমু, রিমুরে! আমি কি করলাম এটা! কি করলাম আমি! আমার রিমু! রিমু, চোখ খোল রে পাখি!

রুমাইশার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া দেহ স্পর্শ করে সাফওয়ানের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, ভ্রু দুইটা অসহায় হয়ে কুচকে এলো ওর। রুমাইশার মুখ টা আলতো করে ধরে মুখের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে রুমাইশা কে ডাকতে থাকলো ও,
— সোনা রে, আমার কলিজার টুকরা, চোখ খোলরে পাখি! আমি কি করলাম এটা! আমার জান, আমার রিমু! চোখ খোল রে ময়না আমার!

আর এরপর ডুকরে কেদে উঠে রুমাইশার নিস্তেজ মুখের ওপর নিজের মুখ খানা ধীরে ধীরে রেখে চরম বেদনা মেশানো এক চিৎকার দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো সাফওয়ান। ওর চিৎকারে ঝোপ ঝাড়ের সমস্ত সরিসৃপ গুলো সচকিত হয়ে গেলো। সাফওয়ানের থেকে একটা নিরাপদ দুরত্বে সরে গেলো ওরা সবাই।

খানিকক্ষণ পর সাফওয়ান কান্না থামিয়ে রুমাইশা কে মাটিতে শোয়ালো। তারপর শেষ আশা নিয়ে নিজদেহ টা ঝুকিয়ে কান পাতলো রুমাইশার বুকে, ওর প্রাণস্পন্দন শোনার চেষ্টায়। আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করতে থাকলো যেন তিনি ওকে নিরাশ না করেন! ওর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী যেন ওকে ছেড়ে না চলে যায়, ওর কাছেই যেন থেকে যায়!

খানিকক্ষন বুকের ওপর কান পেতে থাকার পর হৃদস্পন্দনের ক্ষীন শব্দ কানে এলো সাফওয়ানের। আর তৎক্ষনাৎ হতচকিত হয়ে রুমাইশার বুক থেকে মাথা সরিয়ে নিয়ে দ্রুত গতিতে ওকে দুইহাতে উঠিয়ে কোলের ভেতর নিয়ে সাদা দেয়ালের ওপর নিজের ডান হাত টা মেলে ধরলো সাফওয়ান।
সাফওয়ানের হাতের স্পর্শে দরজা টা খুলে গেলো সাথে সাথেই। এরপরই রুমাইশাকে নিয়ে দৌড়ালো ও ল্যাবের ভেতর৷

দৌড়ে গিয়ে ল্যাবের এআই ভয়েস কে কমান্ড করলো স্ট্রেচার ওপেন করতে। সাথে সাথেই মেঝে ফাকা হয়ে একটি বিশালাকৃতির বক্স উঠে এলো, আর সেই বক্স টা ভাজ ভেঙে ভেঙে পরিণত হলো একটি স্ট্রেচারে। সাফওয়ান রুমাইশাকে নিয়ে স্ট্রেচারের নরম ফোমের ওপর শুইয়ে দিলো। আর তারপর স্ট্রেচারের মাথার কাছে থাকা স্বচ্ছ কম্পিউটার স্ক্রিনে টাচ করে কয়েকটা ফাংশন চালু করে দিলো। তখনি স্ট্রেচারের চার পাশ থেকে বিশ টার মতো রোবোটিক যন্ত্রাংশ বেরিয়ে আসলো।

এরপর সাফওয়ান মৌমাছির কুঠুরির মতো বক্স গুলো থেকে দ্রুত পায়ে নির্দিষ্ট কতকগুলো লিকুইড নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সিরিঞ্জের ভেতর প্রবেশ করালো। আর তারপর সেই সিরিঞ্জ গুলো লাগিয়ে দিলো স্ট্রেচার থেকে বের হওয়া যন্ত্রাংশ গুলোর মাথায়।

এরপর স্ট্রেচারের মাথার কাছে থাকা কম্পিউটার স্ক্রিনে স্পর্শ করে কমান্ড দিতেই সমস্ত সিরিঞ্জের সুচ গুলো এক সাথে রুমাইশার শরীর ভেদ করে মাংস, শিরা উপশিরার ভেতর ঢুকে গেলো। আর সাথে সাথেই স্ট্রেচারের ওপরেই ভয়ানকভাবে লাফালাফি করে ছটফট করতে থাকলো রুমাইশা৷ সাফওয়ান চোখ মুখ শক্ত করে সে দৃশ্য দেখতে থাকলো। ওর কাছে আর কোনো রাস্তা নেই এটা করা ছাড়া৷

নিজের ভেনমের এন্টিভেনম নেই ওর কাছে৷ ছোটবেলার কামড়ের ভেনম টা ব্লাক মাম্বার ছিলো, কিন্তু এখন সে ভেনম টা বদলাতে বদলাতে সম্পুর্ন নতুন এক ভেনম সৃষ্টি হয়েছে যার কোনো এন্টিভেনম নেই, আর ও নিজেও এন্টিভেনম তৈরি করে উঠতে পারেনি। কিন্তু রুমাইশা কে বাচাতে একটা শেষ চেষ্টা করলো ও!

রুমির শরীরে দেওয়া ফ্লুইড গুলো সাফওয়ানের শরীরের ই বিভিন্ন রকম ফ্লুইডের সংস্করণ। এত যাবৎ কাল নিজেকে সুস্থ করতে, আর নিজের ভেনমের এন্টিভেনম তৈরি করতে যতবার পদক্ষেপ নয়েছিলো ও ততবার ই কিছু ফ্লুইড ক্রিয়েট করে ফেলেছিলো ও, যার একটাও ওর উদ্দ্যেশ্য সফল করতে পারেনি।
কিন্তু সেগুলো সযত্নে রেখে দিয়েছিলো সাফওয়ান এতদিন৷ আর আজ সেগুলোই ব্যাবহার করেছে। ও জানে না এতে রুমাইশা বাচবে কিনা! ওর কোনো ধারণা নেই এ বিষয়ে। এইটাই রুমাইশা কে বাচানোর প্রথম আর শেষ উপায়! যে পরিমান ভেনমের উপস্তিতি রুমাইশার শরীরে ও দেখেছে তাতে রুমাইশা যে এখনো বেচে আছে সেটাই অত্যাশ্চর্য একটি ব্যাপার!

সাফওয়ান স্ট্রেচার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রুমাইশার এই ছটফটানি দেখতে থাকলো। চোয়ালদ্বয় শক্ত ওর, হাত দুইটা মুঠি বদ্ধ, চোখের কোণায় বাষ্প!

কিছুক্ষণ পর সাফওয়ান রুমাইশা কে ওইভাবেই রেখেই চলে আসলো বেডরুমে। কাবার্ড থেকে একটা ট্রাউজার বের করলে পরলো। তারপর আবার ল্যাব এ এসে একটা কম্পার্টমেন্ট থেকে কয়েক টা বিশালাকার সাদা রঙা তরল ভর্তি চারকোনা ব্যারেল বের করলো। আর তারপর স্ট্রেচারে ছটফটরত রুমাইশার দিকে একবার তাকিয়ে ব্যারেল গুলো দুই হাতে উচু করে নিয়ে চলল রেপটাইল দের আবাসস্থলের দিকে।

চোখ মুখ ভয়ানক রকমের শক্ত হয়ে আছে সাফওয়ানের! নিজেকে ওর এই মুহুর্তে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে! কিন্তু সেটা সম্ভব না৷
ল্যাব থেকে বেরিয়ে ঝোপ ঝাড় পূর্ণ রেপটাইল দের আবাসস্থলে পা রাখলো ও! চার পাশ টা একবার শেষ বারের মতো মন ভরে দেখে নিলো! মোস্তফা আহমেদের তৈরি করা এই অসম্ভব সুন্দর, রেপটাইল দের অভয়ারণ্য বাগান টাকে ও দেখে নিলো শেষ বারের মতো!
কত রকমের দুষ্প্রাপ্য গাছ পালা দিয়ে ভরে আছে এই সমস্ত এলাকা টা তার হিসাব নেই, কত শত ধরনের সরিসৃপ এইখানে বসবাস করছে, বংশবিস্তার করছে এত বছর ধরে তার ও কোনো হিসাব নেই!

সাফওয়ান বড় করে একটা শ্বাস টানলো, আর তারপর হাতে করে আনা ব্যারেল গুলোর থেকে দাহ্য তরল গুলো ঢালতে লাগলো সমস্ত বাগান জুড়ে।
এই নেশা ও আর নিজের কাছে রাখবে না! তাতে ওর যা হয় হবে! আজ ওর রুমাইশা ল্যাবের ভেতর মৃত্যু পথযাত্রী হয়ে শুয়ে আছে স্ট্রেচারে শুধু মাত্র ওর এই ভয়ঙ্কর নেশার জন্য!

প্রতিবার এই সাপ গুলোর ছোয়ায় ট্রিগার্ড হয় ও! আর ওর সমস্ত হিংস্রতা আগের মতো করেই ফিরে আসে ওর কাছে! সিঙ্গাপুরেও এই একই কাজ হতো ওর সাথে! ওর সংগ্রহের সমস্ত সাপ গুলোকে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে থাককতো ও সমস্ত রাত জুড়ে, আর প্রতিবারই ওর হিংস্রতার পরিমাণ বেড়ে যেত চক্রবৃদ্ধি হারে! সাপগুলোর এই বিষাক্ত ছোবল ওর কাছে ছিলো মাদকের মতো! যা না পেলে ওর মাথায় কাজ করতো না! এই অভ্যাস ওর হয়েছিলো সে প্রথম থেকেই!
আর না, আর এটাকে প্রশ্রয় দিবে না ও!

আজ ও ধ্বংস করে দেবে সব! আর কিছুই রাখবে না! ওর কারণেই ওর রিমু দুই দুই বার মৃত্যু মুখে পতিত হলো!
আর এখন সে বাচবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! এই জঙ্গল কোনো কাজে আসবে না ওর আর! এসবের কোনো মূল্য নেই এখন আর ওর কাছে! সব শেষ হয়ে যাক, সব পুড়ে খাক হয়ে যাক!

সমস্ত বাগান জুড়ে কেরোসিন আর পেট্রোল ঢেলে সাফওয়ান ফিরে এলো আবার দরজার নিকট, আর তারপর ই চোখ মুখ শক্ত করে ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে জ্বালিয়ে ছুড়ে দিলো বাগান টার ভেতরে, আর সাথে সাথে দপ করে জ্বলে উঠে পুরো বাগান ময় ছড়িয়ে গেলো সে আগুনের লেলিহান শিখা। সাফওয়ানের ইচ্ছা করলো এই আগুনের ভেতর ঝাপিয়ে পড়তে, এই জীবন আর ভালো লাগছে না ওর, মুক্তি চায় ও এই জীবন থেকে!

জ্বলতে থাকা গাছ পালার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও ল্যাবএর ভেতর গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে রুমাইশার পাশে বসলো। রুমাইশার ছটফটানি এখন একেবারেই নেই৷ স্থীর হয়ে গেছে রুমাইশা একেবারে৷ কম্পিউটার স্ক্রিনে রুমাইশার হার্টবিট দেখলো সাফওয়ান। ক্ষীন গতিতে চলছে সেটা, যেকোনো সময় হয়তো রুমাইশার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে একবারেই!

চোখের সামনে মুমূর্ষু রুমাইশা কে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে সাফওয়ানের নিজেকে এই মুহুর্তে প্রচন্ড রকম অসহায় লাগলো! দেয়ালের ও পাশে এখনো আগুন জ্বলছে! ও স্ক্রিনে রুমাইশার হৃদস্পন্দনের দিকে তাকিয়ে রইলো, শুধু একটাবার ওই উঁচুনিচু হয়ে বয়ে চলা দাগ টা যদি সোজা হয়ে যায় সাথে সাথেই ও ওই আগুনের ভেতর নিজেকে সপে দেবে। ওর রিমুর যদি কিছু হয়ে যায় তবে ওর আর বেচে থাকার কোনো কারণ থাকবে না এই পৃথিবীতে!

খানিকক্ষণ পর সাফওয়ানের বুক টা কাপিয়ে দিয়ে হঠাৎ করেই কম্পিউটার স্ক্রিনে বয়ে চলা উঁচুনিচু দাগ টা সোজা হয়ে একটানা বিপ শব্দ করে এগিয়ে যেতে লাগলো।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।