আপন মানুষের হঠাৎ বদলে যাওয়া আমরা কখনোই মেনে নিতে পারিনা। আমরা ভরকাই, চমকে যাই, হতবাক হই। আর তা যদি নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ ‘স্বামী ‘ নামক মানুষটি৷ তাহলে, আঘাতের পরিমাণ হয় আরও দগদগে। ভেতরে ভেতরে আঘাতের চিহ্ন বাড়তে থাকে। এক সময় গিয়ে সম্পর্কটাই হয়ে যায় ঠুনকো। সম্পর্কের পিলার গুলো যেনো ধ্বসে পড়ে।
তিন ঘন্টা আগের ঘটনায় মানসিক ভাবে থমকে গিয়েছিলো প্রানেশা। হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো সুফিয়ানের ভয়াবহ রূপে। সবেমাত্র ভালোবাসতে শুরু করেছিলো সে। কিন্তু সুফিয়ানের ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান ঘর থেকে তখনই বেরিয়ে গেলো। তিন ঘন্টায় একবারও আসেনি। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কিছুসময় পরই জ্ঞান ফিরে প্রানেশার। থরথর করে কেঁপে উঠলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ঘরের দরজা বন্ধ। মনে মনে ভাবলো পালিয়ে যাওয়ার কথা।
দ্রুত উঠে দরজা খুলতে নিতেই দেখলো ঘরে দরজা বাহির থেকে লাগানো। দুই একবার হাত দিয়ে বাড়ি দিলো। কেউ নেই বোঝাই যাচ্ছে। তাছাড়া এই সময়টায় সবাই সাগরের পাড়ে থাকে। বুঝে গেলো সুফিয়ান তার যাওয়ার পথ বন্ধ করেই গেছে। ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে প্রানেশা ভয়ানক এক সিদ্ধান্ত নিলো। চোখ মুছে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিলো। এখানে থেকে লাফিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। নিচের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘ এখানে থেকে লাফ দিলে বালুর উপর পড়বো, খুব বেশি একটা ব্যাথা পাবো বলে মনে হয় না ‘
মনে মনে সাহস নিয়ে চোখ বন্ধ করে জানালার উপর দাঁড়িয়ে এক পা বাহিরে দিতেই পেছনে থেকে সুফিয়ান টেনে নিচে নামিয়ে ফেললো। প্রানেশা চমকে উঠলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আগের মানুষটাই কিন্তু চোখ মুখের ভাষা আলাদা।কয়েক ঘন্টা আগেই মুখে হিংস্রতা নিংড়ে পড়ছিলো। অথচ, এখন মুখটা ভীষণ অসহায়ের মতো। চোখে টলমল করছে ৷ সুফিয়ান বুক ওঠানামা করছে। দেখে মনে হয়, খুব ভয় পেয়ে আছে ৷ প্রানেশার হাত মুখ ভালো করে চেক করে প্রানেশাকে বিছানায় বসালো।প্রানেশা মনে মনে ভয় পাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই পাগলের মতোন ব্যবহার করছিলো অথচ এখন কেমন শিশুর মতো আচরণ। সুফিয়ান হাঁটু গেড়ে বসে প্রানেশার কোলের উপর মাথা রাখলো। হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অজস্র চুমু খেলো। প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ান ফুঁপাচ্ছে। প্রানেশার না চাইতেও মায়া হলো৷ হাতে কবজিতে ভেজা অনুভব হতেই এক হাত সরিয়ে সুফিয়ানের মাথায় রাখলো। সুফিয়ান প্রানেশার কোল আরও শক্ত হাত ধরে বললো-
‘এমন আর কক্ষনও করবেনা প্রাণ! আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার সব হারিয়েছি।কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে আমি মারা যাবো প্রাণ। চলে যাওয়ার আগে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিও।তোমাকে হারিয়ে বাঁচা সম্ভব নয় ‘
প্রানেশা এবার বুঝতে পারলো। জানালার উপর দাঁড়িয়ে থাকায় সুফিয়ান ভেবেছে সে আত্মহত্যা করতে চাইছিলো৷ কিন্তু, মুখে কিছু বললো না। কারণ এটাই সুযোগ সত্যি জানার। মুখে গম্ভীরতা নিয়ে বললো-
‘ কিন্তু আপনার মতো একজন মানুষের সাথে একসাথে সংসার করা সম্ভব না। ‘
সুফিয়ান বোধ হয় কয়েক বছর পর কাঁদল। সেই সময়ের কান্নার কারণও ছিলো তার প্রাণ আজও তাই।
প্রানেশার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
‘ক্ষমা করে দাও প্রাণেশা। আমি ভীষণ রেগে গেছিলাম। আমি ভয়ে ছিলাম, যদি সত্যি শুনে তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাও!’
প্রানেশা সন্দেহ গলায় বললো –
‘এমন কী করেছেন আপনি? যা শুনলে আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো!’
সুফিয়ান নিষ্প্রাণ হয়ে বসে রইলো। দৃষ্টি নিচের দিকে। অপরাধীর মতোন মুখ থমথমে। প্রানেশা চুপ করে থেকে বললো-
‘ আপনি যদি আমায় আর ধোঁয়াশায় রাখেন আমি ছেড়ে চলে যাবো, আজই সব সত্যি বলবেন আপনি। আপনাকে আমার কসম’
সুফিয়ান চমকে উঠলো। হাত সরিয়ে বললো-
‘কসম করা গুণাহ প্রাণ! এসব আর বলবেনা ‘
‘ঠিক আছে। কিন্তু আপনি আজই সব সত্যি বলবেন ‘
সুফিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বললো-
‘বলবো প্রাণ, সব বলবো। তুমি নিজের কোনো ক্ষতি করবে না। ‘
‘হুম’
সুফিয়ান আসার সময় খাবার নিয়ে এসেছিলো। হাতের পাস্তার প্লেটটা নিয়ে এক চামচ নিয়ে প্রানেশার মুখের সামনে নিয়ে বললো-
‘ আগে খাবারটা খাও, বিকেল হয়ে এলো । সকালেও কিছু খাওনি ‘
প্রানেশা বললো-
‘কিন্তু, সত্যিটা!’
‘বলবো,আগে খাও। তারপর ‘
‘আচ্ছা ‘
অর্ধেকটা খেতেই প্রানেশার মনে পড়লো সুফিয়ানও সকাল থেকে কিছু খায়নি। সুফিয়ান চামচ আবার মুখের সামনে ধরলে প্রানেশা বললো-
‘ আপনি খেয়েছেন?’
সুফিয়ান মলিন হেসে বললো –
‘আমি পরে খেয়ে নেবো ‘
প্রানেশা জেদি গলায় বললো –
‘না না, পেট ভরে গেছে। এটুকু আপনি খান ‘
সুফিয়ান হাত নিচে নামাতেই প্রানেশা খেয়াল করলো বাম হাতে সাদা ব্যান্ডেজ করা। হালকা ছোপ ছোপ রক্ত। প্রানেশা বললো-
‘এটা কী করে হলো?’
সুফিয়ান নিজের মুখে অল্প পাস্তা পুড়েছিলো। হাতের কথা শুনে চিবোতে চিবোতে বললো-
‘ যে হাত তোমায় আঘাত করে সে হাতকে আমি কী করে অক্ষত থাকতে দেই প্রাণ! ‘
প্রানেশা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো-
‘আপনি নিজেকে ইচ্ছে করে আঘাত করেছেন! ‘
সুফিয়ান হেসে উঠে চলে গেলো। প্লেট রেখে বললো-
‘চলো প্রাণ, আজ তোমার মনের সকল কৌতুহল, প্রশ্ন মেটাবো ‘
প্রানেশার হাত ধরে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে গেলো। প্রানেশা সমুদ্র থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান গম্ভীর স্বরে বললো –
‘প্রাণ, তোমার ওয়াটার ফোবিয়া কী জন্মের পর থেকেই?’
‘নাহ,আমার জীবনের এক দূর্ঘটনায় এই ফোবিয়ার সৃষ্টি হয়’
সুফিয়ান প্রানেশার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘ সেটা শুধু তোমার জীবনের দূর্ঘটনা ছিলো না প্রাণ। আমার জীবনেরও একটা ঘটনা, সেটা না হলে হয়তো আমি তোমায় পেতাম না ‘
প্রানেশা হা করে থেকে বললো-
‘মানে! ‘
‘দূর্ঘটনাটা ঠিক কীভাবে, কোথায় হয়েছিলো মনে আছে তোমার? ‘
প্রানেশা বলতে শুরু করলো আজ থেকে চার বছর আগের ঘটনা-
‘ তখন আমার পরীক্ষার পর ছুটি চলছিলো। বয়স সবে মাত্র ১৭ বছর হয়েছে। সব বান্ধবীরা ঠিক করলাম পিকনিকে যাবো।সেখানে তিন দিনের দিন, নৌকা ভ্রমণে, হঠাৎ নৌকা থেকে আমি পড়ে যাই। সাঁতার না জানায় আরও ভয় পেয়ে যাই। তারপর কে বা কারা আমায় উদ্ধার করেছে আমি জানিনা, হুঁশ ফিরতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে পাই ‘
কিছুটা থেমে বললো-‘ব্যস, এখানেই শেষ ‘
সুফিয়ান পাড়ের কিনারায় বসে আছে। উত্তাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘শেষ নয় প্রাণ। সেটা শুরু ছিলো, এক রক্তাক্ত ইতিহাসের শুরু, গল্পের শুরু। এক ভয়ংকর প্রেমের শুরু। ‘
তারপর প্রানেশার দিকে পেছনে তাকিয়ে বললো-
নীল সমুদ্রের কোলে করে এলে তুমি ভেসে,
মুখখানা ঢেকে ছিলো তোমার এলোকেশে।
ভালোবাসার গহীন কোণে হারিয়ে আমি আজ,
খুঁজে ফিরি বনে বনে তোমার নামের সাঁঝ।
আকাশেতে তারার মেলা, অঢেল আলোর ঘর
আজও ওঠে বুকের মাঝে তুমি নামক ঝড়।