মাঝরাতে ঘুম ভাঙে চেঁচামেচির শব্দে। জামিল ভাইয়ের গলা। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসি। নাবিদও চোখ কচলে উঠে বসে। বাইরের ঘরে জিনিসপত্র ফেলে দেবার শব্দ। নাবিদ আমাকে বলে,
“তুমি ঘরে থাকো জরী। বাইরে আইসো না। ”
আমি তবুও যাই। জামিল ভাইয়ের চোখ দুটো লাল। বিশ্রী রকমের কড়া সিগারেটের গন্ধ। নরমাল সিগারেটে বোধহয় এতো কড়া গন্ধ হয় না। নাবিদের টুকটাক সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে। তবে আমার সামনে আজ অবধি খায় নি।
জামিল ভাই চিৎকার করে বলছে,
“আমার জীবন টা নষ্ট হয়ে যাইতেছে। আর তোমরা আনন্দ ফুর্তি করো! কিসের এতো আনন্দ তোমাদের!”
আম্মা চাপা গলায় বললেন,
66
“থাম, ভাড়াটিয়াদের কাছে মান সম্মান কিছু আর থাকলো না। ”
জামিল ভাই রেগে গিয়ে আম্মাকে বলেন,
“তুমি মান সম্মানের বানী কারে শুনাও! তোমার কারণে আজ আমার এই দশা। তোমার জন্য আমার মেয়ে দুটো মা ছাড়া। ”
নাবিদ চেয়ারে বসে ঢুলছে। কাউকে কিছু বলছে না। বাবা জামিল ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। জামিল ভাই খানিকক্ষণ চেঁচামেচি করে হঠাৎই গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলো। মুক্তা আমাকে আস্তে করে বলল,
“ভাবী টুপুর রে একটু কোলে নাও। ভয় পাইছে। টাপুর ঘুমায়। ”
আমি টুপুর কে কোলে নিয়ে মুক্তার রুমে আসলাম। এটা অবশ্য মুক্তার একার রুম না, মনিরও। মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“টুপুর সোনা পানি খাবা?”
“বাবায় অমন করে ক্যান কাকিমনি?”
“বাবার শরীর টা ভালো নেই। ”
“কি হইছে?”
“একটু জ্বর। ”
“মাথায় পানি দিবে না? আমার জ্বর হইলে আম্মু মাথায় পানি দিতো৷ জ্বর কমে যাইতো। ঘুমায়ে যাইতাম।”
আমার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। মেয়ে দুটো সারাদিন কতো হুটোপুটি করে, খেলে, টিভি দেখে। অথচ একবারও মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে না। আম্মা একদিন বলেছিলেন,
“মা’টা এমন পিশাচ দেখেই মাইয়া দুইটার মায়েরে মনে পরে না। একবারও শুনছ ওগো মা মা করতে। ”
আজ টাপুর টুপুর এর জন্মদিন। একটু কেক কাটা, ওদের সঙ্গে যে বাচ্চাগুলো খেলে তাদের ডাকা, আর একটু ভালো রান্না হয়েছে। টেবিলে খাবার দেখেই হয়তো জামিল ভাইয়ের মনে হয়েছে বাড়ির লোক ভীষণ আনন্দ, ফূর্তিতে আছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বসার ঘরে জামিল ভাইয়ের কান্নার শব্দ এখনো ভেসে আসে। টুপুর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। জামিল ভাইয়ের জন্য কেন যেন আমার খারাপ লাগে না। মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে। একদিন এই মেয়েটা বড় হবে। পড়াশোনা করে চাকরি করবে, নিজের সংসার হবে। তবুও জন্মদিন পালন করার সময় এই রাতের কথা মনে করে গলায় জমাট বাঁধা কান্নাগুলোও গিলে ফেলবে এক টুকরো কেকের সঙ্গে।
জামিল ভাই পরদিন নিজের কৃতকর্মের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত হলেন। আমি এই প্রথম জিজ্ঞেস করলাম,
“ভাইয়া, ভাবী কি ফিরবে না?”
জামিল ভাই অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকেন খানিকক্ষণ। তারপর বলেন,
“ও ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছে জরী। মেয়ে দুটোর জন্যও একটু মায়া হয় না। কত পা ধরলাম! ”
“টাপুর টুপুরের জন্য আপনার কী মায়া হয় ভাইয়া?”
জামিল ভাই বোকার মতো তাকিয়ে থাকেন। সেদিন বিকেলে মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে যায়। ফেরার সময় মেয়েরা আইসক্রিম, বেলুন নিয়ে খুশিমনে ফিরে আসে। তারপর থেকে মেয়েদের স্কুলে নেবার দায়িত্ব জামিল ভাই নেন।
সেই রাতের পর না চাইতেও আমি টাপুর টুপুরের মা হয়ে উঠলাম একটু একটু করে। এই বাড়িতে অন্যান্য মানুষদের চেয়ে ওরা আমাকে অন্য চোখে দেখে। এর আগে আমার ঘরে এসে জিনিসপত্র নষ্ট করেছে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা লিপস্টিক নেইলপলিশ নিয়ে দেয়াল নষ্ট করেছে। ওড়না, বই নিয়ে ভিজিয়ে ফেলেছে। নাবিদ, আম্মা অনেকবার বলেছে ওদের প্রশ্রয় দিও না। দুই একদিন থাপ্পড়, কিল খেলে আর কিছু নষ্ট করবে না।
আমি ওদের কখনো কিছু বলিনি। দিনভর দুষ্টমি করা মেয়ে দুটো যে মায়ের ভালোবাসা না পেয়ে কতটা অপূর্ণতা নিয়ে বড় হচ্ছে সেটা আমি অনুভব করতে পারি।
নিউটনের তৃতীয় সূত্রের হিসেব অনুযায়ী ওরাও আমাকে বুঝতে পারে। এক দুপুরে কলেজ থেকে ফিরলাম। ঘেমে নেয়ে জামাকাপড় এর যাচ্ছেতাই অবস্থা। বসার ঘরে ফ্যান চালিয়ে বসতেই টাপুর এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কাকীমনি, তুমি পানি খাবা?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে পানি নিয়ে আসলো। ছোট মগে অর্ধেকের বেশী পানি। ঠান্ডা পানি। আমাকে বলল,
“তোমার জন্য ফ্রিজে রাখছি। বাইরে থেকে আসলে তোমার কষ্ট হয়। ”
আমি বাড়িতে না থাকলে এরা আমার জিনিসপত্র আগলে রাখে। বিকেলে ছাদে উঠে কেবল আমার জামাকাপড় ই নিয়ে আসে।
আমার চোখে পানি এসে গেল। মাঝেমধ্যে আমার ভাবীর প্রতি অভিমান হয়। জামিল ভাইয়ের ওই কান্নাও মিথ্যে নয়। তবুও এই সংসার টার প্রতি ভাবীর এমন বিতৃষ্ণা।
***
সংসার, পড়াশোনা আর নাবিদ ছাড়াও আমার জীবনে আরও একটা অধ্যায় যুক্ত হলো। তিনতলায় থাকে নাজমা ভাবী। ভাবী ভীষণ মিশুকে স্বভাবের মানুষ। ঘরে ভালো, মন্দ খাবার বানালে আমাদের দিতে ভুলে না। আম্মার অবশ্য ধারণা যে বাড়িওয়ালা বলে তেল দিচ্ছে। আমার তেমন মনে হয় না। শেষ বিকেলে জামা কাপড় তুলতে ছাদে গেলেই ভাবীর সঙ্গে দেখা হয়। প্রায় প্রতিদিনই। আমার ধারণা নাজমা ভাবী আমার সঙ্গে কথা বলবেন বলেই আসেন। ভাবীর সুন্দর ছিমছাম গোছানো সংসার। মেয়েটা সেভেনে আর ছেলেটা ফাইভে পড়ে। ভাবী একদিন বললেন,
“জরী একটা কথা বলব কিছু মনে করবা না তো?”
“জি ভাবী বলুন।”
“মেয়েটার অংক টিচার নিয়ে খুব ঝামেলায় আছি। ব্যাচে পড়তে যায় ঠিকই, কিন্তু তারপরও পিছিয়ে আছে। ফার্স্ট টার্মে অংকে পেয়েছে কত জানো! উনচল্লিশ। ”
আমি ভাবীর কথার মানে বুঝতে পারি। হেসে বলি,
“ভাবী ও কী বিকেলে ঘুমায়? সন্ধ্যেবেলা আমার রান্নার দিকটা দেখতে হয়। ”
“থ্যাংক ইউ জরী। মুক্তাই তোমার কথা বলছিল। আমি অবশ্য সাহস পাচ্ছিলাম না। ”
আমি হাসলাম। ভাবীর বাচ্চা দুটোর নাম রিনি আর সিয়াম। দুজনকে বিকেলে এক ঘন্টা করে অংক পড়ানো শুরু করলাম। আম্মা ভালো চোখে দেখলেন না সেটাও। বললেন,
“এ কী কথা! তুমি এসব কী শুরু করছ! মানুষ কী বলবে?”
“দুটো ছেলেমেয়ে পড়তে আসলে অসুবিধে তো কিছু নেই আম্মা। ”
“লোকে ভাববে নাবিদের টাকা নাই তাই বউরে দিয়ে কাজ করায়। ”
আমি আর জবাব দিলাম না। নাবিদ শুনে বলল,
“তোমার টাকার দরকার হলে আমাকে বলবে তুমি। এতো কষ্ট করতে হবে না। সারাদিন তো কাজ করোই। ”
আমি হেসে বললাম,
“আমার যা দরকার সেটা তো তুমি না চাইতেই দাও৷ আমি শুধু পড়াতে চাইছি নিজেকে যাচাই করার জন্য। কেমন পড়াতে পারি সেটা দেখার জন্য। ”
নাবিদ হেসে বলল,
“তুমি ভালো টিচার হতে পারবে না। অবশ্য কলেজের টিচার হতে পারবে। কিন্তু বাচ্চাদের টিচার হতে পারবে না। ”
“কেন? বাচ্চাদের টিচার হতে পারব না কেন?”
নাবিদ আরও একটু এগিয়ে আসে। গভীর গলায় বলে,
“তুমি হলে মেঘের মতো জরী। কালো মেঘ নয়। নীল আকাশে ভেসে আসা সাদা নরম মেঘ। মেঘের মতো নরম, স্নিগ্ধ, সুন্দর। ”
আমি হেসে চোখ নামিয়ে নেই। জীবনের কাছে আমার বাড়তি কোনো চাওয়া নেই। এই যেমন আছি তেমনই সুন্দর।
চলবে…