তোমাকে | মুন্নি আক্তার প্রিয়া | পর্ব – ২৮

বাবা চলে যাওয়ার পরপরই পরী মায়ের কাছে যায়। রেহেনা বেগম তখন রাতের রান্না করছিলেন। পরী হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“আব্বু এসব কী শুরু করেছে মা?”
রেহেনা বেগম একবার পরীর দিকে তাকিয়ে আবার রান্নায় মনোযোগ দেন। তরকারী নাড়তে নাড়তে বলেন,
“কী করেছে?”
“আজকে নাকি আমায় দেখতে আসবে?”
এবার তিনি ব্যস্ততা বাদ দিয়ে পরীর দিকে তাকান। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,
“দেখতে আসবে মানে?”
“জানো না তুমি?”
“তোর আব্বু তো বলল যে তার নাকি কোন বন্ধুর পরিবার আসবে। তাই রান্নাবান্না করছি। তোকে দেখতে আসবে এসব তো কিছু বলেনি।”
“তাহলে আব্বু কি আমায় মিথ্যে বলেছে?”
“মিথ্যে বলার মানুষ তো উনি নয়। আচ্ছা তুই গিয়ে পড়তে বোস। আমি তোর বাবার সাথে কথা বলছি।”
পরী আর কথা না বাড়িয়ে নিজ রুমে চলে যায়। একটার পর একটা বইয়ের পাতা উল্টিয়েও পড়ায় মন বসাতে পারছে না। বাবার হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে পরী ভীষণ চিন্তিত। মায়ের ওপর পরীর বিশ্বাস আছে। একটা ব্যবস্থা হবেই। কিন্তু বাবার এমন সিদ্ধান্ত কেন হঠাৎ? তুর্যকে কি একবার জানাবে? সাত/পাঁচ ভাবা বাদ দিয়ে পরী তুর্যকে ফোন করে। তুর্য ফোন রিসিভ করে বলে,
“কী ব্যাপার? এই সময়ে না পড়তে বসার কথা? ফোন দিছ কেন? কয়দিন পর যে পরীক্ষা সে কথা মাথায় আছে?”
“তুমি আমার কথা শোনো, দরকারেই ফোন দিয়েছি।”
“পরে শুনব দরকারি কথা। আগে পড়া শেষ করো।”
“তুর্য, আমায় দেখতে আসবে আজ।”
তুর্য কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
“মানে? কারা দেখতে আসবে? কেন দেখতে আসবে?”
“ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।”
“এই শোনো, এখন মজা করার সময় না। তুমি পড়ো।”
“আমি সিরিয়াস তুর্য!”
“কীভাবে কী? বুঝলাম না! হুট করেই বলতেছ দেখতে আসবে।”
“আব্বু মাত্রই এসে আমায় বলল।”
“কী বলো এসব পরী? আমার মাথা কাজ করতেছে না।”
“তুমি চিন্তা কোরো না। মাকে বলেছি। মা ম্যানেজ করে নেবে। কালকে কোচিং-এ যাওয়ার সময় দেখা করব। এখন রাখছি।”
“পরী!”
“বলো।”
“তুমি পাল্টে যাবে না তো?”
“মাথা ঠিক আছে? তোমার মনে হয় আমি পাল্টে যাব?”
“আমার খুব ভয় করছে পরী।”
“ধুর! বাচ্চাদের মতো ভয় পাচ্ছ তুমি। আমি পাল্টাব না।”
“তুমি পাল্টে গেলে কিন্তু আমি শেষ হয়ে যাব পরী।”
“হায়রে! কিচ্ছু হবে না। রাখি?”
“হু।”
“মন খারাপ করছ কেন? পাল্টানোর হলে ভালোবাসতাম না। আমি তোমারই থাকব। এই বিয়েও ভাঙব। টেনশন নিও না।”
.
.
রান্নাবান্না শেষ করে রেহেনা বেগম রুমে আসেন এক কাপ চা হাতে। টেবিলের ওপর রেখে পরীর বাবার উদ্দেশ্য বলেন,
“পরীকে দেখতে আসবে এটা তো বলোনি?”
তিনি পত্রিকার দিকে তাকিয়েই উত্তর দেন,
“তাহলে কি তুমি এলাও করতে?”
“এজন্য কি আমায় বলবেও না?”
“জেনে গেছ তো।”
“পরী বলেছে বলে।”
তারপর কিছুক্ষণ দুজনই চুপ। রেহেনা বেগমই বলেন,
“কয়দিন পর মেয়েটার পরীক্ষা। আর তুমি এখন প্যারা দিচ্ছ ও’কে।”
“এইজন্যই তোমায় আগে বলতে চাইনি। আরে, বিয়ে তো এখনই দিচ্ছি না। এখন তো শুধু দেখে যাবে।”
“দেখাদেখির জন্যও অনেক সময় পড়ে আছে। পরীক্ষার মাঝে ঝামেলা করার দরকার নেই। এসব বিয়ের কথাবার্তা চললে মেয়েটা পড়ায় মন দিতে পারবে?”
কথার মাঝে বাবার ফোনটা বেজে ওঠে। ওপাশ থেকে কী বলে তা শোনা যাচ্ছে না। বাবা শুধু হু, হা আর মাথা নাড়াচ্ছে।কথা শেষ হলে রেহেনা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
“কে?”
“ঐ বন্ধু। তোমার মনের আশাই পূরণ হলো।”
“মানে?”
“মানে ওরা আজ আসতে পারবে না। ওদের বাড়িতেই আজকে প্রচুর মানুষ।”
রেহেনা বেগম মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও সেটা বাবাকে বুঝতে দিলেন না।
————————-
পরেরদিন কোচিং-এ যাওয়ার সময় দেখা হয় তুর্যর সাথে। তুর্যর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব চিন্তিত। পরীকে জিজ্ঞেস করে,
“কাল আসেনি কেন ওরা?”
পরী ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আসলে মনে হয় খুশি হতে?”
“তোমার তাই মনে হয়?”
“আগে হয়নি। তোমার কথা শুনে এখন মনে হলো।”
“ওরা কি পরে আসবে বলেছে?”
“তা তো জানি না। তবে মা বলে দিয়েছে পরীক্ষার মধ্যে কোনো বিয়ের কথা না তুলতে।”
“পরী, একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“আমি আমার পরিবার নিয়ে যাই তোমার বাসায়?”
“তোমার পরিবার বলতে? মানে বলতে চাচ্ছি, তোমার মা রাজি হবে?”
“কেন হবে না?”
“তার কারণ তো তোমার অজানা নয়।”
“ধুর! এত আগের কথা ভেবে মা বসে আছে নাকি? মা নিজেও চায়, আমি যেন এখন বিয়েটা করে ফেলি।”
“কিন্তু আমার সাথে হোক, এমনটা নিশ্চয়ই চায় না?”
“তুমি নেগেটিভ কেন ভাবছ? আর যদি নাও মেনে নেয়, তুমি কি আমায় ছেড়ে দেবে?”
“কতবার বলব ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভালোবাসিনি। যেভাবে হোক পরিবার মানিয়েই বিয়ে করব। তুমি তোমার পরিবারে জানিয়ে দেখো কী বলে।”
“আচ্ছা। এখন চলো তোমায় পৌঁছে দেই।”
.
অফিস শেষে বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নেয় তুর্য। দিশান দৌঁড়ে আসে তুর্যর রুমে। এদিকে তাহমিনা বেগমও যে তুর্যর জন্য মেয়ে খুঁজছেন সেটা বেমালুম ভুলে গেছিল তুর্য। দিশানের মাধ্যমেই জানতে পারে তাহমিনা বেগম আজ তুর্যর জন্য মেয়ে দেখতে গেছিলেন। তুর্য আর সময় বিলম্ব না করে মায়ের রুমে যায়। তুর্যকে দেখে তাহমিনা বেগম বলেন,
“তুই আসলি কেন আবার? আমিই তো যাচ্ছিলাম তোর কাছে। আগে আয় খাবি।”
“তোমার সাথে কথা আছে মা।”
“আমারও তোর সাথে কথা আছে। আগে খেয়ে নে তারপর বলছি।”
“পরে খাব।”
“আচ্ছা।”
তিনি আলমারির ড্রয়ার থেকে কয়েকটা ছবি বের করে তুর্যর হাতে দিয়ে বলেন,
“দেখত ছবিগুলো। মেয়েটা কী সুন্দর দেখ! তোর পছন্দ হয় নাকি।”
তুর্য ছবিগুলো বিছানার ওপর রাখে। তারপর তাহমিনা বেগমের হাত ধরে বিছানায় বসান। তার হাত দুটো হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“তোমার আর আমার জন্য বউ খুঁজতে হবে না। আমি খুঁজে নিয়েছি।”
“খুঁজে নিয়েছিস? কে মেয়ে?”
“পরী। আমি পরীকে ভালোবাসি। ইভেন আমরা দুজনই দুজনকে ভালোবাসি। আমি পরীকে বিয়ে করতে চাই মা।”
তুর্যর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেন তাহমিনা বেগম। মুখটা গম্ভীর করে বলেন,
“আমি আগেই বলেছিলাম ঐ মেয়েকে বাড়ির বউ করব না আমি।”
“মা প্লিজ! আগে কী হয়েছে না হয়েছে সেসব ভুলে যাও। তাছাড়া পরীর কোনো দোষ ছিল না। বিশ্বাস না হলে তিথিকেই জিজ্ঞেস করো।”
“জিজ্ঞেস করার কী আছে? ঐ মেয়ে একটা বেয়াদব।”
“পরী কোনো বেয়াদবি করেনি মা। ও শুধু প্রতিবাদ করেছে।”
“ওর সাফাই গাইছিস তুই? অবশ্য এখন তো ওর গুণগান গাইবিই।”
“সত্যিটা মেনে নিতে আপত্তি কোথায়?”
“সত্যিমিথ্যা তুই শেখাবি আমায়? তাও ঐ দুই দিনের মেয়েটার জন্য?”
“মা! প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। আমি ভালোবাসি ও’কে।”
“আমার চেয়েও বেশি? আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসিস ওরে?”
“না মা। তুমি তোমার জায়গায়। আর পরী পরীর জায়গায়।”
“তাহলে একটা কথা সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, ওকে আমি এই বাড়ির বউ করব না।”
“আমার চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?”
“ঐ মেয়েরে ছাড়া তুই যা চাস, আমি তাই দেবো।”
তুর্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
“আমার পরীকেই চাই। বিয়ে করতে হলে আমি পরীকেই করব।”
কথাটা বলেই তুর্য নিজের রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে পরী অনেকবার ফোন করেছে। এই সময়টায় দুজন কথা বলে। তারপর পরী পড়তে বসে। পরীকে এসব কথা জানাবে নাকি জানাবে না ভাবছে। পরীক্ষার সময়ে এসব বলে মন খারাপ করাতে চায় না বলে কথাগুলো আর পরীকে বলে না। শুধু একটা টেক্সট করে,
“এখন পড়তে বসো। পড়া শেষ হলে ডিনার করে ঘুমানোর আগে কল দেবে।”
ম্যাসেজটা পাঠিয়ে আবার টেক্সট করে,
“ভালোবাসি পরী। খুব ভালোবাসি। ইচ্ছে করছে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরতে তোমায়।”
নিচে আবার লিখে দেয়,
“ফোন করবে না একদম এখন। পড়া শেষ করো।”
.
.
তুর্যর ম্যাসেজটা দেখে পরীর মনে কেমন যেন কু ডাকছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু তুর্য না বললে জোর করা শোনাও সম্ভব না। আবার দেখা যাবে এখন ফোন দিলে রিসিভও করবে না। তাই একটা টেক্সট করে,
“আমিও ভীষণ ভালোবাসি তুর্য।”
তারপর ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে পড়তে বসে। রাত দশটা পর্যন্ত পড়ে বই বন্ধ করে ডাইনিং রুমে যায়। এর আগে কয়েকবার খাওয়ার জন্য রেহেনা বেগম ডেকে গেছেন। পরী আসতে আসতে তারা খেতে বসেছে। বাবা ভাত মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করেন,
“তুই কি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিস না?”
পরী রেহেনা বেগমের দিকে তাকান। রেহেনা বেগম বলেন,
“এখন আবার এসব কথা তুলছ কেন?”
বাবা শান্তস্বরে বলেন,
“আমি পরীর সাথে কথা বলছি।”
বাবার এমন ঠান্ডা মেজাজের কথা শুনে পরী আর রেহেনা বেগম দুজনই অবাক হয়। তিনি আবার বলেন,
“এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিস না?”
পরী আমতা আমতা করে বলে,
“আব্বু, আসলে আমি পরীক্ষার মধ্যে বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। তাছাড়া আগে আমি পড়ালেখা শেষ করতে চাই।”
“এখন বিয়ে করতে আপত্তি নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করতে আপত্তি?”
রেহেনা বেগম বলেন,
“কী শুরু করলে তুমি?”
তিনি এবার ধমক দিয়ে বলেন,
“তোমায় চুপ থাকতে বলেছি না? একদম কথা বলবে না তুমি। মেয়ের খোঁজ-খবর রাখো তুমি?”
এরপর পরীকে ধমকে বলেন,
“তুর্যর সাথে কীসের সম্পর্ক তোর? আজকে সকালে দেখলাম তোকে ওর সাথে। ভালোবাসিস তুই ওকে?”
বাবার ধমকে পরী চমকে যায়। চোখ উপচে কান্না চলে আসে। তিনি আবারও ধমক দিয়ে বলেন,
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”
পরী আবারও কেঁপে উঠে। পরীর নিরবতায় তিনি সব বুঝে নেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,
“তুই এখন বিয়ে করিস আর পাঁচ বছর পর সেটা আমার পছন্দেই করতে হবে। তুর্যর সাথে আজকের পর কোনো সম্পর্ক রাখবি না তুই।”
রেহেনা বেগম মাথা নিচু করে বলেন,
“মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এমন জোর করা ঠিক হচ্ছে?”
“ওর ভালোর জন্যই করছি। ঐ পরিবারে আমার মেয়ে কখনো ভালো থাকবে না।”
“তুর্য খারাপ ছেলে নয়।”
“আমি জানি সেটা। কিন্তু ওর মায়ের জন্য পরী কখনোই শান্তি পাবে না। আর এমন পরিবারে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দেবো না।
আমার বন্ধুর ছেলেই ওর জন্য যোগ্য। ওর পরীক্ষার গ্যাপের মধ্যে এঙ্গেজডমেন্টের ব্যবস্থা করব।”
পরী এবার কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলে,
“আমি এখন বিয়ে করব না আব্বু।”
“কেন তুর্যর জন্য? ডিরেক্ট একটা কথা বল, অন্য কাউকে বিয়ে করবি না?”
পরী ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। তিনি ধমক দিয়ে বলেন,
“উত্তর দে। তুর্যর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবি না?”
“আব্বু প্লিজ!”
“প্লিজ কী? আমার কথা শুনবি না?”
“এমন কোরো না আব্বু। আমি ওরে ছাড়া থাকতে পারব না।”
তিনি এবার সজোরে পরীর গালে থাপ্পড় বসান। পরীর কান্নার মাত্রা বেড়ে যায়। রেহেনা বেগম দ্রুত পরীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,
“পাগল হয়ে গেছ তুমি? এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলছ।”
তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে পরীর উদ্দেশ্যে বলেন,
 “ও’কে যদি বিয়ে করতে হয়, তাহলে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে করবি।”

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।