পুষ্প সুধীর ভঙিতে সিড়ি বেয়ে ছাদে এলো। দরজা আস্তে করে খুলতেই দমকা হাওয়া ঝাপটে এসে ছুঁয়ে গেল। কনকনে ঠান্ডায় হিম হলো শরীর। গায়ের চাদর আরেকটু ভালো করে টেনে জড়িয়ে নিল সাথে। অন্ধকারের মধ্যে আস্তে করে ডাকল,
‘ ইকবাল! ইকবাল!’
আরো একটা ডাকের পর দৃশ্যমান হয় সে। তিঁমিরের মধ্যে তার সাদা দাঁতের হাসি পুষ্পকে নিশ্চিন্ত করে । তবে পড়নের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবিটা দেখে বলল,
‘ একি! গরম কাপড় পরোনি যে? শীত করছে না?’
ইকবাল বলল ‘ করছে। এই যে দ্যাখো গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে। ‘
বলতে বলতে হাত মেলে ধরল সে। পুষ্পর চোখ,মনোযোগ সেদিকে সরতেও পারল না,চট করে ওকে ঘুরিয়ে কাছে টেনে নিল । মেয়েটা চোখ বড় বড় করে তাকায়। শরীর শিহরিত হয় ইকবালের বুকের সঙ্গে মিশে। ইকবাল আরো লেগে এলো পিঠের কাছে। দুহাতে শক্ত করে আগলে ধরল তাকে। থুত্নী ঠেকাল কাঁধে। সরল স্বীকারোক্তি জানাল,
‘ এবার লাগছেনা।’

পুষ্প লজ্জায় নুইয়ে গেল। পুরো শরীর তার কাঁ*পছে। মিহি কণ্ঠে বলল ‘ আমি কিন্তু এইজন্যে ডাকিনি। এটা কথা ছিল না।’

‘ উম জানি। সব হবে, আগে মন ভরে তোমাকে একটু কাছে রাখি। চারটে দিন দেখা হয়নি,ছুঁতে পারিনি মাইলাভ,বোঝো তার ব্যথা?’

পুষ্প দুষ্টুমি করে বলল,
‘ এমন ভাব করছো যেন তোমার বিয়ে করা বউ!’
ইকবাল ভ্রুঁ কোঁচকায়
‘ হতে কতক্ষণ? ভালো যখন বেসেছি, বিয়ে তো তোমাকেই করব মাই লাভ। পালাবে কোথায়?’
পুষ্প মুচকি হাসল। পরমুহূর্তে চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ পিউয়ের যে কী হয়েছে! জন্ম থেকে ওকে এতটা উদাসীন আমি দেখিনি। ‘
এই একটা কথায় ইকবালের হস্ত শিথিল হলো। পুষ্প সরে এলো কাছ থেকে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ চলো বসি।’

এই বাড়ির ছাদ বড় যত্ন নিয়ে গড়েছেন আমজাদ। লোহার চেয়ার টেবিল গোল করে বসিয়েছেন এক কোনায়। অবসরে চার ভাই মিলে গল্প করবেন বলে গেথেছেন ঠিক চারটে কেদারাই। ঈদ, কোরবানি এইরকমই কাটায়। আর গরমে ছুটির দিনের বিকেলটাও কাটে এখানে। ইকবাল, পুষ্প বসল সেখানে। শিশিরে লোহার চেয়ার বরফ স্বরুপ ঠান্ডা। ইকবাল টেবিলের ওপর দুহাত মুঠো করে রাখল, বলল
‘ বলো,জরুরি তলব কেন?’
পুষ্প বলল ‘ বলব, বলতেই তো ডাকা। তার আগে তুমি বলো,ভাইয়ার মতিগতি কেমন বুঝছো?’

‘ ওর আচরন কনফিউজিং। পিউয়ের এতটা অবজ্ঞা কখনও পায়নি তো,মানতেই পারছে না। চরম রে*গে গেছে। পারলে বাম হাতটা খেয়াল কোরো,আঙুল দেখলেই বুঝবে। কিন্তু আমার কথা হলো,এই ঘটনার সূত্রপাত কোথা থেকে?’
পুষ্প নিমিষেই কেমন অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ জানিনা আমি। আমার ওইটুকু বোন আর কত সহ্য করবে বলতে পারো? শুধুমাত্র ধূসর ভাইয়া….’
পথিমধ্যে আটকে দিল ইকবাল। হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
‘ জানি। তোমার দিকটা আমার সব জানা পুষ্প। কিন্তু একটা কথা কি অস্বীকার করতে পারবে, পিউয়ের জন্যে ধূসরের মত বেস্ট কেউ হয়?’

পুষ্প ব্যর্থ, ছোট শ্বাস ফেলে বলল ‘ বেস্ট বলেই এতদিন সাপোর্ট করেছি ইকবাল। কিন্তু আমি যদি দেখি ভাইয়ার কারণে আমার বোন ক*ষ্ট পাচ্ছে আমি চুপ থাকতে পারব না।’

‘ এটাও জানি। কিন্তু আমাদের বলা, কওয়ায় তোমার ভাইয়ের আসবে যাবে না। ও কারো ধার ধারে বলে মনে হয়? এতদিনে এই চিনলে!’

পুষ্প হ*তাশ হয়ে মাথায় হাত দিলো। ভেতরে এই ফ্যাসফ্যাসে অনুভূতিটার জন্যেই রাত দুপুরে,ঝুঁকি জেনেও ইকবালকে টেনে আনলো ছাদে। ছেলেটা পাইপ বেয়ে কত বেগ পুহিয়ে এসেছে সে জানে! কিন্তু কীই বা করবে? ফোনে বলা আর সামনা সামনি আলোচনা করা কী এক? ইকবাল পুষ্পর মাথায় রাখা হাতটা সরিয়ে এনে মুঠোয় ধরে বলল,
‘ এত ভেবোনা। ধূসরের ভাব ভা*ঙছে। পিউয়ের পরীক্ষার তো আর বাকী নেই। তারপর সব ঠিক হবে। ‘
পুষ্প নীচের দিক চেয়ে মাথা নাড়ল।
‘ হলেই ভালো। ‘
‘ আমি এখন যাই?’
‘ ক*ষ্ট দিলাম তাইনা? আসলে…
ইকবাল ঠোঁটে আঙুল চে*পে ধরে বলল ‘ শশশ! ফরমালিটি অন্য কোথাও করবে মাই লাভ, ইকবালের কাছে নয়।’

‘ তুমি ব্যস্ত বলেই…’
ইকবাল এবারেও কথা টেনে নিয়ে বলল,
‘ তোমার জন্যে শত ব্যস্ততায়ও বান্দা হাজির মাই লাভ। এখন ঘরে যাও, ঠান্ডা খুব। অসুস্থ হয়ে যাবে।’

‘ না। আগে তুমি নামো তারপর যাচ্ছি।’
‘ বেশ। কাল দেখা হচ্ছে?’
‘ হ্যাঁ। ‘
প্রতিবারের মতো, ইকবাল যাওয়ার আগে দীর্ঘ চুমু বসাল তার ললাটে। পরপর সাবধানে পাইপ বেয়ে নেমে গেল।
পুষ্প স্বস্তি সমেত ছাদের দরজা আগের মত আটকে রেখে নেমে এলো নীচে। যাওয়ার আগে একবার পিউয়ের ঘরের সামনে এলো। তাদের দুজনের মুখোমুখি ঘর। না,দরজা এখনও বন্ধ। পুষ্প আহ*ত ভারি নিঃশ্বাস নেয়,ফিরে আসে কামড়ায়।

****

পিউ কলেজের কমন রুমের সিড়িতে বসে। রোজকার মত নির্লিপ্ত, নিশ্চুপ। কাল থেকে টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে। প্রবেশ পত্র দিচ্ছে আজ। আর এই কদিনে ধূসরের সামনেও পরেনি সে। সারাটাদিন দোর দিয়ে বসেছিল। বাড়িতে বলেছে পড়ছে। তাই কেউ বিরক্ত ও করতে যায়নি। উলটে মিনা বেগম ভারি খুশি হয়েছেন মেয়ে বইমুখো হওয়াতে। সারাদিন বকে-ঝকেও টিভির সামনে থেকে ওঠানো যায়না,সে যদি চব্বিশটা ঘন্টাই বইয়ের সাথে থাকে খুশি হবেন না? অথচ ভেতরের খবর কে রাখে!
একমাত্র পিউয়ের চার দেয়ালের ঘরটা সাক্ষী,সাক্ষী পিউয়ের ফোলা ফোলা চোখ,চোখের নিচে ছেঁয়ে যাওয়া অসিত রঙ। সাক্ষী আসবাব,তার বারান্দা,তার বিছানা, আজ চারটে দিন ধরে মেয়েটা এক মুহুর্ত থামেনি। কেঁ*দেছে,কাঁদ*তে কাঁদ*তে ঘুমিয়েছে,মাঝরাতে ঘুম ভা*ঙলে তখনও ফেলেছে চোখের জল। প্রতিটা ভোর পুষ্পর বারান্দায় এসে দেখেছে ধূসরের অফিস যাওয়া। ধূসরের জন্যে এখনও রাত জেগে বসে থাকে। শুধু আড়ালে,লুকিয়ে। মানুষটা অন্য কারো হয়ে গেলে যাক। তার ভালোবাসা তো আর বদলাবে না! পাল্টাবে না তার অনুভূতি। আমৃত্যু এই মানুষটা থাকবে তার হৃদয়ে। বুকের মাঝের কোনও এক প্রকোষ্ঠে স্বযত্নে লুকিয়ে রাখবে তার ধূসর ভাইকে ।
পিউয়ের চোখ ভরে ওঠে। ভবিষ্যতের কিছু তিঁ*তকুটে মুহুর্ত কল্পনা করে আ*তঙ্কে গুটিয়ে যায়। চোখের সামনে ধূসর ভাইয়ের সাথে মারিয়ার বিয়ে, তাদের সংসার,কী করে দেখবে সে? না না এ সম্ভব নয়, সে পারবেনা। অতটা শক্তি তার নেই। ম*রে যাবে হয়ত। এই যে এখনো মর*ছে একটু একটু করে। পিউয়ের নেত্রপল্লব বুজে এলো। মানস্পটে হানা দিল ধূসরের সেই প্রথম স্পর্শের ছবি। মানুষটা তাকে না চাইলে কেন ছুঁয়েছিল? কেন? ওই স্পর্শ টুকুই ভাবতে বাধ্য করেছিল ধূসর তাকে ভালোবাসে। ধরে নিয়েছিল,মানুষটা ওর। অথচ সব মিথ্যে!

পিউ হিসেব কষতে ক্লান্ত। বসে থেকে মাথা হেলে দিল দেয়ালে। এদিকে তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান তানহা। রীতিমতো ব্যাডমিন্টন মাঠ থেকে বেরিয়ে এসে ক্লাশ রুমও চেক করেছে। শেষে এলো কমন রুমের এখানে। পিউ এখানেই বসে। তানহা ভ্রুঁ গুটিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। পিউ তাকালোনা। তার অবিচল অক্ষিকূট, তার মলিন চেহারা তানহা মন দিয়ে দেখল। আজকেও এই মেয়ের মন খা*রাপ? সে মহাবি*রক্ত হয়, কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
‘ তা আজও মহারানীর মন খারা*পের কারণ কি ধূসর ভাই?’
আচমকা শব্দে পিউয়ের সম্বিৎ ফিরল। ধ্যান ছুটে সোজা হয়ে বসল। ধূসর ভাইকে ভালোবাসার পর তার মন কি নিয়ন্ত্রনে ছিল? আজকেও তো নেই। কিন্তু কারণ টা যে ভিন্ন। ভিন্ন কারণটা এতটাই বিশ্রী, এই খা*রাপ মনটা হয়ত আর ভালো হবে না।
পিউয়ের নিরুত্তর ভঙি তানহাকে ভাবিয়ে তোলে। কলেজে আসা থেকে দেখছে কেমন মনম*রা হয়ে আছে। তানহা দুটো সিড়ি উঠে গিয়ে ওর পাশে বসল। কাঁধে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলল,
‘ কিছু হয়েছে পিউ?’

পিউ মুখ তুলল। কোটর ভরা টলটলে জল তানহার মুখভঙ্গি বদলে দেয়। পিউকে ক্লাস সেভেন থেকে চেনে । হাসি খুশি,উৎফুল্ল, লাফানো মেয়ে। হেসে গায়ের ওপর গড়িয়ে পরতে দেখেছে কিন্তু আজ অবধি ওকে কাঁদ*তে দেখেনিত। পিউয়ের চোখ থেকে জলটুকু টুপ করে পরতেই তানহা আঁত*কে বলল,
‘ কাঁ*দছিস কেন? ‘
পিউ মাথা নামিয়ে নেয়। হাটু জড় করে তাতে হাত রেখে মাথা গুজে দেয়। কেঁ*পে কেঁ*পে ফুঁপিয়ে কাঁ*দে। তানহা ব্যস্ত হয়ে পরল। বিভ্রান্ত হয়ে হাত বোলাল পিঠে।
‘ এই পিউ আমাকে বল কী হয়েছে,আমি না তোর বেস্টফ্রেন্ড? ‘
পিউয়ের কা*ন্না থামেনা। শব্দ নেই,কিন্তু ভা*ঙছে শরীর। তানহা বেশ কয়েকবার একই কথা আওড়াল,সান্ত্বনা দিল। মেয়েটা শুনল শেষে। মাথা তুলল ফের। লালিত নাক ফে*টে যেন র*ক্ত আসবে এক্ষুনি। তানহা আবার জিজ্ঞেস করে,
‘ কী হয়েছে পাখি? ধূসর ভাইয়া কিছু বলেছেন?’

‘ ধূসর ‘ নামটা শুনে বুকটা ফে*টে গেল তার। ঢোক গি*লে মাথা নেড়ে ‘না ‘বোঝাল। তানহা বলল ‘ তাহলে এভাবে কাঁ*দছিস কেন?’

‘ ধূসর ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।’
তানহা চমকে গেল। বিস্ময়ে ঠোঁট যুগল আলাদা হয়ে বসে। পিউয়ের অনুভূতির শুরু থেকে কেউ জানলে সেটা সে-ই।
আশ্চর্য বনে বলল,
‘ কী বলছিস? কবে,কার সাথে,কে ঠিক করল?’
পিউ বোজা গলায় জবাব দেয়,
‘ মেজো মা। আমার হোম টিউটর মারিয়া আপুর সাথে।’

‘ ঐ সেই মেয়েটা?’
‘ হু।’
‘ তুই কিছু বলিস নি?’
পিউ উদাস কণ্ঠে বলল ‘ কী বলব আমি? বলার কিছু আছে?’
‘ আছে, অনেক কিছু আছে। গত তিন বছর ধরে তুই তাকে ভালোবাসলি,আর মাঝখান দিয়ে বিয়ে করবে অন্য কেউ? আচ্ছা ধূসর ভাইয়া জানেন এসব?’

‘ জানবেনা কেন?আর না জানলেও বা, উনিতো মারিয়াপুকে পছন্দ করেন। রাজিই হবেন হয়ত। আসলে কী জানিস তানি,উনি আমাকে নিয়ে মজা করলেন। সব সময় ওনার পেছন পেছন ঘুরঘুর করি বলে ভীষণ স্বস্তা ভেবে বসেছিলেন আমাকে। তাইত ওভাবে….. ‘

পিউয়ের কথা আটকে গেল কা*ন্নায়। গুনগুন শব্দ হলো এবার। তানহার মস্তিষ্ক হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। বিচলিত হয়ে বলল,
‘ কিন্তু হঠাৎ বিয়ে ঠিক… আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছেনা। আর মারিয়া কে ওনার পছন্দ কেন হবে?’

পিউ চোখ মুছল। মিহিকণ্ঠে বর্ননা দিল সেদিনের ঘটনার। নিঁখুত মনোযোগে শুনল তানহা। আর্ত*নাদ করে বলল,
‘ ধূসর ভাইয়া এরকম করেছেন? আনবিলিভ-এবল।’

পিউ ক্ষীন হেসে বলল ‘ অবিশ্বাসের কিছু নেই। আমিই বোকা! তিনটে বছর নষ্ট করলাম যে পাখির আশায়,সেই পাখি আমার উড়েই গেল। শূন্য খাঁচা আর পুর্নতা পেল না। ‘

‘ তুই ওনাকে কিছু বলিস নি?’
‘ কী বলব আমি? যার সামনে ভালোবাসার ‘ভ ‘ উচ্চারন করতেই জ্বিভ কাঁ*পে তাকে কী বলতে পারি বল?’

তানহা উত্তেজিত হয়ে পরল। তবে প্রকাশ করল না। পিউ বিরতিহীন কাঁ*দছে।
সে একটু ভেবে বলল
‘ তুই বরং একবার ওনার সাথে কথা বলে দ্যাখ পিউ। আরেকটু খোলাসা হ,ভুল বোঝাবুঝিও তো হতে পারে।’
পিউ বিরোধিতা করে বলল ‘
লাভ নেই। যেখানে মেজো মা মারিয়াপুকে পুত্রবধূ ধরেই নিয়েছেন সেখানে আমি আর কী করব? আচ্ছা মেনে নিলাম, ভুল বুঝছি তাকে। কিন্তু যেখানে তার মা মেয়ে পছন্দ করেছেন, আম্মুও রাজি সেখানে আর সুযোগ নেই। ধূসর ভাই ওনাদের যেমন প্রিয়,ওনারাও তার প্রিয় খুব। এক কথায় উনি মেনে নেবেন। রাজী হবেন। আর তাছাড়া, সেজো মা যেভাবে আপুকে সাদিফ ভাইয়ের বউ হিসেবে কল্পনা করলেন মেজো মা তো আমাকে করেননি। ‘

‘ করেননি কারণ, তুই ধূসর ভাইয়ের অনেক ছোট। এটাও হতে পারে তাইনা?’
পিউ শুনল তবে মন মানল না। চোখ মুছে বলল,
‘ বাদ দে। ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলাম। উনি আমার হলে হবেন না হলে নেই।’
‘ আর মন? মনকে বোঝাতে পারবি এই কথা?’

পিউ দমে গেলো আবার। ওষ্ঠ দুটো তিরতির করে কাঁ*পল। তানহা চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ কাল থেকে পরীক্ষা,আর তোর ওপর দিয়ে এসব যাচ্ছে। কীভাবে কী করবি?’
‘ জানিনা।’
‘ পারবিত?’
পিউ কাষ্ঠ হেসে বলল,
‘ গত কয়েক শত ঘন্টা ধরে কত কী সহ্য করতে পারলাম! আর সামান্য পরীক্ষা!’
তানহা চুপ করে যায়। পিউ অন্যমনস্ক হয়ে পরে। কানের কাছে বেজে ওঠে রুবায়দা বেগমের সেই তি*ক্ত প্রশ্ন,
‘ মারিয়াকে ভাবি হিসেবে পছন্দ হয়েছে? তোর ধূসর ভাইয়ের সাথে মানাবেনা?’

****

‘আমার আর সহ্য হচ্ছেনা ইকবাল। পিউকে কিন্তু মেরে*ই ফেলব এবার।’
ডোরা সাপের ন্যায় ফোস*ফোস করল ধূসর। ইকবাল মিটিমিটি হেসে বলল ‘ ফ্যাল। মানা করেছে কে?’
ধূর নাক ফুলিয়ে তাকাল। চেঁচিয়ে বলল,
‘ মজা করছিস আমার সাথে?’
ইকবালকে কিছু বলার সময় অবধি দিলোনা। টেবিলে রাখা গ্লাসটা আছা*ড় মারল ফ্লোরে। দরজার বাইরে থাকা সোহেল গলা নামিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। ইকবালের সাথে চোখাচোখি হতেই সে সরে যেতে ইশারা করে। তারপর চোখ ফেরাল ধূসরের দিকে।
শান্ত ভাবে বলল,
‘ আমি বুঝলাম না তোর এত রাগের কারণ! এরকম ইগ্নোর,অবজ্ঞা তুই কি পিউকে করিস নি? তাহলে সেইম জিনিসটা নিয়ে এইভাবে রিয়্যাক্ট কেন করছিস?’

‘ তুই সব জেনেশুনেও এসব বলবি?’
ইকবাল স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘ বলব। কারণ পিউ এর এক ভাগও জানেনা। আর আমি শতভাগ নিশ্চিত ও যা করছে তার পেছনে বড় কোনও কারণ আছে। যেখানে তুই হান্ড্রেড পার্সেন্ট অপরা*ধী।’

ধূসর আকাশ থেকে পরে বলল
‘ আমি কী করে…..’
বলতে বলতে থেমে গেল সে। মনে পড়ল বিয়ে বাড়ির সেই শেষ ঘটনা। মারিয়া তাকে জড়িয়ে ধরেছিল,পিউ হাজির হলো তখন। তবে কি সত্যিই ও ভুল ভেবেছে? তাদেরকে নিয়ে কোনও উল্টাপাল্টা ধারনা পুষেছে মনে ?
তার চিন্তিত চেহারা দেখে ইকবাল সন্দিহান কণ্ঠে বলল
‘ কী, ঠিক জায়গায় ঢিল ছু*ড়েছি তাইত?’

ধূসর ভাবিত স্বরে বলল ‘ আই থিংক একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।’
‘ কী হয়েছে?’
ধূসর ওপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট চে*পে তাকাল। একে একে পুরোটা খুলে বলল। সে থামতেই ইকবাল হাত তালি দিয়ে বলল,
‘ বাহ বাহ বাহ! চমৎকার! হ্যাঁ রে ধূসর, এই তোর বুদ্ধিতে আমি পার্লামেন্ট চালাচ্ছি? ষ্যাহ! নিজের প্রতি রা*গ হচ্ছে এখন। তুইত আস্ত একটা গাধা।’

ধূসর দাঁত চেপে কটমট করে তাকাতেই বলল
‘ একদম তেঁজ দেখাবিনা আমায়। তোর ঘঁটে বুদ্ধি থাকলে আজ এতদিন পর তুই বুঝতে পারলি যে পিউ ভুল বুঝেছে? আগে মনে হলোনা?’

‘ আশ্চর্য! এই সামান্য কারণে ও আজেবাজে ভাববে কেন? ‘
ইকবাল ভ্রুঁ নাঁচায় ‘ সামান্য কারণ? একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরা সামান্য কারণ?’

ধূসর রে*গেমেগে পুরু কণ্ঠে বলল,
‘ আমি জড়িয়ে ধরিনি ইকবাল, মারিয়া ধরেছে। ও আমার ছোট বোনের মত তুই জানিস। পুষ্প আর ওকে আমি আলাদা চোখে দেখিনা।’

‘ সেটা আমি জানি,তুই জানিস, পিউ জানে? মনে নেই মারিয়াকে প্রথম দিন দেখে ও কী করেছিল! কীভাবে কেঁ*দেছিল? তারপর বিয়েতে দেখেও মানতে পারেনি। তুই-ইতো বলেছিলি আমায়। পুষ্পও তো জানিয়েছে। পিউয়ের মাথায় আগে থেকেই নেগেটিভ চিন্তা চলে এসেছিল তোদের দুজনকে নিয়ে। যেই দৃশ্য আমরা মনে মনে কল্পনা করি, সেটাই যদি চোখের সামনে দেখতে পাই তাহলে কেমন লাগবে? ওর জায়গায় যে কেউ থাকলে একিরকম ভাববে ধূসর৷ বয়স কত পিউয়ের? ছোট মানুষ! বাচ্চা একটা মেয়ে! ওর মনে এরকম চিন্তা আসাটাই স্বাভাবিক। এখানে দো*ষের কিছু নেই। ‘

ধূসর হতবাক হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষন। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে বলল,
‘ কিন্তু… ‘
ইকবাল এসে সামনের চেয়ারটায় বসল। ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ আচ্ছা ওয়েট,আজ যদি পিউ একটা ছেলেকে এভাবে জড়িয়ে ধরত, আর তুই নিজের চোখে দেখতি,মানতে পারতি তখন? সামান্য কোনও ছেলের সঙ্গে কথা বললেইত তুই….

ইকবাল বিরক্ত হয়ে থেমে গেল। বাকীটুকু না বলে ঘনঘন শ্বাস নিলো।

ধূসরের মুখশ্রী থমথমে। বিমূর্ত সে। গোটানো চোখমুখে শৈথিল্য। একটা কথাও বলল না, হুট করে উঠে বেরিয়ে গেল। ইকবাল সেদিক চেয়ে মুচকি হাসে। সে নিশ্চিত জানে ধূসরের গন্তব্যের কথা।

***
পিউ শ্রান্ত পায়ে কলেজের গেট দিয়ে বের হয়। আজকেও গাড়ি আসেনি। ইদানিং এই রাস্তায় জ্যাম পরছে খুব। ফ্লাইওভার গড়া হচ্ছে নতুন। কাজের জন্যে অর্ধেক জায়গাই আটকে দিয়েছে সরকার। এই জ্যামের কারণই সেটা। সে বিরক্ত পায়ে হাঁটতে থাকে। গাড়ি এলে তো সামনেই পরবে। তখনকার কা*ন্নাকা*টির দরুন অক্ষিকোটর গরম হয়ে আছে। পাতা ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে যেন।

আচমকা একটা বাইক এসে পথ আগলে ব্রেক কষল। চমকে সরে গেল সে। ধূসরকে দেখতেই হোচট খেল, অবাক হলো। মানুষটা এখানে কেন?
ধূসর ক্লান্তিহীন তাকিয়ে। নরম চাউনী বিচরন করছে পিউয়ের মুখজুড়ে। আজ টানা কতগুলো দিন পর মেয়েটাকে দেখল৷ ইশ কী অবস্থা চেহারার!
পিউ ধূসরকে দেখে বিস্মিত, অথচ খুব দ্রুত সামলে ফেলল নিজেকে। চোখ ফিরিয়ে নীচের দিকে রাখল। ধূসর বলল,
‘ ওঠ। ‘
সাথে ব্যাকসাইড ইশারা করল সে। পিউ শুনতে পায় স্পষ্ট। কিন্তু পাশ কা*টিয়ে হাঁটা ধরল। ধূসর ভ্যাবাচেকা খেল তার প্রত্যাখানে। পরপর ফুটে উঠল চোয়াল। স্ট্যান্ডের ওপর বাইক দাঁড় করিয়ে নেমে এলো। দ্রুত এগিয়েই পেছন থেকে হাতটা টেনে ধরে বলল,
‘ তোকে উঠতে বলেছিনা?’
পিউ তাকাল না। সামনে ফিরেই বলল ‘ হাত ছাড়ুন।’
‘ এখন তোর থেকে শিখতে হবে কী করব?’

পিউ আবেগ খাম*চে ধরে আটকায়। চোখে পানি আসবে আসবে করছে। শ*ক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ হাত ছাড়ুন ভাইয়া। ‘
এতগুলো দিন যেই ডাকের জন্যে মেয়েটা হাজারটা ধম*ক খেত, তবু শোনেনি, প্রথম বার সেই ডাক শুনল ধূসর। থমকে গেল সে। পরমুহূর্তে রা*গ হলো। ত্যাড়া কণ্ঠে বলল,
‘ না ছাড়লে কী করবি?’
পিউ কাঠ গলায় বলল,
‘ রাস্তার মধ্যে এভাবে একটা মেয়ের হাত টানাটানি করছেন, আপনার লজ্জা না থাকলেও আমার আছে। ‘

ধূসর স্তব্ধ, দৃঢ়ীভূত। বিশ্বাসই করতে পারল না এসব পিউ বলল।
বিহ্বল কণ্ঠে আওড়াল ‘ পিউ!’
পিউয়ের হৃদযন্ত্র দুভাগ হয়ে যায় ধূসরের কণ্ঠে।
বিস্ময়ে বাধন আলগা হতেই পিউ হাতটা টেনে কাছে নিয়ে এলো। ভেজা কণ্ঠ যথাসাধ্য কঠি*ন করে বলল,
‘ পরেরবার যখন তখন আমাকে ছোঁবেন না। রুচিতে লাগে খুব।’
ধূসর পিছিয়ে গেল। স্তম্ভিত সে৷ পিউ ঠোঁট কা*মড়ে কা*ন্না আটকায়। সেই মুহুর্তে বাড়ির গাড়ি এসে থামল। ড্রাইভার জানলা থেকে মাথা বের করে ডাকল। দরজা খুলে দিল সাথে। পিউ এগিয়ে আসে। একবার তাকাল না অবধি ধূসরের দিকে। গাড়িতে উঠে বসে দরজা আটকে দেয়, কাঁচ ওঠায়। ডান হাতে তাকায় নিস্তেজ চোখে। এইত এই জায়গায় ধরেছিল ধূসর ভাই। পিউ বাম হাতটা কোমল ভাবে বোলালো সেখানে। ঠোঁটের কাছে এনে গভীর চুঁমু খেল। পরপর নিরবে কেঁ*দে ফেলল। এইভাবে যে কথাগুলো চায়নি বলতে! বাধ্য হয়েছে,মানুষটাকে দেখে ক্ষো*ভ,দুঃ*খ উগলে এসেছে। খুব ক*ষ্ট পেয়েছে তাইনা? পিউ যত্র ব্যাকুল চোখে ঘুরে তাকাল পেছনে। যতক্ষণ ধূসরকে দেখা যায়,অনিমেষ চেয়ে থাকল।

চোখের সামনে থেকে পিউয়ের গাড়িটা পুরোপুরি অদৃশ্য হয়। ধূসর অক্লিষ্ট ঢোক গি*লে পাথর বনে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকটা জ্ব*লছে তার,জ্বল*ছে
চক্ষুদুটোও।

লেখকের কথা: পিউয়ের সাথে এতদিন লাফিয়েছেন,এবার ওর সাথে একটু কাঁদুন। আপনারাও প্রমাণ দিন ভালোবাসার????।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।