আব্রাহাম মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় একপা দু’পা করে হাঁটে। ইনায়া পাথরের মতো স্থির দাড়িয়ে থাকে। ওর চোখজোড়া থেকে যেন আগুনের ফুলিঙ্গ ঝড়ে। একটুখানি দুরে নিষ্প্রাণ মুখে সিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ওর শান্ত মুখখানার আড়ালে হিমেল হিংস্রতা ফুটে উঠে। যেন সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রাণহন্তা বাঘিনী হয়ে।
উলের সুয়েটারের নিচে লুকিয়ে রাখা ক্রুশ লকেট’টা ইনায়া বাম হাতে শক্ত করে চেপে ধরে। আব্রাহামের সেদিকে খেয়াল নেই। সে কেবলই ধীরপায়ে হাঁটে। ইনায়া তাকে অদৃশ্য মায়াজালে টানছে। কেনো এতো মায়া এই মেয়েটার মুখশ্রীতে? শুধু কি মায়া? আছে নির্মলতা। আব্রাহামের মনে হয়, পবিত্রতার প্রতীক সে।
ইনায়ার গলায় চিকন সুতোয় বেঁধে রাখা ক্রুশ লকেট। চিকন সুতোয় বেঁধে রাখার কারণ ছিলো যাতে প্রয়োজন হলে দ্রুত হাতে গলা থেকে খুলে নিতে পারে। আব্রাহাম আরও একটু কাছে গিয়ে দাড়ায়। সিয়া দু’জনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। নীল চোখ আর সোনালী চুলের অধিকারী আব্রাহামকে চিনে নিতে ওর বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। মায়ের হ’ত্যাকারীকে ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে দেখে সিয়া অবাক হয়নি। সিয়া একপা ইনায়ার দিকে এগোয়। কিন্তু পুনরায় থেমে যায়। যন্ত্রমানবীর মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ইনায়া ডানহাতের তর্জনী নাড়িয়ে ইশারায় কাছে যেতে বারণ করেছিলো ওকে।
এই মেয়েটাকে দেখলেই আব্রাহামের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়।নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে আরও দ্রুততর হয়। বুকের ভেতর থাকা হৃদযন্ত্রটা ক্রমাগত লাফাতে শুরু করে। কই আগে তো এরকম হয়নি কোনো মেয়েকে দেখে? ইনায়া তার দৃষ্টির সম্মুখে থাকলে চারপাশের সবকিছু স্থির মনে হয়।
– মৃ’ত্যু পথযাত্রীদের যেমন শ্বাস টান উঠে। তোমারও তাই। পালাও এখান থেকে। ____আব্রাহামের দুষ্ট আত্মা তাকে সাবধান করে বলে।
– যদি মৃ’ত্যু সুনিশ্চিত হয়। তাহলে পালিয়ে বাঁচবো কিভাবে?___ আব্রাহাম মনে মনেই তার দুষ্ট আত্মাকে জিজ্ঞেস করে।
ভেতর থেকে কোনো উত্তর আসে না। আব্রাহাম নিদারুন হাসে। ইনায়াকে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয় সে।ওর মনে কি চলছে? জানতে চায় না। কিন্তু নিজের মনের কথাগুলো অকপটে জানাতে চায়। বলতে চায় সে নির্দোষ। কাউকে হত্যা করেনি। দু’জনের মাঝখানে দু’হাত দুরত্ব বজায় রেখে ইনায়ার ক্রোধিত চোখজোড়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। রেগে গেলেও বুঝি কোনো মেয়েকে দেখতে এতোটা আকর্ষণীয় লাগে? কয়েক পল সময় গড়ায়। ইনায়া ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। আরও কাছাকাছি এসে দাড়াক শ’য়তানটা। আজ ওকে চরম শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। বুকের ভেতরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সিয়া কিভাবে এতোটা শান্ত আছে কে জানে।
– আমার ভেতর কোনো অনুশোচনা নেই। অপরাধবোধ নেই। কারন তুমি যে অপরাধের অপরাধী আমাকে ভাবছো সেই অপরাধ আমি করিনি। তোমার মা’কে হত্যা করিনি। উইজার্ড পরিবারের কারো মৃ’ত্যুর জন্য আমি দায়ী নই। তুমি কি স্বচক্ষে আমাকে দেখেছিলে? আমি উপস্থিত ছিলাম সেখানে? আমাকে সময় দাও। আমি প্রমাণ করে দিতে চাই এই হ’ত্যাকান্ডের পেছনে আমার কোনো হাত নেই।
আব্রাহামের কথাগুলো শুনেও ইনায়া বাহ্যিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিন্তু ওর ভেতরটা আরও হিংস্রাত্মক হয়ে উঠে। ইনায়ার কাছ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে আব্রাহাম সামান্য বিরক্ত হয়। চোখ সরিয়ে ওর ডান দিকে তাকায়। সিয়াকে খেয়াল করে। নিটোল স্বাস্থ্যের বেশ লম্বা দেখতে একটা মেয়ে। আনুমানিক পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি হবে। সম্পূর্ন মাথা ঢেকে রেখেছে পরিধেয় জ্যাকেটের হুডি দিয়ে। লন্ঠনের মৃদু আলোয় তার ফর্সা মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার দু’চোখের দৃষ্টি ভয়াবহ শান্ত। কিন্তু মনিগুলো আগুনের মতো জ্বলছে।
– ও কে? ____ আব্রাহাম আনমনে ইনায়াকে জিজ্ঞেস করে। দু’জনের কেউই তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সে ভ্রু-কুঞ্চিত করে ভাবে,,,
– ইনায়ার বোন? তাহলে তো চেহারার সাথে মিল থাকার কথা ছিলো। কিন্তু দুজনের মধ্যে একটুও মিল নেই কেনো? না-ই থাকতে পারে। সবাই তো আর আমাদের দু’ভাইয়ের মতো জমজ হয় না।
অহেতুক বিষয়ে ভেবে আব্রাহাম মনে মনে হাসে। সহসা ইনায়া একটা সাংঘাতিক কাজ করে বসে। সিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকা আব্রাহামের বুকের উপর শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ক্রুশ লকেট বসিয়ে দেয়। আচমকা আক্রমনে ভড়কে যায় আব্রাহাম। নজর সরিয়ে নেয়। ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকায় ইনায়ার দিকে। তার দু’চোখে অবিশ্বাস। ইয়ানা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে,,
– যতক্ষণ ক্রুশ লকেটা তোমার বুকে বিঁধে থাকবে, তুমি তিলে তিলে ম’রবে। ম’রবেই। তারপর তোমার মৃতদেহ জ্বালিয়ে দিয়ে আমি আমার মা’য়ের মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ নিবো।
আব্রাহামের হৃদপিণ্ড জ্বলে যাচ্ছে। একারণেই কি ইনায়া এতক্ষণে নিশ্চুপ,নির্বাক হয়ে ছিলো? অসহনীয়,দুর্দম্য যন্ত্রণা অনুভব করে। ক্রুশ বিঁধে থাকা জায়গাটুকু ভীষণ বাজে ভাবে পুড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। দু’কদম পিছিয়ে যায় সে। দু’হাটু ভেঙ্গে শব্দ করে মাটিতে বসে পড়ে। ব্যথাতুর কাতর কন্ঠে বলে,,,
– আমি তোমার থেকে সময় চেয়েছিলাম, নিজেকে নির্দেশ প্রমান করতে।
– তোমার মতো নির্দয়,নিষ্ঠুর ন’রপিশাচ, আমার মায়ের হত্যাকারী। তোমাকে সময় দিব ভাবলে কি করে? আমার মতো আর কেউ যেন মাতৃহীন না হয়। এই সুন্দর পৃথিবীতে তোমার মতো পাপিষ্ঠের কোনো ঠাঁই নেই। নরকেও জায়গা হবে না তোমার।
ইনায়ার ক্রোধিত কন্ঠ। সিয়া তখনো শান্ত। হঠাৎই দরজা খোলার শব্দ শোনা যায়। বাড়ির সবাই জমা হয় পশ্চাদ্ভাগের উঠানে। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। স্ট্রিকল্যান্ড অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন। এই সেই পি’শাচ যে কিনা ইলহামার দেহের সমস্ত রক্ত শুষে খেয়েছিলো। আর্নি ভয়ে ভয়ে ওর বাবার পিঠের পেছনে মুখ লুকায়। একহাতে স্ট্রিকল্যান্ডের বাহু জাপ্টে ধরে। ক্রিস্তিয়ান নির্ভীক। ভয়ের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই তার চোখে মুখে। মাদাম ল্যারি আর ফ্রাঙ্কলিন অত্যাধিক বিস্ময়ে জড়ীভূত। অবিশ্বাস্য!! চোখের সামনে তারা এ কাকে দেখছে? সেই আদল, হালকা নীলাভ চোখ, সোনালী চুল। সেই আঠারো বছর আগের ছোট্ট আব্রাহাম স্যাভেরিনের মতো দেখতে। বড় হলে নিশ্চয়ই এরকমই হতো সে। মাদাম শঙ্কিত মুখে ফ্রাঙ্কলিনের দিকে তাকায়। ফ্রাঙ্কলিনের গলার সাথে আত্মাও শুকিয়ে যায়। শুকনো একটা ঢোক গিলে নেন তিনি। হঠাৎই স্ট্রিকল্যান্ড চিৎকার দিয়ে বলেন,,,
– এই জা’নোয়ারটাই আমার চোখের সামনে ইলহামার প্রাণনাশ করেছিলো।
– ক্রিস্তিয়ান,সিয়া। লোহার গজাল নিয়ে এসো। কাঠের টুকরো, রসুন আর আগুন নিয়ে এসো। আমি ওকে আরও ভয়াবহ যন্ত্রণা দিয়ে মা’রবো।
ইনায়ার কথা শুনে আব্রাহাম ব্যথিত হয়। এই বুঝি চিরতরে তার হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। দু’চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। স্ট্রিকল্যান্ডের বলা কথাটা মনে পড়তেই হিংস্রাত্মক হয়ে উঠে। ভেতর থেকে তার পি’শাচ সত্তা দৃঢ় কন্ঠে বলে,,,
– তোমাকে বাঁচতে হবে। অন্তত নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে তোমাকে বাঁচতে হবে। মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে তুমি ম’রে যেতে পারো না। বুক থেকে ক্রুশ লকেটটা টেনে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দাও দুরে।
ক্রমে ক্রমে শরীর অবশ হয়ে আসে। আব্রাহাম শক্ত হাতে ক্রুশ চেপে ধরে। হাত পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু পারতে হবে। এখানে তাকে রক্ষা করার মতো কেউ নেই। অদুরে ওভারলর্ডের কিছু ভাম্পায়ার সৈন্য পাহারায় আছে। কিন্তু ওরা আব্রাহামের বিপদ সম্পর্কে জানবে কিভাবে?
– জলদি করো। সময় নেই। আমি তোমাকে প্রথম থেকেই সাবধান করেছিলাম।___ আব্রাহামের পি’শাচ সত্তা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে।
আব্রাহাম আকাশ কাঁপিয়ে দু’বার চিৎকার দিয়ে উঠে। আহ! কি বেদনা বিধুর সেই চিৎকার। যার শব্দ চারদিকে প্রতিধ্বনিত হয়। এখান থেকে স্ব শরীরে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। দেহের সব শক্তি ফুরিয়ে গেছে। তবে কি শেষ রক্ষা হবে না আর? দুর্ভাগ্য!! এভাবেই নির্মম মৃ’ত্যু লেখা ছিলো তার?
সিয়া আর ক্রিস্তিয়ান বারান্দা হয়ে কামরায় চলে যায়। ইনায়া দাড়িয়ে থেকে আব্রাহামের যন্ত্রণা উপভোগ করে। হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করে। কিছুক্ষণ পর ইনায়ার কথা মতো সবগুলো জিনিস নিয়ে ফিরে আসে ক্রিস্তিয়ান আর সিয়া। ইনায়া উপহাস করে বলে,,,
– কষ্ট হচ্ছে? খুব বেশি যন্ত্রণা অনুভব করছো? এটা তোমার পাপের শাস্তি। এখানেই শেষ নয়। জানি, তুমি এতো সহজে ম’রবে না। আমি তোমাকে এর থেকেও ভয়ংকর শাস্তি দিয়ে মা’রবো। তোমাকে ধ্বংস করবো। আজ, এই মূহুর্তে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ইনায়া। পেছনে ক্রিস্তিয়ান আর সিয়া। ইনায়া পুনরায় কথা বলে,,,
-কি ভেবেছিলে? আমি তোমার কথা বিশ্বাস করবো ? তুমি এতো সহজে আমার মগজ ধোলাই করবে? ভুল ভেবেছিলে। এভাবেই এক এক করে ধ্বংস হবে সব র’ক্তচোষা পি’শাচগুলো। মৃ’ত্যুর আগে শুনে যাও, তোমার ভাইকেও খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে পৌঁছে দিব। যতদিন বাঁচবো ঠিক ততদিন নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকবো। শক্তি দিয়ে যদি ওদের বিনাশ না করতে পারি, তাহলে ছলনার আশ্রয় নেব। জানোতো, একজন নারী চাইলে সবকিছু করতে পারে।
আব্রাহামের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। চোখগুলো রক্তবর্ণ হয়ে উঠে। লাল টুকটুকে ঠোঁটের দু’পাশ থেকে দু’টো তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে। সিয়ার কাঁধে থাকা ক্রুশ চিহ্ন টা জ্বলজ্বল করে উঠে।
বুকে গেঁথে যাওয়া ক্রুশ লকেটের শুভ শক্তির কাছে আব্রাহামের অশুভ শক্তি যেন ফিকে হয়ে গেছে। নিজেকে ভীষণ দুর্বল অনুভব করে। দৃঢ়চিত্তে দেহের সব শক্তি প্রয়োগে বুকে বিঁধে থাকা ক্রুশ লকেট’টা টেনে তুলে সে। অতঃপর সেটা অনেক দুরে ছুঁড়ে ফেলে। পুনরায় মানব রুপে ফিরে আসে। ক্রুশ ধরে রাখা হাতের মাংশটুকু বাজে ভাবে পুড়ে গেছে। গভীর ক্ষত হয়ে গেছে হাতে। শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। তখনকার দেওয়া তার চিৎকার শুনে একসাথে কতগুলো কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়ে আসে। সিয়ার ক্রশচিহ্নটা আবারও জ্বলতে শুরু করে। আব্রাহাম তো মানব রুপেই আছে। তাহলে পি’শাচ রুপে আর কে আছে এখানে? ভাবতে না ভাবতেই সিয়া একসাথে কয়েকটা কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখতে পায়। ইনায়াকে আড়াল করে ওর সামনে গিয়ে দাড়ায়। বাকিদের সাবধান করে বলে,,
– ওরা একজন নয়। বেশ কয়েকজন।
সিয়ার কথা শুনে বাকিরা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলায়। আচম্বিতে খুব জোরে বাতাস বয়। বাতাসের দাপটে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যায়। শুরু হয় তুষার ঝড়। চোখের পলকে কতগুলো ধোঁয়ার কুণ্ডলী একত্র হয়ে আব্রাহামের অসাড় দেহখানা উড়িয়ে নিয়ে যায়।
ইনায়া হতবাক চোখে দেখে। ওর আফসোস হয়। সাথে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে। আর একটুর জন্য শ’য়তান’টাকে আগুনে জ্বালিয়ে দিতে পারলো না। এই ব্যর্থতা মেনে নিতে ভীষন কষ্ট হয়। সিয়াকে জড়িয়ে ধরে দু’হাতে। আকুল হয়ে কাঁদে। অনুশোচনা মেশানো কন্ঠে বলে,,,,
– হেরে গেলাম সিয়া। অনেক বড় সুযোগ ছিলো, কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। এখনো আমরা কিছুই করতে পারিনি। নিজের এই পরাজয় আমি কিভাবে সহ্য করবো?
সিয়া নিজেকে আরও শক্ত করে নেয়। নিশ্চল হয়ে আসা হাত দু’টো ধীরে ধীরে ইনায়ার পিঠের উপর রাখে। শান্ত গলায় বলে,,,
-মা’য়ের হত্যাকারীকে নিজ হাতে নাশ করতে চেয়েছিলে। আমি মেনে নিয়েছিলাম। তোমার উপর সম্পূর্ণ আস্থা ছিলো। তুমি সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছিলে। তোমার পরিকল্পনা যথেষ্ট প্রসংশনীয়। আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে উপভোগ করছিলাম। আজকের এই হার’টাকে নিজের শক্তি বানাও। আরও শক্তিধর হয় উঠো। প্রথমবার অসফল হয়েছো তো কি হয়েছে?দ্বিতীয়বার তুমি অবশ্যই সফল হবে। আমি সবসময়ই ঢাল হয়ে তোমার পাশে থাকবো।
ইনায়ার মনোবল দৃঢ় হয়। ভেঙ্গে পড়বে না ও। সিয়া ওর কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়। মা মা গন্ধ খুঁজে পায়। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে ইনায়ার মাথার একপাশে চুমু খায়। কয়েক পল সময় গড়ায়। চারদিকে ভোরের আবছা আলো ফুটে উঠে। বাড়ির বাকিরা তখনো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। কারো মুখ থেকে কোনো কথা বোরোয় না। যেন দুঃস্বপ্নে ঘেরা ভয়াল রাতের শেষে আরও একটা সুন্দর সকালের সূচনা হলো।
______________
খারকিভ,ওয়াভেল কোট।
এদুয়ার্দোর কামরায় পরপর কয়েকবার ইতস্তত পায়চারি করছিলো ইজাবেল। দুর্গের বাইরে চারদিকে আলো আঁধারের খেলা চলছে। এই ভোরবেলায় ওভারলর্ড কোথায় গেছেন? নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে। পায়চারি থামিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাড়ায়। ফ্লাওয়ার ভাসে থাকা আর্টিফিশিয়াল চেরি ব্লসমগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। পাতাহীন ডালগুলোতে থোকা থোকা শ্বেতশুভ্র ফুলগুলো একদম জীবন্ত মনে হচ্ছে।
বেশ কয়েক মিনিট সময় গড়ায়। ইজাবেল অপেক্ষা করে। হঠাৎ সশব্দে দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করে এদুয়ার্দো। প্রথমেই ইজাবলের দিকে তাকায়। ভারী গলায় অকপটে জানতে চায়,,,,
– ভোর হতে না হতেই তুমি এখানে?
ইজাবেল হাঁটু ভাজ করে মাথা ঝুঁকে সমান জানায়। চাঞ্চল্য কন্ঠে সহাস্যে বলে,,,
– আসতেই পারি। কিন্তু আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
– ছাদে।
– আচ্ছা। আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। উত্তর না জানা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না।
ইজাবেলের কথা শুনে এদুয়ার্দোর কপাল কুঞ্চিত হয়। চোখ ছোট ছোট করে সরু চোখে তাকায়। ইজাবেল ভয়হীন স্পষ্ট গলায় বলে,,,
-আপনি অস্ত্র হাতে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তা দেখে স্তব্ধ,বাকরুদ্ধ। আপনি সিয়ার সাথে যুদ্ধে লড়েননি কেনো? অন্তত ওর করা আঘাতগুলো প্রতিহত করতেন? তাহলে আপনার পরিধেয় পোশাকটা ছিন-বিছিন্ন হতো না।
এতটুকু বলে ফিক করে হেঁসে দেয় ইজাবেল। হাসির শব্দটুকু যাতে এদুয়ার্দো শুনতে না পায়, তাই দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। এদুয়ার্দো চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায়। ইজাবেল স্বাভাবিক হয়ে দাড়ায়। মিনমিনে স্বরে বলে,,,,
-এই যে আপনি ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু না বলেই চলে এসেছেন। ওরা কি ভাবলো বলুনতো? আজ শেষবারের মতো একজন মাস্টার হিসাবে আমার সাথে আপনার একাডেমিতে যাওয়া উচিত। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আসবেন।
এদুয়ার্দো কিছু বলবে, এমন সময় দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। এদুয়ার্দো অনুমতি দেয়,,,
-এসো।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে কামরায় প্রবেশ করে দু’জন ভাম্পায়ার সেনা। দু’হাটু ভেঙ্গে বসে। বুকের উপর ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ রেখে নত মস্তকে সম্মান জানায়। উদ্বিগ্ন গলায় ভীত ভীত কন্ঠস্বরে বলে,,,,
-অনারেবল ওভারলর্ড। একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা বাঁধা প্রদান করা সত্ত্বেও রুলার ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কোনোভাবে গুরতর আহত হয়েছেন। বুক আর ডান হাতের অনেকটা জায়গা বাজে ভাবে পুড়ে গেছে। দুই জায়গাতেই গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা তাকে চেতনাহীন অবস্থায় দুর্গে নিয়ে এসেছি। এখন নিজের কামরায় আছেন।
ইজাবেল ভয়ার্ত চোখে এদুয়ার্দোর দিকে তাকায়। ওর কৃষ্ণ কালো চোখজোড়া থেকে শব্দহীন অশ্রুকনা গড়ায়। এদুয়ার্দো ঝড়ের বেগে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। চোখের পলকে আব্রাহামের কামরায় প্রবেশ করে। তার চোখে মুখে অস্বাভাবিক ভয়। ভয় পাচ্ছে!! কিসের ভয়? এদুয়ার্দো কোনো কিছুতেই ভীত হয়না। তবুও তার চোখ মুখের রং বদলায়। তুষারশুভ্র মুখকান্তি কালো মেঘে ছেয়ে যায়। পেছনে ইজাবেল। মখমলি চাদর বিছানো নরম বিছানায় পড়ে আছে আব্রাহামের অসাড় অচেতন দেহপিঞ্জর। কামরায় একজন অল্প বয়সী ভাম্পায়ার সেনা দাঁড়িয়ে। সে এদুয়ার্দোকে সম্মান জানিয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। অন্যরা কেউ নয়, এদুয়ার্দো এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার জবাবদিহি কেবলমাত্র অ্যাভোগ্রেডোর থেকে নিবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কোথায়?
নিশ্চল হয়ে আসা পায়ে এদুয়ার্দো বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। ইতোমধ্যে ইজাবেল কাঁদত শুরু করে। আব্রাহামের কাছে বসে ব্যথাতুর স্বরে ডাকে,,,
– ভাই। চোখ মেলে তাকান। কথা বলুন। আপনার এরকম অবস্থা কি করে হলো?
নিঃশ্বাস পড়ছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র নড়চড় নেই। যেন অর্ধমৃত। এদুয়ার্দো নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। ক্রোধের আধিক্যে দু’চোখের রং বদলায়। মনিজোড়া রক্তলাল হয়ে উঠে। কার এতো বড় দুঃসাহস? আব্রাহামের শরীরে আঘাত করার স্পর্ধা দেখিয়েছে!
বেশ কিছুক্ষণ সময় গড়ায়। দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। এদুয়ার্দো অনুমতি দেয়,,,
– এসো।
তার কন্ঠস্বর শুনে ইজাবেল এবং দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তির বুক কেঁপে ওঠে। ইজাবেলের কান্না থেমে যায়। কামরায় প্রবেশ করে অ্যাভোগ্রেডো। তাকে দেখা মাত্রই এদুয়ার্দো ভয়ংকরভাবে রেগে যায়। ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে একহাতে অ্যাভোগ্রেডোর গলা চেপে ধরে। এদুয়ার্দোর মুখখানা ভয়াবহ হিংস্র দেখায়। ক্রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,
– আব্রাহামের এই অবস্থা কি করে হলো? তুমি কোথায় ছিলে?
– অনারেবল ওভারলর্ড। আমি আপনার আদেশ পালন করছিলাম। ক্রিসক্রিংগলের সন্ধানে গিয়েছিলাম। কিন্তু গত তিনরাত ধরে পুরো খারকিভ শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার কোনো সন্ধান পাইনি। আমি লজ্জিত,অনুতপ্ত। দু’দিক থেকেই অপরাধী। নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি। আমাকে শাস্তি দিন।__অ্যাভোগ্রেডো অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে বলে। ইজাবেল ভীত-সন্ত্রস্ত কন্ঠে অনুরোধ করে বলে,,,
– দয়া করে অ্যাভোগ্রেডোকে ছেড়ে দিন। ভাইয়ের অবস্থা ভালো নয়। তাকে সুস্থ করে দিন। শান্ত হন।
এদুয়ার্দো অ্যাভোগ্রেডোর গলা ছেড়ে দেয়। একহাত মুষ্টিবদ্ধ করে পাথুরে দেয়ালে সজোরে আঘাত করে। হাতের উল্টো পিঠ থেকে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। এদুয়ার্দো ক্রোধিত কন্ঠে বলে,,,,
-যেই হোক না কেন, ওর এই অবস্থার জন্য যে দায়ী সে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি ভোগ করবে।
____________
প্রাসকোভিয়া।
বেলা দ্বিপ্রহর। হাঁটতে হাঁটতে একটা শুকনো গাছের গুঁড়ি দেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে দাঁড়িয়ে পড়েন ক্রিসক্রিংগল। ব্যাগের মধ্যে কিছু ফলপাকুড় আছে। খাওয়ার উপযোগী ফল পেলেই তিনি ব্যাগের শূন্য জায়গাটুকু পূর্ন করে ফেলেন। ধপাস করে গাছের গুড়িটার উপর বসে পড়ে মার্কস। অভিযোগের স্বরে বলে,,
-আপনাকে কতবার বললাম, চলুন ফিরে যাই। কেনো বেঘোরে প্রাণ হারাতে চাইছেন? নিজেও ম’রবেন। আমাকেও মা’রবেন।
ক্রিসক্রিংগল বসেন। পকেট হাতরে মানচিত্র বের করে আনেন। শান্ত গলায় নিচু আওয়াজে বলেন,,,
– যেহেতু তুমি রাস্তা চেনো না। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারন আমি নিজের লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত এখান থেকে ফিরে যেতে পারবো না। আমরা এখন দক্ষিণ দিকের রাস্তা ধরে হাঁটছি। এবারও যদি কোনো বিপদের সম্মুখীন হই, পালিয়ে আসবো না। সম্মুখ লড়াই করবো। আমি জানিনা, আমার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে কিনা। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করবো। আমার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সাথে তোমারও। এই ভয়ংকর জঙ্গলে কেনো ম’রতে এসেছিলে? এটা কি ঘুরে বেড়ানোর মতো কোনো জায়গা ছিলো?
মার্কসের মুখখানা ভীষণ করুন দেখায়। শুকনো ঢোক গিলে সে। ক্রিসক্রিংগল উঠে দাড়িয়ে পড়েন। পুনরায় হাঁটতে শুরু করেন। মার্কস তার পিছু নেয়। মনে মনে ভাবে,,,
– আপনার সাথে গেলেও বিপদ, না গেলেও বিপদ।
গতকাল রাতে হওয়া বৃষ্টিতে মাটি পিচ্ছিল হয়ে আছে। দু’জনে সাবধানে পা চালিয়ে হাঁটে। মার্কস ভীত ভীত দৃষ্টিতে চারপাশে নজর বুলায়। দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটার পর তারা এমন একটা জায়গায় চলে আসে, যেখানে জঙ্গলের মাটিতে জন্মানো ঘাসগুলো সব মৃত মনে হয়। গতকাল বৃষ্টি হওয়ার পরও ঘাসগুলো এরকম নেতিয়ে পড়েছে কেনো? ক্রিসক্রিংগল মনে মনে ভাবেন। তার চিত্তজুড়ে বিন্দু বিন্দু সন্দেহের সূচনা হয়। সাবধানে পা ফেলেন। মার্কস নিচের দিকে না তাকিয়ে ডানে বামে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটে। একসময় ক্রিসক্রিংগলের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। অকস্মাৎ মাটি ভেদ করে নিচে পড়তে থাকে সে। ক্রিসক্রিংগল সবে মাত্র ডান পা বাড়িয়েছেন, ঠিক তখনই মার্কস উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠে। ক্ষণিকের জন্য ক্রিসক্রিংগল নিজের বুকের মাঝে মৃ’ত্যুর হিমেল স্পর্শ অনুভব করেন। তিনিও মাটি ধসে ক্রমাগত নিচের দিকে পড়তে শুরু করেন।