প্রেমালিঙ্গণ | পর্ব – ৫

ক্যান্টিনে বেজায় মন খারাপ করে বসে আছে ইলোরা। তন্দ্রাও তার পাশে বসেছে। তার বেশ বোরিং ফিল হচ্ছে এখানে বসে থাকতে। সেই কখন থেকে মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে তন্দ্রা কিন্তু আফসোস বকবকানি বুড়ি ইলোরা কিছুই বলছে না।

“ইলু তুই কী বলবি নাকি আমি চলে যাব?”

বেশ খানিকটা বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলে তন্দ্রা। ইলোরা এবার ন্যাকা স্বরে তন্দ্রার হাতখানা ধরে বলল‚

“মুহিতের সাথে কাল রাতে আমার খুব ঝগড়া হয়েছে। আমি ওকে ফেসবুক‚ মেসেঞ্জার‚ ইন্সটাগ্রাম সব জায়গা থেকে ব্ল’ক করে দিয়েছি। ওর নাম্বারও ব্ল’ক করে দিয়েছি।”

“তাহলে মুখটাকে প্যাঁচার মতো করে বসে আছিস কেন?”

“এখন যদি অন্য কোনো মেয়ের পিছে ঘুরে?”

“তাতে তোর কি? অন্য মেয়ের পিছু ঘুরতেই পারে। তুই তো ওকে ব্লক করেই দিয়েছিস।”

“অ্যা বললেই হলো। অন্য মেয়ের দিকে তাকালে ওর চোখ তুলে নেব আমি।”

“তাহলে আমি তোমাকে দেখব কীভাবে?”

কারো কথা শুনে তন্দ্রা আর ইলোরা দুজনেই দুজনের কথা বাদ দিয়ে পাশ ফিরে তাকাল। মুহিত ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে। ইলোরা তাকে দেখা মাত্রই অন্যদিকে মুখ করে বসল। মুহিতও একটা চেয়ার নিয়ে তার পাশেই বসল।

“স্যরি বেবি। আর তোমার সাথে ঝগড়া করব না। এটাই লাস্ট চান্স।”

মুহিতের কথায় যেন ইলোরা মুহূর্তেই গলে জল হয়ে গেল। সে তো এটাই চাইছিল‚ যে মুহিত এসে তার কাছে স্যরি বলুক। সবকিছু মিটমাট করে ফেলুক।

“সত্যি বলছ তো?”

“হুম হুম!”

“আচ্ছা এবারের মতো মাফ করলাম।”

তন্দ্রা যেন এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। চুপ করে ওদের নাটক দেখছে। ফ্রী তে এমন নাটক কে-ই বা দেখতে পারে! ওদের রিলেশনে এমন ঘটনা অহরহ। সে এমনটায় অভ্যস্ত। তাইতো ইলোরার মন খারাপে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। সে জানত মুহিত কিছু সময় পর এসে ঠিকই মানিয়ে নেবে। দুজনকে একত্রে দেখতে তার বেশ ভালোই লাগে।

“তন্দ্রা কী খাবি বল!”

মুহিতের কথায় যেন তন্দ্রার ভাবনার ছেদ পড়ে। মৃদু কণ্ঠে বলল‚ “হুম!”

তন্দ্রার ছোটো উত্তরে মুহিত যেন খুশি হয়নি। সে নিজেই উঠে চলে গেল খাবার অর্ডার করতে। কিছুক্ষণ পর টেবিলে খাবার আসতেই তিনজন একসাথে খেয়ে নিল। মুহিত খাবারের বিল দিয়ে, তিনজন ক্লাসে চলে আসল। মনোযোগ সহকারেই বাকি ক্লাসে করল ওরা। ছুটির পর ইলোরা তন্দ্রাকে বলল‚

“সামনেই মেলা বসেছে যাবি?”

“এই গরমে মেলায় যাব? পরে না বেহুশ হয়ে যাই!”

“আরে কিচ্ছু হবে না। চল তো।”

ইলোরা তন্দ্রার হাত ধরে নিয়ে যায়, মুহিতও আছে তাদের সাথে। মেলাটা বেশ জমেছে। বিকেল থেকেই কেমন মানুষের ভীড় জমে গিয়েছে! প্রত্যেকটা দোকান ঘুরে ঘুরে দেখছে ওরা। ভীড়ের মাঝে তন্দ্রার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। গরমে হাসফাসও করছে কিছুটা।

“এই গরমে তোকে এখানে আসতে কে বলেছে?”

একটা দোকানে দাঁড়িয়ে তন্দ্রা একজোড়া কানের দুল দেখছিল। এমন সময় কারো গলার আওয়াজে চকিত হয়ে পেছনে ফিরে তাকা। স্বাক্ষর তার সামনে দাঁড়িয়ে। পড়নে সাদা শার্টটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। ফর্সা মুখশ্রীটায় হালকা লাল আভা দৃশ্যমান। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। তন্দ্রা শুনেছে নাক ঘামলে নাকি মেয়েরা “বর সোহাগি” হয়। তবে কী স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে তা উল্টো হবে!

“এভাবে তাকিয়ে কী দেখছিস? কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি!”

তাকানোর কথা শুনে তন্দ্রা হতচকিত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমতা আমতা করে বলল‚

“মুহিত আর ইলোরার সাথে এসেছি। একটু পরেই চলে যেতাম।”

“বুঝলাম। কিছু কিনেছিস?”

“উহু।”

“চল আমি কিনে দিচ্ছি।”

স্বাক্ষর কাছে গিয়ে তন্দ্রার কোমল হাতটা নিজের পুরুষালি রুক্ষ হাতের মাঝে নিয়ে নিল। হুট করে এভাবে হাত ধরায় তন্দ্রার মাঝে একটা উসখুস ভাব চলে এলো। তবে সে তা প্রকাশ করল না। স্বাক্ষর সবসময় প্রয়োজন অনুযায়ী সবার সাথে কথা বলে। তার স্বভাবের দিক থেকে গম্ভীরতা’টাই বেশি। প্রয়োজন ছাড়া তন্দ্রার সাথেও খুব একটা কথা বলে না তবে সে তার প্রতি ভীষণ পসেসিভ। আরও কিছুক্ষণ মেলায় থেকে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে বাসায় চলে আসে। ড্রইং রুমে সোফায় বসেই তুলিকে ডাক দিল স্বাক্ষর। তার গলার আওয়াজ শুনে তুলির পেছন পেছন অ্যালভিনও চলে এসেছে৷ স্বাক্ষর তার ব্যাগ থেকে তুলির জন্য কিছু হেয়ার ব্যান্ড বের করল। হেয়ার ব্যান্ড গুলো তুলির খুব পছন্দ হয়েছে। অ্যালভিন ড্যাবড্যাব করে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আশায় রয়েছে‚ ‘স্বাক্ষর তার জন্যও কিছু এনেছে।’ তন্দ্রা তার ঘরে যাবার আগে অ্যালভিনের দিকে তাকিয়ে বলল‚

“ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তোর জন্য ভাইয়া কিছুই আনেনি দুষ্টু বিড়াল।”

“মিয়াও।”

স্বাক্ষর তন্দ্রার কথা শুনে হাসল এরপর অ্যালভিনকে কোলে তুলে নিল। কিছুক্ষণ আদর করে ঘরে চলে আসল। ঘরে এসেই প্যান্টের পকেট থেকে কালো পাথরের পায়েল বের করল। এটা সে তন্দ্রার অগোচরেই তার জন্য কিনেছে। যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল স্বাক্ষর।

ডাইনিং টেবিলে মিসেস সাহেরা খাবার বাড়ছেন। দুপুরে গরুর গোশত রান্না করেছিলেন। এতো সময়ে তরকারি জমে গেছে তাই মিসেস তাহেরা তা চুলায় গরম বসিয়েছেন। তন্দ্রা গোসল করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল গুলো টাওয়াল দিয়ে মুছছে আর ধ্যানে নিজের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের ডাকে তন্দ্রার ঘোর কা’টল। বিছানার উপর থেকে নীল রঙা ওড়নাটা গলায় পেচিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসল। স্বাক্ষর খাবার নিয়ে বসে আছে।

“এতো সময় লাগে আসতে? তোর জন্য ছেলেটা অপেক্ষা করছে।”

তন্দ্রাকে দেখা মাত্র মিসেয়া তাহেরা কথাটা বললেন। তন্দ্রা চেয়ার টেনে স্বাক্ষরের সামনাসামনি বসল। খাবার বেড়ে দিয়েই মিসেস সাহেরা এবং মিসেস তাহেরা চলে গেলেন। বাকিটা তন্দ্রা বেড়ে দিতে পারবে। ড্রইং রুমে বসে উনাদের প্রিয় নায়ক সালমান শাহ্ এর ছবি দেখছেন। স্বাক্ষর বিনা বাক্যে খাবার খেয়েই যাচ্ছে‚ যার কারণ তন্দ্রাও চুপ। নিরবতা ভেঙে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে বলল‚

“সামনেই তো সেমিস্টার। প্রস্তুতি কেমন?”

তন্দ্রা টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে কিছুটা পানি খেল এরপর উত্তর দিল‚ “ভালোই ভাইয়া।”

ভাইয়া ডাকটা স্বাক্ষর বরাবরই তন্দ্রার কাছ থেকে শুনে এসেছে। যতবারই এই ভাইয়া ডাকটা তার কর্ণকুহরে পৌঁছায় ততবারই তন্দ্রার প্রতি তার মেঘের মতো একরাশ অভিযোগ এসে জমা হয় মনাকাশে। তার পক্ষে কিছু বলারও উপায় নেই। তন্দ্রাকে একটু একটু করে নিজের ভালোবাসা অনুভব করাবে সে। তারও বোঝা উচিত তন্দ্রা বিপরীতে তার জন্য কিছু অনুভব করে কি-না!

সন্ধ্যে থেকে আকাশটা কেমন গুমোট হয়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় কালো মেঘেরা একজোট হয়ে ছিল। বাতাস না বইলেও ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। হয়তো কাছে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে৷ পড়া শেষ করে সবে মাত্র তন্দ্রা বিছানায় গিয়ে বসেছে। এরই মাঝে তুমুল বাতাশ বইতে শুরু করেছে চারপাশে। হয়তো ঝড় আসবে। তন্দ্রা কালো রঙা দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখল। রাত হয়েছে অনেকটা। বারোটার কাছাকাছি ঘড়ির কা’টা। রাতের খাবার খেয়েছে অনেক সময় আগেই। এতক্ষণে হয়তো সবাই যে যার ঘরে ঘুমোচ্ছে। তুলি বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে আছে। বেলকনির দরজা খোলাই আছে। ঘরে জানালা গুলো খোলা যার দরূন ঝড়ো বাতাসে পর্দা গুলো বারবার সরে যাচ্ছে। আকাশে কিছু সময় পর পর শব্দহীন ব’জ্র’পাত হচ্ছে। তন্দ্রা বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা গুলো আটকে দেয়। বেলকনির দরজা আটকাতে গেলে‚ তার মনে হয় কিছু সময় দরজাটা খোলাই থাক। বেলকনিতে গিয়ে গ্রিলে ধরে দাঁড়াল তন্দ্রা। একপলক বাইরের আবহাওয়া কেমন তা দেখে নিল। পাশের বাড়ির আম আর নারকেল গাছটা বাতাসের জন্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা নিশ্বাস নিল তন্দ্রা। তারপর বেলকনির দরজা আটকে ঘরের ভেতর চলে এলো। এরই মাঝে মনে হলো কেউ দরজায় নক করছে। তার ঘরের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। তন্দ্রা বালিশের পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াল এরপর ঘরের ভেতরে আসতে বলল। স্বাক্ষর ঘরে আসল‚

“ভাইয়া তুমি এই সময়?”

“একটু দরকার ছিল।”

“কী দরকার?”

“তোকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল।”

কথাটা বলে স্বাক্ষর তার পকেট থেকে কালো পাথরের সেই পায়েলটা বের করল। যেটা সে তন্দ্রার জন্য তারই অগোচরে মেলা থেকে কিনে এনেছিল।

“পায়েল।”

“হুম তোর জন্য। পড়িয়ে দিই?”

স্বাক্ষরের কথায় তন্দ্রা নির্বাক, নিস্তব্ধ এবং হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। যা দেখে স্বাক্ষর তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল‚

“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? পড়িয়ে দিই?”

তন্দ্রা কী বলবে ভেবে পায় না। এদিকে স্বাক্ষর তন্দ্রার নিশ্চুপ হয়ে থাকাটাকেই সম্মতি ধরে নিল। তন্দ্রার হাত ধরে বিছানায় বসাল। এরপর ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পা’টা নিজের হাঁটুর উপর তুলে নিল। স্বাক্ষরের এমন কান্ডে তন্দ্রা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। অস্বস্তিতে পা সরিয়ে নিতে চাইলেও স্বাক্ষর তা করতে দিল না। নিজেই পায়েলটা তন্দ্রার বাম পায়ে পড়িয়ে দিল। এরপর একটা অসম্ভব কাজ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল স্বাক্ষর। আর তন্দ্রার ফ্যালফ্যাল নেত্রযুগল তার যাওয়ার পানে আটকে রইল। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকা স্বাক্ষর তাকে পায়েল পড়িয়ে দিয়েছে। তার চেয়ে অবাক করা কাণ্ডটা এইযে‚ স্বাক্ষর তার পায়ে চুমু দিয়েছে। ভাবতেই তন্দ্রার গৌরবর্ণের কপোলদ্বয়ে লাল আভা ছড়াল। তার সারা শরীর এখনো শিরশির করছে। অন্যদিকে স্বাক্ষর নিজের ঘরে এসে লম্বা নিশ্বাস ছাড়ল। একটু হলেই যেন দম আটকে মা’রা যেত। এই মুহুর্তে তার ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। কী কান্ডটাই না করে ফেলল সে! আজ রাতে হয়তো আর ঘুমই আসবে না তার।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।