১৬ বছর বয়স | পর্ব – ১৯

আমি মনে মনে বললাম, ওনাকে কি প্রশ্ন করব আমরা একা কেন!
শাওন উঠে দাড়ালো আর বলল, নামো।
বলেই শাওন গাড়ি থেকে নেমে গেল। আমি ভ্রুকুচকে আশেপাশের সীট গুলার দিকে আর একবার তাকিয়ে দেখলাম। সত্যিই কেউ নেই।
তারপর বাস থেকে নামলাম।
অহো! সবাই নেমে দাঁড়িয়ে আছে। গন্তব্যে পৌছে গেছি মনে হয়!
সুমনা হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ভেঙেছে তাহলে ঘুম!
আমি একটা হাসি দিলাম শুধু।
এখন যে প্রশ্ন মনের মধ্যে বাকি সেটা হলো আমি ত মোহিতের পাশে ছিলাম। শাওন কিভাবে চলে এলো!
সুমনা আমাকে হালকা নাড়িয়ে বলল, কি হলো কি চিন্তা করছ?
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।
“এখান থেকে আমরা জিপ নিব। সন্ধ্যার পরেই সাজেক পৌছে যাব। এখান থেকে বাস যায়না আরো কিছু ইস্যু আছে যার জন্য জিপ গাড়িতে যেতে হবে। সামনে গিয়ে আর্মিরা চেক দিবে তারপরই সিরিয়ালে সব কার গুলো যাবে। অর্থাৎ তিন টায় নেক্সট আন্ড লাস্ট চান্স। তার আগেই জলদি খাওয়া দাওয়া করে নিই চলো।” সুমনা বলল।
আমিও যদিও পড়েছিলাম এই বিষয়ে। সাজেকে যাবার জন্য গাড়িগুলো সাড়ে দশ বা এগারোতে ছেড়ে যায় আর দুপুরে তিনটায়। এ বাদে হবে না।
আমরা নিজেদের লাঞ্চ করতে বসলাম সাধারণ একটা হোটেলে। যদিও এটাকে লাঞ্চ টাইম বলা চলে না। সকালের ব্রেকফাস্ট বলা যায় যেটা লেট করে করছি।
এক টেবিলে আমি সুমনা আর দিয়া এক পাশে। অন্য পাশে সুমনার সোজা শাওন আর আমার সোজা মোহিত তার পাশে রবিন।
মোহিত মুখ খুলে কিছু বলতে যাবার আগেই রবিন বলে উঠল, খাবার সময় বেশি কথা বলিস না অন্তত!
মোহিত হেসে বলল, অহ অলরাইট।
সবার জন্য খিচুড়ি অর্ডার করা হলো। অনেকদিন পর খিচুড়ি দেখে আমার এত খুশি লাগছে বলার মত না।
মোহিত আমার দিকে তাকিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল, ইউয়োর ফেভারিট রাইট?
আমি মাথা ঝাকিয়ে হাসির সাথে বললাম, খুবই।
মোহিত একটু নড়েচড়ে বসে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “আমিও বেঙলী ফুড অনেক পছন্দ করি। হাহা। আমার বাবা বেঙলী। হি ক্যান কুক এভরিথিং। জাস্ট এমেইজিং!”
সবাই খেতে ব্যস্ত। কেউ মোহিতের কথায় কান দিচ্ছে না শুধু আমিই শুনছি আর খাচ্ছি। ভালো বিষয় হলো খিচুড়িতে কুমড়ো নেই।
খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা জিপ গাড়িতে উঠলাম। বাসের চেয়ে চওড়ায় একটু ছোট হলেও সীট গুলো বাসের মত দুইটা করে। উচ্চতার দিক থেকেও ছোটো।যাক এটার জালানায় কোনো কাচ নেই। অর্থাৎ ফুরফুরে বাতাসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতে পারব। মোহিন ফট করে এসে আমার পাশে বসে পরল।
আমি এখন ওর সাথে ভালই মানিয়ে নিয়েছি৷ এতটুকু সময়ে যা বুঝতে পেরেছি তা হলো ছেলেটা খুব ভাল মনের মানুষ। বকুলের মত।
সুমনা আর শাওন আমাদের সোজা পিছনে বসেছে এবার।
মোহিত এত সময় অনেক গল্প করেছে তাই এখন ফোন বের করে আমাকে একটা গেম দেখাতে লাগল। সত্যিই গেমটা অনেক মজার। গাড়ি চালানোর গেম। আমি অনেক ক্ষন ধরে খেলা টা দেখছি আর মোহিতের বিবরণ শুনছি যে কিভাবে খেলা যায়। অনেক দূর খেলে তারপর গাড়ির এক্সিডেন্ট হলো।
মোহিত বলে উঠল, অহ শীট!
কিন্তু আমি খুশিতে হাতে তালি দিয়ে বললাম, আপনি অনেক ভাল খেলেন সত্যি।
শাওন পিছন থেকে একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দুই গাধা এক জায়গায় হলে যা হয় আর কি!
আমরা দুইজন ই শুনে নিলাম।
আমি রেগে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। মোহিত হাসিমুখে শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল, Bro, wanna play?
“আমি কোনো ফালতু গেম খেলি না।” বলল শাওন।
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙিয়ে বললাম, “ফালতু গেম খেলি না! হুহ।”
তারপর মোহিতকে বললাম, গেম খেলতে পারেনা ত এজন্য।
শাওন রাগে দাতেদাত চিপে বলল, Shut up. You talk too much.
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে শাওনের দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে বললাম, আপনি Shut up. আমরা ত চুপচাপই ছিলাম।
শাওন আরো রেগে গেল। আমি রেগে সামনে ঘুরে তাকালাম। মোহিত বুঝতে পেরে বলল, ওকে ওকে রিলাক্স। তোমরা এত ঝগড়া করলে রোমান্স কখন করবে?
শাওন কড়া চোখে মোহিতের দিকে তাকালো।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, কিসের রোমান্স!
মোহিত একবার আমার একবার শাওনের দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেল।
তারপর আমাকে বলল, you know, Romance. বেঙলীতে কি বলে?
শাওন গম্ভীর গলায় মোহিতকে বলল, চুপচাপ তুই তোর গেম খেল।
আমিও ইশারায় মোহিতকে আবার শুরু করতে বললাম।
মোহিতকে অনেক সময় খেলতে দেখে এখন আমারো খেলতে ইচ্ছে করছে। তাই বলে বসলাম যে আমিও খেলব।
মোহিত খুশি মনে বলল, ইয়া হিয়ার ইউ গো। ট্রাই ইট।
আমি শুরু করলাম কিন্তু সাথে সাথে হেরে গেলাম। মন খারাপ হয়ে গেল। মোহিত অল্প হেসে বলল, “ইটস অলরাইট। হবে হবে।”
আমি দ্বিতীয় বারও হেরে গেলাম। এবার ঠোঁট উলটে ফোন মোহিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, আরো শিখা বাকি আমার।
অনেকটা পথ গিয়ে সত্যিই আর্মিদের ওখানে থামাতে হলো। যদিও ড্রাইভার একাই গিয়ে সব সামলে নিল। তারপর অনেক গুলো গাড়ি একসাথে সাড়িবদ্ধভাবে রওনা হল সাজেকের উদ্দেশ্যে।
এবার শুরু হলো আসল পথ। রাস্তার দুই পাশে সবুজ গাছ বেয়ে বেয়ে নিচে চলে গেছে। আমরা ধীরে ধীরে অনেক উপরে উঠছি। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে অনেক উপরে। এখন আর আমরা গেম খেলছি না এখন বাহিরে তাকিয়ে আছি মুদ্ধ হয়ে। আকাশ পুরো নীল। মাঝে কয়েকটা তুলোর মত মেঘ কেউ হয়তো ঝুলিয়ে রেখেছে। মোহিত এখন ফটো তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল।
আমি জালানার উপর হাত দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। এদিকে আমার ওড়নার এক প্রান্ত বাহিরে উড়ছে। যত দূর চোখ যায় সব সবুজ আর সবুজ। আমরা আস্তে আস্তে অনেক উঁচুতে উঠছি। হঠাৎ মনে হচ্ছে কুয়াশা এসে আমাদের ঢেকে দিচ্ছে আবার মনে হচ্ছে চারিদিক রৌদ্র উজ্জ্বল।
দেখতে দেখতে যে কখন সাজেক এসে পৌছে গেলাম নিজেও জানলাম না। আসতে আসতে আমাদের সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে গেল। সবাই সাজেকের একটা রিসোর্টে উঠলাম। রিসোর্টটা অনেক সুন্দর। বাশ দিয়ে তৈরি। চারি পাশে বেলকোনি আছে। এখন আমার চিন্তার বিষয় হলো আমাকে শাওনের সাথে এক রুমে থাকতে হবে। ওনার সাথে এক রুমে থাকা মানে মূর্তির মত বসে থাকা। সুমনাকে শাওন বলল ওর সাথে আমাকে এক রুমে নিতে। কিন্তু সুমনা সরাসরি বলে দিলো, আমি আর দিয়া থাকব এক রুমে। তুই আর মিলা একটা রুমে। আর দুইটা রুম আছে যেখানে চারটা করে বেড সেখানে বাকি আটজন থাকবে। এর বেশি রুম আমি বুক করিনি।
বলেই মুচকি হাসতে লাগল সুমনা। শাওন বুঝলো যে সুমনা ইচ্ছে করেই এটা করেছে।
শাওন বলল, তোকে দিয়ে রিসোর্ট বুক করানো আমার বোকামি ছিল।
সব ফ্রেন্ডরা হা করে কাহিনী দেখছে। মোহিত এগিয়ে এসে বলল, এনি প্রব?
রবিন এগিয়ে এসে বলল, নো প্রব। যদি সমস্যা থাকেও সেটা আজ রাতেই ঠিক হয়ে যাবে।
বলেই রবিন হেসে দিল।
আমি কিছু বুঝতে না পেরে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শাওন ভ্রুকুচকে রবিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
সুমনা বলল, বহুত হয়েছে এখন সবাই ফ্রেস হয়ে খাই চল। ম্যানেজার খাবার দিয়ে যাবে। এই খোলা উঠানে বসে আমরা চিকেন কাবাব খাব।
সুমনা আমাকে বলল, এদিক এসো তোমাকে তোমাদের রুম দেখিয়ে দিই।
সুমনা আমাকে নিয়ে গিয়ে রুমে ঢুকিয়ে দিল। রুমটা অনেক সুন্দর। দরজার কাছে লাল পর্দা ঝুলছে। আবার ঘরের চারি কোনায়ও বড় বড় লাল পর্দা ঝুলছে। উপরের দিকে কয়েকটা বল টাঙানো যা রঙিন সুতায় জড়ানো। হলুদ রঙ এর আলো জ্বলছে রুমটায়। বিছানার এক পাশে একটা আলনা আর ড্রয়ার আছে।
সুমনা বলল, থাকো তাহলে। আমি ফ্রেস হব। তারপর সবাই একসাথে বসে শুরু করব আসল আড্ডা। তুমি জলদি শাওয়ার করে চলে আসো।
আমি শুধু সুমনার দিকে তাকালাম। সুমনা চলে গেল। এই রুমে একটাই খাট। তাও কত ছোটো। তার উপর আবার কোনো সোফাও নেই। তবে পিছনের দিকের বেলকোনিতে একটা দোলনা আছে। দোলনায় কিভাবে ঘুমাব? আমি ভাবতে ভাবতে বেলকোনিতে গিয়ে দাড়ালাম। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আমার চোখের সামনে। একটু হাটলেই মেঘ সমেত সূর্য হাতে পাব এমন।বেলকোনিতে কাঠের বেড়া দেওয়া। তার সামনেই অনেক নীচ অব্দি তাকালে শুধু সবুজ গাছ আর গাছ।
শাওন এসে রুমে ঢুকল। আমি পিছন ফিরে তাকালাম। শাওন ব্যাগ নিয়ে এসেছে। যাক ভাল। আমার জামা কাপড় সব ওটাতেই আছে। কারন সুমনা আসার সময় শাওনের ট্রাভেল ব্যাগেই আমার জামা কাপড় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আর বলেছিল, এক দিনের জন্য যাবি এতে যদি দুইজনের দুইটা ব্যাগ লাগে তাইলে আর কি বলব?
শাওন আমার দিকে তাকালো। আমি চোখে চোখ পরতেই অন্যদিকে তাকালাম। শাওন নিজের ব্যাগ খুলে আমার জামাকাপড় গুলো বের করে খাটের উপর ফেলল। তারপর ওর জামাকাপড় নিয়ে গোসলে চলে গেল। আমি একটা হাফ ছেড়ে জলদি এসে নিজের জামাকাপড় গুলো নিলাম। পাশেই একটা ছোট ড্রয়ারের মত জিনিসের উপর জামাকাপড় গুলো রেখে যেটা পড়ব এখন সেটা হাতে নিয়ে বিছানার বসে পা নাড়াতে লাগলাম। না জানি আজ কিনা সত্যিই ওই দোলনায় ঘুমাতে হয় আমাকে! রাতে ত হয়ত শীত পরবে। ভাগ্যিস বিছানায় দুইটা কম্বল আছে।
কিছুক্ষণ পরেই শাওন একটা কালো ফুলহাতা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে বের হয়ে আসলো। আমি আড় চোখে তাকালাম। শাওনও আমার দিকে তাকালো। আমি উঠে দাড়িয়ে পরলাম। কেমন কেমন যেন লাগছে। শাওন আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেলাম।
কিন্তু সে আমাকে পাশ কাটিয়ে আমার পিছনের আলনাতে নিজের তোয়ালে টা রাখল। আমি নিঃশব্দে একটা নিঃশ্বাস মুখ দিয়ে বের করে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
বের হয়ে শাওনকে রুমে পেলাম না। যাক ভাল। আমি ভিজে চুল মুছতে মুছতে বেলকনিতে এলাম।
একটু পরেই দরজার টোকা পরল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। সুমনা এসেছে।
“চলো, আমাদের মুনলাইট ডিনার রেডি।” হাসিমুখে বলল সুমনা।
আমি তোয়ালেটা দোলনার উপর রেখে ভিতরে এসে বললাম, চলো।
বের হতে হতে সুমনা বলল, আমার কেনা থ্রি-পিস গুলোতে তোমাকে ভালই লাগছে।
আমি কিছু না বলে শুধু অল্প হাসলাম।
সবাই আজ এই খোলা উঠানে বসে খাবে! অনেক মজার বিষয়। চাঁদ অনেক বড় করে আকাশে উঠেছে। সাথে তারাগুলোও অনেক সুন্দর করে ঝলকাচ্ছে। উঠানে এক পাশ দিয়ে চেয়ার পাতানো আছে। শাওন নিজের টি-শার্টের হাতা কিছুটা ভাজ করে নিয়ে অনেক সিরিয়াস হয়ে একটা ট্রের মধ্যে কিছু আধ জলন্ত কাঠ রেখে তার উপর শিকের কাবাব গুলো সেঁকছে।
সুমনা শাওনের পাশে এসে দাড়িয়ে বলল, হয়েছে এবার ছাড় এগুলো। কাবাব আর কাবাব থাকবে না। জীবনুর সাথে কাবাব ও মরে যাবে।
সবাই একে একে চলে এসেছে। ম্যানেজার একটা টেবিল দিয়ে গেছে।
তার উপর নান রুটি আর বিভিন্ন সবজি সাজানো।
মোহিত শাওনের কাছে এসে দাড়িয়ে বলল, অহ খাবাব! মজাই মজা হবে!
সুমনা বলল, কাবাব, কাবাব।
মোহিত সে কথায় কান কান না দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, অহ! ইউ লুক বিউটিফুল।
আমি কিছু না বলে শুধু নিঃশব্দে হাসলাম।
মোহিত বলল, you know আমরা খাবার পরে গেম খেলব। সবাই মিলে। আমি এটা এনেছি। বেঙলীতে কি বলে?
মোহিত একটা তাসের বক্স বের করে দেখালো। আমি বললাম, তাস বলে।
মোহিত মাথা নেড়ে হেসে বলল, ইয়া ইয়া।
সুমনা বলল, আয় সবাই বসে পরি এখন খেতে।
টেবিল ছাড়াই শুধু চেয়ারে বসেই আমরা হাতে প্লেট নিয়ে বসে গেলাম। খাওয়ার সময় সবার কত গল্প।
সবার মধ্যে কয়েকজন আগে নাকি সাজেক ঘুড়ে গেছে। তাই ঘুড়তে কোথায় কোথায় যাওয়া যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। অনেকে বলছে একদিনের জন্য এসে ভুল করেছে আরো দুই এক দিন থাকলে ভাল হত।
হঠাৎ দিয়া আমাকে প্রশ্ন করে বসল, মিলা তোমারা হানিমুনে কোথায় গিয়েছিলে?
আমি স্বাভাবিক চোখে দিয়ার দিকে তাকালাম। সুমনা আমার হয়ে বলে উঠল, কোথাও না রে।
মোহিত বলে উঠল, হোয়াট?
শাওন শুধু ভ্রুকুচকে মোহিতের দিকে তাকালো।
মোহিত আমাকে বলল, Then এটাই তোমাদের হানিমুন ধরা যায়।
অন্য ছেলেগুলোও বলে উঠল, হ্যা। ঠিক।
শাওন কিছু না কপালকুচকে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
খাওয়া শেষে সবাই এবার গোল করে টেবিলের চারিপাশে বসল। আমি আর সুমনা একটু পাশে চেয়ার নিয়ে বসেছি। মোহিত বলল, এখন কোনো গেম খেললে কেমন হয়?
“ভালোই হয়” সবাই মাথা নাড়ল। শাওন কিছু না বলে মোহিতের দিকে তাকালো।
মোহিত আমার দিকে ফিরে বলল, কার্ডস পারো?
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।
তাই মোহিত বলল, তাহলে কি খেলা যায় বলো?
আমি এদিকে ওদিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে করতে লাগলাম।
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা খেলা আসতেই আমি বলে উঠলাম, লুকোচুরি খেললে কেমন হয়?
সবাই বড়সড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো আর শাওন উপহাস মূলক চাহনির সাথে আমার দিকে তাকালো।
মোহিত ওর দুই হাতে একটা তালি বাজিয়ে হাসিমুখে বলে উঠল, পারফেক্ট! হাইড এন্ড সিক! আই ওন্ট টু প্লে।
অন্যরাও মাথা নাড়িয়ে হালকা হেসে বলল, খেলা যায়। ইন্টারেস্টিং হবে!
আমি হাসিমুখে সবার দিকে তাকালাম। মোহিত বলল, তাহলে প্রথমে সবাইকে খুজবে শাওন।
শাওন মোহিতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কিছু খেলব।
মোহিত বলল, তাহলে আর কি!
অন্যদের দিকে তাকিয়ে মোহিত বলল, তাহলে গাইজ, রবিন উইল ফাইন্ড এভরি ওয়ান।
রবিন চোখ ছোট ছোট করে বলল, ভাই আমাকেই প্রথমে চোর বানাই দিল!
আমি বলে উঠলাম, আমরা হাত বাটতে পারি ত!
সবাই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
রবিন বলল, মানে?
আমি বললাম, মানে সবাই মিলে হাতের মাধমেই এপিট ওপিট ফেলার দ্বারা চোর কে হবে সেটা বের করা যাবে। যারা বেশির ভাগ এক পাশের হাত মেলবে তারা পাস। তারপর বাকিদের মধ্যে একইভাবে আবার হাত মেলতে হবে। এভাবে লাস্ট এ যে একা অন্য রকম হাত মেলবে সে চোর।
মোহিত বলল, “ভালো আইডিয়া।”
সবাই রাজি হয়ে গেল। শাওন খেলবে না বলে উঠে চলে গেল। চঞ্চল বেচারা চোর হলো।
তাকে এক কোনায় এক থেকে পঞ্চাস গুনতে দিয়ে আমরা সবাই লুকাতে গেলাম।
আমি কোথায় লুকাবো বুঝতে পারছিনা। তাই রিসোর্টের পিছনের দিকে যে গাছ গুলো ছিল সেখানে লুকিয়ে পরলাম। এমনিই অন্ধকার তাই এটাই লুকানোর জন্য ভালো। খুঁজে পাবে না।
কিছুক্ষণ পরেই ‘এক টিপ’ হিসেবে রোহান ধরা পরে গেল। আর ‘দুই টিপ’ হিসেবে মোহিত।
বেচারাদের জন্য খুবই হাসি পাচ্ছে। আর একটু পরে দিয়া আর সুমনা ধরা পরে গেল।
আমি একটু হেটে এসে রিসোর্টে উঁকি দিলাম। কারন যে খুজছে সে ভিতরের দিকে চলে গেছে। যারা ধরা পরেছে তারা উঠানে দাড়িয়ে গল্প করছে। আমাকে দেখে সুমনা ইশারায় বাম দিকে লুকানোর জন্য চলে যেতে বলল।
আমি বাম দিকে চলে ত এলাম কিন্তু এখন লুকাবো টা কোথায়! আমাদের রুমে ত মনে হয় খুজেছে একবার। সেখানেই লুকালে ভাল হবে।
আমি জলদি করে নিজেদের রুমে ঢুকে লাইট বন্ধ করে দিলাম। তারপর এক কোনায় থাকা লম্বা লাল পর্দার মধ্যে ঢুকে গেলাম।
“লাইট অফ করেছ কেন?” শাওন আমার পর্দার সামনে এসে দাড়িয়ে বলল।
আমি অবাক হয়ে একটু মাথা বের করে ফিসফিস করে বললাম, মুখ বন্ধ রাখেন। আপনার জন্য আমি ধরা পরে যাব।
শাওন ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলল, তুমি মুখ বন্ধ রাখো।
আমি মনে মনে বললাম, গরিলা নিজে ত খেলবে না আমাকেও হারিয়ে দিবে।
হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেলাম। সাথে সাথে শাওনের ঘাড়ের কাছের জামা ধরে টেনে পর্দার মধ্যে নিয়ে এলাম।
শাওন বলে উঠল, “what are…?”
সাথে সাথে আমি এক হাত দিয়ে শাওনের মুখ চেপে ধরলাম। আর পর্দার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে লাগলাম যে কেউ ঢুকেছে কি না!
কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।
শাওন আমার হাত টা ধরে ওর মুখ থেকে নামিয়ে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলল, কি সমস্যা তোমার?
আমি সাথে সাথে ইশারা করে বললাম, আস্তে কথা বলুন। আপনার জন্য আমি ধরা পরে যাব ত!
কিন্তু শাওন পর্দা সরিয়ে চলে যেতে লাগল তাই আমি সাথে সাথে পিছন থেকে ওনার টি-শার্টে চেপে ধরে টান দিয়ে আবার নিয়ে আসলাম। আর ফিসফিস করে বললাম, দুই মিনিটও শান্তিতে দাড়াতে পারেন না! কিসের এত তাড়া আপনার?
শাওন রেগে আমার একদম কাছে এগিয়ে আসলো। আমি ভয়ে ওনার টি-শার্ট ছেড়ে দিয়ে দেয়ালের সাথে লেপ্টে গেলাম। কিজানি এখন আবার কি করবে! শুধু শুধু রেগে যায় কেন বুঝিনা!
শাওন কিছু বলতে যাবে তখনি কেউ রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। আমি চোখ বড়সড় করে শাওনের দিকে তাকালাম। শাওন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো।
আমি দুঃখের সাথে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, জানতাম আপনার জন্য ধরা পরে যাবে।
শাওন আমার দিকে তাকালো। আমি আস্তে আস্তে বললাম,চুপচাপ দাড়িয়ে থাকুন। নড়াচড়া করবেন না।
কিন্তু শাওন পর্দা সরিয়ে বেড়িয়ে গেল। আর সাথে সাথে চঞ্চলের সামনে পরল।
“তুই ওখানে কি করছিলি?” চঞ্চল শাওনকে বলল।
আমি মনে মনে বললাম, “আমি যে এখন ধরা পরব তা আমি সিওর।”
শাওন কিছু না বলে বিরক্তির সাথে তাকালো চঞ্চলের দিকে। চঞ্চল সন্দেহের চোখে হেটে এসে পর্দা সরিয়ে দিয়ে আমাকে দেখে বলল, মিলা দশ টিপ।
আমি মন মরা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
চঞ্চল সরে এসে শাওনকে বলল, তুই ত খেলছিলি না! তাহলে তুই পর্দার পিছনে ওর সাথে কি করছিলি?
বলেই চঞ্চল মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। শাওন ভ্রুকুচকে চঞ্চলের দিকে তাকালো। আমি রাগ মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলাম, সেটাই ত! নিজে ত খেলবে না, আমাকেও শান্তিতে খেলতে দিবে না। কতবার বললাম চুপচাপ দাঁড়াতে! কে শোনে কার কথা!
শাওন কড়া চোখে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। আমি মুখ ভেংচি দিলাম। ওদিকে চঞ্চল হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হতে হতে বলল, ডিস্টার্ব করে ফেলেছি মনে হয়! ভাই তোরা চালিয়ে যা।
আমি মনে মনে বললাম, কি চালিয়ে যাব!
শাওন রেগে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি চমকে গেলাম। এখন আবার কি করলাম আমি! একে ত ওনার জন্য ধরা পরে গেছি। তার উপর উলটা আমাকেই রাগ দেখাচ্ছে!
শাওন আমার দুই বাহু চেপে ধরল।
“আহ, কি করছেন আপনি! লাগছে আমার!” আমি ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বললাম।
“কোথায় কি বলতে হয় জানোনা?” শাওন রেগে বলল।
আমি ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম, “না জানিনা, ছাড়ুন এখন। লাগছে আমার।”
শাওন আমাকে দেয়ালের দিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, “অহ হ্যা, আমি ত ভুলেই গেছিলাম, তুমি ত একটা গাধা!”
আমি রাগ মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে বললাম, আমি যাই হই আপনার মত গরিলা না।
“হোয়াট!” বলে শাওন এক পা এগুতেই সুমনা রুমে এসে ঢুকলো।
সুমনা শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?
শাওন সুমনার দিকে তাকালো তারপর কিছু না বলে সুমনাকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে চলে গেল। সুমনা শাওনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তারপর আমার কাছে এসে বলল, কি হয়েছে?
আমি চোখেমুখে রাগী ভাবসহ বললাম, কি আর হবে! যা হয় সবসময়।
সুমনা বুঝতে পেরে একটা হাসি দিয়ে বলল, মন খারাপ কর না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি প্রশ্নসূচক চোখে সুমনার দিকে তাকালাম।
সুমনা বলল, চল, সবাই একজায়গায় আড্ডা দিচ্ছে।
সবাই আবার এক জায়গায় হয়েছে। আমি শাওনের দিকে একদম ই তাকালাম না। তাকাতে চাই ই না।
“আমি ড্রিংকস নিয়ে আসি” বলেই রবিন উঠে চলে গেল।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় দুই বোতল নিয়ে হাজির হলো।
দুই তিনজন বাদে সেই ড্রিংকস সবাই ই খেল। সেই দুইতিন জন হলো আমি, শাওন আর দিয়া।
তাই রবিন একটা ট্রে তে করে ফলের জুস নিয়ে একটা আমাকে একটা দিয়াকে অন্যটা শাওনকে দিল।
আমার এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না তাই গ্লাসটা টেবিলের ট্রেতেই গিয়ে রেখে দিলাম। সবাই গল্পে ব্যস্ত তাই আমি রুমে চলে এলাম। রুমে এসে বেলকোনির ওই দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিল্কিওয়ে দেখা যাচ্ছে। সত্যিই অদ্ভুত!
সাথে হালকা বাতাসে মনটা ভরে যাচ্ছে। অনেক সময় বসে থাকার পর মনে হলো শীত শীত লাগছে!
এখন ঘুমও আসবে একটু পরেই। কোথায় ঘুমাব? মন মরা হয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। সোজা তাকাতেই দেখলাম শাওন ওপাশে, দরজার সামনের বেলকোনিতে দুই হাত দিয়ে নিজের ভর রেখে মাথা হালকা নিচু করে আছে। আমি পিছন এসে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, আজ আমি কোথায় ঘুমাব?
আমার কথায় শাওন আস্তে মাথা তুলে আমার দিকে ঘুরে তাকালো তারপর একটু থেমে বলল, Who are you?
এমন ভাবে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল যেন বাপের জন্মে আমাকে দেখেনি। আমি হা হয়ে গেলাম।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমি কে! যাকে একটু আগে চেপে মেরে ফেলছিলেন প্রায় সে।
শাওন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। এই কথাটা শুনে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলল, “হোয়াট!”
আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম। গেলাম এজন্যই যে উনি হেসে হেসে কথা বলছে আমার সাথে!
সাজেকে অনেক সুন্দর ঘুড়ার জায়গা আছে জানি কিন্তু ঘুড়তে এসে কাউকে ভুতে পেয়েছে এটা শুনি নি কখনো। গরিলাটাকে ভুতে পেয়েছে নাকি?
কারন উনি ত গরিলা থেকে হাসিখুশি গমলেট হয়ে গেছেন!
শাওন হাসিমুখেই বলল, ইউ আর সো ফানি!
একটা হালকা বাতাস বসে গেল। সেই বাতাস যেন এই মুহুর্ত গুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমি শাওনের কাছে গিয়ে ওনার কপালে হাত দিলাম। শাওন আমার হাত ধরে নামিয়ে বলল, কি করছ!
ওনার গা ত গরম হয়ে আছে। মদ খেয়েছে নাকি? দেখলাম ত জুস খেতে।
আমি বললাম, মদ খেয়েছেন আপনি?
শাওন বলল, কি?
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, থাক বুঝেছি। মদ গিলেছেন। ওইজন্যই এভাবে হাসছেন!
শাওন বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
“মাঝে মাঝে হাসলেও পারেন আপনি। আসলে আপনার বাবা মায়ের উচিত ছিল জন্মের সময় আপনার মুখে মদ দেওয়া।” আমি মুচকি হেসে বললাম।
আমার হাসি দেখে শাওনও একটা সুন্দর হাসি দিল। হাসলে ওনার এক গালে টোল পরে।
সত্যিই অনেক সুন্দর। কিন্তু এ সবই মদের কারবার। আমার মতে ওনার সারাজীবন মদ খেয়েই থাকা উচিত।
খানিকক্ষণ আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
একটু পরেই ঘুম চলে আসলো আমার চোখে। তাই আমি বললাম, আপনি ঘুমাবেন কখন?
শাওন আমার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কোথায় ঘুমাব!
আমি হেসে দিলাম। মাথা গেছে গরিলার। আমাকে হাসতে দেখে শাওন আমার দিকে এগিয়ে এলো। আর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরল।
আমি হকচকিয়ে গেলাম। আমি ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম, কি করছেন আপনি?
উনি আমার উপর ওনার সম্পুর্ন ভরই দিয়ে দিয়েছেন। আমাকে মেরে ফেলার ধান্ধা করছে নাকি এইভাবে?
এভাবে কতসময় থাকতে হবে এখন? নেশা করে এখন আমাকে ভর্তা বানিয়ে ছাড়বে। ওদিকে রুমের কারেন্টও চলে গেছে মাত্র। অন্ধকার হয়ে গেছে চারিপাশ। যদিও চাঁদের আলোয় আলোকিত সব।
আমি অনেক কষ্ট করে ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। উনি একটু সরে গিয়ে এক হাত দিয়ে নিজের কপাল চেপে ধরলেন। হয়ত মাথা ব্যথা করছে।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে ওনার এক বাহু ধরে বললাম, আমার সাথে আসেন।
তারপর ওনাকে ধরে ধরে বিছানার কাছে নিয়ে এলাম। কিন্তু রুম মোটামুটি অন্ধকার। বিছানার কাছে ওনাকে দাড় করিয়ে বললাম, আপনার ফোন কোথায়?
শাওন কোনো উওর না দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমি ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললাম। আর দুইজনে এসে বিছানায় পরলাম।
শাওন আমার দুইপাশে ওর দুই হাত রাখল। আমি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললাম, কি করছেন আপনি!
আমার কথা শেষ হবার আগেই শাওন আমার আরো কাছে চলে আসলো।

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।