দরজায় কান লাগিয়ে ওপাশে উপস্থিত মানুষটার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে পরী। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আর শব্দ শোনা গেল না। পরী ভাবল বোধহয় শায়েরই এসেছে। তাকে পরীক্ষা করছে। তাই সে পরীক্ষা দিতেও প্রস্তুত হলো। আবারো জিজ্ঞেস করল,’পরিচয় না দিলে দরজা খোলা যাবে না। যদি কথা না বলেন তাহলে চলে যান এখান থেকে?’
এবার জবাব এলো। মোটা কন্ঠস্বরে একজন পুরুষ বলে উঠল,’সেহরান ভাই আছে??’
চমকে গেল পরী। সত্যিই তো শায়ের আসেনি। তাহলে কে এলো?দরজা তো কিছুতেই খোলা যাবে না। কিন্ত ভয় সে পেলো না। শত্রুকে প্রতিহত করতে পরী জানে। এই একজন কে শেষ করতে কয়েক মুহূর্তই যথেষ্ট। পরী দরজা থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলে,’উনি বাড়িতে ফেরেনি আপনি চলে যান।’
গেলো না লোকটা। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,’নতুন ভাবি আমি হইলাম পলাশ। আপনের দেবর, দরজাডা এট্টু খোলেন। আপনের লগে সাক্ষাৎ করতে আইলাম।’
পরী জানে না আদৌ কোন দেবর আছে কি না। এটাকে তো কিছুতেই ঘরে আসতে দেওয়া যাবে না। পরী বলল,’আপনি চলে যান। আপনার ভাই আসলে তখন আইসেন। আপাতত চলে যান।’
পলাশ যাইতে চাইলো না। পরীকে বারবার দরজা খোলার অনুরোধ করতে লাগল। পরী জবাব দিতে দিতে হয়রান শেষে হাল ছেড়ে পালঙ্কে বসে রইল। পলাশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ বাদেই আবার দরজার কড়া নাড়লো কেউ। পরী বিরক্ত হয়ে গেল। নিশ্চয়ই পলাশ নামের লোকটা আবার এসেছে। সে রেগে বলে,’এতো ঘাড়ত্যাড়া কেন আপনি? এসেছেন কেনো আবার? চলে যান!!’
তবে এবারের গলার আওয়াজ পরিচিত পরীর।
-‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন পরীজান?’
থতমত খেয়ে পরী দ্রুত দরজা খুলে দিলো। শায়ের কে দেখে মৃদু হাসার চেষ্টা করে ঘরে আসতে দিলো। শায়ের এখনও প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে পরীর দিকের তাকিয়ে আছে। পরী তা বুঝতে পেরে বলল,’পলাশ নামের আপনার কোন ভাই আছে?’
-‘কেন বলুনতো??’
-‘সে এসেছিলো আপনার খোঁজে। ভেতরের আসতে চেয়েছিল কিন্ত আমি আসতে দেইনি।’
শায়ের কপাল কুঁচকে এলো। চিন্তিত হয়ে বলল, ‘পলাশ বাড়ি এসেছে!!
-‘আপনি চিনেন পলাশকে?’
-‘চামেলির বড় ভাই পলাশ। ভালো ছেলে ও।’
পরী মাথা নাড়লো। শায়ের বলল,’কিন্ত ওর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন।’
-‘কেন??’
-‘ভালো ছেলেদের থেকে দূরে থাকবেন আর খারাপ ছেলেদের কথা তো বাদই দিলাম।’
-‘তা আপনি কেমন ছেলে মালি সাহেব??’
-‘আমি আপনার স্বামী পরীজান। আমি যেমনই হইনা কেন আপনার বাস আমাতেই হবে।’
পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফুলগুচ্ছ বের করে পরীর হাতে দিলো। আবারও সেই বেলিফুল। সাদা রঙের এই ফুলটিতে মন মাতানো সুবাস থাকে। কেমন যেন নেশা ধরে যায় পরীর। নাকের কাছে ফুল নিয়ে ঘ্রাণ নিতেই মন ভাল হয়ে যায়।
-‘আপনি ফুলের নেশায় আসক্ত আমি পরীজানের নেশায়।’
শায়েরের চোখে চোখ রেখে পরী বলে,’মালি সাহেব যে নিজ হস্তে গড়েছে বাগান। এই ফুলের নেশায় আজীবন আসক্ত থাকতে চাই।’
-‘একজন মানুষের সবকিছু পরিবর্তন হলেও আসক্তির পরিবর্তন কখনো হয়না। আপনি আমার সেই আসক্তি যা কখনোই পরিবর্তন হবে না পরীজান।’
দীর্ঘক্ষণ দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের। যে ঠোঁটের হাসির থেকে চোখ ফেরানো যায় না সে হাসি মারাত্মক সুন্দর। যা সামনের পুরুষটিকে প্রচন্ড বেগে আঘাত করে যাচ্ছে। ভালোবাসা সুন্দর হলে তার দেওয়া সবকিছুই সুন্দর।
-‘আপনার হাসি সুন্দর।’
-‘শুধুই সুন্দর??’
হাসলো শায়ের। এই প্রশ্নটা পরী আরেকবার করেছিল তাকে। শায়ের সপ্তবর্ণে সেই উত্তর দিয়েছিল। কিন্ত এবার সে আর কিছু বলল না। তবে পরী বলল,’আপনার হাসিও কম সুন্দর নয়। আপনার মতোই আপনার হাসি সুন্দর।’
-‘পুরুষ মানুষ কখন সুন্দর হয় জানেন?’
-‘কখন?’
-‘একজন পুরুষ সুন্দর তখনই যখন নারী তার কাছে সুখি।’
-‘তাহলে আপনি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।’
শায়েরের মতে সব পুরুষ সুন্দর হয় না। চেহারায় মাধুর্য থাকলে কি মনটাও মাধুর্যময় থাকে? নারীকে সুখি রাখার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিপন্থা হলো পুরুষের ভালোবাসা। যাতে নেই কোন লোভ,বিদ্বেষ, হিংসা। যে পুরুষ ভালোবাসা দ্বারা একজন নারীকে সুখি রাখতে পারে একমাত্র সেই সর্বোত্তম।
সকালে পলাশ আবারো এসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে অনবরত। তখন ঘরের দরজা বন্ধ ছিলো। পলাশ ভাবছে সে শায়ের কে ডাকবে কি না? এরই মধ্যে খুসিনা চলে আসে। চুলার ছাই ফেলার জন্য ভোরেই সে ঘুম থেকে ওঠে। রান্নাঘরের যাওয়ার সময় দেখলো পলাশ শায়েরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে। তিনি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,’এই হতচ্ছাড়া!!তুই এই সক্কালে এইহানে কি করস??’
পলাশ চমকে ফিরে তাকালো। ফুপুকে দেখে একগাল হেসে বলল,’কাইল রাইতে আইলাম নতুন ভাবি দরজা খুলল না। হের লাইগা এহন আইলাম। হেরা মনে হয় ঘূমাইতাছে।’
-‘ঘুমাইবো না তো কি করবো? তোর মতো বলদের লাহান ঘুরবো? এইহানে আইছোস ক্যান??’
পলাশ যে চামেলির মতোই বোকাসোকা তা জানে ফুপু। কেউ কোন কথা বললে তা কিছুতেই পেটে রাখতে পারে না। গড়গড় করে সব বলে দেয়। তাই সে বলে,’মা’য় কইলো সেহরান ভাই নাকি বিয়া করছে। বউ নাকি আমাগো চম্পার থাইকা মেলা সুন্দর। হের লাইগা দেখতে আইলাম।’
-‘এই বলদ এতো বিয়ানে কেউ বউ দেখতে আহে? যা সর!!আর তোরে সেহরান ওর বউ দেখতে দিবো না।’
-‘ক্যান দিবো না। আমি কি মা’র মতো ঝগড়া করি?’
খুসিনা রেগে আরো দুকথা শুনিয়ে দিলো। দুজনের চেঁচামেচিতে শায়ের পরীর দুজনেই জেগে গেলো। শায়ের দরজা খুলে বের হতেই পলাশ সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠল,’সেহরান ভাই উইঠা পড়ছে। নতুন ভাবি উঠছে কই দেহি।’
শায়েরের মেজাজ গরম হয়ে গেল। আরেকটু ঘুমাতে চেয়েছিল সে। কিন্ত পলাশের জন্য আর তা হলো না। সে বলল,’তুই এখন ঘরে যা।’
-‘ফুপু কইলো তোমার বউ নাকি দেখতে দিবা না? ক্যান?’
-‘সেটা তোর মা ও ভালো করেই জানে। যা গিয়ে জিজ্ঞেস কর। আর এখন এখান থেকে না গেলে কানের নিচে মারব।’
পলাশ পরিমরি করে দৌড়ে পালালো। বয়সে চম্পার ছোট সে এবং চামেলির বড়। বয়স বেশি নয়। তবে বুদ্ধি কম। যে যা বলে তাই করে। শুধু মিষ্টি খাওয়ার লোভ দেখালেই হলো। বছর খানেক আগে পলাশ নদীতে যায় গোসল করতে। ওখানকার ছেলেরা ওকে মিষ্টির লোভ দেখিয়ে বলে মেয়েরা যেখানে জামাকাপড় বদলায় সেখানে উঁকি দিতে। মিষ্টির লোভে সে তাই করে। সেদিন বেশ মার খেতে হয়েছিল পলাশকে। তার পর হেরোনা তার ভাইয়ের কাছে পলাশকে পাঠিয়ে দেয়। তারপর আর বাড়িতে আসেনি। ছেলেকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হেরোনা। এই বোকা ছেলেটা কবে একটু ভালো মন্দ বুঝবে?
গ্রামের মাতব্বর ইলিয়াস আলী। খুবই ভালো একজন লোক। শায়ের গ্রামে খুব একটা আসতো না। তবুও শায়ের কে তিনি খুব পছন্দ করতেন। তাইতো তিনি স্বেচ্ছায় শায়ের কে কাজে নিয়েছেন। শায়েরের কাজ হলো মালপত্রের হিসাব রাখা। প্রতিদিন কতো মাল আসছে যাচ্ছে তা লিখে রাখে সে। লোকদের নানান ধরনের পরামর্শ ও দিয়ে থাকে। শায়েরের কাজে আগ্রহ দেখে ইলিয়াস আলী ভারি খুশি হন। তার ছেলে নেই দুটো মেয়ে। এই বয়সে কাজ সামলাতে হিমশিম খান তিনি। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন জামাই তার ব্যবসা দেখবে। কিন্ত ভাগ্যক্রমে এমন জামাই তিনি পেয়েছেন যে সে ব্যবসার কিছুই বুঝে না।
অবশেষে শায়ের কে পেয়ে তিনি ভিশন খুশি। শায়ের টেবিলে বসে খাতা দেখছে। ইলিয়াস আলী ওর পাশে চেয়ার টেনে বসল। শায়ের বলল,’কেমন আছেন চাচা?’
-‘আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি বাবা। তুমি এসে বড় উপকার করলে। আমি জেনে খুব খুশি হয়েছি যে তুমি এখন থেকে গ্রামেই থাকবে।’
-‘জ্বী চাচা,আপনাদের দোয়া আমাকে গ্রামে ফিরিয়ে এনেছে।’
ইলিয়াস আলী ইতস্তত করছে। হয়তো তিনি কিছু বলতে চান। শায়ের তা বুঝতে পেরে বলল,’চাচা আপনি কিছু বলতে চাইলে নির্ভয়ে বলতে পারেন।’
-‘আসলে সেহরান, বড়ই দুঃখে আছি। বড় জামাই তো কিছুই জানে না। ভাবতাছি ছোট মেয়েকে ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দেবো যাতে ছোট জামাই আমার ব্যবসা দেখতে পারে।’
-‘ভালো তো। আপনি চাইলে আমিও খুঁজে দেখতে পারি।’
-‘বাবা সেহরান এলিনার মা তোমাকে পাত্র হিসেবে খুব পছন্দ করে। তোমার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারলে খুশি হবে খুব।’
শায়ের চমকালো না। ও আগেই কিছুটা আন্দাজ করেছিল। তাই অত্যন্ত বিনয়ের সুরে সে বলতে লাগল,’চাচা আপনি হয়তো জানেন না। অবশ্য আমার বাড়ির আশেপাশের মানুষ ই শুধু জানে আমি বিবাহিত। সেজন্য আপনিও হয়তো জানেন না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
চমকে গেলেন ইলিয়াস আলী। সাথে হতাশাগ্রস্থ ও হলেন। কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করে হাসি মুখে বললেন,’আমি তো জানতাম না বাবা। না জেনে বলে ফেলেছি তুমি কিছু মনে করো না।’
-‘আপনি আমার বাবার মতো। কিছু মনে করব কেন?’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে নতুন বউ কে নিয়ে কাল আমাদের বাড়িতে আসবে। তোমাদের দাওয়াত রইলো। না আসলে আমি বেজার হবো।’
শায়ের হেসে সম্মতি দিলো। সে পরীকে নিয়ে যাবে ওনার বাড়িতে। ইলিয়াস চলে গেলে শায়ের নিজের কাজে মন দিলো। কাজের সময় যেন কাটে না। অথচ পরীর সাথে কাটানো সময়টা যেন দ্রুত চলে যায়।
দুপুর হতেই ফিরে এলো শায়ের। পরী তখন গোসল সেরে উঠোনে শাড়ি মেলছে। শায়ের তা কিছুক্ষণ নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করলো। পরী পেছন ফিরে শায়ের কে দেখেই সেদিকে এগিয়ে গেলো। শায়েরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। পরী নিজের আঁচল শায়েরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,’ঘাম ঝরছে আপনার। মুছে নিন।’
-‘আপনি মুছে দিলে মন্দ হয় না।’
পরী বিনা বাক্যে ঘাম মুছে দিয়ে শায়ের কে নিয়ে ঘরে আসে। হাতপাখা এনে শায়ের কে বাতাস করতে করতে বলে,’রৌদ্রের মধ্যে ছাতাটা নিয়ে গেলেই পারেন।’
-‘হুমম। আমি রোজ দুপুরে না এসেও পারতাম। কেন আসি জানেন কি?’
পরী না সূচক মাথা নাড়ায়।
-‘আপনি যখন রোজ দুপুরে গোসল করে ভেজা চুলে গামছা পেঁচিয়ে কাপড় মেলতে যান। তখন আপনাকে সবচাইতে বেশি মোহনীয় লাগে। এই দৃশ্যটা আমি প্রতিদিন দেখতে চাই। আপনি নিজেও জানেন না যে তখন কতটা স্নিগ্ধ লাগে আপনাকে।’
পাখা ঘুরানো থেমে গেল পরীর। স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল শায়েরের পানে। শায়ের বলেছিল তার ভালোবাসা পরীকে রোজ কাঁদাবে সেজন্য কি এই মুহূর্তে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে পরীর? পরী খেয়াল করলো তার চোখ থেকে এখনি নোনাজল গড়িয়ে পড়বে। শায়ের বসা থেকে চট করে দাঁড়িয়ে আগলে নিলো পরীকে। চোখের জল পড়ার আগেই তা মুছে দিলো। গালে হাত রেখে পরম স্নেহে চুম্বন করলো পরীর গলায়। তখনই ভারি কিছু টিনের চালে পড়তেই শায়ের পরী ছিটকে দূরে সরে গেল। কি হয়েছে তা দেখার জন্য শায়ের বাইরে এলো। দেখলো উঠোনে একটা বড়সড় নারকেল পড়ে আছে। এটাই সম্ভবত চালের উপর পড়েছে। তখনই নারকেল গাছ থেকে পলাশের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,’সেহরান ভাই সরেন। নাইলে আপনের মাথায় পড়বো।’