-‘আপনি এমন একজন নারী যাকে ফেরানোর সাধ্য কারো নেই। আপনাকে দেখে যদি কোন পুরুষ প্রেমে না পড়ে তাহলে সে সবচেয়ে বড় পাপী। আমিই সেই পাপ কি করে করি? কিন্ত আমার কাছে আপনি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমরা বেশি আকৃষ্ট হই। তবুও আপনার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি সবসময়। আপনার আমার মাঝে আকাশ পাতাল তফাত। কোথায় রাজকন্যা আর কোথায় রাজার বাগানের সামান্য মালি!! এই দ্বন্দ্ব আপনার থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্ত নিয়তি দেখুন। আমি কখনোই এটা ভাবিনি যে আমার ভাগ্যে আপনিই আছেন।’
আকাশের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শায়েরের দিকে তাকালো পরী। কিন্ত শায়ের তখনও আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছে। পরীর জবাব না পেয়ে শায়ের আবারো বলল,’আমি আপনার বড় বোনকে দেখিনি আর তার ভালোবাসার মানুষ কেও দেখিনি। সুখান পাগল আর তার বউয়ের ভালোবাসাও দেখিনি। আর রইল সিরাজ ভাইয়ের কথা। সে চলে যাওয়ার পরই কিন্ত আপনাদের বাড়িতে আমি প্রথম আসি। মূলত সিরাজ ভাইয়ের জায়গাটা আমাকে দেওয়া হয়েছে। ওদের ভালোবাসা আমি বুঝবো কিভাবে? তবে সম্পান বিন্দুর ভালোবাসার সাক্ষী আমি নিজেও।’
আকাশের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে পরীর দিকে তাকালো শায়ের,’পৃথিবীতে কেউ কারো মতো করে ভালোবাসতে পারে না। তাহলে সব ভালোবাসার পরিণতিও যে একই হত। নিজ স্থান থেকে নিজের প্রিয় মানুষ কে ভালোবাসতে হয়। সে ভালোবাসার মাধুর্য থাকে অন্যরকম। এখন আপনিই বলুন ওদের মতো ভালোবাসা চাই নাকি আপনার স্বামীর ব্যক্তিগত ভালোবাসা চাই কোনটা?’
দ্বিধায় পড়ে গেল পরী। কি উওর দিবে বুঝতে পারল না। চেয়েও পরী কঠোর হতে পারছে না। যেই মেয়েটা অধিকতর সাহসি,রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার মিশে আছে রাগ। আজ সেই মেয়েটির রাগ উধাও!!সাহস ও হারিয়ে গেছে যেন।
ভালোবাসা মানুষের দূর্বলতা। ভালোবাসলে মানুষ কোন না কোন কারণে ভয় পাবেই। সেই ভয়টা পরীর হচ্ছে। কিন্ত কিসের ভয়? হারিয়ে ফেলার নাকি অন্য কিছু? বুঝে উঠতে পারে না পরী। সে নির্দিধায় শায়েরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষা এই মুহূর্তে পরী পড়তে অক্ষম। তাই বেশিক্ষণ দাঁড়াতে চাইলো না সে। ঘুরে হাঁটা ধরতেই শাড়ির আঁচলে সজোরে টান পড়তেই সে দাঁড়িয়ে গেল। পেছন ফিরে তাকাতেই শায়ের বলল,’আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন না?’
পরী এবার ঘুরে দাঁড়াল। শায়েরের দিকে এগোতে এগোতে বলল,’আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। ভালোবাসা বলতে আমি ওদের কাহিনী গুলো বুঝি। এর বেশি কিছু জানা নেই আমার। পড়ালেখা শেখানোর শিক্ষক থাকলেও ভালোবাসা শেখানোর শিক্ষক কিন্ত নেই।’
-‘ভালোবাসার শিক্ষক থাকে না। দুজনের মধ্যে তৈরি করতে হয়। তাহলেই ভালোবাসার মানে বুঝবেন।’
পরী শায়েরের আরেকটু কাছে আসলো। অন্ধকারের আবছা আলোতেই চোখ রাখলো শায়েরের চোখে। বলল,’তাই? তাহলে দুজনের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি কিভাবে করা যায় বলুন তো?’
শায়ের এবার থামলো। এবার একটু বেশিই বলছে সে। ঠান্ডাও লাগছে, সে নিজেও চাদর আনেনি। তাই সে বলল,’আজকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শিখে ফেলেছেন বাকিটা অন্য একদিন শেখাবো।’
শায়ের চলে আসতে গিয়ে থেমে গেল পেছন ফিরে বলল,’হাত ধরার অনুমতি দিবেন নাকি আঁচল ধরে টেনে নিয়ে যাবো?’
মৃদু হাসে পরী,’কোলে তুলে নিয়ে গেলে মন্দ হয়না।’
কালবিলম্ব না করে চোখের পলকেই সে পরীকে কোলে তুলে নিলো। পরী ভেবেছিলো শায়ের তাকে কোলে নিবে না। কিন্ত সে পরীকে বিষ্মিত করে দিয়েছে।
পরী আজ শাড়ি পাল্টে নিজের ঘাগড়া পড়েছে। শাড়ি পরার তেমন অভ্যাস নেই তার। তাই আপাতত বাড়িতে এটাই পরুক। শীত নিয়ন্ত্রণ করা খুবই মুশকিল হয়ে আসছে বিধায় পরী শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দে চোখটা বন্ধ করে ফেলে যাতে শায়ের বুঝতে পারে পরী ঘুমিয়ে গেছে। কিন্ত চতুর পরী জানে না যে তার স্বামী তার থেকেও কম নয়। সব বুঝেও না বোঝার ভান করে শায়ের শুয়ে পড়ল। বেলি ফুলের সুবাসে চোখ মেলে তাকালো পরী। একটু আগেও তো ফুলের ঘ্রাণ পায়নি সে। এখন কোথা থেকে আসলো? ওপাশ ফিরতেই দেখলো শায়ের ফুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে। নিজের অজান্তেই পরী ধরা দিয়ে বলে,’ফুল কোথা থেকে আনলেন?’
-‘আপনি ঘুমাননি? একটু আগেই তো দেখলাম ঘুমাচ্ছেন।’
-‘ওই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। দেখি ফুলগুলো!’
পরী হাত বাড়াতেই শায়ের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে,’দেওয়া যাবে না।’
পরী একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বলে,’মালি সাহেব আমার রাজ্যে থাকতে হলে আমার কথা মেনে চলতে হবে যে। আপনার একটাই কাজ আমার বাগানে ফুল ফোটানো। কাজ ঠিকমতো করতে পারলেই পুরষ্কার পাবেন।’
-‘তাই নাকি? তা পুরষ্কার টা কি?’
-‘সময় হলেই জানতে পারবেন মালি সাহেব।’
-‘যথা আজ্ঞা রাজকুমারী।’
পরী হাসলো। শায়ের তাকিয়ে রইল পরীর দিকে। কপালে কিঞ্চিত ভাজ ফেলে পরী বলে,’ওভাবে দেখছেন কেন? আপনার সাহস তো কম নয়। এর শাস্তি কি হতে পারে জানেন?’
প্রশ্নের জবাবে শায়ের হাত বাড়ালো পরীর দিকে। গাল গলিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে কাছে টেনে আনে পরীকে। গভীর ভাবে প্রেয়সীর কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয় বলে,’শাস্তি স্বরূপ মৃত্যুদণ্ড হলেও আমি মাথা পেতে নিবো পরীজান।’
ঈষৎ কেঁপে উঠল পরীর সর্বাঙ্গ। কর্ণকুহরে ‘পরীজান’ শব্দটি বার বার বাজতে লাগল। এই ডাকেও যেন মাদকতা আছে। আফিমের মতো নেশালো। আফিমের নেশা কেটে গেলেও এ নেশা যেন কাটবার নয়। নিজের অর্ধাঙ্গিনী কে এইভাবে চেয়ে থাকতে দেখে শায়ের হাসে বলে,’অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। এবার কি শাস্তি দিবেন বলুন।’
আগের ন্যায় পরীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বলে,’শাস্তিটা কি দেবেন ভাবতে থাকুন। আমি ঘুমাই।’
ঊষার আলো ফুটতেই চারিদিক ঝলমল করে ওঠে। ঘাসে পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু চিকচিক করে উঠলো। সূর্য রশ্মিতে মেঘপুজ্ঞের রূপবত্তা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। শিশির ভেজা পথ পেরিয়ে মানুষ যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। শীত আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। দিনের বেলাতে তেমন শীত না লাগলেও রাতে শীত বাড়ে। চাষিরা দলে দলে শীতের ফসল ঘরে তুলছে। তাদের খুশি যেন আর ধরে না। বন্যার পর যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল তা এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। এবারের ফসলে বোধহয় তা মিটবে।
সূর্যের আলোতে ঝলমল করছে জমিদার বাড়ির আঙ্গিনা। তখনই সেখানে আগমন ঘটে শেখরের। শায়েরই প্রথমে দেখে। সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল শেখর কে দেখে। কেননা তার হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ করা। সারা মুখেও অসংখ্য দাগ স্পষ্ট।
শেখর শায়েরের সাথে কোন কথা না বলে বৈঠকে গিয়ে হাজির হয়। আফতাব আর আখির বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। শেখর কে আস্তে দেখে আফতাব প্রচন্ড রেগে গেলেন। বললেন,’তুমি? এখানে কি চাই? তোমার সাহস তো কম না। এতো কিছু করে আবার এখানে এসেছো!!’
মুহূর্তেই বাড়ির সকলে জেনে গেলো শেখরের আমার কথা। মালা জেসমিন ছুটে গেলেন বৈঠকে। পরী কুসুম আর জুম্মান দরজার আড়ালে কান পেতে রইল। শেখর সবার কাছে কিছু বলার অনুমতি চাইছে। আফতাব শুনতে চাইলেন। তিনিও দেখতে চান ছেলেটা কি বলে? শেখর বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতে লাগল,’বিয়ের দিন রওনা হওয়ার আগেই খবর পেলাম আমার ছোট বোন কে কেউ অপহরণ করেছে। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। পুলিশ কেও জানাতে পারিনি যদিও আমার বোনের কোন ক্ষতি করে দেয়? আমার পরিবারের সবাইকেই অপহরণকারী একটা জায়গায় যেতে বলে। কিন্ত দূর্ভাগ্য বশত গাড়ি দুর্ঘটনায় ওইদিনই সবাই আহত হই। হঠাৎই কি হয়ে গেল বুঝিনি। পরে পুলিশই আমার বোনকে উদ্ধার করে। এর পেছনে ছিল আমার বন্ধু নাঈম। ওই এই জঘন্য কাজটা করেছে।’
আফতাব জিজ্ঞেস করলো,’সে কেন এরকম করবে?তুমি মিথ্যা বলতেছো।’
-‘আমি সত্যি বলছি। নাঈম কে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। নাঈম নিজের মুখে সব স্বীকার করেছে। বিশ্বাস না হলে আপনি খোঁজ নিতে পারেন। নাঈমের এরকম করার কারণ সে পরীকে পছন্দ করতো।’
-‘আচ্ছা দেখবো। যদি তোমার কথা মিথ্যা হয় তাহলে কঠিন শাস্তি পাবে তুমি।’
শেখর মাথা নেড়ে বলে,’ঠিক আছে। তাহলে কি এবার বিয়েটা হচ্ছে?’
শায়ের নড়েচড়ে দাঁড়াল। তার সামনে তার স্ত্রীকে বিয়ে করার কথা বলছে তা মানতে পারছে না সে। আফতাব বলল,’সেকথা ভুলে যাও। কারণ আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।’
শেখর অবাক হয়ে বলল,’কি বলছেন এসব? পরীর বিয়ে হয়ে গেছে মানে! কার সাথে? আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন পরীকে আমার হাতে তুলে দেবেন!’
-‘শোন তোমার জন্য আমি আমার সম্মান হারাতে বসেছিলাম অনেক কষ্ট করে সব ঠিক করেছি। এখন বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি যেতে পারো।’
এবার শেখর রেগে আগুন। সে আফতাবের সাথেই দুএক কথায় ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেললো। শায়ের আর ওখানে থাকলো না। অন্দরে চলে গেল। শেখরের কথাগুলো বিষের মতো লাগছে। শায়ের কে ঘরে যেতে দেখে পরীও পিছু পিছু ঘরে গেল। শায়ের কে চিন্তিত দেখে বলল,’আপনি শুধু শুধু চিন্তিত হচ্ছেন কেন?’
-‘আমি কোন কারণে চিন্তিত নই।’
-‘তাহলে এভাবে চলে এলেন যে?’
-‘ওই ছেলেটা বার বার আপনাকে বিয়ে করবে বলছে। তাছাড়া ওর সাথে আপনার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। আমার ওকে ভালো লাগছে না।’
মৃদু হাসলো পরী। শায়ের জ্বলছে,এতঃ খুশিই লাগছে পরীর। ওকে হাসতে দেখে শায়ের রুষ্ঠচিত্তে বলে, ‘আপনি হাসছেন?’
পরী শায়েরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে,’তো কি হয়েছে? আমার তো আর বিয়ে হচ্ছে না তার সাথে।’
-‘আমি ওর মুখে আপনার নাম সহ্য করতে পারছি না।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে আপনার শুনতে হবে না আমিই যাই। গিয়ে শুনে আসি।’
পরীর হাত টেনে ধরে শায়ের। টানের ফলে পরী শায়েরের একদম কাছে চলে আসে। দেখে মনে হচ্ছে তার স্বামীর মনক্ষুণ্য হচ্ছে।
-‘ওই ছেলেটা যতক্ষণ পর্যন্ত না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি এখানেই থাকবেন।’
-‘মালি সাহেব আপনার বউকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না। আপনার কাছ থেকে তো নয়ই।’
পরীকে পালঙ্কে বসিয়ে শায়ের নিজেও ওর পাশে বসলো। পরী জিজ্ঞেস করলো,’আচ্ছা ওই ছেলেটা এমন কেন করলো? বন্ধু হয়ে বন্ধুর এতো বড় ক্ষতি করতে পারলো? যদি মরে যেতো ছেলেটা?’
-‘আপনাকে পছন্দ করে ছেলেটা আসামীদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। যেখানে তার ডাক্তার হওয়ার কথা ছিল।’
-‘সত্যি কারের ভালোবাসা কখনোই মানুষ কে খারাপ পথে নিয়ে যায় না। বরং একটা খারাপ মানুষ কে ভালো পথে নিয়ে আসে।’
পরী শায়েরের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। মুহূর্তটা বেশ লাগছে পরীর কাছে। অনেকগুলো হাত পেরিয়ে পরী এক বিশ্বাসী হাত পেয়েছে। হোক নাসে নিম্নবিত্ত ছেলে। কিন্ত তার ভালোবাসায় তো কোন খাদ নেই। ভালোবাসাটা সত্যি হলে নূন পান্তা খেয়েও
সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। শায়েরের সাথেই অনায়াসে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। কোন নিকষ কালো মেঘের ছায়া যেন কখনোই না আসে।
কিন্ত নাঈম নামের ছেলেটা একটু বেশিই করছে বলে মনে হলো পরীর। ভালোবাসা তো কোন প্রতিযোগিতা নয় যে জোর করে হলেও তাকে পেতে হবে। তাহলে কেন ছেলেটা এমন করে বসলো? এখন এর জন্য কতদিন জেলে থাকতে হবে কে জানে?