আফতাবের রাগ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। শত্রুপক্ষের সাথে আত্মীয়তা করতে চাইছে তার মেয়ে!!একথা আর পাঁচকান হলে তো সর্বনাশ। শত্রুর সাথে মিলিত কখনোই সে হবে না। মালাও চলে এসেছে মেয়ের চিৎকার শুনে। পরীর কথা শুনে সে হতভম্ব। আফতাব আছে বিধায় কিছু বলেনা মালা। আফতাব বলে,’তোমার সাহস দিনকে দিন বাড়ছে পরী। আমার মুখের উপর এতবড় কথা বলতে বাধলো না তোমার??’
-‘বাধলে বলতাম নাহ।’
-‘মেয়েকে বোঝাও মালা। নাহলে খুব খারাপ হবে কিন্ত। মেয়ে মানুষের এতো জেদ ভাল না।’
-‘আর পুরুষ মানুষের এতো অবহেলাও ভালো না।’

আফতাব এবার কড়া চোখে মালার দিকে তাকিয়ে বলে,’পাগল হয়ে গেছে তোমার মেয়ে। সামলাও মেয়েকে।’
বলেই আফতাব অন্দর ছেড়ে চলে গেলেন। মালা পরীর গালে পরপর কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে ওর ঘরে আটকে রাখলো।

জানালার ধারে বসে আকাশের দিকে তাকালো পরী। কি সুন্দর নীল আকাশ। টুকরো টুকরো সাদা মেঘ আনন্দের সহিত ভাসছে। ওদের দিন রাত নিশ্চয়ই খুব সুখে কাটে? নাহলে এতো আনন্দ পায় কোথায় ওরা?পরীর ভাবনায় সবসময় পাখি আর আকাশ নিয়ে। ওই পাখির মতো যদি সে আকাশে উড়ে বেড়াতো তাহলে কতই না ভালো হতো!! কেউ তাকে বকতো না। না কোন বিপদ হতো। এসব ভাবনা প্রতিনিয়ত পরীর মগজ খায়।
দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকায় পরী। কুসুম শব্দহীন পা ফেলে পরীর কাছে এসে বলল,’আপা আপনেরে বড় আম্মা বৈঠকে যাইতে কইছে। শায়ের ভাই কথা কইবো আপনের লগে।’
শায়ের পরীর সাথে আবার কি কথা বলবে?ভাবনাটা মনের ভেতর রেখে মাথায় ওড়না জড়ালো পরী। তারপর এগিয়ে গেলো বৈঠক ঘরের দিকে। কুসুম ও সাথে গেলো। ইশারায় শায়েরের ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল সে। পরী পা রাখলো চৌকাঠের ভেতরে। শায়ের তার জন্য অপেক্ষা করছে। পরীকে আসতে দেখে সে হাত দিয়ে জলচৌকি দেখিয়ে বসতে বলে। তাই করে পরী। মাথা নিচু করে শায়েরের সামনে বসে পরী।
-‘শুনলাম আপনি নাকি নওশাদ কে বিয়ে করতে চান?’
-‘হুমম।’
-‘কতকিছু হয়ে গেল এসব নিয়ে তারপরও আপনার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কি?’
পরী জবাব দিল না দেখে শায়ের আবার
বলে,
-‘আপনার কি মনে হয় এভাবে প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব?আপনাকে যতটা বুদ্ধিমতি মনে করেছিলাম আপনি ততটাই বোকা দেখছি। নওশাদ কে বিয়ে করলে আপনি প্রতিশোধ নিতে পারবেন এটা আপনার ধারনা। কিন্ত এতে আপনার ক্ষতি হবে বেশি। আচ্ছা বিয়ের পর আপনি কিভাবে প্রতিশোধ নিবেন? ওদের সাথে একা কিভাবে লড়াই করবেন? কালকে তো সাত জনের সাথেই লড়াই করতে পারলেন না। আর ওই বাড়িতে যত লোক আছে তাদের সাথে কি শক্তিতে পারবেন? নাহ,কারণ আপনি মেয়ে। একজন দুজনের সাথে পারলেও শতজনের সাথে পারবেন না। আর আপনার বাবাকে তো চেনেন। দরকার পড়লে আপনাকে খুন করে ফেলবে তবুও নওশাদের সাথে আপনার বিয়ে দেবেন না। নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। আর মাথা গরম না করে ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন।
একা যুদ্ধে জয় করা অনেক কঠিন। আপনি যা ভাবছেন তা আপনার জন্য বিপদজনক। তাই ওসব চিন্তা বাদ দিন। তার জন্য আমরা সবাই আছি। আপনি ঘরের দিক সামলান। আমি জানি আপনি শক্ত মনে মানুষ কিন্ত আপনার মা এবং বোন কিন্ত তা নয়। যা করবেন ভেবে করবেন।
আমিও আবারো বলছি এভাবে কখনোই প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব না। মাথা ঠান্ডা রাখুন।’

শায়েরের বলা প্রতিটি কথাই সত্য। তা মাথা খাটিয়ে ভেবে দেখলো পরী। ইশশ কি বোকা সে?ভাবতেই ওর নিজেরই লজ্জা করছে। নিজের গ্রামে পরী যা’ই করুক না কেন অন্য গ্রামে তা পারবে না। আফতাব নিজেই তো পারলো না। মেজাজ আরো খারাপ হলো
পরীর। তবে তা এই মুহূর্তে প্রকাশ করে না। চুপ করেই বসে আছে সে। পরীকে এখনো চুপ থাকতে দেখে শায়ের বলে,’তো এখন কি সিদ্ধান্ত নিলেন? নওশাদ কে বিয়ে করবেন?’
পরী চট জলদি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’আমি আসি।’
-‘প্রশ্নের উত্তর টা দিলে ভালো হয়।’
-‘আপনাকে বলার প্রয়োজনবোধ করছি না।’

এক দৌড়ে নিজের কক্ষে চলে এলো পরী। ভাবনা ওর বাড়ছে। কবিরের কাছে তাহলে ও পৌঁছাবে কিভাবে?রুপালিকে করা আঘাত গুলো পরীকে পোড়াচ্ছে খুব। সহ্য হচ্ছে না পরীর। কবিরকে খুন করতে পারলে ভালো হতো। কিছু একটা মনে করে পরী ছুটলো নিচ তলায়। পথেই মালা ওকে টেনে ধরে কলপাড়ে নিয়ে যায়। কয়েক বালতি ভর্তি পানি। আরেক বালতি ভরার জন্য কল চাপছে কুসুম। মালা পরীকে বসিয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগল। অবাক হয়ে পরী বলে,’আম্মা করেন কি?’
-‘চুপ থাক। সবসময় মাথা গরম থাহে। আইজ সব ঠান্ডা কইরা দিতাছি।’
হতাশ হলো পরী। মাথায় পানি ঢাললে তো মাথা ঠান্ডা হবে। কিন্ত ওর মনে যে দাবানল হচ্ছে তা কিভাবে ঠান্ডা হবে?পরী মাথার তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’মাথায় তো ঠান্ডা পানি দিতেছেন। পরাণে ঠান্ডা পানি কেমনে দিবেন?’

মালার হাত থেমে গেল। আর পানি ওঠাতে পারলেন না তিনি। কুসুম কে পানি ঢালতে বলে চলে গেলেন।

কেটে গেছে দুদিন। এই দুদিন পরী শুধু শায়েরের কথাগুলো ভেবেছে। একবার নয় বারবার ভেবেছে। এটা করলে অনেক বড় ক্ষতি হতো পরীর। তাই ওসব বাদ দিয়েছে পরী।
আজকে নিঃশব্দে বিন্দু এসে পরীর পাশে দাঁড়াল। বিন্দুর অস্তিত্ব পেয়ে পরী ফিরে তাকালো। প্রিয় সখির মুখটা দেখে খুশি হতে পারলো না পরী। কেননা আজকে যে সে মুখ ভার করে রেখেছে। বিন্দুর বিরসচিত্ত বদনের দিকে তাকিয়ে পরী জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে বিন্দু? মুখটা শুকনো কেন?’

প্রশ্নের জবাবে কেঁদে দিলো বিন্দু। মুক্তার ন্যায় অশ্রু গুলো হানা দিলো শ্যামা কপোলে। পরী চিন্তিত হলো বিন্দুর চোখে পানি দেখে। যে গজদন্তিনীর ঠোঁটে সর্বদা হাসি থাকতে আজ সে ঠোঁট কান্নায় ভাঙছে!

-‘কি হয়েছে বিন্দু? বল আমাকে?’
-‘পরী আমি মনে হয় মাঝিরে পামু নারে।’ বলেই বিন্দুর কান্নার বেগ বাড়লো। পরী ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,’আগে আমাকে সব বল। নাহলে বুঝব কিভাবে?’
-‘ওইদিন মাঝি আমারে কাপড় দিছে,সিঁন্দুরের কৌটা দিছে। এই কথা কেডা জানি আমার মায়রে কইয়া দিছে। মা আমারে অনেক মারছে পরী। আমার লাল কাপড় টা পোড়াইয়া দিছে। অখন সিঁন্দুরের কৌটা কোথায় তা জিগাইতাছে। আমি কি করমু পরী?’

-‘বলে দে তুই সম্পান মাঝিকে ভালোবাসিস। বিয়ে করতে চাস। আর সম্পান মাঝিও এখন তোকে বিয়ে করতে পারবে।’
-‘কইছি পরী কিন্ত মা বিয়া দিবে না মাঝির লগে। মাঝির নাকি বাপের পরিচয় নাই। হের মায় ও নাকি জানে না ওর বাপ কেডা।’
বিন্দুর কথায় বিষ্মিত হলো না পরী। সম্পান যে পিতৃহারা তা জানে পরী। গর্ভবতী অবস্থায় নিজের ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছিল সম্পানের মা। নিজের বোন বলে সেদিন সম্পানের মামা তাকে থাকার জায়গা দিয়েছিল। বাড়ির এক কোণে ছোট্ট একটা ঘর তুলেছিলো সম্পানের মা রাঁখি। সেখানেই জন্ম সম্পানের। গ্রামের অনেক লোক কথা শুনিয়েছিলো রাঁখিকে। কেননা নিজের ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল রাঁখি। বছর খানেক বাদেই ফিরে আসে সে। কিন্ত ওর স্বামীর খবর কেউ জানে না। রাঁখির ভাষ্যমতে ওর স্বামী ওকে রেখে শহরে কাজে গেছে তিন মাস আগে। আর আসেনি,রাঁখি আর থাকতে না পেরে চলেই আসে। তবে রাঁখির বিশ্বাস তার স্বামী একদিন ফিরে আসবেই। সেজন্য আজও অপেক্ষা করছে রাখি। সবার কটু কথা সহ্য করে ছেলেকে নিয়ে পড়ে আছে এখানে। গ্রামের সবাই সন্দেহ করে রাঁখিকে। অবৈধ সন্তান হিসেবে জানে সম্পান কে। সম্পান কেও কম কথা শুনতে হয় না। কিন্ত মায়ের অতীত সম্পর্কে অবগত সে। রাঁখি সবই বলেছে ছেলেকে। এও বলেছে সম্পানের বাবা এখনো বেঁচে আছে। সেজন্য রাখি আজও শাখা সিঁদূর পড়ে।
ঠিক এই কারণেই চন্দনা নাকচ করেছে সম্পান কে। মেয়ের মুখে সম্পানের কথা শুনতেই বিষ্ফোরিত হয়ে নিজের মেয়ে কে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়। বিন্দুকে সম্পানের সাথে বিয়ে দিলে লোকে কি বলবে?? চুনকালি পড়বে মুখে। চন্দনা তা হতে দেবে না। দরকার পড়লে মেয়েকে হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবে। তবুও সম্পানের হাতে বিন্দুকে তুলে দেবে না।
পরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বিন্দুর হাত ধরে টেনে পালঙ্কের উপর বসিয়ে বলল,’চিন্তা করিস না। তোর বিয়ে সম্পান মাঝির সাথেই হবে। আপাতত চুপচাপ থাক। সম্পান মাঝি এখন কোথায়??’
বিন্দু নাক টেনে জবাব দিলো,’শহরে গেছে। আইবো কবে জানি না।’
-‘এক কাজ কর তুই। তোর মা’কে কিছু বুঝতে দিবি না। ভান ধরবি যে তুই সম্পান মাঝিকে ভুলে গেছিস। সম্পান মাঝি আগে গ্রামে ফিরে আসুক তার পর পরবর্তী চিন্তা ভাবনা করা যাবে।’
বিন্দু জড়িয়ে ধরে পরীকে। চোখের জলে ভাসালো পরী কাধ। সে জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি মাঝিরে ছাড়া বাঁচমু না পরী। সত্যি করে মইরা যামু।’
নিজের থেকে বিন্দুকে ছাড়িয়ে নিলো পরী। রেগে গিয়ে বলল,’মরার কথা বলস কেন? থাপ্পড় চিনোস?
যা বলেছি তাই করবি। এখন বাড়িতে যা।’
নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়াল বিন্দু। দরজা পর্যন্ত যেতেই পরীর ডাকে ঘুরে দাঁড়াল সে।

-‘বিন্দু,মানুষ পাগলের মতো ভালোবাসে কেমনে?’
এতক্ষণে একটু খানি হাসলো বিন্দু। ঠোঁটে হাসির রেশ ধরেই বলে,’পাগলের মতো কেউ ভালোবাসে না। ভালোবেসেই মানুষ পাগল হয়।’
-‘সুখান পাগলার মতো?’
-‘কি জানি?আমি তো আর দেখিনি সুখান পাগলা ওর বউরে কেমন ভালোবাসতো।’
একটুখানি চুপ থেকে বিন্দু আবার বলল, ‘সত্যি ভালোবাসলে মানুষ পাগল হবেই। কেউ বাইরে থেকে তো কেউ ভেতর থেকে।’
বিন্দুর প্রস্থানও পরীর ঘোর কাটলো না। তবে বিন্দুর কথাটা বাস্তব। সত্যিকারের ভালোবাসা একটা মানুষ কে পাগল বানিয়ে দেয়। প্রিয় মানুষকে হারানোর যন্ত্রনা সবাই সহ্য করতে পারে না। যারা সহ্য করতে পারে তারা মন থেকে ভেঙে পড়ে। আর যাদের সহ্য হয়না তারা মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে পাগল হয়ে যায়। শরীরের ক্ষত সারানো গেলেও মনের ক্ষত সারানো সম্ভব না।
পুরোনো স্মৃতি আকড়ে ধরে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। প্রতিদিন মৃত্যু সমতুল্য যন্ত্রণা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। অভাব,অনটন,টাকা পয়সা হীন,অসহায় হয়েও বেঁচে থাকা যায় কিন্ত বেদনাময় অতীত কে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকা অধিকতম কষ্টকর। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সুখান পাগল। নিজের প্রিয়তমাকে হারিয়ে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। তার স্মৃতিচারণ করতে করতে আজ সে এমন স্থানে এসেছে যে এখন তার স্মৃতিতে তার প্রিয়তম ছাড়া অন্য কিছুই নেই।
পরী শুধু ভাবছে কীভাবে মানুষ এতো ভালোবাসতে পারে? কই সে তো পারছে না কাউকে ভালোবাসতে। তার জীবনে তো কেউ আসেনি এখনো। কীভাবে সে বুঝবে যে একটা মানুষ তাকে ভিশন ভালোবাসে?
সোনালী,বিন্দু আর সুখান নিজেদের ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছে। পরীকে কে কেউ কি তার ভালোবাসার প্রমাণ দেবে না? নাকি পরী নিজেই তার ভালোবাসা খুঁজে নেবে?কিন্ত কীভাবে?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।