৮৮. ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। চারদিক থেকে পাখিরা জেগে উঠে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। বাইরে ভোরের নির্মল বাতাস বইছে মৃদু মন্দ গতিতে। চিলেকোঠার কামরায় বিছানার ওপর ঘুমিয়ে আছে রুমাইশা রা। সাদমান আর শাহমীর শায়রী কে মাঝ খানে নিয়ে বিছানার এক পাশে ঘুমিয়ে আছে, আর অন্য পাশে সাফওয়ানের বুকের ভেতর গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে রুমাইশা।
কাল রাতের ঘটনার পর কেউ আর ছাদে ঘুমায়নি। সবাই যার যার কামরায় গিয়ে ঘুমিয়েছে। ডাক্তার এসে আফসানা কে চেক আপ করে বলেছিলেন যে প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে তার। কিছু ওষুধ দিয়েছেন আর বলে গেছেন বেশি বেশি চিন্তা করে মাথায় চাপ প্রয়োগ না করতে।
সাফওয়ান অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছে। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে ওর কেন জানি! গতকাল আফসানার স্পর্শ ওর কাছে কেন জানি ভালো ঠেকেনি। গতকাল আফসানা কে নিয়ে চিলেকোঠার কামরায় আসার সময় তার মনে হয়েছিলো আফসানা ইচ্ছা করেই তার বুকের ওপর মাথাটা রেখেছে। কিন্তু সে ব্যাপারে কিছুটা কনফিউজড থাকলেও পরবর্তী ঘটনায় সে নিশ্চিত হয় যে তার ভাবনাই সঠিক।
ডাক্তার চলে যাবার পর আফসানা কে আবার কোলে নিয়ে দোতলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন রুমাইশা জোরাজুরি করলো তখন অনিচ্ছা সত্বেও আফসানা কে কোলে নিয়ে সে দোতলার দিকে রওনা দেয়। আর সেই দোতলায় যাওয়ার সময়েই আফসানা অস্বাভাবিক ভাবে ছুয়ে দিতে থাকে ওর পিঠ টা৷
আর তারপরই দ্রুত পায়ে হেটে রাফসান দের জন্য নির্ধারিত রুমে গিয়ে আফসানা কে এক প্রকার বিছানায় ছুড়ে মারে সাফওয়ান। আর এরপর যেভাবে রুমে ঢুকেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে আসে ও সেখান থেকে। আফসানার ওই স্পর্শ সাফওয়ানের মোটেই সুবিধা লাগেনি।
এরপরেও দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সাফওয়ান। রাফসান, শাফিন বা অন্যান্য দের কথায় ও যতটুকু জেনেছে তাতে আফসানা কে খারাপ মনে হয়নি ওর৷ তাহলে ও এরকম কেন করবে? নাকি ও অসুস্থতার ঘোরে এরকম করে ফেলেছে!
এমন সময়ে ওর বুকের সাথে লেগে থাকা রুমাইশা নড়েচড়ে উঠে চোখ মেলে তাকালো। আর রুমাইশার সেই সদ্য ঘুম ভাঙা অগোছালো চুলে ঘেরা ফোলা ফোলা চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সাফওয়ান। আর ভাবলো না ও ওই বিষয় নিয়ে বেশি। ফালতু বিষয় নিয়ে চিন্তা করে নিজের মানসিক অশান্তি বাড়াতে চায় না ও। আপাতত নিজের সমস্ত মনোযোগ ওর রিমুর দিকে।
আজ অনেক কাজ। শাফিনের বিয়ের গোছ গাছ করে বরযাত্রী যেতে হবে। আত্মীয় স্বজন যা বাকি আছে সবাই আজ একে একে এসে পড়বে অল্প সময়ের ভেতরেই৷ রুমাইশা কিছুক্ষণ সাফওয়ানের বুকের সাথে ঘষাঘষি করে, সাফওয়ানকে কিছুক্ষন ইচ্ছামতো চাবকে, খুনসুটি করে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হতে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে গায়ে থাকা সালওয়ার কামিজের কুচকে থাকা অংশ গুলো হাত দিয়ে ভালো করে টেনে সোজা করে চলে গেলো ও নিচে, মায়েদের সাথে কাজ কর্মে সাহায্য করতে।
বাচ্চাদের কে বিছানায় রেখে সাফওয়ান ও উঠে পড়লো। তারপর ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেলো রাফসান আর শাফিন কি করছে সেটা দেখার জন্য।
.
আসরের পর সবাই রেডি হলো বরযাত্রী যাওয়ার জন্য৷ পাত্রীর বাসা অন্য জেলায়, যেতে সময় লাগবে, তাই আগে ভাগেই রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ওরা। বিয়ে হবে কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানেই চলে যাবে ওরা সোজা৷
রুমাইশা চিলেকোঠার কামরায় শাড়ির কুচি ঠিক করছে। শাড়িটা সকাল বেলা শাফিন এনে দিয়েছে৷ ওর আর আফসানা দুজনের জন্যই শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজ এনে দিয়েছে শাফিন। রুনিয়া ব্লাউজ দুইটা সকালেই ঠিক ঠাক করে দিয়েছে৷
সাফওয়ান কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে জানে না রুমাইশা৷ তার, রাফসানের আর শাফিনের খুব ভাব হয়েছে। সকাল থেকে তাদের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। সেলুনে গিয়েছিলো তিনজনে৷ সেখান থেকে ফিরে সেই যে শাফিনের ঘরে ঢুকেছে আর বের হওয়ার নাম নেই। বাচ্চা রা নিচে, শাফিন এসে নিয়ে গেছে সাদমান আর শাহমীর কে। রাশা কে আয়েশা এসে নিয়ে গেছে৷
আজ অনেক অনেক গুলো দিন পর রুমাইশা ভারি সাজগোজ করছে। শাফিনের আনা শাড়িটা সিল্ক কাতান। ডিপ পার্পলের এক রঙা শাড়ী। আচলে আর পাড়ে হোয়াট গোল্ড রঙের নকশা। তার ওপর ছোট ছোট স্টোন বসানো সাদা রঙের। শাড়ীর সাথে হোয়াইট গোল্ডেন রঙের ফুল স্লিভ ব্লাউজ, তার হাতায় ডিপ পার্পল রঙা লেইস লাগানো।
শাড়ির সাথে মিলিয়ে কানে আর গলায় এন্টিকের স্টোন বসানো জুয়েলারি পরে নিলো রুমাইশা৷ চুল গুলো সুন্দর করে উচু খোপা করলো, কয়েক গোছা বেবি হেয়ার বের হয়ে রইলো সে খোপা থেকে। চেহারায় মেকাপের ছাপ দিয়ে ঠোটা টেনে দিলো মেরুণ রঙা লিপস্টিক। আর চোখ দুটো সুন্দর করে সাজিয়ে নিলো।
শাড়ির কুচিটা আর একবার ঠিক করে নিয়ে নিজেকে শেষ বারের মতো আয়নায় দেখে নিলো ও৷ সব ঠিক ঠাকই লাগছে। এখন নিচে যেতে হবে৷ সেই মুহুর্তেই রুমাইশার ফোনে কল এলো শাফিনের৷
রুমাইশা হাতে হ্যান্ড ব্যাগ টা নিতে নিতে কল রিসিভ করলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শাফিন দুষ্টু কন্ঠে বলে উঠলো,
— আপু, সবাই রেডি, আমিও রেডি৷ শুধু তুমি এখনো আসলেনা! মনে হচ্ছে বিয়ে করতে তুমি যাবে, আর আমি বরযাত্রী যাবো।
রুমাইশা হেসে বলল,
— এইতো কেবলই রুম থেকে বেরোচ্ছিলাম আমি। তোর ভাই কোথায়? তার তো দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না!
রাফসান বলল,
— এইতো এইখানেই আছে, তার আদেশেই তোমার কাছে কল করা হয়েছে। তুমি নিচে আসো তাড়াতাড়ি, তোমাকে অনেক ক্ষন দেখেনি বলে ভাইয়া হাসফাস করছে। দ্রুতো আসো।
রুমাইশা হেসে আসছি বলে কল কেটে দিলো। তারপর কামরা থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে দোতলার উদ্দ্যেশ্যে পা বাড়ালো।
হলরুমে সবাই গোছ গাছ শেষ করে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি ডাকা হয়েছে কয়েক খানা, সেগুলো এখনো এসে পৌছায়নি। হয়তো কিছু সময়ের ভেতরেই এসে যাবে৷ শাফিন, সাফওয়ান আর রাফসানের জন্য তাদের বউদের সাথে ম্যাচিং করে পাঞ্জাবি এনে দিয়েছে। আর বাচ্চা গুলোর জন্য ও পোশাক নিয়ে এসেছে একই রকমের৷
রুনিয়া ইশতিয়াক কে একা রেখে যাবেন না৷ রুনিয়া যাবেন না তাই আয়েশাও যেতে পারছেন না। আয়েশা যাবেন না তাই শামসুল ও বেকে বসেছেন। তাই তাদের যে ছাড়াই যাওয়া হচ্ছে৷ এদিকে আয়েশা রাশা কে পাঠাবেন না বলছেন। গরমে বাচ্চা মেয়ের যাওয়ার দরকার নেই। এই অল্প সময় টুকু তিনি কাছে নিয়ে রাখবেন বলছেন। সাফওয়ান প্রথমে অসম্মতি জানালেও পরে ভাবলো যে রাশা বাড়িতেই থাকুক। গরমে কষ্ট পাবে শুধু শুধু, আর রুমাইশাও একটু রিল্যাক্সে থাকতে পারবে না। তাই রাশা কে রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নেওয়া হলো।
হলরুমের সোফায় চোখে মুখে এক অন্যরকম বিচক্ষণতা ফুটিয়ে বসে আছে সাফওয়ান। ওর পাশে রাফসান। আর অন্য পাশে শাফিন। শাফিন শেরওয়ানী পরে আছে৷ চমৎকার লাগছে তাকে। লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে মাঝে মাঝে, সেটা দেখে সাফওয়ান আর রাফসান শাফিন কে খোচাচ্ছে। ওদের অন্যান্য ছেলে কাজিন গুলো ওদের কে ঘিরে কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে আছে৷ সবাই নিজেদের ভেতর হাসি তামাসা করছে।
পার্পল কালারের পাঞ্জাবি তে সাফওয়ানের সৌন্দর্য যেন বেড়ে গেছে কয়েক গুন। রুনিয়া এসে কয়েক বার সাফওয়ান কে দেখে গেছে৷ ব্যাপার টা প্রথমে ওরা কেউ ধরতে না পারলেও পরে শাফিন সাফওয়ান কে বলেছে, যে তোমাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে ভাই, আর মা তোমাকে পাঞ্জাবিতে শেষ কবে দেখেছে তার হিসাব নেই, তাই হয়তো দেখে যাচ্ছে তোমাকে মাঝে মাঝে এসে৷ শাফিনের সে এক্সপ্লানেশনে সাফওয়ানের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে।
সাফওয়ান কে ওর কোনো আত্মীয় স্বজনই কখনোই দেখেনি। সেই ছোট্ট বেলায় যা দেখেছিলো, কিন্তু সেই ছোটবেলার চেহারার সাথে বর্তমানের সাফওয়ানের কোনো মিল নেই। তাই তাকে শাফিনের ক্যাম্পাসের খুবই কাছের সিনিয়র হিসেবেই দেখছে সবাই। তাকে নিয়ে আশে পাশে কানাঘুষা চলছে শাফিনের কাজিন দের মাঝে৷
শাফিনের চাচাতো ফুফাতো ভাইদের সবার পড়াশোনা প্রায় শেষের পথে। জব ক্যান্ডিডেট অনেকেই। শাফিনের সাথে কথায় কথায় ওরা শুনেছে যে তার পাশে বসা সাদ্দাত হুসেইন নামের ব্যাক্তি টা বাইরে পড়াশোনা করেছে এবং তার ওকলাহোমায় ফার্মাসিউটিক্যালসের বিশাল বিজনেস আছে। আর এ কথা শোনার পর থেকেই ছেলে গুলো মোটিভেশন পেতে সাফওয়ানের এ সাফল্যের পেছনের কাহিনী শোনার জন্য শাফিন কে পীড়াপীড়ি কিরছে। কারণ সাফওয়ানের সাথে তারা কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। সাফওয়ান যদিও আজ গম্ভীর মুখে নেই। তারপর ও ছেলে গুলোর ভেতর একটা ভীতি কাজ করছে সাফওয়ানের সাথে কথা বলতে৷ কিন্তু শাফিন তাদের সাফ সাফ বলে দিয়েছে যে এসবের ভেতর সে নেই৷
এদিকে সাফওয়ানের বায়োডাটা জানার পর থেকে শাফিন দের মুরুব্বি মহিলা আত্মীও দের ভেতর সাফওয়ান কে নিয়ে একটা ছোটখাটো ঝড় শুরু হয়ে গেছে৷ এমন সুদর্শন আর প্রতিষ্ঠিত ছেলে কে কারো মেয়ের জামাই করে ফেলতে পারলে আর পেছনে তাকাতে হবে না৷
সাফওয়ানের বয়স সম্পর্কে ওদের কোনো ধারণাই নেই, আর কেউ সেটা জিজ্ঞেস করার ও প্রয়োজন মনে করছে না।
শাফিনের এক চাচাতো ফুফু তো রুনিয়ার কাছে গিয়ে বলেই ফেলেছে, যে শাফিনের পাশে বসা পার্পল কালারের পাঞ্জাবী পরা ছেলেটার বিয়ে শাদি হয়ে গেছে কিনা! কিন্তু রুনিয়া কোনো উত্তর দেননি৷ হেসেছেন শুধু। মহিলাদের ভেতির নিজের বফ ছেলেকে নিয়ে চলা কথা বার্তা অনেক আগে থেকেই তিনি শুনছেন। মজা পাচ্ছেন খুব৷ তাই নিজের ননদ কে কোনো উত্তর দেননি। বলেছেন তিনি জানেন না৷
শাফিনের মেয়ে কাজিন দের ভেতরেও সাফওয়ান কে নিয়ে কথা হচ্ছে চুপে চুপে৷ তাদের অনেকেই বিয়ের বয়সী। ছোট ছোট মেয়ে গুলো তাদের বড় আপুদের গিয়ে মজা করে বলছে সাফওয়ানের কথা, যে ওই লোক টা আমাদের দুলাভাই হলে মন্দ হতোনা, আর সে মেয়েগুলোও কৌতুহল বসত লুকিয়ে চুরিয়ে দেখছে সাফওয়ান কে৷ আর তারপর থেকেই তাদের নিজেদের মধ্যে সাফওয়ানের লুক্স নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।
সাফওয়ানের ওসব দেখার সময় নেই। ও ফোন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। এমন সময়ে রুমাইশার মেসেজ এলো ওর ফোনে৷ সে লিখেছে,
— তোমাকে তো আবার বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে দেখছি।
সাফওয়ান মেসেজ টি দেখে ভ্রু কুচকালো৷ তারপর রিপ্লাই দিলো,
— মানে কি! আর তুমি কোথায়, নিচে নামো না কেন? তোমারে দেখার জন্য বসে আছি কতক্ষণ ধরে! তুমি আমার সাথে আমাদের গাড়িতে যাবে। আর বাচ্চারা রাফসান আর আফসানার সাথে অন্য গাড়িতে যাবে। দ্রুত আসো, তোমারে একটু দেখি!
রুমাইশা সাফওয়ানের মেসেজ পড়ে ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর রিপ্লাই দিলো,
— আমি ছাদেই আছি। গাড়ি বাড়িতে ঢুকলে আমি দেখতে পাবো, তখন নামবো। তোমার সাথে যাবো না আমি, গেলে লোকে বুঝে যাবে যে তোমার বউ আছে, মজা টা নষ্ট হয়ে যাবে৷ তুমি তোমার গাড়িতে আমার দেবর কে নিয়ে যাও। আমি রাফসান ভাইয়াদের সাথেই যাবো। তোমাকে আর একবার বিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা কতোদূর আগায় দেখি!
সাফওয়ান মনে মনে কপাল চাপড়ালো। তারপর লিখলো,
— তিন বাচ্চার মা হয়েছো, তারপর ও তোমার শয়তানি কমেনি! এরকম কোরোনা, আসো দ্রুত।
রুমাইশা আবার লিখলো,
— আসতে পারি, আমার সাথে কথা বলতে আসবানা একদম। আমি যে তোমার বউ সেটা কেউ যদি বোঝে তবে তোমাকে রাতের বেলা রুমের বাইরে বের করে দেবো।
সাফওয়ান মেসেজ দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তাকে রুম থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিতে রুমাইশার কথায় সায় মেনে মেসেজ জানিয়ে দিলো কেউ বুঝবেনা, যে সিড়ি বেয়ে নামা সুন্দ্রি মেয়েটা তার বউ।
রুমাইশা কে নিয়ে কোনো ভরসা নেই। সত্যি সত্যিই সে সাফওয়ান কে রুম থেকে বের করে দিতে পারে, বলা যায় না! আমাজনে তাদের বাড়িতে সাফওয়ান কে বেশ কয়েকদিন রুম থেকে বের করে দিয়েছে সিলি বিষয় নিয়ে। শেষের দিন দু মিনিট দেরি করে ফেরায় রুমে ঢুকতেই দেয়নি ও সাফওয়ানকে। তাই এই কাজ করা রুমাইশার পক্ষে কঠিন কিছু নয়৷
সাফওয়ানের হার মেনে নেওয়া মেসেজ দেখে রুমাইশা দুষ্টু হাসি দিলো। আর এরপর ছাদ থেকে নেমে হলরুমের দিকে এগোলো। দোতলায় আসার পর নিচে তাকিয়ে সবার অবস্থান একবার দেখে নিলো রুমাইশা। নিচের সবার কথা কানে আসছে ওর টুকটাক৷ সব গুলো কথাই ও মনোযোগ দিয়ে শুনছে। সাফওয়ান কে নিয়ে আন্টি মহলে ভালোই আলোচনা চলছে। এমন কি কারো একজনের মেয়ের জন্য সাফওয়ানের কাছে প্রস্তাব দেওয়ার আলোচনা ও চলছে সেখানে৷ মেয়েটাও সেখানে উপস্থিত আছে বলেই মনে হচ্ছে রুমাইশার৷ ঠোঁট টিপে হাসলো ও। তারপর ধীর পায়ে দোতলার সিড়ি বেয়ে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো।
এত সময় পর সিড়িতে কারো পায়ের শব্দ শুনে না চাইতেও সবাই তাকালো সেদিকে। সবার সিড়ির দিকে মনোযোগ দিতে দেখে সাফওয়ান বুঝলো রুমাইশাই নামছে। কিন্তু ওর সামনে সিড়ির ভিউ আটিকে দাঁড়িয়ে আছে ওরই কাজিন মহল। উকি ঝুকি মেরে কয়েক বার চেষ্টা করেও কিছুই দেখতে পেলো না ও৷ কিন্তু এখন দাঁড়িয়ে দেখতে গেলে যদি রাতের বেলা রুমাইশা রুম থেকে বের করে দেয়, সেই ভয়ে আর দাড়ালোনা সাফওয়ান৷ মুখ ভোতা করে বসে রইলো।
আফসানা বসে ছিলো ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে। শরীর ওর আগের থেকে ভালো অনেক টা৷ ওর পরনে শাফিনের এনে দেওয়া গাঢ় নীল রঙা সিল্ক কাতান শাড়ি। অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে এই শাড়িতে। রাফসান বেশ কয়েকবার তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে এসেছে সে কথা! কিন্তু আফসানার মুখ ভার।
কাল রাতে তার করা কাজের জন্য সে অনুতপ্ত। কিন্তু সাফওয়ানের দিকে থেকে সে আজকেও চোখ সরাতে পারছে না৷ অবাধ্য চোখ জোড়া বার বার বেহায়ার মতো সেদিকেই নজর দিচ্ছে৷ মনের ভেতর পাপ বোধ কুড়ে কুড়ে খাওয়া সত্বেও মন কে বাগে আনতে পারছে না ও৷ বার বার কাল রাতে সাফওয়ানের তাজে কোলে নেওয়ার দৃশ্য টা চোখের সামনে ঘুরছে ওর৷ এমন সময়ে সিড়ি বেয়ে নামা রুমাইশার দিকে চোখ গেলো ওর৷
শাড়ির কুচিটা হাত দিয়ে আগলে রেখে প্রতি টা পদক্ষেপ দেখে দেখে ফেলছে রুমাইশা। ওর রক্তলাল ঠোঁট দুটো টস টস করছে। টানা টানা চোখ দুইটা দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন পরিচিত মুখ গুলো খোজার চেষ্টা করছে তখন সে নজর যেন বুকে গিয়ে লাগছে। উচু করে বাধা খোপার নিচে ঘাড়ের ওপর কিছু বেবি হেয়ার এসে পড়েছে, পা ফেলার ছন্দে শরীর টা কিঞ্চিৎ দুলে উঠছে। পার্পল রঙা শাড়িটা শরীরের সাথে আকর্ষণীয় ভাবে লেপ্টে আছে৷
আফসানার বুকের মাঝে ধক করে উঠলো। রুমাইশার গায়ের সাথে শারীর রঙ টা অসম্ভব রকম মানিয়েছে! সেদিক থেকে চোখ ফেরানো দায়৷ ঠোঁটে লেপ্টে থাকা হাসি টা ওর মিষ্টি মুখ টার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক অনেক খানি। রুমাইশা কিভাবে এতটা হাসি খুশি থাকে সবসময় তা আফসানার মাথায় আসে না৷ ওর জীবনে কি এতটুকুও দুঃখ নেই! সব দুঃখ কি তার কপালে এসেই জুটেছে!
রুমাইশা যখন সিড়ি থেকে নেমে হলরুমে আসলো তখনই ওকে দেখার সুযোগ পেলো সাফওয়ান। রুমাইশা শাফিনের দিকে তাকানোর ভান করে সাফওয়ানের দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে এক পলক তাকালো। আর রুমাইশার সে চাহনি দেখে সাফওয়ানের দম আটকে গেলো যেন! অপলক চোখে ও তাকিয়ে রইলো তার সামনে দিয়ে ছন্দে ছন্দে পা ফেলে হেটে যাওয়া রুমাইশার দিকে। রুমাইশা হেটে চলল রান্না ঘরের পাশে দাঁড়ানো রুনিয়া আর আয়েশার দিকে। আর যতক্ষণ না রুমাইশা সাফওয়ানের চোখের আড়াল হলো ততক্ষণ হা হয়ে দেখলো ওকে সাফওয়ান৷
ওর মনে পড়ে গেলো বহু বছর আগে উত্তরের জঙ্গলের পাশের হরীণার বিলের ধারে, তার মার্সিডিজ বেঞ্জের ড্রাইভিং সিটে বসে, জ্ঞান হীন রুমাইশা কে নিজের কোলের ওপর রেখে ঝুম বৃষ্টির ভেতরে তার গাওয়া সেই গান টা,
❝ চাঁদনী রাইতে নদীর ওপারে, আকাশ থেইকা নামলো পরী…… ❞
.
সাফওয়ানের গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করছে সাফওয়ান৷ ওর পাশের সিটে বসে আছে বরবেশী শাফিন।
পেছনের দুই সিটই খালি। এ গাড়িতে আর কাউকে নেওয়া হয়নি। সাফওয়ানের বাড়িতে থাকা মার্সিডিজ বেঞ্জ টা ড্রাইভিং করছে রাফসান৷ সে গাড়িতে আফসানা, রুমাইশা আর বাচ্চারা আছে৷ আর বাকিরা অন্য গাড়িতে আসছে পেছনে।
সাফওয়ান চুপচাপ ড্রাইভিং করছে। চোখ মুখ ওর শক্ত। রুমাইশা যে কেন পাকনামি করে তার সাথে এলোনা সেটা ভেবেই রাগ লাগছে ওর। মনে হচ্ছে এখনি গাড়ি থামিয়ে পেছনের গাড়ি থেকে পার্পল রঙা রুমাইশা কে এক টান দিয়ে কোলে উঠিয়ে এই গাড়িতে নিয়ে চলে আসতে। কিন্তু তা পারছে না ও৷
জীবনে ওই একটিমাত্র মানুষের কাছে ও নিজেকে পুরোপুরি খুলে উপস্থাপন করতে পারে, ওই একটা প্রানীর সাথে থেকেই ও স্বস্তি পায়! আর কোথাও, কারো কাছেই ওই স্বস্তি টা পায়নি ও কখনো, আর হয়তো পাবেও না! সে যেন এক অন্যরকম অনুভূতি!
শাফিন আড় চোখে একবার দেখে নিলো ভাই কে। ভাইয়ের যে মেজাজ খারাপ তা বেশ ভালোভাবেই বুঝলো ও। ওর রুমি আপু যে কেন এরকম করলো সেটাই ভেবে পেলোনা ও। আর সাফওয়ান ও যে রুমি আপুর এই আবদার কোনো বাক্যব্যায় ছাড়াই মেনে নিলো সেটাই ওর কাছে সব চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার!
নিরবতা ভেঙে শাফিন গলা খাকারি দিয়ে উঠলো। সাফওয়ান ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার রাস্তার দিকে চোখ রেখে বলল,
— কি বলবি বলে ফ্যাল!
শাফিন আশ্চর্য হলো। সামান্য গলা খাকারি তেই তার ভাই বুঝে ফেলেছে যে সে কিছু বলতে চায়। শাফিন নিজের সিটে একটু নড়েচড়ে বসে বলল,
— পৃথিবীতে হয়তো তুমিই একমাত্র বড় ভাই যে কিনা ছোটভাইয়ের বিয়ের গাড়ির ড্রাইভার হয়েছো! তা আপু হঠাৎ তোমার সাথে যাবে না বলে বাহানা করলো কেন? ঝামেলা হয়েছে নাকি তোমাদের মাঝে?
সাফওয়ান ছোটখাটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
— তার হঠাৎ মজা দেখার শখ হয়েছে তাই।
শাফিন কিছুক্ষণ অবুঝের মতো সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— মানেহ?
সাফওয়ান দৃষ্টি সামনে রেখেই বলে উঠলো,
— মানে টা তোমার দ্যা মোস্ট বিউটিফুল অ্যান্ড দ্যা মোস্ট গর্জিয়াস রুমি আপুর কাছেই শুনে নিও, উত্তর পেয়ে যাবে!
সাফওয়ানের এমন উত্তরে শাফিন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
— ভালো কথা মনে করিয়েছো! রুমি আপুকে আজকে যা লাগছে না! আমি তো পুরাই ফিদা হয়ে গেছি! আর তুমিও যে আমার বোনের ওপর ক্রাশ খেয়েছ নতুন করে সেটাও দেখেছি আমি। যেভাবে হা করে তাকিয়ে ছিলে তাতে মনে হচ্ছিলো একটা আস্ত মেট্রোরেল ঢুকে যাবে তোমার মুখের ভেতর। যাই হোক, একটা কাজ কইরো, আজ রাতে ঘুমানোর সময় বাচ্চা গুলোকে মায়ের কাছে রেখে আইসো!
শাফিনের এমন লাগামহীন কথা বার্তায় সাফওয়ান কটমট করে তাকালো ওর দিকে। শাফিন দ্রুত নিজের মুখ টা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। এখন আর সাফওয়ানের দিকে তাকানো যাবে না কোনো ভাবেই, ভস্ম করে দিবে ওকে! কিন্তু শাফিন কে অবাক করে দিয়ে সাফওয়ান বলে উঠলো
— ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস, তোর সংসার জীবন সুখের হোক!