৫৫. আহমেদ ভিলার পরিবেশ থমথমা, মাঝে মধ্যে কারো ডুকরে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, এছাড়া আর কোনো শব্দই নেই। বাড়ির মেয়ে নিরুদ্দেশ। তার কোনো খোজ পাওয়া যায়নি৷ আয়েশা শামসুল নিজেদের বাড়িতে চলে গেছেন।
আয়েশা যেতে চাচ্ছিলেন না, কিন্তু শামসুলের ছুটি ফুরিয়ে গেছে। অফিস থেকে আর ছুটি গ্রান্ট হবে না বলেছে, তাই বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয়েছে তাদেরকে৷ রাফসান এখানেই আছে। রুমাইশার খোজ করছে ও অন্য সবার সাথে৷ কিন্তু সাফওয়ান নেই।
গত দুদিন ধরে সাফওয়ান বাড়ির বাইরে। ফোন বন্ধ করে রেখেছে। কোথায় আছে ও কাউকে বলেনি। রুমাইশা চলে যাওয়ার পর থেকে ও কিছুই খায়নি৷ রুনিয়া আর আয়েশা সব রকমের জোর জবরদস্তি করেও কিছুই খাওয়াতে পারেনি ওকে৷ আর এখন তো রুমাইশার শোকে সেও বাড়ি ছাড়া৷
যত জায়গা সম্ভব সব খানেই রুমাইশা কে খুজেছে ওরা। সেই সাথে পুলিশ ও। কিন্তু রুমাইশাকে পাওয়া যায়নি কোথাও৷ পুলিশ তাদের প্রধান সন্দেহভাজনের লিস্টে প্রথমেই রেখেছে সাফওয়ান কে৷ কারণ নিখোজ হওয়ার আগে রুমাইশা সর্বশেষ সাফওয়ানের সাথেই ছিলো৷ এ ছাড়া সাফওয়ান তাদের সামনে আসতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সাফওয়ান কে ডাকা হলেও সে আসেনি। এতে পুলিশদের সন্দেহ আর ও দৃঢ় হয়েছে।
তাদের ধারণা সাফওয়ানই হয়তো রুমাইশা কে মেরে কোথাও গুম করে দিয়েছে, আর এখন স্ত্রী হারানোর শোকে ভেঙে পড়ার নাটক করছে৷ সাফওয়ান কে নজরে রেখেছিলো ওরা৷ কিন্তু দু দিন আগে সাফওয়ান হঠাৎ করেই সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় তারা আর নজর রাখতে পারেনি। তবে এতে তাদের সাফওয়ানের প্রতি সন্দেহের মাত্রা আর ও বেড়েছে৷ এবং এখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস সাফওয়ানই রুমাইশার সাথে কিছু করেছে৷
শাফিন আর রাফসান এখন ওদের দুজনকেই খুজছে। একজন তো হারিয়ে গেছেই, অন্যজনকেও হারিয়ে যেতে দিতে চায়না ওরা। শাফিন কয়েকবার ভেবেছে সাফওয়ান কে ওর ল্যাবে গিয়ে একবার খুজে আসবে৷ কিন্তু পুলিশ যেভাবে ওদের সবার ওপর নজর রাখছে তাতে ল্যাবে যেতে গেলে ওরা নিজেরাই বিপদে পড়ে যাবে৷ আর সাফওয়ান যদি ল্যাবে থেকেই থাকে তাহলে বিপদ টা তার ওপর ও আসবে৷
তবুও আজ রাফসানের সাথে আলোচনা করে ল্যাবের রাস্তায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো শাফিন। মাঝরাতের পর বের হবে ওরা। সাথে কোনো টর্চ নিবে না। কারণ পুলিশের লোকজন কখন কোথায় ওত পেতে থাকে বলা যায় না। অত রাতে যদি ওদের কে জঙ্গলে যেতে কেউ দেখে নেয় তবে সন্দেহের তালিকায় ওদের নাম ও হাইলাইট হয়ে যাবে৷
রাফসান এতদিন শুধু শুনেছে সাফওয়ানের ল্যাবের কথা৷ কিন্তু আজ রাতে সচক্ষে দেখবে বলে ওর মনে অন্য রকমের অনুভুতি হচ্ছে।
রাত যখন পৌনে একটা তখন শাফিন আর রাফসান বের হলো ল্যাবের উদ্দ্যেশ্যে। সাফওয়ানকে পাওয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থান হলো ওর ল্যাব। দুজনে মিলে বাসার কাউকে না জানিয়ে চুপিসারে মেইন গেইট দিয়ে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে এগোলো।
চাঁদের আবছা আলো তে খোলা জায়গা গুলো মোটামুটি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু জঙ্গলের ভেতর হুমো অন্ধকার। গাছপালা আর লতাপাতার ঘন সন্নিবেশে জঙ্গল টা পুরো ব্লাক হোলের মতো দেখাচ্ছে৷ গা ছম ছম করছে ওই অন্ধকারের ভেতর তাকালে।
কিন্তু ভয় কে পাত্তা না দিয়ে সাহস করে এগোলো দুজনেই। আলো না থাকায় ল্যাবের রাস্তায় অনুমানের ভিত্তিতে চলছে ওরা দুজন। শাফিন আগে হাটছে, আর রাফসান ওর পেছন পেছন৷ কিছুদুর যাওয়ার পর ডোবার ধারে এলো ওরা৷ ডোবার পানিতে কচুরিপানা হয়েছে অনেক। ঈষৎ বেগুনি রঙা ফুল ফুটে আছে সেখানে কয়েক টা৷ ডোবার পানিতে চাঁদের আলো পড়ে ঝকমক করছে।
ডোবার এ মোহনীয় দৃশ্য উপেক্ষা করে ওরা সামনে এগোলো। আর ও কিছুদুর হাটার পর একটা খালি জায়গা তে এলো ওরা। এইখানে গাছ পালার পরিমাণ কম। চাঁদের আলো গাছের ডাল পালার ফাক দিয়ে মাটিতে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। এইখানে আগেও এসেছে শাফিন, রুমাইশার সাথে।
এই জায়গার রহস্য ও এখনো উদঘাটন করতে পারেনি। কিন্তু জায়গা টা আর আগের মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নেই। ঘাস উঠে গিয়ে মাটি বেরিয়ে যাওয়া জায়গা গুলোতে আবার নতুন করে ঘাস গজাচ্ছে। অনেক জায়গাতে এখনো কিছু টা মাটি উকি দিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অনেক দিন এইখানে এসে কেউ থাকেনি।
আবার ও হাটা শুরু করলো ওরা। কিছুদুর যাওয়ার পর জঙ্গল টা হঠাৎ করে ঘন হয়ে আসলো। চাঁদের আলোর ছিটে ফোটাও এখানে পৌছাচ্ছে না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ওরা অন্ধকারে ভেতর রাস্তা দেখে দেখে হাটতে থাকলো।
কয়েক পা আগানোর পর হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে গেলো শাফিন৷ ওর দেখা দেখি রাফসান ও দাঁড়িয়ে গেলো। শাফিনের এমন অকস্মাৎ দাড়ানোর কারণ বোধগম্য হলো না রাফসানের। ও শাফিন কে পেছন থেকে একটা খোচা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— দাঁড়িয়ে গেলি কেন? তাড়াতাড়ি যা, এখানে প্রচুর মশা। দাড়ালেই কামড়াচ্ছে।
কিন্তু শাফিনের থেকে কোনো উত্তর এলো না। শাফিন তাকিয়ে আছে ওর সামনের দিকে৷ রাফসান শাফিনের দিকে তাকালো। এইভাবে ওকে সামনের সিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো সামনের দিকে৷
ওদের থেকে প্রায় ত্রিশ হাত দূরে থাকা একটি মোটা গাছের কান্ডের আড়াল থেকে দুইটা জ্বলজ্বলে চোখ উকি দিয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। এই গহীন জঙ্গলে, অন্ধকারের ভেতর সে চোখ দুটোকে কোনো অশরীরির চোখের ন্যায় মনে হলো ওদের দুজনের কাছেই।
শাফিন নিজের বাম হাত টা দিয়ে হাতড়ে ওর পেছনে থাকা রাফসানের হাত ধরলো। ভয়ে রাফসানের গলা শুকিয়ে গেলো যেন।
কি ওইটা! সত্যিই কি কোনো অশরীরী? এত রাতে জঙ্গলে এসে কি ওরা ভুল করলো? কিন্তু সাফওয়ান তো রাত বিরাতে যখন তখন আসে, তেমন কিছু কখনো দেখলে তো ও নিজেই শাফিন কে বলতো।
কিন্তু সাফওয়ানের সাথে নিজেদের তুলনা দেওয়া বোকামি। সাফওয়ান তো নিজেই ভূতের মতো। তাই ওকে দেখলে কোনো কিছুই ওর ধারে কাছে ঘেষবে না৷
আর ওরা হলো সাধারণ মানুষ।
রাফসান শাফিনের পেছন থেকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
— শাফিন, কি ওটা!? আমাদের দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছে কেন? হাতে করে তো কোনো লাঠি সোটাও নিয়ে আসিনি যে কাছে আসলে পেটাবো!
শাফিন সে দিকে চোখ রেখে নিজেও ফিসফিস করে উত্তর দিলো,
— এমনও তো হতে পারে যে ওটা সাফওয়ান ভাইয়া। হয়তো আমাদের দেখে আড়ালে চলে গেছে। ওর হয়তো মনে নেই যে ওর চোখ দুইটা জ্বলজ্বলে! তাই উকি দিচ্ছে! কি বলো?
রাফসান আর ও ভালো করে সেদিকে তাকিয়ে বলল,
— না, সাফওয়ান অনেক লম্বা। সামনে যে আছে সে সাফওয়ানের হাটু সমান হবে৷ এটা অন্য কিছু৷ হয়তো ওটা কোনো জন্তু জানোয়ার। আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে আড়ালে গেছে।
কিন্তু বিরোধিতা করলো শাফিন, বলল,
— না ভাইয়া। ওইটা কোনো চারপা ওয়ালা জন্তু না৷ ওইটা দুই পা ওয়ালা কোনো কিছু। আর তাছাড়া, জন্তু জানোয়ারের চোখে আলো পড়ার পর তবেই জ্বলজ্বল করে, এমনিতে করে না। ওইখানে যে বা যা আছে তার চোখে তো কোনোভাবে আলো পড়ছে না। এর মানে ওইটা কোনো জন্তু জানোয়ার নয়। অন্য কিছু। শোনো, ভয় পেলে চলবে না। চলো আমরা আগাই। কারণ এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কোনো অপশন নেই। আমরা অনেক ভেতরে চলে এসেছি।
রাফসান আর শাফিন দুজন দুজনের হাত ধরলো শক্ত করে৷ সে উজ্জল চোখের অধিকারী জন্তুটা এখনো ওখানেই আছে৷ ওরা দুজন ধীর পায়ে জন্তুটার দিকে নজর রেখে সামনে এগোতে থাকলো৷
কিন্তু জন্তু টার বেশ খানিক টা কাছাকাছি আসার পর জন্তু টা আস্তে আস্তে পেছন দিকে সরে যেতে লাগলো। কিন্তু একেবারে পালিয়ে গেলো না৷
আর ঠিক তখনি শাফিনের দৃষ্টি গোচর হলো যে ওটা কোনো জন্তু নয়। ওটার আকৃতি মানুষেরই মতো৷ আর এরপরই শাফিনের চোখ গেলো সেই মানুষের মতো আকৃতির প্রাণীটার মাথার চুলের দিকে। অন্ধকারের ভেতরে ও লম্বা চুল গুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে৷ চুল গুলো প্রাণি টার প্রায় অর্ধেক উচ্চতা ছাড়িয়ে আর ও নিচে চলে গেছে ।
শাফিন এবার ভয় পেলো সত্যি সত্যিই। ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলো ও। রাফসান কে ফিসফিসিয়ে বলল,
— ভাইয়া, আমরা হয়তো খুব বড় বিপদে পড়ে গেছি। ওটা সতিই কোনো চার পা ওয়ালা জন্তু নয়। মানুষেরই মতো দুই পা ওয়ালা কিছু একটা। আবার ওর মাথায় ইয়া লম্বা চুল আছে, আমি দেখেছি। ও নিশ্চিত অশরীরী টাইপ কিছু হবে৷ হয়তো আমাদের কে প্রথম থেকেই ফলো করছে, এখন ঘন জঙ্গল পেয়ে সামনে এসেছে৷
রাফসান প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না। শুধু দেখতে থাকলো সেই প্রাণি টাকে৷ কিন্তু সেটা পেছন দিকে সরতে সরতে এখন আর ও দূরে চলে গেছে৷ পেছন দিকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে সেটা। তার আচরণে আক্রমণাত্মক কিছু আছে বলে রাফসানের মনে হচ্ছে না।
দুই পা ওয়ালা প্রাণি টা ওদের দিকে নজর রেখেই সরে যাচ্ছে পেছন দিকে। আর এভাবে সরতে সরতেই সেটা একটা কম ঘনত্বের ডাল ওয়ালা গাছের নিচে গিয়ে পৌছালো। আর তখনই গাছের ডালের ফাকা দিয়ে এক টুকরো চাঁদের আলো এসে পড়লো প্রাণি টার মুখের ওপর। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই হতভম্ব হয়ে গেলো রাফসান। মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারণ করলো,
— রুমি!
৫৬. ল্যাবের রুমের বিছানার ওপর কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে সাফওয়ান। গত দুদিন ধরে ও এখানে এই অবস্থাতেই আছে। বিছনা থেকে ওঠেনি একটি বারের জন্য ও। বিশালাকার শরীর টা শুকিয়ে গেছে। পর্যাপ্ত খাবার আর পানির অভাবে শরীর পানি শূন্য হয়ে ঠোট ফেটে চামড়া উঠে যাচ্ছে।
শরীর থেকে খোলশ ছাড়ছে ওর, কিন্তু খোলসের সাথে যেন চামড়াটাই উঠে আসছে। শক্ত হয়ে আছে সেগুলো, অন্যান্য বারের মতো পাতলা আবরণ আর নেই।
গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কিছুই না খাওয়া সাফওয়ানের বুকের পাজরের হাড় গুলো বেরিয়ে গেছে, চামড়ার ওপর দিয়ে সেগুলো দৃশ্যমান হয়ে ফুটে পড়েছে। পিঠের মেরুদন্ডের হাড়ের গিট গুলো স্পষ্ট হয়ে আছে। অস্বাভাবিক লম্বা হাত পা দুইটা হাড় জিরজিরে হয়ে আছে৷ অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওকে।
চোখে পিচুটি জমে গেছে ওর। কিন্তু সেগুলো ছাড়ানোর জন্য কোনো উদ্বেগ কাজ করছে না ওর ভেতরে৷ চোখ থেকে পানি গুলোও যেন কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে। বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাওয়া সত্বেও চোখ থেকে আর পানি ঝরছে না ওর৷
বুকের কাছে নীলের ওপর সাদা রঙা কুচি ফুলের একটা কামিজ দুই হাতে জড়িয়ে রেখে আছে সাফিওয়ান যার গলার দিক টাতে মুখ লুকিয়ে শুয়ে আছে ও৷
কামিজ টা থেকে ওর রিমুর গায়ের গন্ধ আসছে। গত দুইদিন ধরে নাওয়া খাওয়া কিছুই না করে, এই কামিজ টাকেই সম্বল করে এইখানে পড়ে আছে ও।
কাবার্ডের ওপাশের কিচেন থেকে মাংস পচা গন্ধ আসছে। সেদিনের সেই গরুর মাংস সেখানে সেভাবেই রাখা আছে এতদিন ধরে। পোকা কিলবিল করছে তাতে। এত তীব্র গন্ধের মাঝেও নির্দ্বিধায় শুয়ে আছে ও৷
এই ল্যাব থেকে ওর আর বের হবার কোনো ইচ্ছা নেই৷ ওপরের দুনিয়াটা ওর কাছে নিমের থেকেও তেতো লাগছে এখন৷ রুমাইশা যে ওকে এই সামান্য কারণে ভুল বুঝে এইভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
খানিকক্ষণ পর ওর ল্যাবের দরজার কাছ টাতে শব্দ হলো কয়েকবার। কেউ ল্যাবের লোহার দরজাটার ওপর দুম দাম শব্দ করছে। সাফওয়ান চোখ মেলে তাকালো। শব্দ টা আর ও জোরে হচ্ছে এখন৷ কিন্তু সেটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলো সাফওয়ান। আগের মতো করেই পড়ে রইলো বিছনায়।
কিন্তু শব্দ টা না কমে গিয়ে আর ও জোরালো হলো। কেউ যেন ভেঙে ফেলতে চাইছে ল্যাবের দরজা টা। ধাতব শব্দে ল্যাবের ভেতর টা ভরে উঠছে।
বিরক্ত হয়ে সাফওয়ান ওর দুর্বল শরীর টা টেনে উঠালো বিছানা থেকে। তারপর শব্দের উৎপত্তিস্থল টা দেখতে ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ল্যাবের দরজাটা খুলল ও৷ মাংস পচা গন্ধ টা বদ্ধ জায়গা থেকে খোলা বাতাসে এসে অনেক খানি ক্ষীন হয়ে এলো।
দরজা খুলেই শাফিন কে হুড়ুমুড়িয়ে পড়তে দেখলো সাফওয়ান। সাফওয়ান কে দেখে শাফিন উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো,
— ভাইয়া, রুমি আপু! আপুকে আমরা দেখেছি এই জঙ্গলের ভেতর! পালিয়ে গিয়েছে আমরা কাছে যেতেই। হরিণার বিলের দিকে গিয়েছে সম্ভবত।
‘রুমি’ নাম টা শুনেই যেন সাফওয়ানের সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। ওর মস্তিষ্ক যেন হঠাৎ করে দপ করে জ্বলে উঠে সচল হলো৷
নিজের দুর্বল শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে ও ছুটলো পূর্ব দিকে৷ পায়ে জুতা নেই ওর, ছুটতে ছুটতে জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা সুচালো কাটার কয়েকটা ঢুকে গেলো ওর পায়ের ভেতর। তাল কূল হারিয়ে ছুটতে ছুটতে কত গুলো গাছের সাথে ও বাড়ি খেলো তার হিসাব নেই।
কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সাফওয়ানের৷ ও উর্ধশ্বাসে ছুটছে। ওর রিমু কে যদি পেয়ে যায় একটি বারের জন্য, আর কখনোই রিমু কে কাছছাড়া করবে না ও, সামান্য একটা মুহূর্তের জন্যও না৷
ছুটতে ছুটতেই জঙ্গলের চারদিকে নিজের উজ্জ্বল দৃষ্টি দিয়ে রুমাইশা কে খুজতে থাকলো সাফওয়ান। ঠিক কত ক্ষণ ধরে ও ছুটলো তা জানে না ও।
ছুটতে ছুটতে একসময় জঙ্গলের গাছ পালার ফাক দিয়ে হরিণার বিলের পানির ওপর পড়া চাঁদের আলোর খলবলানো প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো ও৷ আর তারপর ই জঙ্গল ঠেলে ও চলে এলো হরিণার বিলের ধারে।
নেই রিমু, কোথাও নেই! ওর রিমু এই জঙ্গলেই আছে। ওর একদম কাছে, কিন্তু ওর থেকে দূরে সরে থেকে ওকে শাস্তি দিতে চাইছে! এমন কেন করছে রিমু! কিসের শাস্তি দিচ্ছে ও!
সাফওয়ান যা করেছে, যা লুকিয়েছে, সব তো ওকেই নিজের করে পাওয়ার জন্য! ওর যেটুকু স্বার্থ সে সবটুকুই তো শুধু রিমু কে পাওয়ার জন্য, এ ছাড়া আর কিছুই না! কিন্তু কে বোঝাবে ওই পাগলি মেয়েটাকে! সে তো নিজের মতো করে ভুল বুঝে নিয়ে, অভিমান করে হারিয়ে গেছে! আর সাফওয়ানের জন্য রেখে গেছে এক বুক হাহুতাশ!
ধীর পায়ে বিলের পাড় থেকে নেমে বিলের ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলো সাফওয়ান৷ কাদামাটির ওপর হাটু গেড়ে বসে পড়লো ও৷ কোথাও নেই ওর রিমু!
এই বিলের ধারেই একদিন ওর রিমু কে দেখে ও প্রথম ঝটকা খেয়েছিলো, এই বিলের ধারেই ও করেছিলো ওর প্রথম চুমুর নিবেদন। প্রথম বারের মতো পুচকে থেকে বড় হয়ে যাওয়া রুমাইশা কে কোলের ভেতর নিয়েছিলো ও, আঠারো বছর পর।
সেদিনের সমস্ত স্মৃতি আজ সাফওয়ানের চোখের পাতায় ভাসছে৷
রুমাইশার সেই ভেজা লম্বা চুল, ঢোলা গেঞ্জি; যার ভেতর দিয়ে উকি মারছিলো ওর ফর্সা কাধ, ওর নরম তুলতুলে গলার ওপর সাফওয়ানের আঙুলের ছাপ লাল রঙা ছাপ! সেই ভয়ে দুরু দুরু করা বুক, সেই ভীতসন্ত্রস্ত চাহনি, সাফওয়ানের মুখের দিকে না তাকাতে চাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা; সব, সব মনে পড়ে গেলো সাফওয়ানের৷
ডুকরে কেদে উঠলো ও! বুক ফেটে আর্তনাদ বের হয়ে এলো ওর৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে আর্তচিৎকার দিলো ও। তারপর হাউমাউ করে লুটিয়ে পড়লো বিলের ধারের কাদামাটি তে।
শাফিন আর রাফসানও রুমি কে খুজতে খুজতে বিলের দিকে আসতে লাগলো। রাফসানের চোখ দুইটা সতর্ক, যদি আর একটিবারের জন্যও রুমির ওই উজ্জল চোখ জোড়ার হদিস পাওয়া যায়!
কিন্তু এত সাবধানী নজরেও কিছুই বাধলো না৷ শাফিন ও সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বুলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওর মাথায় শুধু ঘুরছে রুমাইশার ওই জ্বলজ্বলে চোখ জোড়া। হাটতে হাটতেই ও রাফসান কে জিজ্ঞেস করলো,
— ভাইয়া, রুমি আপুর চোখ জোড়াও সাফওয়ান ভাইয়ার মতো হয়ে গেলো কিভাবে! আমরা তো কিছুই টের পেলাম না। আপু নিখোজ হওয়ার আগের দিনেও তো স্বাভাবিক দেখেছিলাম। তাহলে কি হলো হঠাৎ?
রাফসান শাফিনের কথায় সায় মানলো। তারপত হতাশার সুরে বলল,
— আমিও কিছু বুঝতে পারছিনা রে শাফিন! আমিও এসবের কিছুই জানিনা। এর উত্তর একমাত্র সাফওয়ান দিতে পারবে। আমার প্রাণের রুমির অবস্থা এমন হবে জানলে আমি কখনোই সাফওয়ানের কাছে ওকে দিতাম না! আমি ওকে সাবধান করেছিলাম, যে ও যেন ওর জীবনের সাথে আমার রুমি কে না জড়ায়! কিন্তু আমার কথা শোনেনি ও। রুমি কে ও নিজের করে ছেড়েছে। আর এখন তার পরিণতি নিজের চোখে দেখছে ও।
আমার বোন টা আজ ঘর ছাড়া! আমার মা টা কেদে কেদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমার বাবা হাই প্রেশারের রোগী। মেয়ের শোকে তার কখন কি হয়ে যায় আল্লাহ জানেন! আমার পুরো পরিবার টাই আজ যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে৷ মনে হচ্ছে যেন সেই আঠারো বছর আগেকার পরিস্থিতিই আমার চোখের সামনে আবার কেউ রিপ্লে করছে!
আমি যদি বাড়িতে কোনো একজন কে বলি, আমার রুমির এই হালের কথা, তাহলে কি হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এতবার করে সাবধান করেছিলাম আমি সাফওয়ান কে! কিন্তু ও শোনেনি আমার কথা!
শাফিন নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে বলা কথা গুলো নিতে পারলো না। গম্ভীর হয়ে গেলো ও। হ্যা, ওর ভাইয়ের দোষ আছে। ওর ভাই অপরাধ করেছে। কিন্তু সাফওয়ান ভাইএর করা সমস্ত অপরাধ শুধু রুমি আপুকে পাওয়ার জন্য। জেদ খাটিয়ে রুমি আপুকে সে নিজের করেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের ভেতর কখনোই ভালোবাসার কমতি ছিলো না৷ সাফওয়ান যতটা ভালোবাসা রুমি কে দিয়েছে ততটা ভালোবাসা আর কেউই রুমি কে দিতে পারতো না, সেটা শাফিনের দৃঢ় বিশ্বাস।
গম্ভীর গলাতেই ও বলল,
— এসব বলে এখন লাভ কি ভাইয়া? সাফওয়ান ভাইয়া রুমি আপুকে কত টা ভালোবাসে সেটা তুমি আমি সহ বাড়ির সকলেই জানে৷ সাফওয়ান ভাইয়া জেনে শুনে কখনোই যে রুমি আপুর ক্ষতি করবে না সেটা তুমি বেশ ভালো করেই জানো। হয়তো তাদের ভেতরে এমন কিছু আছে যেটা আমরা জানিনা৷ তাই না জেনে শুনে এইভাবে মন্তব্য করা ঠিক না। এসব কথা না ভেবে এখন আমরা রুমি আপুকে কিভাবে খুজে বের করবো সেটাই ভাবা উচিত৷
রাফসান প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না। ওর এখন কোনো কথা খরচ করতে ইচ্ছা করছে না৷ চুপচাপ হাটতে থাকলো ও৷
আরও কিছুক্ষণ হাটার পর ই ওরা প্রায় বিলের ধারে চলে এলো। আর দূর থেকেই ওরা শুনতে পেলো সাফওয়ানের করুণ আর্তনাদ!
চকিতে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ওরা ছুটলো সেদিকে। আর বিলের আর ও একটু কাছে যেতেই ওপর থেকেই ওরা দেখতে পেলো কাদা মাটিয়ে লুটিয়ে পড়া সাফওয়ান কে৷
কিন্তু সাফওয়ানের কাছে আসলো না ওরা। জঙ্গলের ধার ঘেষেই দাঁড়িয়ে রইলো। শাফিন একবার যেতে চাইলেও রাফসান যেতে দিলো না। সাফওয়ান কে ছেড়ে দিলো ওর মতো করে।
সাফওয়ান কাদামাটি তে লুটিয়েই উচ্চস্বরে বিলাপ করছে,
— ফিরে আয় রে রিমু! আমার সব খালি হয়ে গেছে রে রিমু! কোথাও কিছু নেই আমার, সব ফাকা হয়ে গেছে! আমার কাছে ফিরে আয় একটিবার! আমি আর কখনোই ধমকাবোনা! কিছুই বলবো না আর কোনোদিন৷ সব কিছু ছেড়ে দিবো আমি সব, সব! কিছুই চাইনা আমার, শুধু তুই ফিরে আয়! আমি স্বার্থপর নইরে রে, আমি শুধু তোর জন্য স্বার্থপর! আমার শুধু তোকে চাই, আর কিচ্ছুটি চাইনা আমার! শুধু তুই ফিরে আয়!
সাফওয়ানের এমন আকুতি পূর্ণ আর্তনাদে রাফসানের চোখ দুইটা পানিতে পূর্ণ হয়ে এলো। রুমাইশার মুখ টা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কান্নার শব্দ ঠেকাতে মুখের ওপর হাত চাপা দিলো ও।
চাঁদের আলোয় সাফওয়ান কে স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। সাফওয়ানের সেই বিশাল দেহ টা লিকলিকে হয়ে গেছে। হাড় ছাড়া আর কিছুই যেন দেখা যাচ্ছে না!
সাফওয়ানের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো রাফসান, সাফওয়ান কে এই অবস্থায় দেখতে পারছে না ও। সেই বিশালদেহী, কর্কশ কন্ঠের, গম্ভীর আর উঁচু ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষটার এত করুণ অবস্থা হবে তা ও স্বপ্নেও ভাবেনি।
শাফিন এখনো তাকিয়ে আছে ওর ভাইয়ের দিকে৷
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকায় সাফওয়ানের পিঠের মেরুদণ্ডের হাড় আর পাজর গুলো যেন চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷
শাফিন সেদিকে তাকিয়েই স্বগতোক্তি করলো,
— আহ আপু, তুমি যদি একটাবার দেখতে, তোমাকে ছাড়া সেই শক্ত খোলসের কঠোর লোক টা কেমন আছে তাহলে তুমি এখনি ছুটে চলে আসতে আপু! তুমি দেখলে না আপু, তুমি দেখলেনা!