৪১. পরদিন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠলো সবাই। রাতে বৃষ্টি হয়নি, যদিও আকাশে মেঘ ছিলো। রাতের বেলা বেশিক্ষণ জেগে থাকার কারণে ফজরের পর রুমাইশা আবার গিয়ে ঘুমালো চিলেকোঠার কামরায়।
সাফওয়ানের কাজ ছিলো কিছু কিন্তু রুমাইশার জোরাজোরি তে ওকেও গিয়ে ঘুমাতে হলো সেই সাথে। তার ওপর আবার, ঘুমিয়ে পড়ার আগে রুমাইশা হুমকি দিয়ে নিলো যে, যদি ঘুম থেকে উঠে ও সাফওয়ান কে না দেখে তাহলে আর এই খানে ঘুমাবে না, নিজের এক্স রুমে গিয়ে ঘুমাবে। অগত্যা বেজার মুখে সাফওয়ান ও আবার ঘুমালো রুমি কে জড়িয়ে।
রাফসান আর শাফিন ঘুরতে গেলো জঙ্গলের ভেতর। বহু বছর আসা হয়নি এখানে, ছোটবেলার কত শত স্মৃতি ওদের এইখানে। স্মৃতি গুলো আবার তাজা করতে ধীর গতিতে ওরা জঙ্গলের দিকে এগোলো। ঘুরে এসে সকালের খাবার টা খেয়েই রওনা দিবে ও৷
.…
রুমাইশার যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়ির কাটা নয়টার দিকে ঝুকে গেছে। তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠে বসলো ও। ফুপ্পি হয়তো একা একাই সমস্ত কাজ করছে রান্না ঘরে। কাজের খালা অন্যান্য কাজ গুছিয়ে দিলেও রান্না টা রুনিয়া নিজেই করেন। আগে করতেন না, সাফওয়ান আসার পর থেকে সব রান্না গুলো উনি নিজেই করার চেষ্টা করেন। কারণ সাফওয়ান বাইরের মানুষের হাতের রান্না খেতে চায় না। রেস্টুরেন্টেও যায়নি কখনো ও, কারণ প্রথমত ওর এই ফিজ্যিক্যাল কন্ডিশন, আর দ্বিতীয়ত ওর খুতখুতে স্বভাব৷
রুনিয়া যতটুকু পারেন, যা পারেন রান্না করে দেন সাফওয়ান কে। আর নয়তো সাফওয়ান নিজেই রান্না করে খায়।
রুনিয়া উঠে পড়ায় সাফওয়ানের ও ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে ও জিজ্ঞেস করলো,
— কি সমস্যা? লাফাচ্ছিস কেন বাদরের মতো? আস্তে উঠতে পারিস না?
ওকে বাদর বলায় চটে গেলো রুমাইশা। ভ্রু কুচকে বলল,
— না পারিনা, পারলে তো আস্তেই উঠতাম, বাদরের মতো লাফাতাম না। আমি বাদর তাই লাফাচ্ছি।
সাফওয়ান শুয়ে শুয়েই ফিচেল হেসে বলল,
— কি দারুণ সহজ স্বীকারোক্তি। সত্যি কথা মানুষ এত সহজে স্বীকার করে নেয়! এমন টা তো আগে কোনোদিন কাউকে করতে দেখিনি। আমার বউ সত্যবাদী এবং এক্সেপশোনাল। ইমপ্রেসিভ, ভেরি ইমপ্রেসিভ!
রুমাইশা কটমট করে তাকালো সাফওয়ানের দিকে, কিন্তু যার দিকে তাকালো তার কোনো হেলদোল হলো না, সে মুখে হাসি ফুটিয়ে মনের সুখে মুখ খানা রুমাইশার দিক থেকে ফিরিয়ে বিশালাকার দেহ টা অন্য পাশে ঘুরিয়ে আবার আরামে শুয়ে পড়লো৷ রুমাইশার রাগ হলো খুব। ব্যাডা ওকে পাত্তাই দিলো না! এইডা কিছু হইলো?
হাত মুষ্টি করে সাফওয়ানের বাহুতে একটা কিল বসিয়ে দিতে গিয়েও দিলো না। পরনের পোশাক ঠিক ঠাক করে বিছানা থেকে নিচে নামার প্রস্তুতি নিলো ও। তখনি সাফওয়ান এদিক ফিরে খপ করে ওর হাত টা ধরে ফেলে বলল,
— মায়ের কাছে কত গুলা ব্লাউজের পিস আছে, ওগুলো আজকেই মাপ দিয়ে বানিয়ে ফেলবি। ফুল স্লিভ হতে হবে, পিঠে কোনো আবরণ থাকবে না, সুধু দুইটা ফিতা থাকবে বড় মাপের গোল গলা হতে হবে আর কোমর এর পুরোটা অনাবৃত থাকা লাগবে। মনে থাকে যেন।
রুমাইশা মুখ বেকিয়ে হাত টা ছাড়িয়ে নিলো। তারপর বিছানা থেকে নামতে নামতে বিড় বিড় করে বলল,
— ডিম্যান্ড কত ব্যাডার!
তারপর হেটে রুম থেকে বের হতে হতে জোরে বলে উঠলো,
— ঠিক আছে, ভেবে দেখবো।
রুমাইশার মুখ বাকানো টা বেশ লাগলো সাফওয়ানের। হেসে উঠলো ও। রুমাইশা বাইরে চলে যাওয়ার পর নিজে কয়েকবার রুমির মতো করে মুখ বাকানোর চেষ্টা চালালো, কিন্তু হলো না। নারী জাতির কাছে হার মেনে সাফওয়ান আবার ঘুরে শুয়ে পড়লো। আপাতত বিছানা ছাড়ার কোনো ইচ্ছা নেই ওর, শুধু বউ টা নেই বলে একটু ফাকা ফাকা লাগছে, পাশ থেকে কোলবালিশ টা টেনে নিয়ে বউ এর অভাব টা সামান্য পরিমাণ কমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু ব্যর্থ হলো।
৪২. মধ্যরাত পার হয়েছে৷ নিশাচর প্রানী গুলো ব্যাতিত বাকি সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। থেকে থেকে দূরে কোথাও হুতোম প্যাঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। কুউক পাখি ডেকে উঠছে সেগুন গাছের ঘন পাতা ওয়ালা ডাল টা থেকে।
চিলেকোঠার রুমটাতে সাফওয়ানের বুকের সাথে লেপ্টে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে রুমাইশা। দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রুমাইশা নড়ে উঠছে মাঝে মাঝে। ঘুম টা ওর এখনো গাঢ় হয়ে উঠেনি। খানিকক্ষন পর রুমাইশার নড়াচড়া স্তিমিত হয়ে এলো কিছুটা।
ঠিক এমন সময়ে আকস্মিক ভাবে ঘুম ছুটে গেলো সাফওয়ানের। ঘুম ভেঙেই হাপাতে শুরু করলো ও৷ পাশে চোখ যেতেই রুমাইশা কে ওর গায়ের সাথে মিশে থাকতে দেখে নিঃশ্বাস টা যথাসম্ভব আস্তে ছাড়ার চেষ্টা করে আলতো হাতে রুমাইশা কে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো, খুব সাবধানে কাজটি করলো যেন ওর ঘুম টা না ভেঙে যায়।
রিমু কে সরিয়ে সন্তর্পণে বিছানা থেকে নামলো ও। তারপর হেটে দরজার কাছে এসে নিঃশব্দে দরজার লক খুলে বাইরে বেরিয়ে দরজা টা ভেজিয়ে দিলো আবার৷ দিয়েই প্রচন্ড জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো সাফওয়ান। তারপর আবার জোরে শ্বাস নিলো! দম আটকে আসছে ওর। বুক টা হাপরের মতো জোরে জোরে ওপরে নিচে ওঠানামা করতে থাকলো ওর। শরীরের ভেতর সুক্ষ্ম এক যন্ত্রনা ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছে! বুক টাতে কেউ যেন চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে!
চোখ দুইটা তে হঠাৎ করেই যন্ত্রনা শুরু হয়েছে। মাথার ভেতর টা ফেটে যাচ্ছে যেন। না আর দেরি নয়!
ছাদ থেকে দ্রুত গতিতে নিচে লাফ দিলো ও। তারপর প্রাণপণে ছুটতে থাকলো জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলের দিকে একবার ঢুকেই গগনবিদারী চিৎকার দিলো সাফওয়ান। অসহ্য যন্ত্রনায় ওর শরীর টা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু ছোটা থামালো না ও। নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ছুটতে থাকলো ও জঙ্গলের ভেতর। মুখ থেকে না চাইলেও আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসছে ওর। অসহায়ের মতো চিৎকার দিতে দিতে ছুটলো ও৷
ছুটতে ছুটতে সেই ভাঙাচোরা ভুতুড়ে কুড়েঘর টার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাফ ছাড়লো সাফওয়ান। দম আটকে আসছে ওর। প্রচন্ড গতিতে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চলছে ওর। দৌড়ের কারণে সেটা আর ও বেড়ে গেছে।
কিন্তু যন্ত্রণার তীব্রতায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না বেশিক্ষণ। চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে ওর৷ নিজের সাথে কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও। এই সিম্পটমস ওর কাছে সম্পুর্ন নতুন।
মাটিতে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে পাগলের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে ল্যাবে ঢুকলো ও৷ ঢুকেই শরীরের অসহ্য জ্বালাপোড়ার কারণে নিজের শরীরের সমস্ত পোশাক টেনে ছিড়ে খুলে ফেললো ও৷ শরীর টা যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে! শরীরের বিভিন্ন জায়গার মাংসপেশি গুলো অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে।
হাত পা গুলো হঠাৎ করেই কষতে শুরু করলো সাফওয়ানের। কষে সেগুলো কুকড়ে যেতে লাগলো, সেই সাথে অসম্ভব যন্ত্রণায় নীল হয়ে এলো সাফওয়ানের মুখ টা। গগনবিদারী চিৎকার দিলো ও আবার। ল্যাবের মেঝেতে শুয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগলো ও৷ এই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা, পরিবারের সবার অজানা ল্যাবের ভেতর নিঃসঙ্গ সাফওয়ান অসহায় হয়ে ল্যাবের ছাদের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রাণপণে প্রার্থনা করতে থাকলো। শরীর ছেড়া যন্ত্রণায় চোখ দুইটা দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো ওর৷
দুই পাটি দাঁত একসাথে লেগে গেছে ব্যাথার তীব্রতায়। এসবের মাঝে হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর যন্ত্রনা শুরু হলো সাফওয়ানের চোখে। আকাশ বাতাস কাপিয়ে আবার চিৎকার দিয়ে উঠলো ও। প্রচন্ড কষ্টে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো ওর। যন্ত্রনায় চোখ মেলতে পারলো না আর। চোখ খিচে চিৎকার করতে থাকলো শুধু।
শেষ বারের মতো চেষ্টা করলো একবার উঠে বসার। কষে যাওয়া হাতে ভর দিতে পারলো না। তবুও মাথা টা উচু করে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলো প্রাণপণে। চোখ মেলেই রুমের ভেতর থাকা ফুল ভিউ মিররের ভেতর নিজেকে দেখতে পেলো ও৷
শরীর টা পুরো কালো বর্ণ ধারন করেছে। মাংশপেশি গুলো অদ্ভুতভাবে কাপছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে ওর চোখ দুইটা। জ্বলজ্বলে চোখের সেই উজ্জ্বল আলোটা আকাশের তারার মিটিমিটি আলোর মতো করেই কম বেশি হচ্ছে, উজ্জলতা টা কমে গিয়ে আবার বেড়ে যাচ্ছে, পরমুহূর্তেই কমে গিয়ে আবার জ্বলে উঠছে।
কিন্তু সে দৃশ্য বেশিক্ষন দেখতে পারলো না সাফওয়ান। অসহ্য যন্ত্রনায় চোখ দুইটা খিচে বন্ধ করে নিলো। আর তারপর এই প্রচন্ডরকম যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে একসময় শরীর টা তীব্র বেগে ঝাকি দিয়ে জ্ঞান হারালো সাফিওয়ান সেখানেই।
.…
সাফওয়ানের আদুরে আলিঙ্গনের অভাবে ঘুম ভেঙে গেলো রুমাইশার। চোখ না খুলেই বিছানার অপর পাশ টা হাতড়িয়ে দেখলো ও৷ নেই সাফওয়ান। সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকিয়ে উঠে বসলো ও৷ ভাবলো ওয়াশরুমে গেছে হয়তো।
বসে রইলো সাফওয়ানের বের হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু কিছু সময় পার হওয়ার পর ও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না৷
তখনি উত্তর দিক থেকে হাওয়ায় ভেসে এলো কারো গগনবিদারী চিৎকারের ক্ষীণ শব্দ। ঘুম ঘুম ভাব টা একেবারেই ছুটে গেলো রুমাইশার। তৎক্ষনাৎ বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমের দরজার জাছে গেলো ও, কিন্তু সেটা তো বাইরে থেকেই লক করা! বুকের ভেতর কেপে উঠলো রুমাইশার। সাহস না হারিয়ে দরজা খুলে খোলা ছাদ টা চেক করতে গেলো ও, যদি সাফওয়ান কে সেখানে পায় সেই আশায়।
দরজার জাছে গিয়ে দরজার লক টা খোলা দেখলো ও। তড়িৎ গতিতে রুম থেকে বের হয়ে ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা হন্যে হয়ে খুজলো ও সাফওয়ান কে।
না, নেই সাফওয়ান, কোথাও নেই! পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেলো ওর৷ তখনি জঙ্গলের ভেতর থেকে কারো আর্তচিৎকার ভেসে এলো আবার ও৷ অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কেউ জঙ্গল টাকে কাপিয়ে তুলছে তার তীব্র চিৎকারে৷
সেটা যে সাফওয়ানেরই প্রবল বেদনার চিৎকার তা বুঝতে আর বাকি রইলো না রুমাইশার। হতভম্ব হয়ে ছাদের মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে পড়লো ও। অসহায় চোখে একবার তাকালো ও জঙ্গলের দিকে। চোখ থেকে নিজের অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো ওর।
কিন্তু এইভাবে ওর বসে থাকলে চলবে না৷ মেঝে থেকে উঠে দ্রুত গতিতে রুমে গেলো ও। তারপর শাফিনের ফোনে কল করলো। গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো রুমাইশা৷ কয়েক বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করলো শাফিন৷ ঘুম ঘুম গলায় কে জিজ্ঞেস করতেই রুমাইশা বলে উঠলো,
— আমি রুমি বলছি শাফিন।
এত রাতে রুমির কল পেয়ে শাফিন উঠে বসলো, উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— কোনো সমস্যা হয়েছে আপু? ঠিক আছো তুমি?
রুমাইশা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে দ্রুতস্বরে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,
— তোর ভাই রুমে নেই। ওয়াশরুম ছাদ সব চেইক করেছি, কোথাও নেই ও৷ জঙ্গলের ভেতর থেকে আমি কারো চিৎকার শুনেছি পর পর দুই বার। আমার মনে হয় ওইটা তোর ভাইয়ের ই চিৎকার, মনে হয় না; আমি নিশ্চিত!
শাফিন রুমাইশা কে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল,
— হয়তো ভাইয়ের কোনো কাজ আছে, তাই গিয়েছে জঙ্গলে।
রুমাইশা প্রতিবাদ করে কান্না মেশা গলায় বলল,
— কাজ থাকলে ও চিৎকার করবে কেন? আমি স্পষ্ট শুনেছি, যন্ত্রনায় চিৎকার করছে ও। আমি এখানে থাকতে পারছি না আর। আমি জঙ্গলে যাবো, ওর কাছে। তুই আমাকে নিয়ে চল।
শাফিন কি বলবে ভেবে পেলো না। ভাইয়ের জন্য ওর নিজের ও চিন্তা শুরু হলো এবার৷ কোনো উপায় না পেয়ে রাজি হলো ও রুমাইশার সাথে জঙ্গলে যেতে।
বলল,
— ঠিক আছে আমি রেডি হচ্ছি। সন্ধ্যায় অল্প বৃষ্টি হয়েছে, জঙ্গলের মাটি কাদা কাদা হয়ে আছে। শক্ত ধরনের জুতা পইরো, পরে নিচে আসো। আমিও আসছি।
বলে ফোন কেটে দিলো শাফিন৷ তার পর চেয়ারের ওপর খুলে রাখা শার্ট টা গায়ে জড়াতে লেগে গেলো। রুমাইশা জঙ্গলের ভেতর হাটার সুবিধার্থে একটা ট্রাউজার পরে নিলো। আর তার ওপর পরলো সাফওয়ানের একটা টি শার্ট। ওর গুলো সব বাড়িতে।
লম্বা চুল গুলো শক্ত করে খোপা করে একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেধে নিলো। শক্ত পোক্ত জুতা আছে কিনা মনে পড়লো না ওর। তবুও একবার দোতলার রুম টা দেখে যাবে ভাবলো। সেদিন বাড়ি থেকে আসার সময় স্যান্ডেল পরে এসেছিলো। তারপর সাফওয়ান এক জোড়া হিল জুতা কিনে দিয়েছিলো। এ ছাড়া তো আর কিছু নেই। গোছানো শেষ হলে সাফওয়ানের স্টাডি টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোট টর্চ লাইট নিলো।
রেডি হয়ে দোতলায় এসে নিজের রুমে গেলো। এক জোড়া কাপড়ের শু জুতা পেলো ও। উপায় না পেয়ে সেগুলাই পরে নিলো।
শাফিন রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো পাশের রুমের দরজা খোলা। উকি দিয়ে দেখলো রুমাইশা জুতা পরছে৷ ওকে দেখে রুমাইশা জুতা পরা দ্রুত শেষ করলো। তারপর দুজনে সিড়ি বেয়ে নেমে সন্তর্পনে মেইন ডোর খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের দিকে তাকালেই গা ছম ছম করে উঠছে। তার ওপর বৃষ্টি হয়ে জঙ্গল টা আর ও ভয়ঙ্কর রূপ ধারন করেছে। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা করলো না রুমাইশা। দ্রুত পায়ে জঙ্গলের দিকে আগালো ও। ওর পেছন পেছন শাফিন আশপাশ টা নজর দিতে দিতে এগোলো।
এতক্ষন ওরা টর্চ না জ্বালাইয়েই হাটছিলো। জঙ্গলের খানিক ভেতরে এসে টর্চ জ্বালালো রুমাইশা। উদ্দ্যেশ্য হীন ভাবে জঙ্গলের ভেতর হাটতে লাগলো ওরা দুজন। এত বড় জঙ্গলের ভেতর কোথায় খুজবে ওরা সাফওয়ান কে?
পায়ের জুতা টা কাদায় মাখা মাখি হয়ে গেছে রুমাইশার। দু তিন বার স্যাতলা জায়গায় পড়ে যেতে গিয়েও পড়েনি। ট্রাউজারের নিচের দিক টা কাদার ছিটেয় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সেসবের দিকে একদম ধ্যান নেই রুমাইশার। চোখ দুইটা ওর সামনের দিকে, অধীর হয়ে খুজছে ও ওর প্রাণপিয় স্বামী কে।
হাটতে হাটতে হঠাৎ রুমাইশা বামের দিকে মোড় নিতে গেলে শাফিন পেছন থেকে বলে উঠলো,
— ওদিকে না আপু, ডান দিকে ।
রুমাইশা চকিতে পেছন ফিরে বিস্মিত গলায় বলল,
— তুই কিভাবে জানিস?
শাফিন ইতস্তত করে বলল,
— আমি একদিন গিয়েছিলাম ভাইয়ার পেছন পেছন, ভাইয়া আসলেই কোথায় যায় দেখতে। জঙ্গলের অনেক ভেতরে গিয়ে একটা কুড়ে ঘর আছে। ভাইয়া ওর ভেতরেই যায়। গিয়ে কোথায় যায় তা অবশ্য আমি জানিনা৷ ওইটা একটা ভাঙা ঘর। ভুতুড়ে দেখতে, আর অনেক ছোট। আমার ধারনা ভাইয়া ওখানেই আছে৷
রুমাইশা কিছুক্ষন চুপ থেকে শাফিন কে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে বলল, শাফিন এবার রুমাইশার সামনে গিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো ওকে৷ খানিক পথ যাওয়ার পর শাফিনের চোখে পড়লো কারো পায়ের ছাপ। জায়গা টা একটু বেশি কর্দমাক্ত থাকায় পায়ের ছাপটা গভীরে বসে গেছে।
শাফিন রুমাইশাকেও দেখালো সেটা। রুমাইশা তীর্যক চোখে সামনে তাকিয়ে রাস্তা টা দেখলো। সরু একটা রাস্তা চলে গেছে যেন। অন্য জায়গার তুলনায় এখানের ঘাস, ঝোপঝাড় কম।
কাদা মাটিতে কেচো, জোক, বিছা সহ অন্যান্য পোকা মাকড় অবাধে বিচরন করছে। অন্য সময় হলে রুমাইশা ভয়ে আর ঘেন্নায় চিৎকার করে বাড়ি কাপিয়ে তুলতো। কিন্তু এখন সেসব সহস্রপদী প্রানীর দিকে একদমই খেয়াল নেই ওর৷ সেসব ছোট ছোট ঘৃণিত প্রানী কে পায়ে মাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেটে যেতে লাগলো ও শাফিনের পেছন পেছন।
বেশ খানিকটা জোর কদমে হাটার পর ওরা এসে থামলো সেই ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে৷ রুমাইশা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। শাফিন ও ঢুকলো রুমাইশার পেছন পেছন।
কিন্তু এখানে তো কিছুই নেই। তারপর ও ভেতরে ঢুকে ঘরময় হাটাহাটি করলো ওরা কিছুক্ষন। তখনি রুমাইশার পায়ের তলায় ধাতব জাতীয় কোনো কিছুর শব্দ হলো। চকিতে ও তাকালো শাফিনের দিকে। শাফিন ও সেই মুহুর্তে তাকালো রুমাইশার দিকে। তৎক্ষনাৎ ওরা সেখানের শুকনা পাতা আর আবর্জনা সরিয়ে আবিষ্কার করলো একটা লোহার দরজা। দুজনেই বুঝলো এইটাই সেই ল্যাবে যাওয়ার রাস্তা।
কিন্তু কিভাবে খুলবে এটা বুঝতে পারলো না। দুজনে অনেক ক্ষন ধরে টেনে ওঠানোর চেষ্টা করলো দরজা টা। কিন্তু উঠলো না। অনেক্ষন চেষ্টার পর ও যখন দরজটা উঠলো না তখন শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে ধৈর্য হারিয়ে শাফিন হাত দিয়ে জোরে একটা আঘাত করলো দরজার ওপর৷ আর তখনি সেখানে একটা স্ক্রিন ভেসে উঠে ফিঙ্গার প্রিন্ট চাইলো।
চমকে উঠলো ওরা দুজনেই। কিন্তু হাতের ছাপ কোথায় পাবে এখন ওরা। রুমাইশা ভালো ভাবে স্ক্রিন টা পরখ করলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ স্ক্রিনের বাম কোনায় চোখ গেলো ওর। রুমাইশা চোখ ছোট ছোট করে দেখার চেষ্টা করলো কি লেখা আছে সেখানে৷ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দেখলো সেখানে খুব ছোট্ট করে ইংরেজিতে লেখা ‘pass’।
সেখানে টাচ করতেই পাসওয়ার্ড লেখার অপশন উঠে এলো ওদের সামনে৷ চকিতে দুজন দুজনের দিকে তাকালো। কিন্তু ওরা তো জানেনা পাসওয়ার্ড কি! কি দিবে এখন পাসওয়ার্ড ওরা?
শাফিন সরে এলো স্ক্রিনের সামনের দিকে। প্রথমে কয়েকটা সাধারণ সংখ্যা দিয়ে ট্রাই করলো ও। কিন্তু লাভ হলো না কোনো। শাফিন এবার রুমাইশার নাম টা দিয়ে চেষ্টা করলো একবার কিন্তু তাতেও হলো না। বাড়ির সবার নামই একটা বার করে দিয়ে চেষ্টা করে দেখলো, কিন্তু কোনোটাই কাজে আসলো না।
রুমাইশা বলল,
— তোর কি মনে হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গার পাসওয়ার্ড ও এইরকম পানির মতো সোজা নাম ধাম দিয়ে সেট করে রাখবে?
শাফিন অসহায় হয়ে তাকালো একবার রুমাইশার দিকে। রুমাইশা ওকে সরিয়ে দিয়ে এবার নিজে ট্রাই করতে লাগলো। সেদিন রাতে সাফওয়ান ওর ফেবুতে লগইন করার সময় ওর পাসওয়ার্ড দেখেছিলো রুমাইশা। সেই হিসাব করে পাসওয়ার্ডের প্যাটার্ণ কেমন হতে পারে সেটা আন্দাজ করে ট্রাই করতে লাগলো ও৷
বেশ কয়েকবার বিভিন্ন ভাবে ট্রাই করার পর ও যখন খুলল না তখন হাল ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো ও নিজেও৷ মুখে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো ও কি করবে এখন। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে আবার ও পাসওয়ার্ড লিখতে বসলো ও। একে একে যতগুলো আইডিয়া মাথায় আসে ওর সবগুলো ট্রাই করলো। কিন্তু খুলতে পারলো না। শেষে টাচ স্ক্রিন টা ওদের কে ওয়ার্নিং দিলো। যে আর পাঁচবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলেই স্ক্রিন লক হয়ে যাবে৷ আর পাসওয়ার্ড দিতে পারবে না ওরা।
রুমাইশা অসহায় চোখে একবার শাফিনের দিকে দেখলো। শাফিন ও একইভাবেই তাকিয়ে আছে ওর দিকে৷ রুমাইশা দমে গেলো না৷ আবার ও পাসওয়ার্ড দেওয়ার চেষ্টা করলো ও। কিন্তু পর পর দু বার চেষ্টা করার পর ও খুলতে পারলো না ও।
তারপর নিরুপায় হয়ে চোখ বুজে কিছুক্ষন বসে রইলো। আর সামনে আগাবে কিনা সেটাই ভাবতে লাগলো বসে বসে। কান্না পাচ্ছে ওর, গলা ভারী হয়ে আসছে! চোখের বাধ ভেঙে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ সাফওয়ান যদি আসলেই ভেতরে থেকে থাকে তাহলে হয়তো খুব যন্ত্রনায় আছে ও! একা একা কি করছে ও এই বদ্ধ জায়গার ভেতরে ভেবেই রুমাইশা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ফুপিয়ে কেদে উঠলো। শাফিন তাকিয়ে রইলো রুমাইশার দিকে। রুমাইশা ভাঙা ঘর টার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে অসহায় হয়ে কাদতে লাগলো।
শাফিন কয়েকবার কান্না থামাতে বলতে গিয়েও বলল না৷ কাদতে দিলো রুমাইশা কে। ওর নিজের ও ভাইয়ের চিন্তায় বুক ভারী হয়ে আসছে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই ওর।
কিছুক্ষন পর কান্নাকাটি থামিয়ে চোখ মুছে, মুখ টা দৃঢ় করে আবার স্ক্রিনের দিকে এগিয়ে এলো রুমাইশা। তারপর আবার চেষ্টা করলো একবার। এইবার ও নিজের আর মোস্তফা আহমেদের নাম দিয়ে সাথে আর ও কিছু সংখ্যা আর চিহ্ন যোগ করে পাসওয়ার্ড পাতালো। আর এইবার ওদের দুজনকেই চমকে দিয়ে দরজা টা মেটালিক সাউন্ড করে খুলে গেলো। আর তারপরই ভেসে উঠলো নিচে যাওয়ার সিড়ি৷
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়েই সিড়ি বেয়ে নেমে ভেতরে গেলো দ্রুত গতিতে। শাফিন গেলো প্রথমে। আর গিয়েই দূর থেকে দেখতে পেলো সাফওয়ানের নগ্ন দেহটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে রুমের এক কোণায়৷ ঝাকুনি দিয়ে উঠছে সেটা থেকে থেকে৷ উজ্জর শ্যমলা রঙা শরীরটা কুচকুচে কালো বর্ণ ধারন করেছে।
এই দৃশ্য দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলো শাফিন। চোখ ওর বড়বড় হয়ে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের ওই কালো শরীর টার দিকে।
শাফিন কে এইভাবে সিড়ির ওপর দাঁড়িয়ে যেতে দেখে শাফিনের চাহনি অনুসরণ করে রুমাইশা ও তাকালো সেদিকে। শক্ত খোলোশে আবৃত তার সাফওয়ানের পুরুষালি শরীর টাকে এইভাবে মেঝেতে নেতিয়ে পড়ে থাকতে দেখে বুক কেপে উঠলো রুমাইশার। উচ্চস্বরে কেদে উঠে সেদিকে ছুটলো ও৷
রুমের বাউন্ডারির ভেতর পা রাখতেই লেজার রশ্মি লাগলো রুমাইশার গায়ে। আর আনম্যাচ পেয়েই অদ্ভুত রকমের সতর্কিকরন শব্দ শোনা গেলো রুমের দেয়ালের উপরের দিকে কোণায় কোনায় রাখা সাউন্ডবক্স থেকে। লেজারের তীব্রতায় পুড়ে গেলো রুমাইশার শরীরের কিছু কিছু অংশ। যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠলো ও।
কিন্তু নিজের দিকে খেয়াল করার সময় পেলো না৷ দৌড়ে গিয়ে বিছানা থেকে চাদর টা তুলে ঢেকে দিলো সাফওয়ানের নগ্ন দেহ টা৷ তারপর উপুড় হয়ে থাকা সাফওয়ানের বাহু ধরে টেনে সামনের দিকে ফেরালো। কোলে তুলে নিলো সাফওয়ানের মাথা টা আলতো করে। সাফওয়ানের শরীর টা তখন ও ঝাকুনি দিয়ে উঠছে থেকে থেকে, শরীরের মাংসপেশি গুলো অদ্ভুত ভাবে লাফাচ্ছে৷ হাত পা কষছে ওর এখনো। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। মুখের ওপর অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। মুখ থেকে অস্পষ্ট শব্দ করছে সাফওয়ান।
সাফওয়ানের এ অবস্থা দেখে আবার ও কেদে উঠলো রুমাইশা। সবকিছু তো ঠিকঠাকই চলছিলো, আবার কেন এসব শুরু হলো ওদের জীবনে?
শাফিন ও এগিয়ে এলো ওদের দিকে। লেজার রশ্মি ওকেও আহত করে দিলো খানিক টা। দৌড়ে এসে ও ভাইয়ের পাশে বসলো। রুমাইশা সাফওয়ানের চোয়ালে আলতো হাতে স্পর্শ করে নাম ধরে ডাকতে লাগলো সাফওয়ান কে। ওর চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো টুপ টুপ করে সাফওয়ানের মুখের ওপর। সাফওয়ানের কষনের পরিমাণ হঠাৎ করেই বেড়ে গেলো। হাত পা দুইটা অদ্ভুত ভাবে একে বেকে যেতে লাগলো ওর। ভয়ঙ্কর দেখা যেতে লাগলো সাফওয়ান কে।
রুমাইশা চিৎকার দিয়ে কেদে উঠলো, শাফিনের দিকে তাকিয়ে অসহায় হয়ে বলল,
— শাফিন রে, কি হচ্ছে আমার সাফওয়ানের! কি হচ্ছে ওর! কি করবো আমরা এখন? ওর এই অবস্থা আমি দেখতে পারছিনা রে! আমরা কি করবো এখন? কিভাবে ঠিক হবে এসব! কিভাবে?
শাফিন কিছু বলতে পারলো না। ভাইয়ের এই কষ্ট চোখে দেখা আসলেই সম্ভব হচ্ছে না আর! চোখ মুখ চেপে কান্না আটকে ও বসে রইলো সাফওয়ানের পাশে।
সাফওয়ান কে আর ও খানিক টেনে নিজের বুকের কাছে নিলো রুমাইশা, তারপর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রইলো। ওর কপালে চুমু খেলো কয়েকটা।
সাফওয়ান এবার হঠাৎ করেই পা দাপাতে শুরু করলো অস্বাভাবিক ভাবে। শাফিন গিয়ে ভাইয়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরলো দুই হাত দিয়ে। কিন্তু সাফওয়ানের শক্তির সাথে ও পেরে উঠলো না৷ ওর পায়ের আঘাত লাগলো শাফিনের বুকে। ছিটকে দেয়ালের সাথে গিয়ে বাড়ি খেলো ও৷ রুমাইশা প্রাণপণে সাফওয়ানের দেহের উপরিভাগ আকড়ে ধরে রইলো। মনে মনে শুধু আল্লাহ তায়ালার নাম নিতে লাগলো ও।
পা দাপিয়ে মেঝে ভেঙে ফেলার উপক্রম করলো সাফওয়ান৷ হাত দুটো কুকড়ে রুমাইশার দিকে চলে গেলো ওর। একটা হাত রুমাইশার পেটের উপরিভাগের নাগাল পেতেই পেটের নরম জায়গাটা সজোরে খামছে ধরলো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে।
তীব্র ব্যাথায় চিৎকার দিয়ে উঠলো রুমাইশা। কিন্তু সাফওয়ানের হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না একটিবার ও। সাফওয়ান সেখানে খামছে ধরেই পড়ে রইলো।
খামছিটা আর ও জোরালো হলো ধীরে ধীরে৷ অস্বাভাবিক নড়াচড়ার কারণে গায়ের ওপর দেওয়া বিছানার চাদর টা সরে যেতে শুরু করলো। রুমাইশা অতি কষ্টে সেটা আবার টেনে ঠিক করে দিলো৷
শাফিন ধীরে ধীরে আবার এগিয়ে এলো সাফওয়ানের দিকে। রুমাইশা একা পেরে দিচ্ছে না সাফওয়ানের সাথে। এগিয়ে আসার পর শাফিনের চোখ গেলো সাফওয়ানের হাতের দিকে, যেটা রুমাইশার পেটের উপরিভাগটায় নখ বসিয়ে দিয়েছে। শাফিন সেদিকে দ্রুত গতিয়ে এগিয়ে গিয়ে সাফওয়ানের হাত থেকে রুমাইশা কে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সাফওয়ানের হাত কষে আছে। ছাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অনেক ক্ষন চেষ্টার পর সাফওয়ানের হাত আলগা করতে সক্ষম হলো শাফিন। নখের আগায় রক্ত লেগে থাকতে দেখলো ও।
সাফওয়ানের খামচি দেওয়া স্থান টাতে রক্তে ভিজে উঠলো।দাঁত চেপে সে ক্ষতের যন্ত্রণা সহ্য করে নিলো রুমাইশা। শাফিন আবার এসে প্রাণপণে সাফওয়ানের পা দুইটা বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বুকের ওপর লাথি টা ওর খুব জোরালো ভাবেই লেগেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর এখনো!
রুমাইশা অনেক কষ্টে সাফওয়ানের বুকটা নিজের দুই হাত দিয়ে ওর বাহুর তল দিয়ে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। আর এরপর অসহায় রুমাইশা দিকবিদিকশুন্য হয়ে কি করবে ভেবে না পেয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করা সাফওয়ানের ঠোটে এক প্রগাঢ় চুম্বন বসিয়ে দিলো।
কিন্তু এরপর ওদের দুজন কেই অবাক করে দিয়ে ধীরে ধীরে সাফওয়ানের শরীরের ছটফটানি স্তিমিত হয়ে এলো। দুরন্ত গতিতে ছোড়া হাত পা দুইটা শান্ত হয়ে এলো ক্রমে। সাফওয়ান শান্ত হয়ে আসা সত্বেও চুম্বন থামলো না রুমাইশার। সাফওয়ানের ঠোটে ঠোঁট রেখেই ফুপিয়ে কেদে উঠলো ও আবার।
সাফওয়ানের শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক ভাবে চলতে লাগলো আবার। যন্ত্রনায় কুচকে যাওয়া ভ্রু দুইটা আবার জায়গায় চলে এলো। শক্ত হয়ে যাওয়া চোয়াল দুইটা আলগা হয়ে এলো কিঞ্চিৎ। রুমাইশা সাফওয়ানের মুখ থেকে ঠোঁট সরিয়ে ওর কপালে ঠোট ছুইয়ে শাফিন কে বলল সাফওয়ান কে ধরে বিছানায় নিয়ে যেতে সাহায্য করতে। তারপর দুজনে মিলে সাফওয়ানের বিশাল শরীর টাকে কোনো রকমে টেনে নিয়ে বিছানায় উঠালো।
সাফওয়ান কে বিছানায় উঠিয়ে রুমাইশা শাফিন কে বলল বাড়িতে ফিরে যেতে, ও সাফওয়ানের সাথে এখানেই থাকবে৷ আর সাফওয়ানের এমন অসুস্থতার কথা বাড়িতে কাউকে জানাতে বারন করে দিলো। শাফিন সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। কুড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে হেটে হেটে বাড়ির দিকে এগোলো ও৷
৪২. সাফওয়ান এখন ঘুমিয়ে আছে স্বাভাবিক ভাবেই। গায়ের কালো বর্ণ টা অনেক টাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ঝাকুনি ও বন্ধ হয়ে গেছে। রুমাইশা এতক্ষন মেঝেতে পা ঝুলিয়ে সাফওয়ানের পাশে বিছানার ওপরেই বসে ছিলো। সাফওয়ান কে স্বাভাবিক হয়ে যেতে দেখে এইবার রুমের দিকে চোখ বুলালো ও।
ওর আর শাফিনের জুতার কাদায় রুম টা নোংরা হয়ে আছে। জুতা এখনো খোলেনি ও নিজেও। পেটের কাছ টা রক্ত পড়ে এখন জমাট বেধে গেছে৷ শরীরের পোড়া জায়গা গুলো থেকে থেকে যন্ত্রনা দিচ্ছে।
রুমাইশা বিছানা ছেড়ে উঠলো। কাদা মাখা জুতা জোড়া খুলে ওয়াশরুমে রেখে এলো। তারপর মেঝে থেকে সাফওয়ানের কাপড় গুলো উঠিয়ে মেঝের কাদামাটি ধুয়ে মুছে চকচকে করে ফেললো।
সাফওয়ানের পায়ে কাদা লেগে ছিলো, বালতিতে করে পানি এনে পা দুইটা যত্ন সহকারে ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিলো। তারপর তোয়ালে ভিজিয়ে সাফওয়ানের সমস্ত শরীর টা একবার মুছে দিলো। ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে গোসল দেওয়া তো কোনোমতেই সম্ভব না।
ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেয়ে সাফওয়ানের ঘুমন্ত মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠলো। সাফওয়ানের শরীর টা মুছে রুমাইশা নিজেও ঢুকলো এবার ওয়াশরুমে৷ কাদা মাখা পোশাক গুলো খুলে রেখে মাথার ওপরের ঝর্ণা ছেড়ে দিলো। শরীরের পোড়া জায়গা, আর পেটের কাছের কাটা জায়গাটাতে পানির স্পর্শ লাগতেই ককিয়ে উঠলো রুমাইশা। কাটা জায়গাটার জমাট বাধা রক্ত সরিয়ে ধুয়ে ফেললো ভালোভাবে৷
গোসল শেষে নিজের আর সাফওয়ানের জামা কাপড় গুলো ডিটারজেন্ট দিয়ে ভিজিয়ে রাখলো। তারপর বাইরে বেরিয়ে কাবার্ড থেকে সাফওয়ানের একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার বের করলো। ট্রাউজার টা পায়ের দিক থেকে এক গাদা ভাজ দিয়ে উপরের দিকে উঠিয়ে তারপর পরলো। এরপর টি শার্ট টা পরে বিছানায় উঠে সাফওয়ানের পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ঘুমাতে না চাইলেও ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহটা বিছানায় মিশে গেলো, চোখ দুইটা কোনো বাধা না মেনেই একসময় বন্ধ হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো রুমাইশা।
শাফিন যখন বাড়িতে পৌছালো তখন প্রায় ফজরের আযান পড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সন্তর্পণে মেইন ডোর দিয়ে ঢুকে সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো ও। জামা কাপড় ছেড়ে গোসল দিয়ে এসে ঘুমিয়ে গেলো ও নিজেও৷
…
সকালে সাফওয়ানের যখন ঘুম ভাঙলো তখন নিজেকে ল্যাবের রুমে আবিষ্কার করে দ্বিধান্বিত হয়ে গেলো ও। তারপর আস্তে আস্তে রাতের ঘটনা গুলো মনে পড়লো ওর। অসহ্য যন্ত্রনায় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে চলা, কাদামাটিতে হোচট খাওয়া, ল্যাবের আয়নায় দেখা ওর সেই চেহারা, ওর গায়ের কালো বর্ণ, ওর চোখের উজ্জ্বলতার ওঠানামা সবকিছু মনে পড়তেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো ও।
কিন্তু ও তো মেঝেতে পড়ে ছিলো, ওকে বিছানায় নিয়ে আসলো কে? তখনি পাশে কারো উপস্তিতি টের পেয়েই চমকে পাশ ফিরে তাকালো সাফওয়ান৷
নিজের পাশে রুমাইশা কে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলো ও৷ রিমু ল্যাবে কিভাবে আসলো? ও কি স্বপ্ন দেখছে? ও কি আসলেই ল্যাবে আছে? নাকি ওর চিলেকোঠার রুমেই? ওর কি দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে?
কিছুক্ষণ নিজেই নিজেকে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেললো সাফওয়ান। তারপর শোয়া অবস্থাতেই মাথা টা উচু করে রুমাইশার মুখের ওপর ঝুকে পড়লো৷ রুমাইশা কে ভালোভাবে দেখে নিলো ও৷
রুমাইশার গায়ে তো এই পোশাক ছিলো না রাতে! এগুলো তো ওর নিজেরই পোশাক! রুমাইশার চুল গুলোও তো ভেজা!
ভ্রু কুচকে ভাবতে লাগলো ও। তারপর রুমাইশার চোয়ালের ওপর নিজের হাত টা রেখে আলতো করে ঝাকি দিয়ে বলে উঠল,
— রিমু, রিমু! এই রিমু, উঠ তো, এখনি। রিমু!
সাফওয়ানের গলায় নিজের নাম শুনে লাফিয়ে উঠে বসলো রুমাইশা। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো সাফওয়ানের মুখের দিকে। রুমাইশা কে এমন চমকে যেতে দেখে সাফওয়ান ও চিন্তিত ভঙ্গিতে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
সাফওয়ান কে একেবারে সুস্থ সবল হয়ে এভাবে নিজের সামনে বসে থাকতে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলো রুমাইশা৷ ঝাপিয়ে পড়ে সাফওয়ানের বুক টা দখল করে ফুপিয়ে কেদে উঠলো ও।