লাজুকপাতা | পর্ব – ১৭

ঈদের পর একসঙ্গে অনেক গুলো ঘটনা ঘটলো। মনির সম্পত্তির ভাগ চাওয়া নিয়ে একদিন ঝামেলা হলো। পাশা মিয়া তার ফ্যামিলি সহ এসেছিল। সঙ্গে মনিও, এবারও ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র। সঙ্গে কয়েক রকম মাছও। মনি সম্পত্তির ভাগ চায়। সে সবকিছু বুঝে পেলে আর এদিকে আসবে না। তবে এবার ওরা ঝামেলা করতে পারলো না। এসেছিল ঝামেলা করতে। উল্টো কিল, ঘুষি, থাপ্পড় খেয়ে গেল। মামাশ্বশুর আর জামিল ভাই মিলে পাশা কে বেশ মারলেন। শিল্পী আক্তার চিৎকার চেঁচামেচি করতে গিয়ে মামীর হাতে এক থাপ্পড় খেলেন৷ মনিকে আম্মা কয়েকটা থাপ্পড় মারলেন। চূড়ান্ত রকম অশান্তি৷
এরা আবার পুলিশও নিয়ে এসেছে৷ তখনই আসল চাল টা চাললেন। মামাশ্বশুর মনির কাছ থেকে স্ট্যাম্পে যে সই নিয়েছিল সেখানে লেখা, মনি পাশা মিয়ার সঙ্গে বিয়ে করে চলে গেলে বাপের সম্পত্তির কিছুই পাবে না৷ এমনকি বাপের বাড়িতে এসে কোনোরকম অশান্তি করলেও তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমন উইল দেখে মনি কেঁদেকেটে অস্থির। পাশা মিয়াও গ্যাড়াকলে পড়ে গেছেন। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছেন। মাছ খাইতে খাইতে তার শরীরে তেল জমে টইটম্বুর। এখন কয়দিন জেল হাজতের খাবার খাক, তেল কমবে।
শিল্পী আর মনির নাটক বেশীক্ষন চলল না। তারা বিদায় হলো নাটকীয় কান্নাকাটি করে। আম্মাকে দেখলাম খুব কাঁদলেন। কার অভিশাপে তার সংসারের এই দশা! এই আক্ষেপে কাঁদলেন৷
***
পরের ঘটনা টা হলো মুক্তাকে নিয়ে। মুক্তা এমনিতে মনির মতো নয়। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ। কলেজে যায় সম্ভবত আড্ডা দিতে। পরীক্ষার আগে টেনশনে অস্থির থাকে। মনির মতো সাজগোজ নিয়ে অতো সচেতন না হলেও বাইরে গেলে সেজে যায়। আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক সহজ আবার কঠিন। পুরোপুরি সহজ, সরল হয়ে ওর সঙ্গে আমি মিশি না, তাতে কিছু সমস্যা হয়।
এবার আসি আসল ঘটনায়। সেদিন আমার কলেজ নেই। দুপুরে রান্না করছিলাম। ও’কে দেখলাম শোকেসে রাখা কাঁচের গ্লাস নিয়ে এসেছে ধুতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কেউ আসছে?”
“হ্যাঁ ভাবী, একজন মহিলা। পানি চাইলো। ”
“শুধু পানি দিও না, একটু লেবুর শরবত দাও। টিনের বাক্সে বিস্কুট আছে, কিছু বিস্কুটও দিও। ”
ও আচ্ছা বলে চলে গেল। লেবু আনতে গিয়ে দেখলো ফ্রিজে তরমুজও আছে। বলল,
“ভাবী তরমুজ কেটেও দেব? গরমে ঠান্ডা জিনিস ভালো হবে না?”
“দিতে পারো। ”
সেই মহিলা পানি আর শরবত টুকুই খেলেন। বাকী কিছু মুখে দিলেন না। নামাজ পড়ার জন্য জায়নামাজ চাইলেন। মুক্তা সব ব্যবস্থা করে দিলো।
আমি ভদ্রমহিলাকে ভাত খেতে অফার করলে রাজী হলো না।
আম্মা গেছিলেন পাশের বাসায়। এসে সবকিছু শুনে আমার উপর রাগ ঝাড়লেন খানিকক্ষণ। কে না কে আসছে, তারে তুমি খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হইয়া যাও! চোর, ডাকাতও তো হইতে পারে! আর ভালো মানুষ হইলেও তারে খাওয়ান লাগবে কিজন্য! জিনিসপত্রের যা দাম! এরপর কেউ পানি চাইলেও দিবা না।
ভদ্রমহিলা দিন দুয়েক পর আবার এলেন। তিনি এসেছিলেন পাত্রী দেখতে। এভাবে উনি পাত্রী দেখেন। মুক্তাকে উনি পছন্দ করেছেন তার ভাইয়ের ছেলের জন্য। মুক্তার আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করেছে। আশেপাশে অনেক গুঞ্জন শুনলেও মুক্তার সঙ্গে বিয়ে দিতে কোনো আপত্তি নেই।
নাবিদ রাজী হলো না। মুক্তা পড়ুক, ঠেলেঠুলে হলেও অন্তত ইন্টারমিডিয়েট টা কমপ্লিট করুক। আম্মা রাজী নন, এমন পাত্র এরপর যদি না পায়! মামাও পাত্রের খোঁজ খবর নিয়ে রাজী হলেন। পাত্রের নাম জুয়েল। চকবাজার কসমেটিক্স এর দোকান আছে নিজের। লালবাগে নিজেদের বাড়ি। ছয়তলা বাড়ির একেক ফ্ল্যাটে একেক জন থাকে। সব মিলিয়ে তারা আট ভাই বোন। জুয়েল ছেলেদের মধ্যে সবার ছোট।
জামিল ভাই শুনে বললেন,
“এইখানে বিয়া হইলেই ভালো, কেনু গুতা খাইয়া ঠিক হবে৷ এইগুলারে তো ভালো বানাতে পারে নাই। ”
আম্মা জামিল ভাইয়ের উপর রেগে যায়। নাবিদের সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পায় না। মুক্তা নিজেও কেমন রাজী রাজী মনে হলো। একদিন জুয়েল ভদ্রলোকের সঙ্গে মুক্তা ঘুরতেও গেল। ফেরার পর মুখ দেখে বুঝলাম যে খুশি। অনেক কিছু কিনেও দিলো। বাসার সবার জন্য পুরান ঢাকার স্পেশাল কাচ্চি কিনে পাঠালো। মুক্তা আম্মাকে জানালো যে ওর বিয়েতে আপত্তি নেই।
একদিন পাত্রপক্ষ দেখতে এলো৷ মোট ষোলো জন এলো বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে৷ যথারীতি রান্নার দায়িত্ব আমার হাতে পড়লো। পোলাও, রোস্ট, ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়ি মাছ ভাজা, গরুর মাংস ভুনা, খাশির মাংস, টিক্কা, পায়েশ।
ঘরোয়া বৈঠকে আলোচনা হলো আপাতত বিয়ে হবে সাদামাটা৷ পরে বড় করে অনুষ্ঠান করবে৷ পরের শুক্রবার বিয়ের আয়োজন করা হলো৷ সাদামাটা বিয়েতেও তারা চৌত্রিশ জন আসবে। নাবিদ আম্মাকে বলল,
“এতো লোকের রান্না জরী সামলাতে পারবে না৷ বাবুর্চির ব্যবস্থা করা হোক৷ ”
আম্মার মুখ টা ছোট হয়ে গেল বাবুর্চির খরচের জন্য।
বিয়ে ঠিক হবার পর মুক্তার হাবভাব পাল্টে গেছে। আমার সঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও জবাব দিতে কষ্ট হয়। আম্মাকেও ভীষণ উৎফুল্ল দেখায়। একেকজনের কাছে মুক্তার হবু শ্বশুর বাড়ির গল্প বলে। যা আছে তার চেয়ে তিন গুন বাড়িয়ে বলে।
বিয়ের আগের দিন আম্মা আমাকে বলেন,
“জরী শোনো, তোমারে বিয়ের সময় আমরা যে গয়নাগুলি দিছিলাম ওই গুলা দাও। ”
আমি বিস্মিত হই। বুঝতে পারি যে ওই গয়নাগুলো মুক্তাকে দেয়া হবে। বিনা বাক্যেই দিয়ে দেই৷ মা গয়নাগুলো দেখে বলেন,
“তোমাগো বাড়ি থেকে যে আংটি আর চেইন নাবিদ রে দিছিল ওইটাও দাও। বোঝোই তো, কত খরচ! এখন এগুলো দিয়া ম্যানেজ করি! কী বলো!’
আমি সেগুলোও দেই। বিপত্তি ঘটে পরী আপার দেয়া কানের দুল নিয়ে। আম্মা সেই কানের দুল চাইলে বলি,
“ওইটা দেব না। ওইটা আমার। ”
আম্মা কপাল কুঁচকে বলেন,
“আরে তোমার জিনিস কী একবারে নিতাছি আমি। মুক্তা কয়দিন পরবে৷ শ্বশুর বাড়িতে পুরান হইলে তোমার জিনিস ফিরায়ে দিবে। ”
আমি কঠিন গলায় বললাম, না।
আম্মা আমাকে রুক্ষ গলায় বললেন,
“বেয়াদব। বাপ, মায়ে আদব কায়দা না শিখায়েই শ্বশুর বাড়ি পাঠাইছে।”
এর পরবর্তী ঘটনা ভয়াবহ । আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম বাড়ি যাবার জন্য। নাবিদ কিছুতেই যেতে দিবে না৷ রাগে, অপমানে আমি খুব কাঁদলাম। আম্মার হেলদোল নেই। নাবিদ আম্মাকে কিছু বলতে গেলে উল্টো আরও দুই কথা শুনিয়ে দেয়।
মামাশ্বশুর আসেন, সঙ্গে মামিও৷ মামি বলেন,
“আপনে কোন মুখে ওর বাড়ির লোকেরে নিয়া খোঁটা দেন! আপনের মাইয়াই তো বিয়ের আগে কাইল্যা মাচ্ছুয়া ব্যটার লগে হোটেলে গেছে। আপনে এইগুলা শিখাইছেন। ”
আম্মাও পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করেন। মামিকে গালাগাল করেন৷ মামা নাবিদ কে বলেন,
“তুই জরীরে নিয়া যা। বিয়েতে তোর থাকা লাগবে না। বিয়া শেষ হোক, তারপর বাকী ব্যবস্থা নেয়া যাবে৷ ”
নাবিদ আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আমি রিকশায় বসে কাঁদতে কাঁদতে বলি,
“আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিলেই হবে। আমি একলা যাইতে পারব। ”
“পাগল আমি! আর এমন চেহারা নিয়ে তুমি বাড়ি গেলে আমাকে কেউ আস্ত রাখবে!”
“তাইলে পরী আপার বাসায় দিয়া আসো। ”
“কোনো বাসায় ই যাব না আমরা। আমরা কক্সবাজার যাব৷ অফিস থেকে তো ছুটিই পাই না৷ চলো এই সুযোগ কাজে লাগাই৷ ”

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।